সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

তরুণদের প্রোত্থিত স্বপ্ন ও বেকারত্বের পদধ্বনি : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:২৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:২০

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর ইতালীতে অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপকতা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে বেকারত্বের দোলাচল। তারই আবহে ভিত্তোরিও ডি সিকা নামক একজন পরিচালক ১৯৪৮ সালে 'দ্য বাইসাকেল থিফ' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বেকারত্বের ফলে রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লোক ছোটাছুটি করছে কাজের সন্ধানে। তাদের ভীড়েই এমন একজন এন্টোনিও রিকি বেকারত্বে যাপিত জীবনে চাকরি খোঁজে চলেছে। বেকারত্বের হতাশায় নিমজ্জিত এন্টোনিও রিকির ভাগ্যে বহু কষ্টে পোস্টার লাগানোর একটি কাজ জুটে। তবে শর্ত হলো, এই কাজের জন্য তার একটি বাই সাইকেল থাকতে হবে।

 

হতাশায় নিমজ্জিত এন্টোনিও রিকি বিয়েতে পাওয়া দামি চাদরগুলো বিক্রি করে একটি বাই সাইকেল কেনে। বিধিবাম; ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে পোস্টার লাগাতে গেলে প্রথম দিনেই সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। ছোট ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে হন্যে হয়ে সাইকেল খোঁজতে থাকে এন্টোনিও রিকি। কিন্তু কোথাও বাই সাইকেলের কোন হদিস পেল না। পরের দিন কাজের উদ্দেশ্যে বের হবে কিভাবে? উপায়ন্তর না পেয়ে নিজেও একটি বাই সাইকেল চুরির কথা চিন্তা করে। অগত্যা বাই সাইকেল চুরি করতে গিয়ে জনতার রোষানলে পড়তে হয় এন্টোনিও রিকিকে।

 

এভাবেই বেকারত্বের মুল ধারাকে এক কঠিন বাস্তবতার মিশেলে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এটি একটি সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র। মূলত পরিচালক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দিনগুলোতে বেকারত্বের যে নেতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছিল তারই প্রতিফলন তুলে ধরেছেন।

 

বর্তমান সময়েও মহামারীর প্রকোপে হতাশার চাদরে মোড়ানো বেকারত্বের ধারা অব্যাহত রয়েছে। করোনা কালে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও অর্থনৈতিক সঙ্কট। অর্থনৈতিক সঙ্কট বেকারত্বে প্রভাব ফেলে। ফলে সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রয়া সৃষ্টি হয়।

 

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ক্রম বর্ধমান হারে শিক্ষিত যুব সমাজ গড়তে দেখলেও ২০২০ সালের প্রারম্ভিক সময়টুকু থেকে তেমন ভাল সময় কাটছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ করে মহামারীর প্রকোপে তাদের জীবনের ছন্দটুকু হারিয়ে যায়। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে কোন প্রকার চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ থাকছে না। বরং অনেকেই চাকরি হারিয়ে অতি কষ্টে দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছে। এরই মাঝে কেউ কেউ চাকরি জীবন থেকে ছিটকে পড়েছে, আবার কেউ কেউ চাকরি জীবনে নব্য প্রতিযোগী হিসেবে প্রবেশ করছে। যে বাবা-মা ভেবেছিল সহসাই তার শিক্ষিত ছেলেটি চাকরি পাবে, সে এখন বাড়িতে বেকারত্বের মাঝে দিন পার করছে।

 

আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্প কিংবা অন্যান্য কল-কারখানায় প্রচুর কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক কল-কারখানা কিংবা গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ থাকায় অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টডিজের (বিলস) মতে, করোনাকালীন সময়ে প্রায় ২৬ হাজার পোশাক শ্রমিক ছাটাইয়ের শিকার হয়েছেন।

 

আগস্ট, ২০২০ প্রকাশিত "ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক" শীর্ষক প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩ টি দেশের তরুণদের চাকরি হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনা ও লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে স্বল্প মেয়াদে চাকরি হারিয়েছেন ১১ লক্ষ ১৭ হাজার তরুণ এবং দীর্ঘ মেয়াদে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১৭ লক্ষ ৩৫ হাজার তরুণ।

 

চাকরি হারানোর ফলে তাদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যাতনা। হতাশায় জড়ো হয়ে কষ্টের মোড়কে ঢেকে থাকে তাদের প্রাত্যহিক জীবন বোধ। অসহায়ত্বের মাঝে খোঁজে পায় না পথচলার সঠিক পথ। তারপরও একটি চাকরি পাবার নেশায় বুদ থেকে অনেকটি দিন অগোছালোভাবে ক্ষেপন করে। বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোর মাঝে অগোছালো দিনগুলো আরও অগোছালো করে রাখে। বেকারত্বের মাঝে কখনো ফিরে পায় না যাপিত জীবনের সুন্দরতম দিক। মনের ভেতরে কেমন যেন এক চাপা কষ্টের মাঝেই স্তিমিত করে রাখে কষ্টের মুহূর্তগুলি। বার বার জানান দেয় বেকারত্বে যাপিত জীবনে কষ্টের পথচলা।

