সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

হিটলারি কর্তৃত্ব জল ও উদ্ভিদের সাথেও,

ভবিষ্যতে গুণতে হবে চুড়ান্ত মাশুল! : তন্ময় সিংহ রায় 


প্রকাশিত:
১০ মে ২০২১ ২৩:২৭

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৯

 

অসচেতনতা, অবহেলা নামক এই মানবিক দোষগুলো আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মিলিয়ন-বিলিয়ন মানুষকে যে কতবার, কিভাবে ও কোন কোন ক্ষেত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিঃস্ব-রিক্ত এবং সর্বশান্ত করে ছেড়েছে, সর্বোপরি মূল্যস্বরূপ দিতে হয়েছে জীবন পর্যন্ত, তার উল্লেখযোগ্য আর এক উদাহরণ যেন নতুন করে সৃষ্টি হল বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের এই মহাসংক্রমণকালে!

পাকস্থলী যন্ত্রণায় চিৎকার করলে, তখন যেমন অনুভবে ধরা দেয়, এবারে সে চায় ওষুধ, ঠিক তেমনই বিপদ হয়ে গেলে, তবেই ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী দ্বিপদীদের বিবেক বা চেতনা!  

এ এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য! ছেলেবেলায় শেখা সেই শব্দগুচ্ছের মূল্যবান সমষ্টি 'জলের অপর নাম জীবন!'

আর মানুষের আজীবনের পরম মিত্র গাছ! পৃথিবীর প্রায় জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত জীবিত ও মৃত মিলিয়ে আনুমানিক ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, ক্ষমতা প্রভৃতির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে, এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক  বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে মানুষ নামক এই প্রজাতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে ক্রমাগত এঁরা জয় করে চলেছে অনন্ত মহাশূন্য। 

অথচ সেই মানুষই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ও প্রতিনিয়ত করে চলেছে এ বিশ্বের, অর্থাৎ মানুষ দ্বারা সৃষ্ট নানান কৃতকর্মের ফলেই, বুকে জমানো দীর্ঘদিনের তীব্র দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও অপমানের ফলস্বরূপ, এ পৃথিবীটা আজ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার একমাত্র পথ! দিনের পর দিন চুড়ান্ত নির্দয় হয়ে, প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় অমূল্য সম্পদের সাথে নির্দ্বিধায় আমরা নানাভাবে করে চলেছি যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার!

দিচ্ছি স্বার্থসিদ্ধির আন্তরিক উদ্দ্যেশ্যে বা অহেতুক মৃত্যুদণ্ড, যার মধ্যে পানীয় জল ও গাছ অন্যতম প্রধান উদাহরণের দাবি রাখে যথেষ্ট। আধিপত্য ফলানোটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন আমাদের জন্মগত অধিকার, এ গ্রহের সমস্ত বস্তুর উপরেই চাই আমাদের আধিপত্য! পেতে পেতে আমাদের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পৌঁছে গিয়েছে এমন পর্যায়ে যে , কিছু না পাওয়াটা যেন আজ গরু ডিম দেওয়ার মতন অনুভূত হয়!

এ অহংবোধ ধারণ করেছে এক সর্বনাশা জটিল মানসিক রোগ! দীর্ঘকাল ধরেই মনের রাজপ্রাসাদে তাকে আবার যত্নে লালন-পালন করেও আসছে সেই মানুষ! আর এ অহংকারই ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে আমাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে জমকালো অন্ধকার ব্ল্যাকহোলে, যেখানে লক্ষ-কোটি অণু-পরমাণুতে পরিনত হবে আমাদের সেই মিথ্যে অহংকার!

