সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অস্থিচর্মসার গণতন্ত্র! : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
৯ জুন ২০২১ ১৮:১০

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২৩:০৩

 

সেই কবের অনুভব, প্রকৃতিতেই শেখা, রাজনীতি ও ধর্ম পৃথিবীর অক্ষরেখা! একটি রাষ্ট্র যে যে মৌলিক শর্তের উপরে ভিত্তি করে প্রশাসিত হবে সেই সমস্ত শর্তের সংকলনকে বলা হয় সংবিধান। দেশের সাধারণ জনগণের হয়ে যাঁরা সংবিধান রচনা করেন, সম্মিলিতভাবে তাঁদের বলা হয় গণপরিষদ। অবশেষে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৫০ সালে ২৬ শে জানুয়ারি, অর্থাৎ সুষ্ঠ, স্বাভাবিক, আদর্শমিশ্রিত ও ন্যায়নিষ্ঠ গণতন্ত্রের শুভ জন্মদিন ও পথচলা শুরু! ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, 'আমরা ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ,  গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সহিত শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিকের জন্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সুযোগসুবিধা সমতা সৃষ্টি এবং তাঁদের সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব গড়ে তুলে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের গণপরিষদে আজ ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি!' 

চরম অনাহার ও অপুষ্টিতে, সংবিধানের জরায়ুতে গণতন্ত্র আজ অস্থিচর্মসার! রক্ষক আজও ভক্ষকের ভূমিকায় শান্ত করছে তাঁর পাকস্থলী। সমাজসংষ্কারকের পাহাড়প্রমাণ ঢেউ, তবু অরাজকতা, খুন, ধর্ষণ, চুরি, জালিয়াতি ও দুর্নীতির আধিপত্য লঙ্ঘন করেছে এদের সীমা! বঙ্গমায়ের প্রকৃত বীর সন্তান আজ আর জন্মায়না! লোভ-লালসা, হিংসা ও ঈর্ষার সূচক ক্রমশই উর্ধ্বমুখী! 

টাকা পেলেই সৃষ্টি হয় মিছিল বা জনসভায় ক্রীত, সাধারণ মানুষের দুর্ভেদ্য জঙ্গল! টাকা বা ভয় পেলেই ভোটটা নিজের পায়ে হেঁটে চলে যায় অন্য গুহায়! টাকা পেলেই পার্টি কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ, বিরোধী পক্ষের সাথে মারামারি, খুনোখুনি করে সৃষ্টি হয় তুমুল অরাজকতা! অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় এ শান্ত সমাজে!

টাকা মিললে অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে কেনা বা দখল করা হয় বৈচিত্র্যময় দেওয়াল!  মুখে দেশভক্তির উৎকৃষ্ট সব বাণী আটকে ঝুলিয়ে রেখে, চলে অন্য প্রক্রিয়া, আর এগুলো বংশপরম্পরায় চলে আসছে ও বোধহয় আসবেও, এগুলোই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ বাঁধাধরা নিয়ম!

আর এটা কম-বেশি প্রায় সব দলেরই সু-বৃহৎ ও শক্তিশালী এক সিস্টেম, যে সিস্টেমের ঠিক পিছনেই আবার সাজানো স্বপ্ন নিয়ে লুকিয়ে বসে আছে দৈত্যাকার পুঁজিবাদীদের সেই দুটো চির আকাঙ্ক্ষিত ও জ্বলজ্বলে দু'চোখ।

যুগের পর যুগ ধরে নিদারুণ জ্বালা-যন্ত্রণার হলদে-লাল আগুনে পুড়ে ঝলসে যাবে শুধু সাধারণ মানুষগুলোর কম দামী দেহগুলোই! নেতা-মন্ত্রী না হয় রাখলাম ব্রাকেটেই, টাকা থাকলে প্রায় সবাই যেন আজ হতে চায় প্লেটো, তৈমুরলং বা নভোচারী! যেখানে অর্থহীন প্রকৃত শিক্ষিতগুলো আজ পর্যবসিত মূক-বধির ও দৃষ্টিহীন নিরক্ষরে!

