সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

মানবিক কর্মকাণ্ডের অনন্য নিদর্শনে আমাদের নারীরা : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৮

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:১৩

ছবিঃ রিনা আক্তার এবং রিমা সুলতানা রিমু

 

আমাদের সমাজের অন্তরালেই কিছু কল্যাণকামী মানুষ থাকে যারা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে অন্যের কল্যাণে নিবেদিত থাকে। সেটাকে মনুষ্যত্ব গুণাবলীর অনন্য নিদর্শন বলা চলে। সর্বদা মহত্ত্ববোধের মাধ্যমেই জেগে থাকে সুষ্ঠু জীবনবোধ। অসত্যের শৃঙ্খলকে পরাজিত করে কিংবা আঁধারে ধেয়ে আসা নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করার নিমিত্তে সম্মুখে এগিয়ে চলে। আঁধারে ডুবন্ত সমাজকে অস্পৃশ্যতার মাঝেও যারা টেনে ধরে রেখেছেন তাদের কথাই বিশ্বসংসারে বার বার উঠে আসে।

 

বলা যেতে পারে, মহৎ গুণ তাদেরকে সুন্দর পথে চালিত করে, সুন্দর সুশোভিত সমাজ গড়তে শিখায়। অন্যের বাঁচাকে স্বার্থক করে তোলার মাঝেও নিজের অন্তর্নিহিত সুখটাকে উপলব্ধি করতে পারে। সেজন্যই হয়তো আমাদের সমাজ আজও খুঁজে পায় সম্মুখে পথচলার দৃপ্তপ্রয়াস।

 

মহত্ত্ববোধের মাঝেই মানুষ্যত্বের বিচরণক্ষেত্র। প্রতিনিয়ত ব্যবহারের আশায় সেটাকে সৃষ্টি করা যায় না। সঠিক চিন্তা-চেতনার মাঝেই প্রোত্থিত থাকে। সমাজের চিন্তা-চেতনায় নিমজ্জিত ব্যক্তিরাই কেবল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে অপরের চিন্তায় মগ্ন থাকে। নিজের ত্যাগ-তিতিক্ষা উপেক্ষা করে কারো স্বার্থে এগিয়ে চলা কঠিনতম কাজ। আর, সেটা যদি মহামারীর মতো কঠিন সময়ে হয় তাহলে কঠিনতম কাজের ধ্রুপদী বলা চলে। সে বিবেচনায় মহত্ত্ববোধের স্থানকে মহানুভবতার এক উচ্চ স্থানে আসীন হতে হয়। যদিও মহামারীর লকডাউনের মুহূর্তে অস্পৃশ্যতাই সর্বজন স্বীকৃত, ছিল গৃহবন্দি মনুষ্যসকল। অস্পৃশ্যতার মাঝে দু'একজন দু:সাহসিক কাজের বিনিময়ে মহানুভবতার অধ্যায় রচনা করেছেন। নিস্তব্ধতার দেয়ালে আটকে রাখা কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের মাঝেও নিতান্ত আপন মনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মানবতাবোধের নিপুণ নিদর্শন।

 

 

মহামারীর প্রকোপে যখন নিস্তব্ধতায় সারা দেশ, বিভীষিকাময় ভয়াল থাবা তখনই আঘাত হানে। লকডাউনে আতঙ্কিত হয়ে দিন পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিনতর সময়ে। একদিকে ঘরবন্দি জীবন অন্যদিকে টিকে থাকার লড়াই। সে সময়টাকে যুদ্ধের অনন্য বাহকও বলা যেতে পারে। দুর্দিনে আশ্রয়ের সারথি হিসেবে নিস্তব্ধতায় আঁধার ভেঙ্গে আলোকময় পথে মানবতার হাত বাড়িয়েছেন কেউ কেউ। বলা চলে, অন্ধকারময় ঘিরে থাকা জগৎকে দু'দন্ড মুক্তির আশায় এভাবে পথ চলতে শিখায়। তাদের নিবেদিত আত্মোপলব্ধিই প্রতিটি মুহূর্তের পথচলার সাহস খুঁজে পায়।

 

