সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

মহামারীতে ব্যাংকিং সেবা ও বেতন হ্রাসে ব্যয় সংকোচন নীতি : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২০ ২০:৫৬

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২০:৫৯

 

যুক্তরাজ্যে Banker এবং Drunker- দের নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে কথা প্রচলিত আছে। ব্যাংকাররা প্রয়োজনে অনেক রাত অবধি কাজ করে থাকে। তাই কাজ শেষে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে আসে। ততক্ষণে Drunker- রাও রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশ দূর থেকে Drunker এবং Banker-দের অনুধাবন করতে না পেরে কাছে গিয়ে গন্ধ শুকে নিতো। আর তাতেই বুঝে নিতে পারতো কে Banker কে বা Drunker!

হ্যাঁ, বলছিলাম ব্যাংকারদের কথা। সারা দিন পরিশ্রম করে কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যুগ যুগ ধরে ব্যাংকারদের পরিশ্রমের কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন কাহিনীর আলোকে। ব্যাংকে প্রবেশ করার সময় থাকলেও বের হওয়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই! যদিও অফিস কর্মঘন্টা সকাল দশটা থেকে বিকাল ছয়টা পর্যন্ত নির্ধারিত। অফিসের নির্ধারিত কাজ শেষ করে তবেই বের হবার পথ খুঁজতে হয়। ব্যাংককে লাভজনক পর্য়ায়ে নিয়ে যাওয়ার মাঝেই মোক্ষ উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। ব্যাংক কিংবা ব্যাংকের সহিত সম্পর্কিত কোন তথ্য আমাদের সামনে চলে আসলেই অর্থনীতির ব্যাপারটাও চলে আসে। ব্যাংকের মাধ্যমেই টাকার দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো হয়। কাজেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংক সহায়তা করে। বলতে গেলে ব্যাংককে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিও বলা যেতে পারে।

বর্তমান সংক্রমিত এই মহামারীর সময়েও প্রথম থেকেই জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছে সারা দেশের ব্যাংকাররা। দেশের অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও আমাদের দেশে একদিনের জন্যও ব্যাংক বন্ধ থাকেনি। যদিও স্ব স্ব অফিসে উপস্থিত হয়েই ব্যাংকিং কর্মকান্ড সম্পাদন করতে হয়েছে। বাসায় বসে কাজ করা সম্ভবপর নয় তথাপি নিজেদের দায়বদ্ধতা স্বরুপ দেশের স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। ব্যাংকের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সম্পর্ক। সেজন্যই দেশে সাধারণ ছুটি বিদ্যমান থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ব্যাংকিং কার্যক্রম সচল রাখতে হয়। এটা যেমন অর্থনীতির চাকা চালু রাখার হাতিয়ার তেমনি জনগণের সেবামুলক কার্যক্রমেও বটে।

ফলস্বরুপ; কেউ বা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, এরই মাঝে কেউ না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। আবার কেউ কেউ নতুনভাবে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে। কিন্তু কখনো কোন ব্যাংক কর্মকর্তা অশনি সঙ্কেতে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রকাশ করে অপারগতা প্রকাশ করেনি। বর্তমান এই মহামারীর সময়ও ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষা করে স্বল্পসময়ে দ্রুততম সার্ভিস দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ব্যাংকিং সেক্টরে এ চিরচেনা দৃশ্য শুধু বর্তমান এই মহামারীর সময়েই নয়, বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের সুচারুরূপে সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পেরেছে। যেমন গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বা বোনাস পরিশোধের জন্য ঈদের আগের দিনও ব্যাংক খোলা রেখে সার্ভিস প্রদানে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। আয়কর প্রদানের নিমিত্তে বিশেষ কোন দিন ব্যাংক খোলা রেখে সেবা প্রদানে ব্রতী থাকছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝেও ব্যাংকাররা দেশের স্বার্থে কিংবা সমাজের স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বিভিন্ন বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী করতে ব্যাংকাররা প্রতি ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালণ করে থাকে। সার্ভিস প্রদানে কখনো কার্পণ্যবোধ কাজ করে না। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ বলা চলে।

একটি দেশে দুর্যোগ মুহূর্তে অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় যে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার চেয়েও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ঘনিভূত হয়ে আসে দুর্যোগ পরবর্তী সময়গুলোতে। সেজন্যই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান এই সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের প্রান্তিক কিংবা দরিদ্র্য জনগোষ্ঠির জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে কুটির শিল্প, মাইক্রো ক্রেডিট, ক্ষুদ্র এবং মাঝারী  শিল্প উদ্যোক্তাদের মাঝে স্বল্প সুদে বিনিয়োগ সুবিধা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। মহামারী প্রাদুর্ভাবের কারণে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নিমিত্তে কৃষিতে শস্য ও ফসল চাষের জন্য ৪% রেয়াতি সুদ হারে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও ”কৃষিখাতে বিশেষ প্রণোদনামুলক পুন:অর্থায়ন স্কীম”-এর আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে আমাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক রূপালী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক দুগ্ধজাত দ্রব্যের উপর ঋণ প্রদানে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মহামারীর এই সঙ্কটকালীন মুহূর্তে দুগ্ধ খামার থেকে দুধ বিক্রি করা অসাধ্য হয়ে উঠেছে। তাই সেদিকে খেয়াল রেখে দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য ঋণ দেবার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

