সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন ও দুর্ভোগের অবসান : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৪২

 

দিনটি ছিল ২০০৯ বা ২০১০ সালের শুক্রবার। আমি বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকা গিয়েছিলাম। দিনের শুরুটা ভালভাবে শুরু হলেও দিনের শেষটা অনেক কষ্টের বাঁকে ধারণ করেছিলাম। প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে সিলেটে ফিরে আসার তাগাদা ছিল। তাই কাজটুকু শেষ করে ঢাকা বাসস্ট্যাণ্ডে এসেছিলাম। কিন্তু; সিলেটে আসার মতো সিলেটগামী বাসের কোন টিকেট পেলাম না। মাঝে মাঝে এ ধরণের নেতিবাচক কিছু ঘটনার সম্মুখীন হওয়ায় সেদিনকার ঘটনাটি আমার মনের ভেতর নাড়াও দেয়নি কিংবা এতটুকু ভাবায়নি। তাই হয়তো হতবিহ্বল হয়ে পড়িনি কিংবা আশ্চর্য্যবোধ হইনি, শুধু ইতস্তত: বোধ করেছিলাম। শুনতে পাই পরের দিন সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। ফলে সব টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু শুক্রবারের জন্য টিকিট বিক্রি শেষ হলে বাঁচা যেত, জানতে পারলাম পরের দিন দুপুর পর্যন্ত টিকেট বিক্রি শেষ। বাসায় যাবার তাগাদায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল সিলেটে যাওয়া কঠিন ব্যাপারে পরিণত হবে, হয়েছিলও তাই।

চিন্তিত মনে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগুতেই দেখতে পেলাম একজন অভিভাবক উনার মেয়েসহ (পরীক্ষার্থী) হন্যে হয়ে একটি টিকিট খুঁজছে। মনে হলো বেচারার জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা এই প্রথম! পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পেরেছিল কিনা জানি না। তবে অনুভব করেছিলাম, তাদের কষ্টের বারতা। তাদের উদাস চাহনির দৃষ্টি আমাকেও অনেক হতাশ করেছিল। অথচ মেয়েটির নাকি ইচ্ছে ছিল সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার। যদি সে বাসের জন্য আটকা পড়ে যায় তবে তার এ সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার সীমাবদ্ধতার সীমানা এখানেই স্থিত! জীবনের ইচ্ছার পরিসমাপ্তি বাসস্ট্যাণ্ডেই ঘটলো। তার উদ্যম জীবনে এমন একটা আঘাত সহ্য করতে হবে সে হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে শেষ হয়ে এলো ঈপ্সিত মনের আকাঙ্ক্ষা। আর যদি যেতেও পারে তবে কতটুকু কষ্ট স্বীকার করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে সেটা সহজেই অনুমেয়।

পরক্ষণেই আবার ভাবি, এ ধরণের সীমাবদ্ধতার দেয়ালে তো অনেকেই আটকা পড়ে। তাদের খোঁজ আমরা কয়জনেই বা রাখি! এভাবেই হয়তো অনেকেই সীমাবদ্ধতার দেয়ালে আঁচড়ে পড়ে এক পার্শ্বে ছিটকে পড়ে। অথচ আমরা যদি আরেকটু সচেতনভাবে এ কাজটুকু করার সুযোগ তাদের দিতে পারতাম তবে তাদের এত বড় ক্ষতি সাধন হতো না। জীবন গঠনের জন্য পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার প্রয়াসে লিপ্ত থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা মানেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া, নতুন এক জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। তার উপর পরিবহণ সঙ্কটে পতিত হওয়া মানে আরও একটি অযাচিত যুদ্ধে নামা।

আমাদের দেশে বর্তমানে ৪৬ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই সেগুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। উচ্চ শিক্ষার গন্তব্যস্থল কিংবা কারিগর হিসেবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে যে সুপ্ত স্বপ্ন প্রোত্থিত থাকে সেটার প্রতিফলন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফূটনে প্রকাশ পায়। ফলশ্রুতিতে, আশা আকাঙ্ক্ষা সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে। সেজন্য ঈপ্সিত আশা পূরণে তারা কঠোর পরিশ্রমে ব্রতী হয়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কেউ গন্তব্য স্থানে পৌছতে সক্ষম হয় কেউবা নিমিষেই ছিটকে পড়ে। তবে যারা শুধু পরীক্ষার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ছিটকে পড়ে তাদের জন্য এটা মেনে নেয়া অতি কষ্টকর। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা বিদ্যমান থাকায় একজন পরীক্ষার্থীর জন্য কতটুকু মানসিক যন্ত্রণার সেটা সে-ই উপলব্ধি করতে জানে। এমন তো নয় যে সে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেই ভর্তির হওযার সুযোগ লাভ করবে। সেজন্য তাকে আলাদাভাবে মানসিক প্রস্তুতি এবং ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। এ মানসিক যাতনার মাঝে যদি আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে দৌঁড়াতে হয় তবে কঠিনতর অবস্থা প্রতীয়মান হয়। আবাসন সঙ্কটজনিত সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।

