সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ আগামী প্রজন্মের পাঠ : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:২৪

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:২৩

 

বিশেষ বিশেষ দিন উদযাপন বর্তমান আধুনিক সমাজের আবশ্যকীয় অঙ্গ। বর্তমান যুগে বিশেষ দিনগুলো গোষ্ঠী, জাতি, দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পেয়েছে। এরকমই একটি বর্ণময় দিন হল ২১শে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস '-এর মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। প্রতিটি বাঙালির কাছে এই দিনটি হল মাতৃভাষাকে নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে ভাবার দিন, মাতৃভাষার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ও অফুরান ভালোবাসা জানানোর এক পবিত্র দিন এবং এর মর্যাদা রক্ষার জন্য নতুনভাবে শপথ নেওয়ার দিন। এ-বছর আমাদের দু'বাংলার মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার উনসত্তর বছর। কয়েক বছর বাদে পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত হবে নানান বর্ণময় মহা অনুষ্ঠান। সেই দিনটার অপেক্ষায় আছে কোটি -কোটি দুই বাংলার বাঙালি ভাষাপ্রেমি মানুষ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার গুরুত্বকে খর্ব করার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল প্রথম গণ-অভ্যুত্থান। ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, জাতি নয়-- সাম্রাজ্য বিস্তারের আগ্রাসনও নয়-- মাতৃভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য, তার মর্যাদা জন্য প্রথম গর্বিত প্রয়াস সেটাই। 

 

দুই

মা আর মাতৃভাষা দুই-ই মানুষের শরীর মনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সামগ্রী-- কোনটিকেই কোনদিন ছাড়তে পারবে না মানুষ। যেমন মা-আমাদের আশ্রয় ভূমি, প্রেরণা ভূমি, ঠিক তেমনি ভাষা আমাদের জাতি সত্তার ও সাংস্কৃতিক সত্তার প্রাণ ভোমরা। ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব বিনিময়ের সময় পেরিয়ে কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ যখন প্রথম কথা বলতে শুরু করে তখনই বস্তুতপক্ষে মাতৃভাষার জন্ম। যুগে যুগে ভাষার বৈচিত্র্য, বিস্তৃতি, ভিন্নতা এক এক সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ভাষার এক এক রূপকে অবলম্বন করে বসে। জন্মদাত্রী -মা এক্ষেত্রে শিশুর ভাষা স্ফুটনে বিশেষ সহায়তা করে। বিশ্বে বর্তমানে ভাষার সংখ্যা আনুমানিক ৬০০০। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের দু'বাংলার মাতৃভাষা প্রেমিক মানুষের কাছে গর্বের বিষয় এটাই যে, ভাষার জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা রয়েছি চতুর্থ স্থানে। বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদদের মতে মাধুর্যের দিক থেকে বিশ্বে ফরাসী ভাষার পরেই বাংলার স্হান।

 

তিন

বাংলা ভাষার উদ্ভব কবে হয়েছে এ-নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের বিতর্ক। কারো মতে সপ্তম-অষ্টম শতকে, কারো মতে দশম শতকে প্রাকৃত-অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে বাংলা ভাষা নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। এই ভাষাতেই রচিত হয়েছে চর্যাপদ। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য সহস্র বৎসরের সুপ্রাচীন। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের শ্রেণীতে বাংলা ভাষা এখন গৌরবময় স্হানে উন্নীত হয়েছে। এই ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি করে নোবেলজয়ী হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

 

চার

বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার বন্দনার শুভ সূচনা উনিশ শতকে। পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল হল এটি।যেমন বিদেশী দেশপ্রেমের ছোঁয়ায়, লোকহিত করার প্রবণতায় আলোড়িত আমরা দেশসেবাব্রতি হয়ে উঠেছি তেমনি প্রথম পর্যায়ে বাংলাভাষা বন্দনার স্হলে লক্ষ্য করা গেছে স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ। রামনিধি গুপ্ত লিখেছেন--'বিনা স্বদেশীয় ভাষা মেটে কি আশা?' প্রকৃতপক্ষেই চাতকের তৃষ্ণা যেমন ধারা জল ছাড়া মেটে না তেমনি এদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের কথা বলার পিপাসা মেটে না বাংলা ভাষা ছাড়া। গুপ্ত কবি ঈশ্বরগুপ্ত তাই লিখেছিলেন,---'মাতৃসম মাতৃভাষা/মিটালে তোমার আশা/তুমি তার সেবা কর সুখে।'