ফিরে আসি সেই ছেলেবেলার পড়া-লেখায়। এ পৃথিবীর ৭১ ভাগ জল, বাকি ২৯ শতাংশ  পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে স্থল। এখন ২৯ ভাগ জলকে যদি হিসেবের সুবিধার্থে ধরে নেওয়া যায় ১০০, তো সেই মোট ১০০ ভাগের ৯৭ ভাগই আবার সমুদ্রের লবণাক্ত জল, এবং বাকি ৩ ভাগের ২ ভাগ হিমবাহের বরফ হিসেবে আছে জমে কঠিন বস্তু হয়ে, আর অবশিষ্ট পড়ে থাকা মাত্র ১ ভাগ হল পানযোগ্য বিভিন্ন নদী, হ্রদ ও ভূ-গর্ভস্থ জল। 

এ পর্যন্ত এসেই না হয় একটা প্রাথমিক ধারণা করা যাক যে, এই মাত্রাতিরিক্ত সীমিত পানীয় জলকে কেন্দ্র করে ঠিক কি ভয়াবহ পরিস্থিতির বুকে দাঁড়িয়ে, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে তাঁদের অস্তিত্বকে বজায় রেখে চলেছে এ নীল গ্রহের বাসিন্দারা!

আর জীর্ণ-শীর্ণ এই ১ ভাগ দেহের উপরে যদি আবার চেপে বসে উদাসীনতা, অবহেলা ও অসচেতনতার মতন স্থুলকায় সব বস্তু, তো এবারে ভাবা যাক আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণামের সেই মর্মান্তিক চিত্রটা!

একদিকে পৃথিবী থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে আসার ঈশারা অবিরত দিয়ে চলেছে মিষ্টি জলের উৎস, অপরদিকে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান, ফলতঃ বেড়ে চলেছে সেই জলেরই চাহিদা!  

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সাধারণ মানুষ থেকে সরকার, কারোরই ঘুম এ ব্যাপারে বিশেষ ভাঙেনি এখনও বলাটাই এখানে যুক্তিসংগত! সচেতনতাকে কোমা থেকে বের করে এনে, পানীয় জলের এ হেন ইচ্ছেস্বাধীন ব্যবহারে দাঁড়ি টানা যথাশীঘ্র সম্ভব যদি না হয় তো, আনুমানিক আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বোধকরি অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে ভোগ করতে হবে এর চুড়ান্ত ফল, অর্থাৎ তীব্র জল সংকটে এ উন্নত ও সাধের সভ্যতার অস্তিত্বকে পড়তে হবে ভয়ানক চ্যালেঞ্জ-এর করাল গ্রাসে!

আর সে সময়ে যখন থাকবে না দাঁতই, যত্ন-আত্তিরের তো ওঠেই না কোনো প্রশ্ন।

বলাবাহুল্য স্ফুলিঙ্গের দাবানলে রূপান্তরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে বিশ্ববাসী পাওয়া শুরু করে দিয়েছে আফ্রিকাসহ চেন্নাই, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাট, কেরালা ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে। 

অস্বাভাবিক জলসংকটে সেখানে নাজেহাল অবস্থা বিপুল সংখ্যক মানুষের! ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্বের অন্যতম জনবসতিপূর্ণ এক শহর, ভূগর্ভস্থ জলস্তর সেখানে কমে গিয়েছে এতটাই যে, সেখানকার বাসিন্দারা মাসে জল পায় মোট ২০ দিন!

মিশরের শহর কায়রো'তে জল সংকট তীব্র! নীল নদ থেকে জল সরবরাহ হচ্ছে তো ঠিকই, কিন্তু সঠিক ব্যবস্থার অভাব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির জেরে জল সেখানে হয়ে পড়েছে একেবারে দূষিত!

রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে ২০২৫ নাগাদ সমগ্র মিশরে জল সংকটের অত্যন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। জাপানের রাজধানী ও বাণিজ্যিক শহর টোকিয়োতেও সেই চেনা দৃশ্য, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় বরফগলা জলের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে সেখানকার বাসিন্দারা, এর ফলে সেই শহরে বছরে জল থাকে মাত্র ৪ মাস! এছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা, তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুল ইত্যাদি আজ দাঁড়িয়ে আছে জীবন্ত ও করুণ দৃষ্টান্ত হয়ে!

