সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নীরবতার দেয়াল ভাঙ্গার শিক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
৪ জুন ২০২০ ২২:৩০

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২১:০৭

 

লক্ষী মেয়ের বৈশিষ্ট্য হলো ‘সাত চড়ে যে রা করে না।’ সমাজ অতি যত্ন করে সব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকা মেয়ে তৈরি করে। ফলে ঘরে-বাইরে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বত্র চুপ করে থাকা লক্ষী মেয়েরা নির্যাতিত। সমাজে যেহেতু অসুরের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের অবয়বে মানব সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসুর, তাই লক্ষী নয় প্রয়োজন রণরঙ্গিনী, এলোকেশী ‘মা কালী’কে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য বেছে বেছে এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। সহজ, সরল, নির্লোভ জ্ঞানীদের হত্যা করে যে শূন্যতা ১৯৭১ সালে তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, আজও সে শূন্যতা পূরণ হয়নি। ফলে দৃশ্যমান যুদ্ধ শেষ হলেও, নিজের সঙ্গে অদৃশ্য যুদ্ধটি শেষ হয়নি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো তাদের মেধা খাটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার নানা কৌশল খুঁজে বের করেছে। ফলে তাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সুদীর্ঘ কৌশলের মধ্যে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র দলীয় লোকেরা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ায় ক্ষমতায় যখন যারা থেকেছে তাদেরই জয়গানে মুখরিত হয়েছে শিক্ষাঙ্গন, ধন্য হয়েছে শিক্ষক সমাজ।


আমাদের স্বাধীন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের দখলে থাকে। তাদের দপটে ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন সাধারণ ছাত্ররা। যখনই ক্ষমতা বদল হয় সঙ্গে সঙ্গে দখলের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

দিন এগিয়ে যায়, বুদ্ধি শাণিত হয়। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা, দীর্ঘমেয়াদি হয়। রাজনীতিবিদরা ভেবে দেখলেন নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ আমাদের দখলে থাকলে আমাদের জয়গান প্রচার হবে। শিশুপর্যায় থেকে মগজধোলাই করে মাথায় আমাদের চেতনা ঢুকিয়ে দিতে পারলে আমাদের প্রচেষ্টা সহজ হবে, সফল হবে। সুতরাং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সে দলের আত্মীয়স্বজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
মেধা, মনন, আদর্শ এসবের চেয়ে ক্ষমতার দাপট, মামা-চাচার বাহাদুরি বেশি থাকে।

প্রায়ই শোনা যাচ্ছে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের কাহিনি। তা-ও আবার একটি নয়। একাধিক ছাত্রী যখন শিক্ষক কর্তৃক দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার হয় তখন কেউ একজন লজ্জার মাথা খেয়ে তার কাহিনি প্রকাশ করে।

আমাদের সমাজে শিশুকাল থেকেই নারীরা নানাভাবে নির্যাতিত। কাছের লোক, ঘরের লোক দ্বারাই শুরু হয় এ নির্যাতন। কাকা, মামা, খালু, ফুপা এ জাতীয় ব্যক্তিরা যখন যৌন নির্যাতন করে, তখন শিশুটির মনে ভয় এবং লজ্জা এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যাতে শিশুটি ভাবে, এ লজ্জা শুধুই তার। ফলে পরবর্তী জীবনে নারীরা তাদের লজ্জার অপমানের কথা মুখ ফুটে প্রকাশ করে না।

নীরবতার কারণে নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী। লজ্জা আর অপমানের গ্লানি বহন করে বেঁচে থাকে দিনের পর দিন।

শিক্ষক শব্দটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। নির্ভীক হৃদয়, সাহসী কণ্ঠস্বর, নীতি-নৈতিকতা আদর্শের দৃষ্টান্ত যা একজন শিক্ষককে উন্নত সমাজ গঠনের ভূমিকা পালনে সহায়তা করে, তা কিছুসংখ্যক নীতিবিবর্জিত, জ্ঞানপাপীর কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর নামীদামি বিদ্যালয় থেকে কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম, কোথাও নিরাপদ নয় ছাত্রীরা। দিনের পর দিন তথ্য এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নারীর লজ্জা আর নীরবতাকে পুঁজি করে শিক্ষক নামধারী কিছুসংখ্যক পশু ছাত্রীদের সঙ্গে গড়ে তোলে অবৈধ সম্পর্ক।