বঙ্গভাষার আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বন্দনা করেন আমাদের মহাকবি মধুসূদন দত্তও--' মাতৃভাষা রূপখনি পূর্ণ মণিজালে।' প্রথম বয়সে অন্ধ প্রাশ্চাত্য মোহে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন, বেদনানুভব করেছিলেন। কিন্তু মধুসূদন দত্তের সময় পর্যন্ত বাংলাভাষায় বন্দনার মধ্যে দেশপ্রীতির ভাব ছিল কম, এইভাষাপ্রীতির সঙ্গে পরবর্তীকালে যুক্ত হল গভীর দেশাত্মবোধ। ভক্তকবি অতুলপ্রসাদ সেন জাতীয়তা বাদীদৃষ্টিতে দেখেছেন বাংলা ভাষাকে। তাই হৃদয় উড়ার করে লিখেছেন --

'মোদের গর্ব মোদের আশা 
আ-মরি বাংলা ভাষা 
তোমার কোলে তোমার বোলে
কতই শান্তি ভালবাসা। '

কবি ভুলতে পারেননি বাংলা গানের অপরূপ যাদু--- ভুলতে পারেননি এ ভাষার গান গাইতে গাইতে মাঝি দাঁড় টানে--চাষা মাঠে মাঠে কাটে ধান।বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বাংলা ভাষার বন্দনার শুরু হয়েছিল প্রবলভাবে-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার মাটি বাংলার জলের গুরুত্ব বিচার করতে গিয়ে বাংলা ভাষার মহান উৎকর্ষের কথাও বলেছিলেন। 

'বাঙলা ভাষা উচ্চারিত হলে' কবিতায় কবি শামসুর রাহমান তাঁর মাতৃভাষা বাংলার প্রতি একদিকে যেমন গভীর অনুরাগ প্রকাশ করেছেন,অন্যদিকে তেমনি তাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন গৌরবের আসনে। এ-এক পরমপ্রাপ্তি। এই কবিতায় উল্লিখিত 'একুশে ফেব্রুয়ারি 'র সঙ্গেএকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্হানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষাকে সরিয়ে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গের জনগণ সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয় নি। শুরু হয় এক মহান গণ প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ঢাকা শহরের পথে প্রতিবাদ- মিছিল বের হয়। পুলিশ সেই মিছিলের উপর গুলি চালালে প্রাণ হারায় অনেক ভাষা প্রেমিক মানুষ। অর্থাৎ বুকের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দিন হল একুশে ফেব্রুয়ারি। তাই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি দু'বাংলার মানুষের কাছে এত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক অনেক রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই ভাষা তাই কবির সমস্ত সত্তাকে আবেগে আপ্লুত করে। বাংলা ভাষা তাঁর কাছে হয়ে ওঠে নিকানো উঠোনে সকালের উজ্জ্বল রোদ, রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না।বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে তিনি দেখতে পান, অন্ধ বাউলএকতারা বাজিয়ে গান গাইছে বাংলার মাঠে, পথে কিংবা নদীর ধারে ধারে। কবি মনে করেন, এই ভাষার স্পর্শেই নদীও হয়ে ওঠে নর্তকীর মতো ছন্দোময়ী। সকাল বেলায় প্রথম শিক্ষার্থী যখন বাংলা অক্ষর লেখে, তখন কাননে ফুটে ওঠে কুসুমকলি, রাখালের বাঁশির মেঠো সুর ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়, পুকুরে ভাসে কলস। বাংলা ভাষা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে আজও ভেসে ওঠে নানা ধরনের পরিচিত বর্ণময় দৃশ্য। রমজানী -সন্ধ্যায় 'আজও 'বিষাদ সিন্ধু'র কাহিনী শোনা দু'বাংলার মানুষের কাছে এক আকাশ অহংকার। বাংলা ভাষা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি জনপ্রিয় ছবি দেখতে পাই আমরা। সেটি হল, 'একুশের প্রথম প্রভাতফেরী--অলৌকিক ভোর'।

