সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের নারী সমাজ  : ওসমান গনি  


প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২০ ২২:৫০

আপডেট:
১ জুলাই ২০২০ ২৩:৩৫

ছবিঃ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

 

পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ -নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেনআমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে আদিকাল থেকে আজকের যে সভ্যতা তাতে নারী পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী পুরুষের সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নারী সমাজ কে কোন ভাবেই পশ্চাতে ফেলে আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না। আমরা যদি আমাদের বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাব আজকে নারী সমাজ বসে নাই। তারা সমানতালে কর্ম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা নারীর কোন অবদান কে অস্বীকার করব। কিভাবে করব? আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কোথায় নেই নারী সমাজের অবদান। যেখানে যেদিকেই তাকাই সর্বত্র রয়েছে তাদের অবাধ বিচরণ।আমাদের প্রতিটা পরিবারে সবার আগেই নারীর অবস্থান। আমাদের রান্না ঘর থেকে শুরু করে, বাজার থেকে ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কী আনা হবে, কী রান্না হবে, টাকা কোথায় খরচ হবে, ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার কি না, পরিবারে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একসময় পুরুষরা যেখানে হাতের ছড়ি ঘুরাতেন, সেখানে আজ বড় পরিবর্তন এনেছেন আমাদের  নারী সমাজ। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সংসার পরিচালনায় এখন নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। ১০ বছর আগেও শ্রমশক্তিতে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও এখন পাল্লা দিয়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা একসময় খুব কম হলেও এখন তা অনেক বেড়েছে।আমাদের দেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশই পোশাক খাত হওয়ার পেছনের কারিগর আমাদের  নারীরাই। বর্তমানে নারীরা বিক্রয়কর্মী,কৃষি,কুটির শিল্পসহ সব জায়গায় রয়েছে নারীদের অবস্থান। 

বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলার স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ বৈশ্বিক নানা সংস্থার প্রতিবেদনেও। আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, বিরোধীদলীয় নেতাও একজন নারী। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মতো একজন নারীকে স্পিকার হিসেবে দেখেছে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় পূর্ণ মন্ত্রী রয়েছেন দুজন নারী। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের আটজন নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারে নারীর অবস্থান দিন দিন শক্ত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে প্রথমবারের মতো একজন নারী কমিশনার মিলেছে। এখন ১০ জন সচিব আছেন নারী। প্রায় সমানসংখ্যক নারী আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসক বা ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধি বাড়ছে তরতর করে। রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ ও তাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীর অগ্রগতি অব্যাহত। বিবিএসের জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

২০১২ সালে দেশে নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৮২ শতাংশ, সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ শতাংশ। নারীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের চিত্রও চমৎকার। বিনা মূল্যে বই বিতরণের পাশাপাশি উপবৃত্তির ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবস্থান এখন বেশি। উচ্চশিক্ষায়ও ছেলেদের কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছেন মেয়েরা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন মজবুত হচ্ছে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে।

দেশের জন্য সমাজের জন্য কিছু করতে নারীদের মধ্যেও ব্যাপক সম্ভাবনা আছে, যা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে নারী কী না করতে পারে, সেটাও দেখা গেছে। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে বের হয়েই নতুন নতুন কাজে যোগদান করছেন। নারীদের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে দেশের উন্নয়নে নারীদের আরো বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। যদি নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে তাঁদের বাচ্চাদের ‘ডে কেয়ার’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরো বাড়বে।

দেশের শাসনব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এই ক্যাডারে নারীদের সুযোগ ছিল না। মেধাসহ সার্বিক যোগ্যতা দিয়ে গত ৩৮ বছরে সেই চিত্র আমূল বদলে দিয়েছেন নারী কর্মকর্তারা। শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তৃণমূলে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র উপজেলায় শীর্ষ পদে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৪৯২টি উপজেলায় ৪৪৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মধ্যে ১৪০ জনই নারী। জেলা প্রশাসক পদে আছেন আট নারী। আর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে সচিব পদে আছেন দশ নারী কর্মকর্তা।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সচিবালয়সহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক নারী কর্মকর্তা যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব ৮৫ জন (পুরুষ ৪৩০), যুগ্ম সচিব ৮২ জন (পুরুষ ৫৫৬), উপসচিব ৩৫০ জন (পুরুষ ১৩৪০), সিনিয়র সহকারী সচিব ৪৪৮ জন (পুরুষ ১০৭০) ও সহকারী সচিব পদে প্রায় ৫০০ (পুরুষ ১১০০) নারী কর্মকর্তা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে প্রথম নারী সচিব হয়েছিলেন খোদেজা আজম। বর্তমানে সরকারে ৭৭ জন সচিবের মধ্যে আটজন নারী। আর ৬৪টি জেলার মধ্যে আটটির জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারী কর্মকর্তা। 

