সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

মানব সভ্যতার নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য ভালোবাসা : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৪ জুলাই ২০২০ ২০:৩৭

আপডেট:
৪ জুলাই ২০২০ ২০:৩৮

 

আমি ব্যাক্তগতভাবে সবসময়ই প্রচন্ড রকমের আশাবাদী মানুষ। যেকোন নৈরাশ্যই আমাকে বেশিক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে না। মনেমনে সেখানেও কোন একটা আশার আলো দেখতে পাই। এইবার বলি আশার কথাগুলো। পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান প্রাণী হচ্ছে ডাক্তার, কারণ সৃষ্টকর্তা মানুষ বা প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন আর ডাক্তাররা সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আর মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা জীব তাই মানুষকে রক্ষা করা অন্যতম মহৎ কাজ তাই স্বভাবতই ডাক্তারদের মহৎ প্রাণী হিসাবেই মানা হয় কিন্তু বাংলাদেশে বুঝে না বুঝে ডাক্তারদেরকে ডাকা হয় “কশাই” নামে। আমি নিজেও নচিকেতার গান শুনে শুনে এমন একটা ধারণাই পোষণ করতাম কিন্তু সময়ের সাথে সেই ধারণাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে।   

বাংলাদেশের ডাক্তারদের নিয়ে যত অভিযোগ আছে তার বেশিরভাগের সাথেই তাদের কোন সম্পর্ক নেই। হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনুন্নত যন্ত্রপাতি, ঔষুধ স্বল্পতা, সেবার নিম্নমান, ডাক্তারের সংখ্যার অপ্রতুলতা এর কোন কিছুই আসলে ডাক্তারের হাতে নেই। একটু ভেঙে বলার দরকার। ডাক্তারি পড়াশোনা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য কাজ। ক্লাসের একেবারে প্রথম দিকের হাতেগোনা ছেলেমেয়ে ডাক্তারি ভর্তি পরীক্ষা উৎরাতে পারে। এরপর শুরু হয় একেবারে গাধার পরিশ্রম। আমার খুব কাছের বন্ধুরা বুয়েটের পাশের ক্যাম্পাস ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তো। আমরা যখন ক্লাসের ফাঁকে বা অবসরে তাস খেলে বা আড্ডা দিয়ে সময় আর ওরা তখন ঘাড় গুঁজে বইয়ের পাতায় পরে থাকতো। যদি কখনও ওদের সাথে দেখা করতে যেতাম ওদের উস্কোখুস্কো অবস্থা দেখে মায়ায় লাগতো কিন্তু এই ছেলেগুলো স্কুল কলেজের ফলাফলের রেকর্ড বিবেচনায় যেকোন দিক দিয়ে ছিলো আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ডাক্তারি পড়াশোনার চাপটা এমনই। 

এতো কঠোর সাধনার পর ডাক্তারি পাশ করেও চাকুরীর নিশ্চয়তা নেই। সবাইকে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকুরীতে ঢুকতে হয়। শুধুমাত্র একটা এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারের কাছে কেউ রোগী দেখতে আসে না তাই প্রাইভেট প্র্যাকটিস তখন অনেক দূরের বিষয়। সরকারি চাকুরী মানে একেবারে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পদায়ন। সেখানে নূন্যতম নাগরিক সুযোগ সুবিধা নেই, নেই রোগী দেখার সরঞ্জাম। তারপরও ডাক্তারেরা সেই সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেই মানুষের সেবা দিয়ে যান। পাশাপাশি আবার এফসিপিএস ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। এফসিপিএস পরীক্ষার প্রথম ধাপ একবারে পার হওয়া গেলেও দ্বিতীয় ধাপ পার হতে অনেকের জীবন পার হয়ে যায়। এফসিপিএস পার হওয়ার পরও আরো হাজার রকমের পড়াশোনা আছে। আমি বলি সাধারণ মানুষ জীবনের প্রয়োজনে পড়াশোনা করেন আর ডাক্তারদের পুরো জীবনটাই পড়াশোনার জন্য উৎসর্গীকৃত।