 

অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক পেক্ষাপটঃ

ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডনের মূল্য দেশ হল স্বাধীন। গঠিত হল পাকিস্তান আর ভারত।অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার সঙ্গে ধীরে ধীরে গুরুত্ব বিস্তার করতে থাকে উর্দু। তৎকালীন পূর্বপাকিস্হানে উর্দু ভাষার সরকারি ক্ষেত্রে ক্রম প্রতিষ্ঠার রূপ দেখে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চিন্তার শুভ সূচনা সেইখানেই। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক বিষয়টিকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করেছিলেন। চক্রান্ত করে রাষ্ট্রভাষা পরিষদের দাবির বিপ্রতীপে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে বসলেন শাসকগণ। ১৯৫২-র২১শে ফেব্রুয়ারিতে সেই কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে আয়োজন করা হয়েছিল এক ছাত্র বিক্ষোভের। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ছাত্রদের শান্তি পূর্ণ বিক্ষোভের উপর পাকিস্তানি বাহিনী গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলা ভাষা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিকদের--রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম প্রভৃতি জানা ও নাম না জানা বহু ভাষা-শহীদকে।

 

পাঁচ

ভাষা আন্দোলন--পৃথিবীর অন্য দেশের চিত্র:

শুরু হয়ে যায় মাতৃভাষার অধিকার ও আত্ম মর্যাদা রক্ষার আপোসহীন লড়াই ও আত্মদানের হুড়োহুড়ি। ১৯৫২সালে ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের উঠোনে প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বানানো হল বিশাল মঞ্চ--ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য নেওয়া হল শপথ। শুধু বাংলা ভাষার জন্য বিশ্বে ভাষা আন্দোলন হয়েছে এমন নয়---- ১৮৩০ সালে বেলজিয়াম প্রতিষ্ঠার সময় সে দেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ফরাসিকে।কিন্তু ১৮৪০ সালের কাছাকাছি সময়ে ফ্লেমিশ ভাষাভাষীরা শুরু করে মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ১৮৯৮ সালে বেলজিয়ামে ফরাসি ও ফ্লেমিশ দুটি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তেমনি সুইজারল্যান্ডে প্রথমে জার্মানকে দেওয়া হয়েছিল জাতীয় ভাষার মর্যাদা, পরে আন্দোলনের তীব্রতায় বাধ্য হয়ে জার্মানের সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি ও ইতালিয়ানকেও জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে আসামের শিলচরে অসমিয়া ভাষার পক্ষে উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৪ সালে তামিল ভাষার আত্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বেশকিছু তামিল ভাষাপ্রেমি মানুষ গায়ে কেরোসিন ঢেলে সর্বসমক্ষে আত্মবিসর্জন করেন। পরের বছর আরো পাঁচ জন তামিলভাষী একইভাবে ভাষার দাবিতে আত্মহত্যা করেন। এই ধরনের আত্মঘাতী উন্মাদনাই বুঝিয়ে দেয় মাতৃভাষা কতখানি আদরের সামগ্রী। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, মানুষ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য কোন কিছুর সঙ্গেই আপস করেনি। কিন্তু সব আত্মত্যাগের ইতিহাসকে পিছনে ফেলে বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে--- "উনিশশো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি।" অর্থাৎ, ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার বাঙালির আত্ম বলিদান। মাতৃভাষার জন্য আত্মবলিদানের এই বিরল ঘটনা স্মরণ করে ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' রুপে ঘোষণা করে। 

 

