সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

টিসিবির ছয় পণ্যের প্যাকেজে ক্রেতাদের অনীহা


প্রকাশিত:
২৬ মার্চ ২০২২ ০৪:২১

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২১:০৭

 

স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কম দামে পণ্য বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ডিলারের মাধ্যমে ট্রাকে বিক্রি করা টিসিবির ছয়টি পণ্যের মধ্যে তেল, ডাল এবং চিনির দাম বাজারের তুলনায় অনেক কম। তাই এই তিনটিতে ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু প্রয়োজন না থাকলেও ডিলাররা পেঁয়াজ, খেজুর এবং ছোলা কিনতে ক্রেতাদের বাধ্য করায় প্রকৃতপক্ষে কোনো অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে না তাদের। শুধু তাই নয়, প্যাকেজ ধরে এসব পণ্য কেনায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া ৫ কেজির পেঁয়াজের প্যাকেজে প্রায় ৩ কেজি বের হচ্ছে পচা, যা একেবারেই খাওয়ার অনুপযোগী।

প্রাথমিকভাবে টিসিবি শুধু তেল, চিনি ও ডাল বিক্রি করলেও এখন আসন্ন রমজান উপলক্ষে ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের এসব পণ্যও কিনতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। রমজান আসতে এখনও এক সপ্তাহের বেশি বাকি। তাই এসব পণ্যে গ্রাহকদের এখনও কোনো আগ্রহ নেই। অথচ এখনই ছোলা ও খেজুর বিক্রি করছে টিসিবি। ফলে টিসিবির পণ্য কিনে অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে না স্বল্প আয়ের মানুষের।

সোমবার টিসিবির একটি ট্রাক আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে। এখানে সাধারণত ট্রাক আসে না। কিন্তু সোমবার এখানে ট্রাক আসে স্থানীয় কাউন্সিলরের সুপারিশে। সেখানে দেখা যায়, বিশাল লাইন। এই লাইন সামলাতে হিমশিম খেতে হয় ট্রাকের সঙ্গে থাকা ৪-৫ জন কর্মীকে। ক্রেতার বিশাল লাইন সামলাতে তারা সিরিয়াল দিয়ে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে। এখানে ট্রাক দুপুর ১২টায় এলেও বিক্রি শুরু হয় আড়াইটার পর। এত দেরি কেন জানতে চাইলে ভাই ভাই স্টোরের প্রতিনিধি সময়ের আলোকে জানান, ‘প্যাকেট করতে সময় লাগে। এরপর এই বিশাল লাইন ঠিক করতেই সময় গেল। এখানে মহিলারা ঝগড়া এমনকি মারামারিও করে। তাই আগে তাদের সামলাতে হয়। সেজন্যই দেরি।’

এই ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসেছেন গোপীবাগের বাসিন্দা মতিয়া বানু। তিনি এসেছেন তেল আর ডাল কিনতে। সঙ্গে চিনিও কিনতে হবে জেনে তিনি এসেছিলেন। বাজারে তেল ১৭০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ট্রাকে বিক্রি হয় ১১০ টাকায়। চিনি বাজারে ৮০, এখানে ৫৫ এবং ডাল বাজারে ১১০ এবং ট্রাকে বিক্রি হয় ৬৫ টাকায়। কিন্তু এখানে এসে দেখেন এগুলোর সঙ্গে বাড়তি কিনতে হচ্ছে পেঁয়াজ, খেজুর ও ছোলা। পেঁয়াজ পচা, ছোলার মান ভালো নয়। খেজুরও নিম্নমানের। তিনি এসব নিতে চান না। তবু তাকে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে প্যাকেজের নামে।

প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে ২ লিটার তেল, ২ কেজি চিনি, ২ কেজি মসুর ডাল, ৫ কেজি পেঁয়াজ, ৫ কেজি ছোলা এবং ২ কেজি খেজুর। এতে প্যাকেজটির দাম পড়ছে ১ হাজার ২০ টাকা। কিন্তু সেখানে রাখা হচ্ছে ১ হাজার ৩০ টাকা। প্যাকেজের কারণে ক্রেতাকে খরচ করতে হবে অতিরিক্ত ৫৬০ টাকা। এর মধ্যে ৫ কেজি পেঁয়াজের দাম ১৫০, ৫ কেজি ছোলার দাম ২৫০ এবং ২ কেজি খেজুরের দাম ১৬০ টাকা।

