সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৪

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২১

ছবিঃ পূরবী ও তাঁর পরিবার

 

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ছেলে মেয়ের মধ্যে রক্তের সম্পর্কগুলোকে ছাড়া অন্যসব সম্পর্ককেই এখন সন্দেহের চোখেই দেখা হয়। চাচাতো, ফুপাতো, মামাতো, খালাতো ভাইবোন, বেয়ায়-বেয়াইন, দেবর-ভাবি, শ্যালিকা দুলাভাইয়ের মতো এমন মধুর সম্পর্কগুলোতে এখন সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। আমি ঠিক জানি না কিভাবে এই পবিত্র সম্পর্কগুলোতে সন্দেহ ঢুকে পড়েছে তবে যতদূর মনেহয় হিন্দি এবং বাংলা সিরিয়ালগুলোর প্রভাবে এমনটা হতে পারে। আগেকার দিনে নতুন করে আত্মীয়তা করার আগে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে বিবেচনায় রাখা হতো সম্মান দেখিয়ে। এতেকরে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হতো না কিন্তু এখনকার সমাজে আগের সম্পর্ক পরের সম্পর্ক মিলিয়ে এমন একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যায় যে কোনটা আসল সম্পর্ক সেটা নির্ণয় করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। আর যেকোন ছেলেমেয়ের মেলামেশাকে সরাসরি সন্দেহের চোখে দেখা হয় যদি না তাদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। বাংলাদেশে ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও বিরল কারণ লোকজনের সমালোচনার জবাবে বা যেকোন কারণেই হোক বন্ধুত্বটা একসময় পরিণয়ের রূপ নেয় তাই সন্দেহটা দিনে দিনে আরো বেশি ঘনীভূত হয়। আর ছেলেমেয়ের মধ্যে যদি কোন একজন বা দুজনই বিবাহিত হন তাহলে তো আরো অনেক রসালো গল্প তৈরি হয়। একটা ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছাড়াও যে বন্ধুত্বের মতো খাঁটি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে আমাদের সমাজব্যবস্থা সেটা মেনে নিতে নারাজ।  

আমার জীবনে এতদূর আসার পিছনে বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য। একেবারে সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আমিনুর থেকে শুরু করে আমার প্রত্যেকটা বন্ধু আমার জীবনে কোন না কোনভাবে অবদান রেখে চলেছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমার কোন বান্ধবী ছিলো না কারণ আমি সত্যিকার অর্থেই মেয়েদের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না। আমাদের পরিবারে আমাদের মা ছাড়া আর কোন মেয়ে ছিলো না তাই হয়তোবা আমার মধ্যে এক ধরণের জড়তা কাজ করতো। পরবর্তিতে উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে পরিচয় হয় বন্ধু জিনিয়ার সাথে যে এখনও আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। আমার মেয়েবন্ধু বলতে এই একজনই যে আমার আদ্যপান্ত সবকিছুই জানে। আমার আচরণের সামান্য পরিবর্তনেও ও বলে দিতে পারে আমার মনের মধ্যে কি ভাবনা খেলা করছে। আমি যেকোন বিপদে সবার আগে ওর শরণাপন্ন হতাম। সত্যি কথা বলতে এই সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে থেকে এখনও শরণাপন্ন হই। ইতোমধ্যেই ওর বিয়ে হয়েছে আর সেই সংসার আলো করে এসেছে রাজপুত্র আর রাজকন্যা কিন্তু আমাদের দুজনের আত্মিকতা এখনও অটুট আছে এবং আমি নিশ্চত বাকি জীবনটাও অটুটু থাকবে।  