খুব কম ডাক্তারেরই সৌভাগ্য হয় ঢাকাতে বা তার আশেপাশের জেলা উপজেলায় কাজ করার। সেইসব পদায়ন পেতে গেলে আবার মামা খালুর জোর থাকতে হয় অথবা টাকার জোর। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ জায়গাগুলোর অন্যতম। সেখানকার সামান্য একজন পিয়নের ক্ষমতাও একজন ডাক্তারের তুলনায় হাজারগুণ, লক্ষগুণ বেশি। এইসব পিয়নদের সহায় সম্পত্তির হিসাব করতে গেলে আপনার অংকের জ্ঞানকে অপ্রতুল মনে হবে। যাইহোক এই সমস্ত বিড়ম্বনাকে সাথী করে নিয়েই ডাক্তারেরা মানুষের সেবা দিয়ে যান কিন্তু একটা সরকারি হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পান থেকে চুন খসলেই ক্ষমতাবানেরা ডাক্তারদের উপর চড়াও হন এমনকি অনেক সময় তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত পর্যন্ত করেন।

সাধারণ যেকোন চাকুরীতে সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি করলেই মাসের শেষে একটা নির্দিষ্ট অংকের বেতন পাওয়া যায় কিন্তু ডাক্তারদের কাজের এরকম কোন ধরাবাধা রুটিন নেই কারণ উনারা মানুষের জীবন মরণ নিয়ে কাজ করেন। মানুষের জীবন এবং জমদূতের মাঝে একজন নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব নিয়ে একজন ডাক্তারকে ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে ডিউটি করতে হয়। আমরা একজন ডাক্তারকে তাই "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে"র মতো "জি হাজির" দেখতে চাই কিন্তু আমরা ভুলে যায় উনিও একজন রক্ত মাংশের মানুষ। ডাক্তারেরা কোন রোবট না। তাদেরও আমাদের মতো হঠাৎ অসুস্থ্যতা দেখা দিতে পারে এবং তার জন্য তাদেরকেও চিকিৎসা নিতে হতে পারে। এছাড়াও তাদের নিজেদের পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, আছে সামাজিকতা রক্ষা করার দায়।

ডাক্তারেরা যেহেতু মারাত্মক সব রোগ নিয়ে কাজ করেন তাই সবকিছুর আগে দরকার ছিলো তাঁদের নিজেদের সুরক্ষা করা কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতালেই নূন্যতম পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) নেই তবুও তারা নিজের জীবনের পরোয়া না করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের খুব সামান্যই তাদের কথামতো চলে। সেখানে আছে দালালদের দৌরাত্ম, আছে প্রশাসনের দৌরাত্ম কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার কেন ঔষুধ দিলো না তার জন্যও আমরা ডাক্তাদেরই দোষারোপ করি। সরকারি হাসপাতাগুলোতে সাধারণত নিম্নবিত্তেরাই চিকিৎসা নেন। বিত্তবানেরা তো যান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট হাসপাতালে কিন্তু যখন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে দেখা দেয় তারা একটা সেকেন্ডও নষ্ট না করে তাদেরকে কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে রেফার করেন তাই দেখবেন খুব কম রোগীই বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মারা যান। তারা মারা যান সরকারি হাসপাতালে নেয়ার [পথে বা সরকারি হাসপাতালে পৌঁছানোর পর। আর তখন বিত্তবানেরা তাদের টাকার এবং বাহুর ক্ষমতা জাহির করেন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের উপর।  