বড় আশার কথা হল, বর্তমান সময়ে দেশের ১৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রিত হয়ে গুচ্ছ পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক পরীক্ষার্থীর মনের সংশয়ের আভাস দূরীভূত হলো। কালের ত্রিসীমানায় এসে ভাবি, মহামারী এসে বুঝি বিশেষ কাজটুকু অতি সাবলীলভাবেই করতে পেরেছে। নতুবা ভর্তি পরীক্ষার মতো যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে মুক্তি পেতে অসহনীয় থাকাটা অবচেতন মনের বিরূপ প্রতিফলনই বলা চলে। সেজন্য যারা এ কাজটুকু করতে উৎসাহ যুগিয়েছেন কিংবা যারা করেছেন তাদেরকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। অতি কষ্টের সীমানা থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলেছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের। বিষয়টি যে কতটুকু যন্ত্রণাদায়ক সেটা শুধু ভূক্তভোগীরা তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই নিতে জানে। আর নিতে জানে তাদের অভিভাবক যারা অতি কষ্টের মাঝেও ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্যে কষ্টের বেহাগ সুরে প্রাণপণে চেষ্টা করে ভর্তি পরীক্ষায় নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন শিক্ষার্থী যখন ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি গ্রহণ করে তখন তাদের মাথায় কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নটুকুই ঘুরপাক খায়। তাই আশান্বিত হয়ে অনেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। আবার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেয়ার ফলে তাদের মানসিক যাতনা দেখা দেয়। অনেকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করেও শারীরিক ক্লান্তিজনিত কারণে পরীক্ষায় ভাল করতে পারে না। ফলে একজন ভাল শিক্ষার্থী অতি সহজেই জীবনযুদ্ধে হেরে যায়। সেখানে অনেক ধরণের সমস্যার উদ্ভূত হয় যা আমরা কখনো আঁচ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারি না।

আবার অনেক সময় একই পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পুনরায় ভর্তি বাতিল করতেও অনেক টাকার জলাঞ্জলী দিতে হয়। অন্যদিকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই তারিখে ভর্তি পরীক্ষা নির্ধারিত হবার কারণে ফরম পূরণ করেও অনেকে পরীক্ষা দিতে পারে না। ফলে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত একজন মেধাবী শিক্ষার্থী তার পছন্দের বিষয়টি নিয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্স পড়ার স্বপ্ন তখনই ইতি টানতে হয়। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এমন অনেকেই আছে যারা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত হয় সেখানে তাদের আবাসনগত সমস্যাসহ অনেক ধরণের সমস্যা পড়তে হয়। মেয়ে পরীক্ষার্থী হলে আরও বেশি দুর্ভোগ নেমে আসে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটি এক জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খায়। যদি বর্তমান সময় অর্থাৎ মহামারীর প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে এমন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না আসতো, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা নেয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। গুচ্ছে থাকা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার কেন্দ্র থাকবে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১৯ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট তিনটি পরীক্ষা হবে। এর মাঝে বিভাগ পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকবে।

আমরা এই শতাব্দীতে এসে যদি সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পরীক্ষার কথা চিন্তাই না করতে পারি তবে তা আমাদের মনের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এভাবে পরীক্ষার জন্য প্রতিটি পরীক্ষার্থীর মানসিকভাবে প্রস্তুতির জন্য ঠেলে দেই তবে সেটা যে অসহায়ত্বের নেতিবাচক প্রভাব তা সহজেই অনুমেয়। সেখানে গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি শুধু পরীক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক নয়, অনেক কষ্ট, পরিশ্রম এবং অভিভাবকদের অর্থনৈতিক মুক্তি লাঘব হবে।

অনেক আগে BIT(Bangladesh Institute of Technology) -তে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে কয়েক বছর পূর্বে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পরে তা বাস্তবায়িত হয়নি। যদি বিসিএস প্রিলিমিনারীর মতো প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় কয়েক লক্ষ পরীক্ষার্থীকে বিভাগীয় শহরগুলোতে পরীক্ষা নেওয়া যায় তবে আশা করি প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও একসাথে নেয়া অসম্ভব নয়। বলতেই হয়, গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের সাথে সাথে যদি প্রতিটি জেলা ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা যায় তবে আরও ফলপ্রসু হবে এবং অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব হবে, মানসিক যাতনা থেকে রেহাই পাবে।

 

অনজন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top