ছয়

সুদূর প্রসারী তাৎপর্য ও আগামী প্রজন্মের মেধাবী পাঠঃ

ভাষার মর্যাদা রক্ষায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদানের কথা স্মরণ করার জন্য এই মহান দিনটিকে বিশেষ ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর।মাতৃভাষাতেই শিশুর প্রথম বোল ফোটে কিন্তু আধুনিক জীবন যাপনের অভ্যস্হ মানুষ সারা বছর যথাযথভাবে মাতৃভাষার চর্চা ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না। তাই এই অমর একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ দিনটি পালন করা হয় যাতে প্রতিটি বাঙালি ও বাংলা ভাষী মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষা ও সাহিত্যকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারে। এই দিনটি যথাযথ ভাবে পালন করার মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালি ও বাংলা ভাষার মানুষকে নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার একটি শুভ প্রচেষ্টা নিহিত আছে। প্রতিটি বাঙালির কাছে দিনটির গুরুত্ব আগেও ছিল। এখন তা আরও প্রসারিত হয়েছে। দুই বাংলার লক্ষ লক্ষ ছাত্র- ছাত্রীরা যথাযথ উদ্যোগ না নিলে দিনটির মাহাত্ম্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যাবে না বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। এক্ষেত্রে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা (কবিতা, গান, কুইজ, হাতের লেখা)-র আয়োজন করা যেতে পারে। সরকারি কাজে ও উচ্চশিক্ষায় আরও বেশি করে মাতৃভাষার ব্যবহারের দাবিতে সরকারের কাছে আবেদন জানানো কিংবা আন্দোলন জন্য ওই দিনটিকে ছাত্র- ছাত্রীরা বেছে নিতে পারে।এভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ না করলে 'ভাষা মাৎস্যন্যায়'--এর প্রভাবে অনেক ছোট ছোট ভাষা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেবে বলে মনে হয়।

 

একুশের ভাবনা: 

UNESCO ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' রূপে ঘোষণা করেছে যে মহান লক্ষ্য নিয়ে, তা সমস্ত দেশের মানুষের কাছে এই দিনটির তাৎপর্য পৌঁছে দেওয়া না পর্যন্ত সফল হবে না বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। শুধু একটি দিনই নয়,সারাবছরব্যাপী মাতৃভাষার ব্যবহার ও চর্চা যথাযথভাবে করতে হবে। মাতৃভাষার সাহিত্য, গান, কবিতার পাঠ আরও বাড়ানো দরকার। শুধু নিজের মাতৃভাষাই নয়, অন্যান্য ভাষার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। তবেই এই দিনটির পালন যথার্থ হবে। ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের কাছে গর্বের, আনন্দের,আত্ম-আবিষ্কারের দিন। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ইউনেস্কা চিহ্নিত করেছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। প্রতিটি বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি সারা পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের ভাষাপ্রেমি মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হিসেবে এটি আমাদের কাছে পরম গর্বের। ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর হয়ে গেল। এই উপলক্ষে আমাদেরও কিছু করণীয় আছে। ইতিমধ্যেই দুই বাংলার শিক্ষিত জনসমাজ ও কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকেরা গঠন করেছেন বাংলা ভাষা প্রসার সমিতি। এপার বাংলায়, 'আ মরি বাংলা ভাষা' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাষা প্রসার সংস্হা। তবে পরম দুঃখ ও বেদনার কথা বাংলাভাষা ও বাঙালির উন্নতির জন্য বিপুল সমারোহ সহকারে ভাষা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হয়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলা ভাষা নিজভূমেই আজ পরবাসী। স্বাধীনতার ৭২বছর পরও সরকারি কাজের প্রধান ভাষা ইংরেজি ভাষা। এমনকি পঞ্চয়েত, পুরসভা, সর্বত্রই যোগাযোগের ভাষা আজও ইংরেজি। বাংলা ভাষার প্রতি এ ধরণের সরকারি ঔদাসীন্য আর কতদিন চলবে কে জানে??