বাংলাদেশের মিডিয়া সবে তার কৈশোর বয়স অতিক্রম করছে তাই তারা ঠিক জানে না কোন বিষয়ের কত গভীরে যাওয়া উচিত এবং ঘটনার আড়ালের ঘটনাও বের করে আনা উচিত কিন্তু তারা সেটা না করে হাসপাতালে কোন রোগী মারা গেলেই প্রশ্নের তীর সরাসরি ডাক্তারের দিকে ছুড়ে দেয় আর সাধারণ মানুষও সেটাকে দ্রুতই লুফে নেয় কারণ তারা কখোনোই একজন আমলার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না কিন্তু তার তুলনায় ডাক্তার অনেক সহজলভ্য তাঁদের কাছে যদিও শিক্ষাগত যোগ্যতায় বা মেধায় একজন ডাক্তার একজন আমলার চেয়ে অনেক বড় কিন্তু আমলাতন্ত্রের প্যাঁচে পরে ডাক্তাররা নিয়ন্ত্রিত হয় একেবারেই মেডিকেল জ্ঞানহীন আমলাদের দ্বারা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বাবা মায়েরা ধরে নেন তাঁদের সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে আর দেশের মানুষের সেবা করবে কিন্তু দিনশেষে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন সেই সুযোগ পাই তাই অবচেতনভাবেই বাংলাদেশের মানুষের ডাক্তারদের উপর একটা রাগ তৈরি হয়। উপরন্তু তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতাও অনেকের মনোপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই যখনই সুযোগ আসে তখনই তাঁরা ডাক্তারদের চৌদ্দগুষ্ঠি ধুয়ে দেন।  

এতো এতো বাধা বিপত্তির পরও ডাক্তারেরা মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দিবেন সেই বিশ্বাস আমার আছে কারণ ডাক্তারি পেশাটাই এমন। সেই সত্যটাই আবার নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে মহামারী "করোনা"। বাংলাদেশে ডাক্তারদের নূন্যতম কোন পিপিই'র ব্যবস্থা নেই তবুও তারা দিনরাত সেবা দিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তার উপস্থিতি নিয়ে কারো সন্দেহ নেই কিন্তু তার হাত থেকে যারা রক্ষা করবে সেই ডাক্তারদের নিজেদেরই কোন বর্ম নেই, নেই পর্যাপ্ত অস্ত্রের মজুদ তবুও তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছেন প্রত্যেকটা প্রাণকে বাঁচাতে।    

করোনার সাথে লড়াই করতে যেয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক চিকিৎসকই প্রাণ হারিয়েছেন এবং অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়াতেও এমন সংক্রমণের ঘটনা পাওয়া গেছে যেখানে হাসপাতালে ডাক্তারেরা সকল ধরণের সাবধানতা অবলম্বন করেন। মিনিটে মিনিটে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করেন। এই অবস্থা যদি বাংলাদেশে হয় আমি কল্পনাও করতে পারছি না অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হবে। একজন সাধারণ মানুষ মারা গেলে হয়তোবা শুধু একটা পরিবারই ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিন্তু একজন ডাক্তার মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় একটা পুরো কমিউনিটি বা সমাজ। করোনার প্রভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আরো কিছু পার্শপ্রতিক্রিয়া সামনে চলে এসেছে।

ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশ সে দেশের সবগুলো হাসপাতালকে সরকারিকরণ করে রোগীদের সেবা ত্বরান্বিত করেছে। গবেষণাবিদগণ দিনের পর দিন গবেষণাগারে আটকে থেকে তেমন কিছুই আবিষ্কার করতে পারেন নি কারণ আমরা একজন ফুটবল তারকা বা একজন চলচ্চিত্রের তারকাকে যে মজুরি দিই তার এক শতাংশও আমরা গবেষণার পিছনে ব্যয় করি না তবুও আমি আশাবাদী খুব শীঘ্রই করোনার টিকা আবিষ্কার করে ফেলবেন আত্মনিবেদিত গবেষণাবিদগণ। আমি শুধু মনেপ্রাণে চাইছি ততদিন যেন মানব সভ্যতার নিরাপত্তারক্ষী ডাক্তারেরা যেন নিজেরা সুস্থ্য থেকে মানব জাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। পরিশেষে কায়মনোবাক্যে একটাই প্রার্থনা সকল আশংকা কাটিয়ে মানব সভ্যতার জয় হোক, মানবতার জয় হোক। এই মহামারীতে আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়ায়, অভয় দিই। ভুপেন হাজারিকার ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে -

"মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না
ও বন্ধু…." 

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top