ফেসবুকের একেবারে জন্মলগ্ন থেকে এটা ব্যবহার করি সাগর ভাইয়ের অছিলায়। সেই সময় আমি সাগর ভাইকে ইয়াহু মেইলে সালাম দিতাম আর উনি ফিরতি মেইলে আমার সালামের উত্তর দিতেন। সাগর ভাই ছিলেন বন্ধু শিশিরের যতটা না বড় ভাই তার চেয়ে ছিলেন আমাদের বন্ধু মহলের অভিভাবক। একদিন সাগর ভাই ফেসবুকের লিংক দিয়ে বললেন, এখানে একটা একাউন্ট করো তাহলে আর আমাদের এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি একটা একাউন্ট তৈরি করলাম। শুরুতে আমি সাগর ভাইয়ের ওয়ালে লিখতে যেয়ে প্রায়শই নিজের ওয়ালে লিখতাম। পরবর্তিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তবে তখনও ফেসবুকের প্রতি মোহ বা নেশা তৈরি হয়নি। একবার আমার বুয়েটের রুমমেট তৌহিদ জিজ্ঞেস করেছিলো, ফেসবুক জিনিসটা আসলে কি? উত্তরে আমি বলেছিলাম, বন্ধুহীন মানুষদের বন্ধু খুঁজে পাওয়ার জায়গা। দেশে থাকতে ফেসবুকে তেমন একটা বসা হতো না। সংসারের কাজ সামলে বাকি সময় ব্যায় করতাম বই বই পড়ে, মুভি দেখে আর ঘুরে বেড়িয়ে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আসার পর ফেসবুক একেবারে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেলো। দেশে মানুষের সাথে সহজে এবং সুলভে যোগাযোগ করার জন্য ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারের কোন বিকল্প নেই। আর বিদেশের মাটিতে বসে দেশের যেকোন কিছুর সংস্পর্শ পাওয়ার একটা জানালাও হচ্ছে ফেসবুক। প্রতিনিয়ত দেশকে মিস করার ঘায়ে কিছুটা প্রলেপ লাগে এতেকরে। এভাবেই একসময় ফেসবুকের প্রতি মোহ তৈরি হয়ে গেলো।

ফেসবুকের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও অবশ্য আছে। অনেক অনেক পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি, পেয়েছি অনেক অজানা অচেনা বন্ধুর সন্ধানও। এদের অনেকের সাথেই সরাসরি কোন পরিচয় নেয় কিন্তু ফেসবুকে বা মেসেঞ্জারে কথা হয় প্রায়শই। আমার নীতি হচ্ছে কারো সাথে ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি হলে তার সম্পর্কে জানা কারণ এক একজন মানুষ আমার কাছে এক একটা নতুন বই। নতুন বই পড়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যায় তেমনি একজন নতুন মানুষের জীবন থেকেই অনেক কিছুই জানা যায়। অবশ্য অনেকেই আমার এই আগ্রহটাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন। অনেকেই জিজ্ঞেস করে বসেন এর পিছনে আমার আসল উদ্দেশ্য কি? সত্যি কথা বলতে আমার আসলে কোন গোপন অভিসন্ধি থাকে না।  এভাবেই অনেক নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে আবার অনেকেই মতের মিল না হওয়াতে আমাকে বন্ধু তালিকা থেকে বাদও দিয়েছেন কিন্তু আমি কখনওই কাউকে পারতপক্ষে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিই না কারণ প্রত্যেকের জীবন থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে। সবচেয়ে বড় কথা আমি সেই মানুষটাকে আনফ্রেন্ড করলেই কিন্তু সেই এই পৃথিবী থেকে উবে যাচ্ছে না তাই আমি তাদেরকে আমার বন্ধু তালিকায় রেখে দিই। এতেকরে একদিকে যেমন ভিন্নমতের একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায় তেমনি নিজের সহ্য়শক্তিও বহুলাংশে বেড়ে যায়। 

ফেসবুকের অছিলাতেই কোন একদিন বন্ধু পূরবীকে হয়তোবা রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। একসময় ও সেটা এক্সেপ্টও করলো। এরপর থেকেই আমাদের বন্ধুত্বটা দিনেদিনে আরো পোক্ততা পেয়েছে। আসলে মানসিকতার মিল থাকলে এবং একে অপরের মতামতকে সম্মান করলে যেকোন সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের এই সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হচ্ছে আমাদের দুজনের আলোকিত এবং বর্ণিল শৈশব এবং কৈশোর। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়াতে কিন্তু ওর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরের এক বনেদি পরিবারে। বাবা বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তাই সংসারে তেমন একটা সময় দিতে পারতেন না। পূরবী বেড়ে উঠেছিলো ওর মায়ের শাসন এবং আদরে। সেইসময় মফস্বল শহরগুলোতে এখনকার মতো সভ্যতার এতো ছোঁয়া লাগেনি তাই দাদা বা নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে আর আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়া ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর খেলাধুলার সকল উপকরণের মধ্যেও ছিলো প্রকৃতির ছোঁয়া। আমাদের দুজনের গল্পের মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে এটা। আমরা যে বিষয় নিয়েই গল্প শুরু করি না কেন আমাদের গল্প গিয়ে থামে আমাদের শৈশবে যেখানে আমরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে কখনও দাড়িয়াবান্ধা খেলছি, আবার কখনও বা কারো গাছ থেকে আমি চুরি করছি। আবার দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি বাড়ির পাশের পুকুরে। 

