সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষার নতুন দিগন্ত- এজেণ্ডা ২০৩০ : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩৮

আপডেট:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:২৮

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো একটি সমন্বিত শিক্ষা পরিকল্পনা Education Sector Plan তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় SDG4 Strategic Framework For Bangladesh ভিসন-২০৪১ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে সাযুজ্যতা রেখে Education Sector Plan (খসড়া) তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ধাপে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

১৯৯০ সালে সবার জন্য শিক্ষা ঘোষণা পরবর্তীতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও ছেলেমেয়ের সমতা অর্জনসহ শিক্ষার মানবৃদ্ধি ও বৈষম্য কমানো ও অন্যান্য অধিকার অর্জনে শিক্ষা অপেক্ষাকৃত অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় MDG এর অসমাপ্ত কাজগুলো এবং পরবর্তীতে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে জাতিসংঘভুক্ত ১৯৩ টি সদস্য দেশ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০৩০ সালকে সামনে রেখে Transforming our World: The 2000 Agenda for Sustainable Development শীর্ষক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবনা আগামী ১৫ বছরে অর্জনযোগ্য ১৭ টি লক্ষ্য বা গোল এবং ১৬৯ টি টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। এই ১৭ টি গোলের ৪র্থ লক্ষ্য বা গোল হচ্ছে সবার জন্য অন্তভূর্ক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। Ensure Inclusive and equiatable quality education and promote life long learning for all যা এডুকেশন ২০৩০ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

এই সূচকে ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে ও মেয়ে যাতে প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও ফলপ্রসু অবৈতনিক, সমতাভিত্তিকও গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি টেকশই উন্নয়ন ও টেকশই জীবনধারার জন্য শিক্ষা, মানবাধিকার, নারী পুরুষ সমতা, শান্তি ও অহিংসামূলক সংস্কৃতির বিকাশ, বৈশ্বিক নাগরিকত্ব এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও টেকসই উন্নয়নে সংস্কৃতির অবদান সম্পর্কিত উপলব্ধি অর্জনের মাধ্যমে সকল শিক্ষার্থী যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। 

শিক্ষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি প্রতিদিন সে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পবিত্র কুরআনের প্রথম বানীই হচ্ছে ‘ইকরা’। অথাৎ ‘পড়’। জ্ঞান অর্জনের প্রথম নির্দেশ দিয়েই জ্ঞান আহরণের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন ‘বিদ্যার্জনের জন্য সুদূর চীন পর্যন্ত যাও’। তিনি আরও বলেছেন ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যার্জন কর’। দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষার সাথে প্রকৃতিকে মিশিয়ে গাছ তলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রের সাথে শিক্ষকের নিবিঢ় সম্পর্কের জায়গা, মমতায় মাখা শিক্ষাব্যবস্থায় অভ্যস্থ করেন। সেই প্রকৃতির সাথে মানবিকতার মিশ্রনে সহজ সরল শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণীকক্ষে জায়গা করে নিয়েছে। জৌলুসবিহীন শিক্ষা পদ্ধতিতে এখন আভিজাত্যের ঝিলিক লেগেছে। কিন্তু অন্তর্গত মান বাড়ে নি। সক্রেটিসের সময়ের মতো বর্তমানে একজন শিক্ষকের ছাত্রের প্রতি দরদ ভালোবাসা চর্চ্চার নিদর্শনের ঘাটতি রয়েছে। ছাত্রের প্রতি দরদ ভালোবাসা না থাকলে এবং বন্ধুর মতো আচরণ না করলে তাকে পরিপূর্ণ সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষিত সচেতন মহলে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। পাশের হার ও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে সন্দেহ, শংকা ও ক্ষোভ। এর জন্য দায়ী কে? এর জন্য নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তাদের নিজেদের স্বার্থে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের দিকটা এড়িয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতি সুশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা এবং একই সাথে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও মান হ্রাস পেয়েছে ভয়ানক রকম। কিছু শিক্ষক আছেন অযোগ্য, আবার কিছু শিক্ষক আছেন যোগ্য বটে, তবে সুষ্ঠু পাঠদানে তাদের রয়েছে চরম অনীহা। এসবের ঘেরাটোপে আবদ্ধ আমাদের আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা। ক্লাস কার্যক্রম রেখে তারা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট টিউশান, কোচিং ক্লাস নিয়ে। জীবন জীবিকার জন্য অবশ্যই টাকার প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু টাকা উপার্জনই যদি একজন শিক্ষকের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে কেন শিক্ষকতা পেশা বেছে নেওয়া? কর্পোরেট শাখা তাদের যোগ্য জায়গা বলে ভাববার প্রয়োজন ছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আদর্শ শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন যাদের উচিৎ ছিলো জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া। তাদের কোনমতেই উচিৎ হয় না, ছাত্রদিগকে মানুষ করবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তারাই লইবার অধিকারী, যারা নিজেদের চেয়ে বয়সে অল্প জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকে ও সহজেই শ্রদ্ধা করতে পারেন। এক সময় শিক্ষকগণ ছিলেন সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র। বর্তমানের প্রেক্ষিতে বিষয়টি নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। 

বর্তমান কোভিড নাইনটিন এর পেণ্ডামিকের কারণে সারা বিশ্বেই এবং বাংলাদেশের রাজধানীসহ কিছু কিছু শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে অন লাইন ক্লাস চলছে, তবে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রাম এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীরা এ থেকে পিছিয়ে আছে। স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট কানেকশানের অভাবে একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা অন লাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না। 

 দিন মুজুর বাবারা সন্তানদের এই প্রয়োজনীয় চাহিদা না মেটাতে পেরে নানা সংশয় এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো অঘটন ঘটাচ্ছেন। যা আমরা দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে দেখতে পাই। তাছাড়াও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে পরিচালিত হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা, কওমী শিক্ষা, বাংলা বা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সনের কারণে একেকজন একেক রকম করে শিখছে। তদুপরি আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও চাপ। তাই সবদিক বিবেচনায় শিক্ষাকে একীভূত করে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। মূলত কোয়ানটিটির উপর জোর না দিয়ে কোয়ালিটি এনসিওর করতে হবে। টেকনিক্যাল সার্টিফিকেটের ওপর জোর দিতে হবে। যাতে করে ফাইনান্সের ব্যাপারে শিক্ষার্থীগণ এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারে। মেধা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে কর্মমুখী জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক, যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রতিষ্ঠা, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেম সম্পৃক্ত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ সংযুক্ত করতে হবে। আনন্দদায়ক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে হাসিমুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে প্রলুব্ধ করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি হবার সাথে সাথে যেই উল্লাসে শিক্ষার্থীগণ শ্রেণীকক্ষ থেকে বের হয়, আমরা চাই সেই একই রকম উল্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীগণ যেন শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে।

 যদিও বর্তমানে শিক্ষা কারিকুলামে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে, তদুপরি সৃজনশীল শিক্ষা পাঠদান পদ্ধতি বিষয়ক পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যোগ্য শিক্ষককে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদেরকে আরও মনোযোগী করে তুলতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষাক্ষেত্রে সকল রকম বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধি, দক্ষতা, মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে গুণগত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ঝউএ৪ পরিমাণগত শিক্ষা পূরণ করতে পেরেছে। এখন যদি আমরা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষা গবেষণা, বিজ্ঞানমনস্ক, কর্মমুখী, নৈতিকতা, মানবিকতা সম্পন্ন শিক্ষাকে জাগ্রত করতে পারি, তাহলেই এই গুণগত শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত, প্রতিশ্রুতিশীল মানবিকতা সম্পন্ন আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। 

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top