আর দাসত্ব প্রথা তো সেই খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালের মধ্যে মেসোপটেমিয়া গর্ভে জন্ম থেকে চলে আসছে আজও, সেখানে নেতা-মন্ত্রীরা বর্তমানে অবিক্রীত থাকাটাই চুড়ান্ত বোকামি, অর্থাৎ বর্তমানে আদর্শ বেশি, তসলিমা নাসরিন, নচিকেতা বা আমার মতন নিতান্তই বোকাদের! আদর্শ থাকলেই যে অর্থবান হবে এমন ভাবাটা যুক্তিসংগত নয়, তবে টাকা থাকলে আদর্শ কেনা যায় ঠিকই, কারণ আদর্শ বেপারীরা সমাজের প্রায় চারিদিকেই ATM- পরিসেবার মতন ২৪ ঘন্টা খুলে রেখে দিয়েছে তাঁদের অদৃশ্য সব দোকান বা কাউন্টার, শুধু দৃষ্টিশক্তির দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেখে নিতে হবে, এই আরকি।

নয়াদিল্লির সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ (সিএমএস)-এর তরফে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে খরচের সম্ভাব্য পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবৎকাল পর্যন্ত যে কোনও রাষ্ট্রে হওয়া নির্বাচনের সব খরচকে দু'কূল ছাপিয়ে পৌঁছে গিয়েছে একেবারে শিখরে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলে যেখানে কথা, সাধারণ মানুষের টাকায় সেখানে একটু বেশি বেশি না দেখালে, কেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেদেরকে। করোনার নৃশংস আক্রমণে এদিকে প্রাণবায়ুর নিদারুণ অভাবে চতুর্দিকে জ্বলছে সেই ভোটারদেরই সারি সারি চিতা! নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে কোভিশিল্ড বা কো-ভ্যাকসিন! চাকরি নেই, শিল্প নেই, উন্নতি নেই, সমাজের আকাশ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শুধু 'নেই' আর 'নেই!' কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট খরচের জন্যে সরকারের টাকা প্রজন্মের পর প্রজন্ম থাকে ঠিকই।

১৯৫১-৫২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কম-বেশি চলে আসছে তো এভাবেই। পরিবর্তন শুধু সরকার কেন, কিছু সিস্টেমেও তো কখনও কখনও হয়ে পড়ে অত্যন্ত প্রয়োজন?  তাই আদৌ আসবেনা কোনোদিনও সে দিন জেনেও, আগামীর জন্যে মাত্র দুটো আর্জি রইলো যে কোনো সরকারের প্রতি আমার।

(১) প্রতি অর্থবছরে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রের আয়-ব্যয়ের নিঁখুত হিসেব, ক্ষমতায় থাকা সরকার না হয় এবারে দিক রাষ্ট্রের সমস্ত সাধারণ জনগণকে। গঠন করা হোক এক বিশেষ কমিটি ও তদন্ত কমিটি, সেখানেও যেন দুর্নীতি না হয় তার জন্যে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নেতৃত্বে গঠন করা হোক এক বিশেষ তদন্তকারী দল বা সংস্থা। 

(২) ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০৫ নম্বর বিলটাও সংসদে পাশ হোক এবারে না হয় একটু অন্যরকমভাবেই। কিভাবে? গ্রুপ D থেকে I A S বা I P S, সমাজের প্রায় সর্বস্তরের কাজের ক্ষেত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ জনগণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে নির্বাচিত হয়ে তবেই কমবেশি উপার্জন করে অর্থ।

১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও জটিলতম ভারতীয় সংবিধানের প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২০ সাল অবধি ৩৬৮ নং ধারা প্রয়োগ করে তা সংশোধিত হয় মোট ১০৪ বার। ভারতের সংবিধানের ১০৫ নম্বর সংশোধিত বিলটা এবারে সংসদে উত্থাপিত ও পাশ হোক না হয় একটু অন্যরকমভাবে? যে কোনো দলের প্রার্থী নির্বাচিত হতে গেলেও নেতা-মন্ত্রীকে আবশ্যকভাবে না হয় দিতে হোক যোগ্যতার পরিচয়।

চালু হোক প্রিলিমিনারি, মেইন ও ইন্টারভিউ।

বিষয়: ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সংবিধান, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন ইত্যাদি।  

কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট মানুষ এ দেশের ১৩০ থেকে ১৩২ কোটি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সমস্ত রাজ্য, সর্বোপরি দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করবে মানে তো আর সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়?

সরকার কিন্তু আজও জনগণেরই, জনগণের দ্বারাই, লিঙ্কনের Government of the people, by the people, for the people আজও জীবিত তো বটে, কিন্তু ভারতে সে আক্রান্ত নিউমোনিয়ায়!

সর্বশেষ মনে পড়ে গেল আমার কোটেশনের সেই দুই লাইনঃ 

“এ দেশেও নিষিদ্ধ ড্রাগ, ডিসকাউন্টে গাঞ্জা, 
রাজনীতি আর দুর্নীতি, এরা তো হীর ও রাঞ্ঝা!”

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top