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার একটা দুষ্ট ক্ষত হচ্ছে বড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা নিজেদেরকে যথাসম্ভব ভদ্র এবং মার্জিত ভাবতে এবং সেই মোতাবেক চলতে শুরু করি। আমার একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত লাগে যে বাংলাদেশই মনেহয় পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ যেখানে ধনী এবং গরীবের জীবনযাত্রার পাশাপাশি ভাষাতেও বৈষম্য বিদ্যমান। এছাড়াও আছে রুচির বৈষম্য। গ্রামের মানুষেরা যেসব শিল্পীর গান শুনে শহরে তারা মোটামুটি অপাংতেয়। একেবারে হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী আছেন যারা বাংলাদেশের সব শ্রেণীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন তারই একজন এন্ড্রু কিশোর। আমাদের গল্পে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য থেকে শুরু করে আসে জীবনযাত্রা। আমাদের শৈশবের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন মুজিব পরদেশী। আমি নিশ্চিত আমাদের প্রজন্মের অনেকেই তাঁর গান শুনেছেন কিন্তু এখন আর সেটা ভদ্রসমাজে বলেন না সম্মান হারানোর ভয়ে কিন্তু আমরা দুজন একেবারে জোর গলায় সেটা বলি এবং প্রচারও করি। এছাড়াও গ্রামীণ অনেক খাবার আছে যেগুলো শুধুমাত্র গ্রামের গরীব মানুষরাই খেতো আমাদের দুজনেরই সৌভাগ্য হয়েছে তেমন সব খাবারের স্বাদ নেয়ার এবং এখনও সেগুলো নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমি যেমন বলি পূজার সময় কলা দিয়ে মাখানো আতপ চালের ভোগের গল্প ঠিক তেমনি ও বলে মিলাদের শেষে সিন্নি হিসাবে দেয়া বাতাসার গল্প। এভাবেই আমাদের গল্পগুলো হয় খুবই উপভোগ্য।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায়ই শুধু নিজের শেকড়কে অস্বীকার করার ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ নেই। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এসেও আমরা সেই ক্ষুদ্রতা থেকে বের হতে পারিনি যদিও এখানে বাংলাদেশের মেথরশ্রেণীর (অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় প্লাম্বার) দৈনন্দিন আয় সবচেয়ে বেশি। বিদেশে এসে সবাই রাতারাতি এমনসব গল্প ফাঁদেন যেন তারা বাংলাদেশের হয় রাষ্ট্রপতির সন্তান নাহলে সেনাপ্রধানের সন্তান। যাইহোক এটা বাংলাদেশের বহু বছরের জীবনচর্চার অংশ তাই দেশ বদলালেও এই খাসলত বদলায়নি। আশাকরি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে একটা সাম্যের বাংলাদেশী কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। পূরবী আর আমি এগুলো নিয়ে আলোচনা করি আর হাসি। আর আছে বাংলাদেশের মতোই দলাদলি এবং গলাগলি। আমি বলি সিডনিতে যদি দুজন বাংলাদেশী থাকেন তাহলে সংগঠন তৈরি হবে তিনটা। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংগঠন আর দুজনের মিলিত আরেকটা সংগঠন এবং প্রতিনিয়ত সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের দ্বন্দ্ব। জানিনা কবে আমরা এর থেকে বের হতে পারবো। কাকতালীয়ভাবে আমি ঠিক তেমনই একটা সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম আর পূরবী জড়িত ছিলো সেই সংগঠনটার বিপরীত শক্তির সাথে। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে মাঝে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে বেশকবার কিন্তু প্রত্যেকবারই ও মানসিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়ে আলোচনাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি খুব দ্রুতই মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং আগেপিছে না ভেবে তাদের কথামতো কাজ করি এতেকরে অনেকের সাথেই আমার সরাসরি শত্রুতা না থাকলেও এখন অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলেন।  