Live এবং Let Live- এর দার্শনিক তত্ত্বমতে সমাজে আমরা মানবতার হাত বাড়িয়ে দেই। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত চির সুন্দর নিপুনশৈলীতে মানবতার হাত প্রসারিত করে সুন্দরের বহি:প্রকাশ ঘটাতে পারি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ভাইরাস টিকা গবেষণা দলের প্রধান সারাহ গিলবার্টের কথা আমরা প্রাণভরে স্মরণ করি। মাঝে মাঝে আশান্বিত হতাম, সারাহ গিলবার্টের মতো একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি যিনি আমাদের সমাজের না হোক অন্তত: সমাজের একটি অংশের জন্য হলেও কাজ করে যেতে পারবেন। হ্যাঁ, আমরা পেয়েছিও তাই। করোনা ভাইরাস মহামারীতে সারাহ গিলবার্টের মতো না হোক অন্তত: সমাজের মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দিয়েছেন। তারা দু'জন হলেন রিনা আক্তার ও রিমা সুলতানা রিমু। বিবিসির দৃষ্টিতে একশত নারীর তালিকায় নাম নেয়া সারাহ গিলবার্টের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছেন বাংলাদেশের রিনা আক্তার ও রিমা সুলতানা রিমুর নাম। করোনা ভাইরাস মহামারীতে রিনা ও তার টীম প্রতি সপ্তাহে অন্তত চারশত যৌন কর্মীদের খাবার সরবরাহ করেছেন। অস্পৃশ্যতার আড়ালে সর্বদাই ঢেকে থাকে যাদের যাপিত জীবন, মহামারীর আঁধারে তাদের মুখেই খাবার তুলে দিয়েছেন অতি নিরবে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব তাদের কখনো ভাবায় না। ভালবাসার মাঝে কার্পন্যবোধ কাজ করে না। তাই, অস্পৃশ্যতার কালো মুখ সেখানে দানা বাঁধতে পারে না।

 

রিনা আক্তারের মতে, 'সমাজের মানুষ আমাদের হেয় করে দেখে। আমি চেষ্টা করেছি এই পেশার কেউ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে। তাদের মেয়ে বাচ্চাদের যেন এ কাজ করতে না হয়।' সত্যি, কথাগুলোর মাঝে মানবিক বোধটুকুই ফুটে উঠে। সেখানে নিস্পৃহতা হার মানায়। সেটি শুধু মহৎ গুণের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করে না বরং সমাজের স্তরে টিকে থাকা দু’একজন মানুষের পূর্ণ অভিব্যক্তির স্তিতধী প্রকাশ করে।

 

অন্যদিকে রিমা সুলতানা রিমু ' ইয়ং উইমেন লিডার্স ফর পিস' এর একজন সদস্য। যার মুল উদ্দেশ্য সংঘাতপূর্ণ দেশ থেকে আসা নারীদের ক্ষমতায়ন করা যাতে তারা নেতৃত্বদান করতে পারেন এবং শান্তির এজেন্টে পরিণত হতে পারে। রিমা তার মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবেলায়। রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী ও শিশুদের লিঙ্গ সংবেদনশীল ও বয়সভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেন, 'অধিকার আদায়ের জন্য নারীর শক্তিকে আমি বিশ্বাস করি।'

 

ভাবি, এ কঠিনতম সময়ে দৃঢ়চিত্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তাদের দেখেছি নিজেদের আপন মহিমায় উদ্ভাসিত করতে। মানবতাবোধের এ ব্যাপ্তিটুকু আরও আশান্বিত করে যখন দেখতে পাই আমাদের সমাজেরই কোন নারী দৃঢ়চিত্তে সমাজের নিচুস্তরের চিন্তা-চেতনায় সামিল হয়ে নিজের অভিব্যক্তিকে ঠাঁই দিতে পেরেছে। তখন এ গদ্যময় রাজ্যটাই হয়ে উঠে আরও প্রাণময়। সুস্থিত চিন্তার সুনিপুন বৈশিষ্ট্য দেখা দেয় আলোকিত জীবন বাঁকে। মহানুভব হতে পারা যেমন কঠিনতর কাজ, তেমনি মহানুভবতা কর্মে রূপান্তরিত করে দেখানো তার চেয়েও অনেক কঠিনতর। সেই কঠিন কাজুটুকু সামলে চলা যেমন আমাদের সমাজে বিরল তেমনি তাদের সামান্য উপস্থিতি আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করে থাকে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যক্তি প্রসঙ্গ প্রবন্ধগুচ্ছে গুরু সদয় দত্তের স্ত্রী সরোজনলিনী দত্ত সম্পর্কে বলেন, "আজকালকার দিনে নারী একান্তভাবেই গৃহিণী, তিনি আমাদের আদর্শ নহে, ঘরে বাহিরে সর্বত্রই যিনি কল্যাণী, তিনিই আদর্শ।" রিনা আক্তার ও রিমা সুলতানা রিমু আদর্শ নারী যারা ঘরে ও বাইরে সর্বত্র কল্যাণী ও মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আদর্শ হয়ে আছেন!

 

অনজন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top