সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

অপরাধীর অপরাধ ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তি : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৫ মার্চ ২০২১ ১৯:১৬

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:০১

 

রামু, সাথিয়া, নাসিরনগর নামগুলো শুনলেই মনের মাঝে আতঙ্ক ঘিরে ধরে। কোন একটি সম্প্রদায়ের উপর কত সহজে হামলা করা যেতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এবার এগুলোর কাতারে সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁওয়ের নামটিও চলে এসেছে! ঘটনা (অপরাধ নয়) যে ঘটায় তাকে নিয়ে যতটা না দ্বিধা বিভক্ত তার চেয়েও অতি উৎসাহের জায়গা একটি সম্প্রদায়কে নিয়ে। তারপর নির্দিষ্ট ওই সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা হয়। ন্যক্কারজনক হামলা তৈরি করার ক্ষেত্রে যেন এক গুচ্ছ দল এক জায়গাতেই নিজেদের গেঁথে রাখে। ঘটনা যাই হোক পরিসমাপ্তি এক ট্র্যাজেডীর নামান্তর। কারণ, বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই যাকে অপরাধী হিসেবে ধরে নেয়া হয় তার অপরাধের সংশ্লিষ্টতা মেলে না। অথচ, তাকে অপরাধী হিসেবে তকমা দিয়ে তার সম্প্রদায়কেও ন্যক্কারজনক ঘটনায় শিকার হতে হচ্ছে। এত সহজ, এত সুন্দর উপায় অবলম্বন করে একটা জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়তে পারে!

কেউ যদি অপরাধ করেই থাকে তার দায় কেন তার সম্প্রদায়ের উপর বর্তাবে? সম্প্রদায়ের উপর দায় মানেই তো সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অপচেষ্টা করা। অপরাধীর বদলে অন্য কাউকে আঘাত করলে কি অপরাধীর কৃত অপরাধ শেষ হয়ে যায়? নাকি অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা মানে নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা প্রকাশ! সেক্ষেত্রে মনে হয় আমরা এখনো অপরিণতই রয়ে গেছি। তবে প্রতিটি ঘটনার পেছনে লক্ষ্য করলেই আঁচ করা যায়, সেখানে যতটা না সাম্প্রদায়িক আবেশ তারও চেয়ে অধিক ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিরাজমান। সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও ঘটনার ক্ষেত্রেও তেমনটি বের হয়ে আসছে।

নোয়াগাঁওয়ে হামলার দিনটি ছিল জাতির পিতার জন্মদিন। অথচ সে দিনটিতেই হামলাকারীরা অতি সু উৎসাহে হামলা চালায়। শত আর্তনাদেও জেগে উঠেনি হামলাকারীদের নিদ্রিত বিবেক। আত্মগোপনে হাওড়ের মাঝে রাত যাপন করে আতঙ্কের থাবা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা। বেঁচে যায় তাদের জীবন কিন্তু দেখতে পায় বিপন্ন জীবনের খণ্ড চিত্র। নিজের বাড়ি-ঘরের অস্তিত্বের জন্যও যারা লড়তে জানে না তাদের চেয়ে অসহায় আর কে হতে পারে? হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা নির্লিপ্ত থেকে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যারা আকাশপানে চেয়ে বিচার প্রত্যাশা করে তাদের ক্রন্দন হয়তো ঈশ্বরও শুনতে পায় না। তাই বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাদের উপর হামলা করা অবচেতন মনের বহি:প্রকাশ বলা চলে না। কারণ, হামলাকারীরা তো একগুচ্ছ দলের সমর্থন নিয়েই হামলা চালায়!

নোয়াগাঁওয়ে হামলা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলাকারীর কোন একজনকে সগর্বে বলতে শুনি, “তাদের (হামলার শিকার) ভেতর কম্পন ধরিয়ে দিয়েছি”! আসলেই তো ঠিক। এ যেন ভয়ার্ত হৃদয়ের সামনে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রকে দেখতে পাওয়ার মতো! কে থামাবে নোয়াগাঁওয়ে হামলার শিকার সহজ-সরল মানুষদের আর্তচিৎকার। স্বাধীনতার কয়েক দশক পরও এমন সকল ঘটনা আমাদের সমাজকে বয়ে যেতে হচ্ছে। এ সকল ঘটনার শেষ কোথায়? কখন রেহাই পাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উপর হামলা করার মতো ঘৃণ্য মনোভাব থেকে।

দিন দিন সমাজের কোন এক ধরণের মানুষের মাঝে ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। তাই হয়তো সমাজের মাঝে দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে, দুর্বলের প্রতি আঘাতকে অতি সহজেই মেনে নিতে হয়। তাই সুযোগ ও সময়ের সমন্বিত মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে নির্যাতন সহজ হয়ে আসে। অথচ আমাদের সমাজের সুন্দর মনের মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখেছি। সেখানে ছিল না কোন সম্প্রদায় বিভক্তি কিংবা হানাহনি। তাহলে কি আমরা দিন দিন সাম্প্রদায়িকতার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি, নাকি নিজেরাই এ বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছি। তাই আগের সমাজটাকেই প্রতি মুহূর্তে অন্তর দিয়ে অনুভব করি। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন তাঁর ‘পরিচিতি ও হিংসা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “এ হল সত্ত্বার সঙ্কট এবং সত্ত্বার পারস্পারিক সংঘাত। অন্যের সত্ত্বাকে তার পরিসরটুকু দিতে না চাওয়া, সেটাই হল মুল সমস্যা।”

কি জানি, সংখ্যালঘু শব্দটির মাঝেই কেমন যেন বিষমাখা শব্দের বিস্মৃতি বার বার বয়ে নিয়ে আসে। তা না হলে এ শব্দটি দ্বারা বার বার আঘাত করা হয় কেন? অথচ এদেশে তো অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরও বসবাস রয়েছে যারা সংখ্যায় কম। কে জানতো, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও এই ভ্রান্ত চেতনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। বাস্তবতার ক্ষুদ্র অংশও যদি দিকভ্রষ্ট হয় তাহলে ন্যূনতম অংশটুকুও বাস্তবতার বৃত্তাবরণে থাকে না। ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বাকে যদি মানব মস্তিষ্ক দিয়ে সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করতে না পারি তাহলে ক্ষুদ্র সত্ত্বা কর্তৃক বৃহত্তর অংশে অবদান রাখার সম্ভাবনা পিছিয়ে পড়ে। যদি সমাজের বৃহত্তর অংশের একটি জাতিকে কিংবা জাতি সত্ত্বার একটি অংশকে নিষ্প্রয়োজন মনে করে প্রগতিশীলতার নামান্তরে গা ভাসিয়ে চলি তাহলে ক্ষুদ্র জ্ঞান সত্ত্বার আলোকে শুধু একটি জাতিকেই অপমান করা চলে না বরং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও আঘাত করা হয়। রামু, নাসিরনগর কিংবা নোয়াগাঁওয়ের ঘটনা সেটাই জানান দেয়।

নোয়াগাঁওয়ে হামলার শিকার মানুষগুলোকে মানসিক যাতনা থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব নয়। মনের বিষাদ ছড়িয়ে পড়লে তাতে গড়ার মুল্য অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। তাই দু:খটাই তাদের বার বার তাড়া করে বেড়াবে।

 

অনজন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top