এমনই অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব টিকে আছে। আমি ওকে মামা বলে সম্বোধন করি আর পূরবীও আমাকে মামা ডাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে পূরবী এবং মামুন ভাইয়ের সন্তান পৃথিবীকেও আমি মামাই ডাকি। মামুন ভাই আমার দেখা অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ। নিজে ছেলে বলেই জানি যে নিজের সংসার স্ত্রী নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ধরণের জটিলতা থাকে। সংসারে আমরা স্বামী স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু একে অপরের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করি না। মামুন ভাই পূরবীর সবচেয়ে ভালো বন্ধু তারপর স্বামী তাই ওদের বোঝাপড়াটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। পৃথিবী দুর্দান্ত ছবি আঁকে এবং ছবি একে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছে। আমি ওর ছবির দারুণ ভক্ত বিশেষকরে ওর ছবির বিষয়বস্তু আমাকে ভাবায়। বিভিন্ন উপলক্ষে ফেসবুক পোস্টে আমি ওর আঁকা ছবি ব্যবহার করি। আর ও ছবির সাথে কিছু কথা লিখে যেটা খুবই মিলে যায় তখনকার বাস্তবতা এবং ছবির বিষয়বস্তুর সাথে। পৃথিবী যে শুধু ছবি আঁকাতেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছে ব্যাপারটা এমন না পাশাপাশি ও দারুণ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা পৃথিবী এখনও বাংলাদেশ দেখেনি আর অস্ট্রেলিয়াতে বাংলা ওর সেকেন্ড ল্যাগুয়েজ তবুও মায়ের চেষ্টায় ও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে। এছাড়াও লেখাপড়াতেও সে ভালো। গত বছর সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে একটা স্বনামধন্য সিলেকটিভ স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

বাংলাদেশীদের মধ্যে গল্প মানেই পরচর্চা আর নিজের এবং নিজের পরিবারের অর্জন নিয়ে বড়াই করা কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার আর পূরবীর গল্পে কখনও এগুলো আসে না। যদিবা কখনও অনিচ্ছকৃতভাবে চলে আসে আমরা সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাই। আমাদের আলোচনাতে বরং আমাদের শৈশব কৈশোরের আচারের পাশাপাশি আসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গল্প, আসে বাংলাদেশের সংগীত থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য। আমি ওর কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি অনেক লেখকের নাম। আমরা এক একটা বই পড়ি আর তার ভাবনাগুলো শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখি করি তার কড়া সমালোচক হচ্ছে পূরবী। আমার লেখার শব্দ চয়ন থেকে শুরু করে বাক্যের গঠন সবকিছুতেই আছে ওর কড়া নজরদারি। ওর যেহেতু আউট বই পড়াশোনার অভ্যাস আছে তাই ওর উপদেশগুলো আমার লেখার মানকে সবসময়ই শাণিত করে।

শুরুতেই যে কথাটা বলছিলাম বাংলাদেশের সমাজে যেমন ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকে সহজভাবে নেয় না ঠিক তেমনি প্রবাসের বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও এটাকে দেখা হয় অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে। আমাদের নিয়ে তাই অনেকেই আমাদের পিছনে অনেক কথাবার্তা বলেন কিন্তু আমরা কেয়ার করি না কারণ আমরা জানি আমাদের সম্পর্কের মাত্রা কতটা। আমাদের দুজনেরই আছে আলাদা আলাদা সংসার এবং দায়িত্ব এবং আমরা সুচারুভাবে সেটা পালন করার পর আমাদের বন্ধুত্বকে সময় দিই তার আগে নয়। পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই আসলে আছে একটা আলাদা মাত্রা এবং সৌন্দর্য। আমরা যদি একটু সাবধান থেকে সম্পর্কের মাত্রাটা অতিক্রম না করি এবং পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকি তাহলেই কেবল সম্পর্কের সৌন্দর্যটা আমাদের কাছে ধরা দেয়। আর আমার মতে বন্ধুত্বই হচ্ছে পৃথিবীর বুকে একমাত্র পরিপূর্ণ সম্পর্ক যেখানে এমন অনেক কথা শেয়ার করা যায় যেটা অতি আপনজনের সাথেও আমরা শেয়ার করতে পারি না। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক যেখানে একজন মানুষের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও হয়ে উঠে আমাদের একান্ত আপনজন। আর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিপরীত লিংগের সাথে বন্ধুত্বটা হয় অনেক বেশি পরিষ্কার এবং পরিপকারী। বন্ধুত্বের জয় হোক। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল নিঃস্বার্থ পরোপকারী বন্ধুরা।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top