 

কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর আমাদের দেশ অনেক লোক বাইরের দেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, বাংলাদেশের চাকরি বাজারে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ আসছে। এদের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রতি বছর কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। আবার, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা তুলনামুলকভাবে মধ্যপ্রাচ্যেই বেশি। করোনার প্রভাবে অর্থনীতিতে বিরুপ প্রতিক্রয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে তেলের মুল্য হ্রাসসহ মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমনকি চাকরি হারানোর মতো পরিস্থতিও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে গমণ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ফলে দেশের ভেতর বেকারত্বের বোঝা বেড়েই চলেছে।

 

করোনায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ১৮- ২৯ বছর শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের উপর। এ পর্যায়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রী অর্জন করে বেকারত্বে যাপিত জীবন নির্বাহ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটি সুন্দর লক্ষ্য নিহিত থাকে। সেজন্য অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। স্বপ্ন পূরণে ব্রতী থেকে শেষ অবধি কেউ ঈপ্সিত আশাটুকু বাস্তবায়নে পারঙ্গম হয়। আবার কেউ কষ্টের গ্লানি বইতে থাকে। তারপরও সর্বোপরি প্রবল প্রতিযোগিতার মাঝেই তাদের বেড়ে উঠতে হয়। কিন্তু সবটুকু আশা লীন হয়ে গেলে মানসিক বৈকল্যে ভোগে। ফলে জীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। মহামারীর প্রকোপ হেতু অনেকেই সঠিক মুল্যায়নের ভিত্তিতে নিজেকে তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের প্রোত্থিত স্বপ্নগুলিও এখনো দোলাচলে দোলায়মান। তবে সরকারী খাতে কিছু চাকরির বাজার খোলা থাকলেও মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়নি। পূর্বের কিছু চাকরিতে আবেদন করে থাকলেও সামনের চলমান কাজটুকু ভাটা পড়ে আছে। সেটা করোনা পরিস্থতির উপর নির্ভর করছে। কখন সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছবে তাও বলা যাচ্ছে না। পরিস্থতি স্বাবাবিক হতে কত দিন সময় লাগবে সেটাও অনিশ্চিত।

 

অন্যদিকে, যাদের বয়স ইতোমধ্যে ত্রিশ পার হয়েছে তাদের সরকারী চাকরিতে আবেদন করার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বেসরকারী চাকরির বাজারও অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তাই, তাদের বেকারত্বের চিত্রিত রুপ খুবই খারাপ বলা চলে। চিন্তিত মনে দিনগুলোয় অতি কষ্টের মাঝে জীবন নির্বাহ করছে।

 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের উপর করোনা মহামারীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

 

একদিকে কারো চাকরি হারানোর ভয় অন্যদিকে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া হতাশার মাঝে এক বিভাজন সৃষ্টি করে। কঠিন সময়ের মাঝেও বেকারত্বের প্রকোপ বাড়তে থাকে। কারো একটি চাকরি হারানোর ফলে নতুন একটি চাকরি পাওয়ার প্রহর গুণতে হচ্ছে। এতে সংঘর্ষ জনিত বেকারত্ব বেড়ে চলছে। বেকারত্বের এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের জন্য খারাপ পরিস্থতি তৈরি হবে। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৩০ সালে বিশ্ব মহামন্দার প্রেক্ষিতে বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জেএম কেইন্স মহামন্দা মোকাবেলার জন্য তার কাল জয়ী গ্রন্থ "A General Theory of Employment, Interest and Money" রচনা করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন নিম্ন সক্রিয় চাহিদার (Low Effective Demand) কারণে শ্রম বাজারে High Unemployment কখনো শেষ হবে না এবং সেক্ষেত্রে আর্থিক নীতি কেন অকার্যকর হয় কেইনস তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উপস্থাপন করেন।

 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)'র তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলোতে গত ষাট বছরের সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে এ বছর। এডিবির মতে, এসব দেশে ছয় কোটির বেশি সংখ্যক মানুষ বেকার হবার ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

জীবনের হিসাবটা অনেক সময়ই গোলমেলে থাকে, সহজ হিসাবটুকু মেলানো ভারী হয়ে আসে অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের জন্য। তাই শত প্রচেষ্টার অগোচরে প্রত্যাশিত জীবনবোধে সহজ হিসাবটুকু কঠিন হয়ে আসে। প্রতিটি মুহূর্ত ঘিরে আসে হতাশার অমোঘ বার্তা।

 

পরক্ষণেই ভাবি, আবারও স্বপ্নগুলি ডানা মেলবে, মানুষের ভাগ্যে চিত্রিত হবে না বেকারত্বের অভিশাপ।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top