ভারতীয় সংসদে ভবিষ্যতের জল সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কয়েকদফা, দেশের জলসংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদরা!  এ নিয়ে নাকি রীতিমতন চিন্তিতও, ভারত সরকার এবং বিরোধী দলগুলি, কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের এক চতুর্থাংশও যদি সম্পূর্ণ দেশ জুড়ে বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্নভাবে এবং ক্রমাগত তা প্রচার করে ঘুমন্ত বিবেকগুলোকে যথাশীঘ্র সম্ভব জাগানো না হয়, গ্রহণ করা না হয় উপযুক্ত গুচ্ছখানেক পদক্ষেপ, তো আর হবে কবে, দাঁতের জীবনাবসান হলে? না করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতন বিপদ এসে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লে, তারপরে?

স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যাচ্ছে, সমগ্র বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ স্বচ্ছ জলের স্তর ক্রমশই কমছে আশঙ্কাজনকভাবে! 

মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা-এর মতন এর সাথে আবার যোগ হয়েছে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও জার্মানির অ্যারো স্পেস সেন্টারের এক যৌথ প্রকল্পে কিন্তু উঠে এসেছে এই তথ্যই। 

জানা গেছে, যে সব দেশে জলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ স্বচ্ছ জলের ভাণ্ডার অত্যন্ত বিপদের মুখে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম, অর্থাৎ স্বচ্ছ জলের লভ্যতা ক্রমশই কমে যাচ্ছে এ দেশে উদ্বেগজনকভাবে!

নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে, জলের যথেচ্ছ ব্যবহার , জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে আর্দ্র এলাকা হয়ে উঠছে আরও বেশি আর্দ্র এবং খরাপ্রবণ এলাকা হয়ে উঠছে আরও বেশি শুষ্ক!

আর অসম বন্টন, জলদূষণ এবং জলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পারদ তো উপরে উঠছে আজ ক্রমাগতই।  

এদিকে পানীয় জলের অভাবের এই সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে রাষ্ট্রসংঘও, তাই United Nations Department of Economic and Social Affairs (UNDESA), 2005 থেকে 2015 সাল পর্যন্ত 'International Decades for Action' "WATER FOR LIFE " ঘোষণা করেছিল, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টা যেন কেমন হঠাৎই থমকে মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল বলে মনে হয়!

মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সুতরাং এ পৃথিবীর বাকিরা তাঁদের সম্মান করবে, এটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু বাকিদের যে একটা Minimum সম্মান থাকলেও থাকতে পারে, এটা আমরা যেন রাখতেই চাইনা গুরুমস্তিষ্কে! একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ প্রকৃতির বায়ু থেকে প্রতিদিন অক্সিজেন ব্যবহার করে প্রায় ৫৫০ লিটার বা ৫৫০ কেজি, এখন যদি আনুমানিক ধরা হয় ৫৫০ কেজি = ৩ টে অক্সিজেন সিলিন্ডার, তো এক একটি সিলিন্ডারের ন্যায্য, বাজার মূল্য ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। অর্থাৎ সেই মানুষটা ৭০০ × ৩ = ২, ১০০ টাকার প্রতিদিন এবং ৩৬৫ × ২, ১০০ = ৭ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকার অক্সিজেন প্রতি বছরে বায়ু থেকে বিনামূল্যে গ্রহণ করে।

এখন মানুষের গড় আয়ু যদি ধরা হয় ৬৫ বছর, তো সেখানে গিয়ে মোট অঙ্কটা দাঁড়ায়, ৭, ৬৬, ৫০০ × ৬৫ = প্রায় ৫ কোটি টাকার মতন, আর ফুল, ফল, আসবাবপত্র, জ্বালানি, জীবনদায়ী সব আয়ুর্বেদিক ওষুধ, পুষ্টিগুণ ও পরিবেশকে ঠান্ডা রাখা তো নয় দিলাম বাদই। 

সুযোগের সৎব্যবহারী ও অর্থলিপ্সু Hoarder এবং Black Marketer নামধারী কিছু মানুষ, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে কোনো পরোয়া না করে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা মূল্যের এক একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, করোনার মুমূর্ষুপ্রায় রোগীদের জন্যে নির্দ্বিধায় বিক্রি করছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়!

 

তন্ময় সিংহ রায়
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top