ফলে প্রতিটি বিদ্যালয়ে নীরবতা ভাঙার শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবি। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে দেহের শুদ্ধতা উঠে যাচ্ছে দিন দিন। ফলে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে নারীরা। একদিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অন্যদিকে নেশার নীল ছোবল ছাত্রীদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার নিষিদ্ধ এক জগতে। সমাজ শুদ্ধতা আর লজ্জার শিক্ষা শুধু নারীকে দেয়। ফলে নির্লজ্জতা নিয়ে বড় হয় কিছু পুরুষ। পুরুষের এই নির্লজ্জতার কারণে নারী আজ সর্বত্র আক্রান্ত। কতিপয় পুরুষের শ্বাপদের মতো আচরণের কারণে নারী ঘর, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র আক্রান্ত, অনিরাপদ।

সময়ের প্রয়োজনে, কন্যাদের নিরাপত্তার কারণে, সর্বোপরি সামাজিক শান্তি এবং শুদ্ধতার কারণে নারীকে তার নীরবতার দেয়ালটি ভেঙে বেরিয়ে আসার শিক্ষা দিতে হবে। অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, অশোভন ইঙ্গিত, অবৈধ সম্পর্কের প্রস্তাব, এসবের প্রতিবাদ করার সাহস অর্জন করতে হবে।

লজ্জা যে অপরাধ করে তার, যার সঙ্গে অপরাধ করা হয় তার নয়। নারী তার অপমানের লজ্জা নিজে চুপ থাকে বলেই পুরুষ নির্লজ্জ হওয়ার দুঃসাহস দেখায়। শুধু তা-ই নয়, নারীকে চরম শাস্তি দেয়ার জন্য অথবা তাকে লোভী করে তোলার জন্য পুরুষ নির্লজ্জ আচরণ করে যায় দিনের পর দিন।

শিশু এবং কিশোর বয়সের শুধু নারীরাই নয়, ছেলেরাও নানাভাবে বিদ্যালয়, বাড়িতে অথবা খেলার মাঠে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নির্যাতনের কথা ভয় এবং লজ্জায় প্রকাশ করতে না পারার কারণে দিনের পর দিন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আর অপরাধবোধ নিয়ে এরা বড় হয়।

প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্তত একজন শিক্ষক থাকা উচিত যে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হবে। যার সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীরা ভয় আর লজ্জাকে জয় করতে পারবে এবং সব কথা খুলে বলতে পারবে।

প্রতিটি বিদ্যালয় শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ করার জন্যই তাদের নীরবতা ভঙ্গ করার শিক্ষা দিতে হবে।
আন্তরিকতা, ভালোবাসা, নির্ভীকতা দিয়ে শিশুদের লজ্জা এবং ভয়কে জয় করতে হবে।
আকাশ সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কারণে অতি অল্প বয়সেই শিশুরা নানা জটিলতায়, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। শিশুদের শৈশব এবং কৈশোরকে নিরাপদ, নির্মল রাখার জন্যই তাদের ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার শিক্ষাও পরিবার এবং বিদ্যালয়কেই দিতে হবে।

নীরবতার কারণেই বিদ্যালয়গুলো শিশুদের জন্য নিরাপদ থাকছে না। গুটিকয়েক মানুষরূপী জানোয়ারের পশুত্বের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষক নামের কলঙ্ক যেসব কামনার্ত পশু তাদের শুরুতেই শনাক্তের কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিশুদের নীরবতা ভঙ্গের শিক্ষা দিতে হবে।
শুরুতেই এসব জানোয়ারের হিংস্র দাঁত ভেঙে দিতে হবে। সামাজিকভাবে এসব জ্ঞানপাপীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্ক বাদ দিয়ে তাদের বয়কট করতে হবে।
আমাদের সন্তানদের শারীরিক, মানসিক শুদ্ধতা আর তাদের সুনির্মল শৈশব, কৈশোর উপহার দেয়ার স্বার্থেই তাদের শেখাতে হবে মুখ খুলতে, নীরবতা ভঙ্গ করতে।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top