তবে মহামারীর প্রকোপের কারণে যেমন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে মন্দাভাব চলে এসেছে তেমনি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও বিরুপ প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। ফলে ঋণ আদায় করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে আসছে এবং আমানতের পরিমাণও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও ব্যাংকগুলো আগে থেকেই মন্দ ঋণের বোঝা বয়ে চলেছে। মহামারীর প্রকোপ বিবেচনায় বিতরণকৃত ঋণের কিস্তি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিশোধ না করলেও খেলাপী ঋণে পরিণত হবে না। তাই ঋণ পরিশোধেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাংক কর্তৃক বিতরণকৃত ঋণের সুদ হলো আয়ের অন্যতম একটি খাত। মহামারীর কারণে গত এপ্রিল এবং মে মাসে ঋণের সুদ স্থগিত করায় আয়খাত অনেক সংকোচিত হয়ে এসেছে। তাছাড়াও গত এপ্রিল মাস থেকে ঋণ-আমানতের সুদের হার নয়-ছয় কার্যকরী হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ, প্রতিটি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ থেকে পাওয়া সুদ আয়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। আবার বিভিন্ন ধরণের ফি এবং কমিশন ব্যাংকের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। অথচ অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের ফি, কমিশন, অনলাইন চার্জ আদায় করা হয় না। অন্যদিকে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায় আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে অনেক সুদ প্রদান করতে হয়। সামগ্রীক দিক বিবেচনায় মহামারীর প্রকোপের মাঝে ব্যাংকের আয় খাতের উপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়। মূলত নন পারফরমিং সম্পদ বৃদ্ধি এবং আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে মুনাফা কমে আসছে।

বর্তমান এই পরিস্থতি বিবেচনায় কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তাই এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের নিমিত্তে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরণের পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এতে করে স্বাভাবিকভাবে কিছু মানুষ কাজ হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে যা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে স্থবির অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে না আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে। ইতোমধ্যে অনেকটি দেশে বিরুপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরেও প্রভাব বিদ্যমান।

সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ১৩ দফা সহকারে পরামর্শ জারি করে। এর মধ্যে একটি হলো কর্মীদের ১৫ শতাংশ বেতন কমিয়ে নিয়ে আসা। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক বেতন কমানোর পরিপত্র জারি করে ফেলে। অথচ এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ব্যাংকারদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বিবেচনাপূর্বক তাদের উজ্জীবিত রাখার কথা ছিল। এই সময়ে একজন ব্যাংক কর্মীর বেতন হ্রাস করা মানে পুরো ব্যাংকিং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলা, কাজ করার মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। অথচ এই ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে ব্যাংকাররাই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বিতরণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালণ করবে। মহামারী প্রাদুর্ভাবের কারণে সত্যিকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বের করে নিয়ে আসবে। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্ততবায়নের জন্য ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পর্যালোচনা করে ব্যবসায়ের ক্ষতি নিরুপন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাজটি করতে হবে অত্যন্ত দক্ষতা ও দৃঢ়তার সাথে। দুর্যোগের এই সঙ্কটকালীন মুহূর্তে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে ব্যাংকাররাই সুদুর প্রসারী ভূমিকা পালণ করতে পারে। মহামরীর এই সঙ্কটকালীন সময়ে ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানো হলে কথা থেকেই যায়।  অথচ এই সঙ্কটময় মুহূর্তে কর্মীদের উদ্বুদ্ধকরণে আরও উৎসাহব্যঞ্জক কর্ম পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারতো।

কিন্তু ব্যাংকের আয় খাতের মূল ভিত্তি ব্যাংকাররাই গড়ে তুলে। অথচ আয় সম্প্রসারণের মূল বাঁধা হিসেবে যদি তাদেরকেই সামনে নিয়ে আসা হয় তবে কথাই থেকে যায়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই সে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ। তাই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে কর্মী বান্ধব হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই মুনাফা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে ব্যাংকগুলো চলে আসে। তাই প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের যথাযথ মুল্যায়ন অত্যাবশ্যক। তা না হলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

 

সেদিক বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকে ব্যয় হ্রাস করার অনেক পন্থায় কাজ করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে কিছু কিছু ব্যয় খাত সংশ্লিষ্ট কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে। ব্যাংক ভবনগুলোর সাজ-সজ্জা কিংবা ভবন ভাড়া কমিয়ে। স্টেশনারী সামগ্রী ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক ব্যয় বহুল একটি খাত। সেক্ষেত্রে লাগাম টেনে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে যা গ্রীন ব্যাংকিংয়ের একটা অংশ। গ্রীণ ব্যাংকিং অনেক আগে থেকে শুনে আসলেও তার বাস্তবায়ন ব্যাংকগুলোতে নেই বললেই চলে। গ্রাহক আপ্যায়নে কিংবা প্রশিক্ষণের মতো জায়গাগুলোতে ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা নেয়া হাতে নেয়া যেতে পারে। লেনেদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের চার্জ আরোপ করা যেতে পারে। এছাড়াও এমন অনেক খাত আছে যে খাতগুলো থেকে ব্যয় হ্রাস করা হলেও সমগ্র ব্যাংকের উপর তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

বর্তমান মহামারীর এই সময়ে সবাই উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মাঝে দিন পার করছে। তার উপর বেতন কমালে ব্যাংকারদের উপর অর্থনৈতিকভাবে আরও নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। তবে, আশার কথা হলো ইতোমধ্যে অনেক ব্যাংক বেতন না কমানোর ঘোষণা দিয়েছে যা অতি বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এতে ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট কর্মী বান্ধব বলেও মনে হয়েছে। আশা করি মহামারীর প্রকোপ বিদায় নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সকল নেতিবাচক কিংবা বিরুপ প্রভাব দূর হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top