কিছু হতাশার কথা থাকলেও আশাবাদি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হওয়ার ফলে 'একুশের' চেহারাটা আমূল বদলে যায়। এপার বাংলায় ২১শে ফেব্রুয়ারি আর ভিন্নদেশী তকমায় চিহ্নিত থাকে না। তার আন্তর্জাতিক অভিযাত্রা ও মান্যতা সূচিত হওয়ার ফলে সরকারি আর বেসরকারি উদ্যেগে নানা ধরনের কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভাষা শহীদ স্মারক নির্মিত হয়। এপার বাংলার লেখকরা 'একুশ'কে নিয়ে প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, গান লিখতে থাকেন। বিশেষ এই ঐতিহাসিক দিনে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় বিশেষ 'একুশে' সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে আসছে। লেখা হয় সম্পাদকীয়। প্রকাশিত হয় 'একুশে 'বিষয়ে নানা সংকলন, গ্রন্থ।

বিজিতকুমার দত্ত তাঁর 'মাতৃভাষার পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ' শীর্ষক রচনায় বলেছেন: 'মাতৃভাষাকে এড়িয়ে বিশ্বায়ন সম্ভব নয়। দেশকে ভালবাসলে মাতৃভাষার চর্চা আমাদের করতে হবে। বাঁচার জন্য এই প্রতিজ্ঞা। আমাদের বড় লাভ মাতৃভাষার পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশ।' ২০০২ সালে বাংলাদেশের 'একুশের' সুবর্ণজয়ন্তী ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে ভাষা-আন্দোলনের শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয় 'অমর একুশে' বিশেষ সংকলন। এই স্মারক সংকলনের বিশেষ তাৎপর্য হলো বাংলাদেশের লেখকদের পাশাপাশি এপার বাংলার বিশিষ্টজনের রচনার সন্নিবেশ ঘটানো। এই সংকলনে বিশেষ রচনা পর্যায়ে প্রকাশিত হয় বিশিষ্ট লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'আমি কি ভুলতে পারি '। কলকাতার নবজাতক প্রকাশনী বের করে 'মহান একুশে' শিরোনামের 'সুবর্ণজয়ন্তী সংকলন'। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক চিত্ত মণ্ডল এবং প্রথমা রায় মণ্ডল। সংকলনটিতে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার ২১শে ফেব্রুয়ারি সংক্রান্ত রচনা বিন্যস্ত হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি-- বাংলাদেশে বাংলাভাষা ও রবীন্দ্রনাথ 'শীর্ষক প্রবন্ধে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রশিক্ষিত ও রবীন্দ্র-আন্দোলনের কথা ব্যক্ত করেছেন।

সমীর দাশগুপ্তের নাটক 'একুশের রোদ্দুর ' একুশে ফেব্রুয়ারি সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব পরিস্ফুট করেছে। 'মায়ের ভাষার গান' (প্রতুল মুখোপাধ্যায়) এবং 'একুশের গান' (কবীর সুমন-এর মধ্যে দিয়ে) বাংলার ভাষাপ্রীতি ও একুশে ফেব্রুয়ারির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য উদ্ভাসিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর অতিক্রান্ত হবে এ-বছর। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে দিনটির মহিমা ও গুরুত্ব অনেকখানিই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এপার বাংলা -- ওপার বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ মাস ফেব্রুয়ারি যা 'ভাষার মাস' হিসাবে পরিচিত। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস ঘিরে প্রতিবছরের মতো এ-বছরেও মাসের শুরু থেকেই নানান ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করছে দু বাংলার মানুষ। হৃদয়ের মানচিত্রে চিরকাল বেঁচে থাকবে অমর 'একুশে ' দিনটি। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে করোনার ক্ষত এখনও পর্যন্ত শুকিয়ে যায় নি। তাই একটা দুঃসময়ের মুখোমুখি দু'দেশের মানুষ।

তবে আয়োজনে খামতি নেই। সব প্রতিকূলতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মেতে উঠবে ভাষাপ্রেমি মানুষ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি, এই সব আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হবে সুমহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'। এই গান স্মরণ করিয়ে দেবে ভাষার মাসের আগমনী বার্তা।

 

শেষ কথা:

