সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার ও বঙ্গবন্ধুর দর্শন : কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী


প্রকাশিত:
১৯ অক্টোবর ২০২০ ২২:১৯

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩১

 

খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে ক'টি উপকরণ একান্ত প্রয়োজন এর মধ্যে বীজ হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। চিরন্তন সত্য হচ্ছে "ভালো বীজে ভালো ফসল "। ভালো বীজের গুণাগুণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভালো ফসল উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। আর তাই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্যের সংস্থান করা অর্থাৎ দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা।আর অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন 'মানসম্পন্ন ভালো বীজ, সার ও সেচের। বঙ্গবন্ধু হাতে নিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত সোনার বাংলার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও পুরাতন কৃষি অবকাঠামোসমুহ পুনর্গঠন উন্নয়ন প্রকল্প।
আর তাই ১৯৭৩-৭৮ মেয়াদের বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চালু করা হলো "দানাশস্য বীজ প্রকল্প" এবং বিএডিসি-কে দায়িত্ব প্রদান করা হলো ধান, পাট, ও গম ফসলের বীজ উৎপাদনের জন্য।
বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রজ্ঞা ও অসীম দূরদর্শিতায় অনুধাবন করেছিলেনঃ

"ভালো বীজে ভালো ফসল, সুধীজনে কয়,
প্রত্যায়িত বীজই ভালো বীজ, জানিবে নিশ্চয়।
২০ ভাগ বেশি ফলন পাইতে হলে ভাই,
প্রত্যায়িত বীজ ছাড়া আর যে উপায় নাই।"

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাই ১৯৭৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড গঠনের পরপরই ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন তৎকালীন "বীজ অনুমোদন সংস্থা " তথা আজকের "বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী"। যার অন্যতম প্রধান কাজ হলো বিএডিসি কর্তৃক উৎপাদিত বীজের মাঠমান ও বীজমান যাচাইপূর্বক প্রত্যয়ন দেয়া।

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অধিক বীজ উৎপাদনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপঃ-

সাধারণ মানুষের ক্ষুধা নিবারণ ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সােনার বাংলা গড়ার ইস্পাত দৃঢ় স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু লালন করেছেন, ধারণ করেছেন সব সময়। আর তাই তিনি বুঝেছিলেন, এই স্বপ্ন পূরণে প্রথমেই প্রয়ােজন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন এ দেশের শােষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাই বঙ্গবন্ধু বলেছেন "খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের আছে উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ আর আমাদের পরিশ্রমী মানুষ। আর তাই ভালাে জাত উদ্ভাবন, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব"।

তিনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন, যে দেশের ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী, সে দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষি, কৃষক আর কৃষিবিদদের মর্যাদা উন্নয়ন করতে হবে। তাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে এসে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ঘােষণায় কৃষিবিদদেরকে সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু আরও বিশ্বাস করতেন "কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে পড়ে না থাকে এবং জমিতে ফসলের ফলন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্য দেশের কৃষক সমাজকেই সচেষ্ট হতে হবে"। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম সভায় নিম্নবর্ণিত যুগান্তকারী সিদ্ধান্তগুলাে গ্রহণ করেন।

> দানাদার ফসল ও বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য পূর্ব জার্মানি থেকে ৩৮,০০০ সেচযন্ত্র আমদানি করে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়। ৪০ হাজার শক্তিচালিত লাে লিফট পাম্প, ২,৯০০টি গভীর নলকূপ ও ৩ হাজারটি অগভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়।
> ফিলিপাইন আন্তজার্তিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আইআর-৮ জাতের উচ্চফলনশীল ধানের ১৬,১২৫ টন মানসম্পন্ন ধান বীজ আমদানি করা হয়।

> তাছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে ৪৫৪ টন পাটবীজ, ১১১ টন উফশী গমবীজ ও ১৭০০ মন উফশী আলুবীজ আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ।
> কৃষিতে কেবল বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিই নয় বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্যই বরাদ্দ করেছিলেন ১০১ কোটি টাকা, যা ছিল মােট বাজেটের ২০ শতাংশের বেশি