একজন নারী হয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে আসা খুব সহজ ব্যাপার নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন। আর শুধু প্রশাসন নয়, অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা ভালো করছেন।নারী কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে পারবেন কি না, এমন সন্দেহ একটা সময়ে পুরুষদের মধ্যে ছিল। একইভাবে নারীরাও দায়িত্ব নিতে দ্বিধা করতেন। এখন এই দুই জায়গাতেই উন্নতি হয়েছে।’

মাঠ প্রশাসনসহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে ডিডিএলজি পদে ১১ জন, এডিসি ৩৮ জন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চারজন, সহকারী কমিশনার ৪১, সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) ১৩০, এলএ ১০, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ২৪ এবং জেলা পরিষদ সচিব হিসেবে দুই নারী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রশাসনে সাত হাজার ৫৩২ জন কর্মকর্তার মধ্যে এক হাজার ৮৬০ জনই নারী কর্মকর্তা। স্বাধীনতা অর্জনের ২৮ বছর পর ২০০০ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টে সর্ব প্রথম একজন নারীকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। ইতিমধ্যে তিনি অবসরে চলে গেছেন। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও বিচারিক ক্ষমতা দেশের বিচার বিভাগে আরো নারীকে বিচারকের পদে নিয়োগের পথ প্রশস্ত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইন পেশায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী কর্মতৎপর রয়েছেন। দেশের উচ্চ আদালতে বর্তমানে আটজন নারী বিচারপতি রয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। নিজেদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজের উচ্চ স্তরে প্রতিষ্ঠিত। বিচারাঙ্গনের মতো কঠিন জায়গায় নির্ভীক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তাঁরা বিচারাঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছেন। তাঁরা হলেন বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি কাশেফা হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও কাজী জিনাত হক।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইন পেশায়ও নারীর উপস্থিতি লক্ষণীয়।বর্তমানে হাজার হাজার নারী আইনজীবী সদস্য রয়েছেন। এঁদের প্রায় অর্ধেকই দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে নিয়মিত আইন পেশায় নিয়োজিত। আর সুপ্রিম কোর্টে (আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) পাঁচ হাজারের কাছাকাছি আইনজীবী পেশায় আছেন। তাঁদের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি নারী। এমন বাস্তবতায় নারীদের মধ্য থেকে আরো বেশিসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগের দাবি জোরালো হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিএনসিসিতে যোগ দেন আবিদা সুলতানা নামের এক নারী। বিএনসিসিতে দায়িত্ব পালনের সময় মাথায় আসে ভবিষ্যতে ইউনিফর্ম পরা কোনো পদে যোগ দেবেন তিনি। প্রস্তুতি নেন বিসিএস দেওয়ার। চয়েসে দেন পুলিশ। বিসিএস পাস করে সত্যি সত্যি তিনি ইউনিফর্ম পরার চাকরি পান। তিনি আজকের লালমনিরহাট জেলার সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (এসপি); দিন-রাত যখনই হোক, আসামি ধরার অভিযানে যেতে যাঁর ক্লান্তি নেই। যেখানেই তিনি নারী নিপীড়ন ও নির্যাতনের খবর পান, ছুটে যান ঘটনাস্থলে। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনেন। তাঁর এই কর্মচাঞ্চল্যে জেলার মানুষও খুশি। 

আবিদার মতো অনেক নারীই বর্তমানে পুলিশের কাজে অনেক ঝুঁকি মোকাবেলা করে কাজ করছেন। অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে পুলিশ কনস্টেবল, সবখানেই নারীরা তাঁদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। বাংলাদেশের নারী পুলিশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। আবিদা সুলতানার মতো আরো তিনজন নারী আরো তিনটি জেলায় দায়িত্ব পালন করছেন এসপি হিসেবে। তাঁরা হলেন গাজীপুর জেলার এসপি শামসুন্নাহার, বান্দরবানের এসপি জেরিনা আক্তার ও ঝালকাঠি জেলার এসপি ফাতিহা ইয়াসমিন। একইভাবে অতিরিক্ত ডিআইজি আমেনা বেগম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আরেক অতিরিক্ত ডিআইজি আতিকা ইসলাম বরিশালের র‌্যাব-৮-এর সিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমবারের মতো কোনো নারী পুলিশ সদস্য র‌্যাবের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশে নারী পুলিশের যাত্রা শুরু ১৯৭৪ সালে সাতজন এসআই ও সাতজন কনস্টেবলের যোগদানের মধ্য দিয়ে। প্রথমে সাদা পোশাকে তাঁরা ডিউটি করতেন। দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে ইউনিফর্মধারী নারী পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। ১৪ জন নিয়ে যাত্রা করা বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২৮০, যা মোট এক লাখ ৯৫ হাজার ৮৫২ জন পুলিশের মধ্যে ৭.৮০ শতাংশ। নারী পুলিশের মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি পাঁচজন, এসপি ৭০ জন, অতিরিক্ত এসপি ১১০ জন, এএসপি ১০১ জন। ইন্সপেক্টর ১১২ জন, সাব-ইন্সপেক্টর ৮০৮ জন, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর এক হাজার ৬৪ জন, নায়েক ১৬২ জন ও কনস্টেবল ১৫ হাজার ২৮০ জন।

 

ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top