দ্বিজাতিতত্ত্ব স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল, শুরু হয়েছিল ভাষা বিক্ষোভ ১৯৪৭-র নভেম্বর-ডিসেম্বরেই। তারপর, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যার স্বীকৃতি পরবর্তীকালে পথ দেখালো সারা পৃথিবীকে, হয়ে রইলো এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা এবং সম্মান রক্ষা, স্বীকৃতি,সেই সাথে আত্মপ্রতিষ্ঠায় শুরু হলো আরেক যুদ্ধ, যা স্বাধীনতার যুদ্ধ অপেক্ষা কোনও অংশে কম ছিল না। আসলে, এ তো শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন নয়, মায়ের ভাষা, গানের ভাষা, আবেগের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শহীদদের প্রতিটি রক্তবিন্দু মাতৃদুগ্ধকে করিয়েছিল স্মরণ প্রতিটি বাঙালি ও বাংলা ভাষী মানুষের মনে ও প্রাণে। কৈশোর বয়সে একুশের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে নি, পরবর্তী সময়ে বুঝেছি, মাতৃভাষার অধিকার ও স্বীকৃতি,সেই সঙ্গে আত্মপ্রতিষ্ঠা কত মুল্যবান! গর্বিত বাংলাদেশবাসী এখনো স্বীকার করেন, গত শতাব্দীতে তাদের দুটি শ্রেষ্ঠ অর্জন--স্বাধীনতা এবং মাতৃভাষার স্বীকৃতি। আর দুটি ক্ষেত্রেই আন্দোলন হয়েছে রক্তাক্ত। এই কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও "শহীদ" হন আবুবকর, রফিকউদ্দীন, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামরা। বর্তমানে বিশ্বকে আনুমানিক ৩০ কোটির বেশি মানুষের ভাষা হল বাংলা। এই ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন--দুই দেশের দুই জাতীয় সংগীত, "জনগণমন অধিনায়ক জয় হে---আর" আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি--।" বর্তমান যুগে বিশেষ করে বাংলা ভাষার গুণগতমান ও উৎকর্ষতার প্রতি আমাদের অধিক দায়িত্বশীল হওয়ার সময় এসে গেছে বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে বারবারই মাতৃভাষা কি মাধুর্য হারাচ্ছে?

ভাষার ঐক্য, সম্প্রতি, ভাষার মৌলিক অধিকার শিক্ষা, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ এবং মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা--এই দিকগুলির প্রতি নজর দেওয়ার সময় এসেছে হয়ত।কারণ বিশ্বের ৭০০কোটি মানুষ আনুমানিক ৬০০০ ভাষায় কথা বলেন। ভাষাতত্ত্ব বিদদের ধারণা আগামী ১০০ বছরের মধ্যেই প্রায় ৩ হাজার ভাষার বিলুপ্তি ঘটবে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত The summer institute of Linguistics-র তথ্য অনুযায়ী ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাভাষার স্হান বিশ্বে চতুর্থ। অতি সরলীকরণের জন্য মাতৃভাষার মাধুর্য নষ্ট হচ্ছে না তো? এইসব ভাবনা জাগছে নানান রকম ঘটনা থেকেই। ভবিষ্যত প্রজন্মের মাতৃভাষার অবস্থা কি হবে?আন্তর্জাতিক প্রভাবের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আকর্ষণ থেকেও কি আমাদের আজন্ম লালিত মাতৃভাষা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে? প্রশ্নগুলো কিন্তু ইতিমধ্যেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তবু প্রতি বছর আমাদের চেতনায় ও মননে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বারবার ফিরে আসে। আর কয়েক দিন বাদে দু'দেশের সমগ্র বাঙালি জাতি মেতে উঠবে ও বিনম্র চিত্তে অফুরান শ্রদ্ধায় ভাষা সৈনিকদের স্মরণ করবে। এ-এক পরমপ্রাপ্তি।আমাদের সবার ভাবনাও হোক--অভয়বানী হোক-

"ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ 
দুপুর বেলার অশ্রু অক্ত 
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই রোহিতের লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ায় ডাল যে!
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা 
বিষাদগীতি গাইছে পথে 
তিতুমীরের কন্যা। 
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী 
আমায় নেবে সঙ্গে, 
বাংলা আমার বচন, 
আমি জন্মেছি এইবঙ্গে।" (একুশের কবিতা, কবি আল মাহমুদ)

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক প্রাবন্ধিক, অনুগল্প, রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top