তার সাড়ে তিন বছরের বাস্তব শাসনামলে দেশের বাজেটের শতকরা ৩১ ভাগ অর্থ কৃষি খাতে ব্যয় করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাস্তব ও গতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যে কৃষিতে সার্বিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৭ শতাংশ।
১৯৭১-৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন সোনার বাংলায় খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ৮৭.৫ লক্ষ টন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে এসে সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন "বাংলার মাটির মত মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না, বাংলার সম্পদের মত সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। গত বছর ২৭ লক্ষ টন খাদ্য আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে কিনে, ভিক্ষে করে। এই বছর ১২৫ কোটি টাকার খাবার কেনার ব্যবস্থা করেছি।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, "পোকা মারার কোন ঔষধের কারখানা আমার নাই। বিদেশ থেকে আনতে হয়। বীজ নাই, বীজ আনতে হয়। উইন্টার ক্রপ করতে পারলে কিছুটা উপকার হয়। প্ল্যান্ড ওয়েতে আমাদের কাজ করতে হবে। তা যদি করতে পারি তবে আমি আশা করি ০৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করবে। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভবিষ্যৎবাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৭৪-৭৫ সালে বীজ অনুমােদন সংস্থা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক স্থাপনসহ বিএডিসি ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ফলে উন্নত জাতের মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৫-৭৬ সালে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টন, যা বঙ্গবন্ধু নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি।

কারণ কিছু দুর্বৃত্ত সেনা অফিসারদের নৃশংসতায় শাহাদতবরণ করতে হয়েছে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণের পথিকৃৎ আমাদের জাতির পিতা , স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে বলেছেন "বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। নিরলস কাজ করে দেশে কৃষিবিপ্লব সাধন করুন"।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সাল হতে "দানাশস্য বীজ প্রকল্প" এর আওতায় বীজপ্রযুক্তি ও বীজমান নিশ্চিতকরণে বিএডিসি ও তৎকালীন বীজ অনুমোদন সংস্থার তদারকীতে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফলে
১৯৭৪-৭৫ সাল হতে এ কার্যক্রমের আওতায় ১৯৭৬-৭৭ সালে ৫৭৬ টন মানসম্পন্ন গমবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়। মাত্র এক বছর পরেই ১৯৭৭-৭৮ সালে ধান, পাট ও সবজিসহ মােট বীজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৫,০৬৬ টনে উন্নীত হয়। যা ছিল মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সঠিক সময়ে চাষিপর্যায়ে ভালো বীজ সরবরাহে বঙ্গবন্ধুর অসীম দূরদর্শিতার সফল পদক্ষেপ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যেও এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় "সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করার ফলে"। যা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০- এর প্রতিপাদ্যকে শতভাগ সঠিক প্রমাণ করেছে।
১৩ ফ্রেরুয়ারি ১৯৭৩ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ভাষণে অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে আরও বলেছিলেন "খাদ্য বলতে শুধু চাউল, আটা নয়, মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারিও আছে। এই সমস্ত কৃষি ও কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে, না হলে মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও হবে না"।

বঙ্গবন্ধুর এই সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনা প্রদান ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে যথাযথ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করার ফলেই দেশে আজ ধান, পাট, গম ও আলু ফসলের প্রত্যয়নকৃত বীজ উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৭-১৮ বর্ষে দাঁড়িয়েছে ৮০,৯৫৪ টনের বেশি, বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদিত হয়েছে ৭০,৬২৭ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ বর্ষে ১,০৫,১০৯ টন দানাশস্য বীজ, ৩১,২৪৬ টন বীজআলুসহ বিভিন্ন ফসলের ১,৩৯,৫৮১ টন বীজ উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়, যা ফসল উৎপাদন অনুযায়ী ৫০-৭০ শতাংশ।ফলে বাংলাদেশে আজ ভালো বীজের কোন সংকট নেই।

বর্তমানে ভুট্টাবীজ, পাটবীজ, কিছু হাইব্রিড ধান ও সবজি বীজ ছাড়া ঢালাওভাবে আর বীজ আমদানি করতে হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৫২ লক্ষ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ মৌসুমে গম উৎপাদন হয়েছে ১৩,১১,৪৭৩ টন, ভূট্টা ৩০,২৫,৮১১ টন। বঙ্গবন্ধুর সেই দৃঢ়চেতা দিকনির্দেশনা আর কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদ যােদ্ধাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধান চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বর্তমানে দেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্ত ও খাদ্য রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হয়েছে।

চলতি ১০১৮-১৯ বর্ষে বাংলাদেশে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডি) পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০১৯ - ২০ মৌসুমে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এতে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের ৩য় শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশ

হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ মে, ২০২০)। যা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও মুজিববর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযােগ্য কন্যা শেখ হাসিনার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সােনার বাংলায় পরিণত করে ২০৪১ রূপকল্পের মাধ্যমে "সুখ সমৃদ্ধিত ভরা উন্নত এক বাংলাদেশ" হওয়ার পথে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পরবর্তী বাংলাদেশে বীজ সংকটের ইতিহাস (১৯৭৫-১৯৯৬):