মতিয়া বানু হিসাব করে দেখেন তার প্রয়োজন ৪৬০ টাকার পণ্য। এই টাকার পণ্য কিনলে তার সাশ্রয় হবে ৩৬০ টাকা। কিন্তু এ টাকা সাশ্রয় করতে তার অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে ৫৬০ টাকা। এর মধ্যে পেঁয়াজের ১৫০ টাকা পুরোটাই নষ্ট। কারণ টিসিবি থেকে সরবরাহ করা পেঁয়াজ খাওয়ার যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন এই গ্রাহক। এত হিসাব কষে তিনি চলে যান স্থানীয় মুদি দোকানে। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো পণ্য কিনে চলে যান বাসার উদ্দেশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে আরেকটি ট্রাকে বিক্রি হচ্ছিল টিসিবির পণ্য। এখানে ট্রাক আসে দুপুর ১২টার পর। কিন্তু পণ্য বিক্রি শুরু হয় দেড়টায়। এখানে খেজুর বিক্রি হচ্ছিল এক কেজি করে। কিন্তু প্যাকেজ ছাড়া বিক্রি করছিল না। প্যাকেজের দাম রাখছিল ৯৪০ টাকা। পেঁয়াজের দুর্গন্ধ এখানেও পাওয়া যায়। গ্রাহকদের নানা অভিযোগ। লাইন ছাড়া বিক্রি করা, খারাপ আচরণ, এর সঙ্গে ধীরগতির কারণে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা। ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য পান সিরিয়ালের ২১ নম্বরে দাঁড়ানো তাসলিমা বেগম। পণ্য নিয়েই পেঁয়াজের ব্যাগ খুলে পচা পেঁয়াজ আলাদা করেন। ৫ কেজিতে মোটামুটি ভালো বের হয় ২ কেজির মতো। পচা না হলেও এই ২ কেজিও পুরোপুরি খাওয়ার উপযোগী নয়। কারণ প্রতিটি পেঁয়াজে গাছ গজিয়েছে। এসব পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করলে তরকারিতে স্বাদ হয় না, তাই পরিবারের সদস্যরা খেতে চায় না বলে জানান তাসলিমা বেগম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো ডিলারকেই পরিমাণ উল্লেখ করে বিক্রি করতে নির্দেশনা দিইনি। আমরা বলে দিয়েছি ২ থেকে ৫ কেজি বিক্রি করতে। এখন ডিলাররা তাদের অবস্থা বুঝে যদি বিক্রি করে থাকে, তা হলে তো আমাদের বলার কিছু নেই। তবে প্যাকেজ অনুযায়ী দাম বেশি রাখলে আমরা ব্যবস্থা নেব। ইতোমধ্যেই আমরা অনেক জায়গায় ব্যবস্থা নিয়েছি।’

দেরি করে বিক্রি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিক্রির জন্য আমাদের তো নির্দিষ্ট টাইম নেই। যদি থাকত তা হলে বলতে পারতাম, লেট হচ্ছে। আর ট্রাকে পণ্য লোড করতে যে সময় লাগে, সে পণ্য পরিমাপ করে প্যাকেট করতেও তো সময় লাগে। তাই গ্রাহকদের এ সময়টুকু মেনে নিতেই হবে। প্যাকেটজাত পণ্য কিনে বিক্রি করতে গেলে খরচ অনেক বেশি হবে, তাই প্যাকেট কিনছি না আমরা। তবে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্যাকেটজাত পণ্য কেনার। তখন সময় কম লাগবে।’

টিসিবির এ পণ্য বিক্রিতে আসলে কতটা লাভ হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনতে বাধ্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে না বলেও জানান তারা।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘টিসিবি যদি প্যাকেজ আকারে পণ্য বিক্রি করে, তবে তা ঠিক হচ্ছে না। আর যদি ডিলার প্যাকেজ করে বিক্রি করে তবে টিসিবির উচিত হবে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। যে গ্রাহকের চিনি প্রয়োজন সে কেন ছোলা কিনবে? তা হলে তো তার কোনো লাভই হচ্ছে না। এ ছাড়া পচা পেঁয়াজ বিক্রি করার যে অভিযোগ আছে, সেটাও যেন টিসিবি গুরুত্বসহকারে দেখে।’

টিসিবির পণ্য প্যাকেজ আকারে বিক্রি করা প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্যাকেজ করা হয়েছে জনগণের স্বার্থেই। আগে পেঁয়াজের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু এখন নেই। তা হলে যে পেঁয়াজ আমদানি করা হলো সেগুলো কী হবে? পেয়াজ তো পচনশীল পণ্য। যেহেতু এখন পেঁয়াজ দরকার নেই, তাই পেঁয়াজের দাম কমানোর কথা ভাবছি। এখন ৩০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে, সামনে ২০ টাকা করে বিক্রি হবে। তবে ৫ কেজি করে বিক্রি করার কথা নয়। এ বিষয়ে আমি টিসিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলব।’

এদিকে সোমবার টিসিবির বরাদ্দ বৃদ্ধি ও বিভাগভিত্তিক নিজস্ব গোডাউন নির্মাণ করে চাল, ডাল, আটা, চিনি, ভোজ্য তেলের আপদকালীন মজুদের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top