কৃষি ও বীজের ক্ষেত্রে এর পরের ইতিহাস করুণ ও নির্মমতায় ভরা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর থেকে ২১টি বছর ৩টি স্বৈরশাসকের দেশ পরিচালনাকালে বীজ মান নিশ্চিতকরণে ছিল না কোনাে উন্নয়ন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনাে সম্পৃক্ততা। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক কষ্ট করে ১ (এক) ব্যাগ বীজ আর ২-১ ব্যাগ সারের জন্য কৃষক যেতে হয়েছে এক বাজার থেকে অপর বাজারে। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে এক ব্যাগ বীজ ও সার। ফলে পরিমাণ মতাে বীজ ও সার না পেয়ে এবং সেচ দিতে না পেরে ফসল পায়নি কৃষক। ফলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি করতে হয়েছে প্রচুর ধান, পাট, গম, আর আলু ও সব্জি ফসলের বীজসমুহ। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশের খাদ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৩০-৪০ লক্ষ টনে।

বীজ মান উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদানঃ

১৯৭৪ সালে "বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, বীজ প্রত্যয়নের সৃষ্টি " যেমন সে সময়ে সঠিক ও যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১৫ বছরের কৃতিত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনা বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের বীজ সেক্টর আজ সুসংহত ও বিকশিত হতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা "আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ"-এই দর্শনে নেতৃত্ব প্রদানের ফলে যা আজকের বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্যের সাথে শতভাগ সম্পৃক্ত।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলােকে বীজ উৎপাদনে সম্পৃক্তকরণঃ

বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের ২১ বছর পর জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশের বীজ সেক্টরেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বীজ উৎপাদন, সম্প্রসারণ ও বীজ শিল্প উন্নয়ন খাতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফলে বাংলাদেশে বীজ উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, প্রত্যয়ন ও বাজারজাতকরণে শুরু হয় ব্যাপক কর্মকাণ্ড। তারই ফলশ্রুতিতে আজ প্রায় ১৫০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি, ডিএইসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দানাদার ফসলের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে নিয়ােজিত আছে যার পরিমাণ মাত্র ১৫-২০%। তবে বীজ সরবরাহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বেসরকারি খাত মুলত উচ্চ মুনাফার বীজ যেমন হাইব্রিড ধান বীজ (৯২.৪২%), ভুট্টা (৯৮,৮৫%); পাট (৯৫.৩৭%), শাকসবজি (৯৬.২১%) এবং আলু (৭২.২৬%) বীজের ব্যবসার সাথে জড়িত, যা বর্ণিত ফসলের বা খাদ্যের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে ।

তাই "বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার দর্শন, মানসম্পন্ন বীজের উন্নয়ন" এ আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ফসল উৎপাদনে ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ হয়েছি। কৃষি উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি মানসম্পন্ন ভালো বীজ ব্যবহার করা হয় তাহলে ঐ " ভালো বীজ হতে পাবো অধিক ফসল, দেশ ও জাতি হবে সুস্থ সবল"।

সবশেষ কথা হচ্ছে "ভালো বীজেই সুস্থ জীবন"। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে আমাদের সবার এই হােক অঙ্গীকার 'মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করবো, অধিক ফসল ঘরে তুলবো"। এভাবেই আমরা পাবাে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা' আর দেশ হয়ে উঠবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের "সুখ সমূদ্ধিতে ভরা উন্নত এক বাংলাদেশ"। সুতরাং এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে-

"বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বীজ উন্নয়নে অবদান মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহারে বাড়ছে দেশের সম্মান"।
তাই স্বরচিত কবিতার কিছু লাইন দিয়ে উপসংহারে বলতে চাই-

"হে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
তোমার চির উন্নত শির, উঁচু রেখেছি বারবার, আজ তাই ২০২০ সালে তোমার জন্ম শতবর্ষে, ১৬ কোটি মানুষের সোনার বাংলায়,
ভাত-কাপড় আর মাছ-মাংসের নেই কোন হাহাকার"।

 

কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী
'বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪২৩' প্রাপ্ত কৃষি সাংবাদিক, উদ্ভাবক ও (অবঃপ্রাপ্ত) উপ পরিচালক ও জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার, এসসিএ(কৃষি মন্ত্রণালয়) এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত পরিষদ, বাংলাদেশ।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top