সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

মাসে একদিন হলেও শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসুক : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
৯ জুন ২০২১ ১৮:২১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:০৩

 

করোনার কারনে যখন লক ডাউন ছিল তখন মানুষ ভয় পেয়েছিল। ঘরে থেকেছিল।  লক ডাউনের সাথে যখন কঠোর শব্দ যোগ হল তখন কর্পূরের মতো উবে গেল সব ভয়। এখন আর মানুষ ভয় পায় না।  ঘরেও থাকে না।
২০২০ সাল শুরু হয়েছিল অনেক স্বপ্ন আর বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে। মুজিব শতবর্ষ  উপলক্ষে ছিল নানা কর্মসূচী। বছরের শুরু থেকেই ছিল উৎসব উৎসব  পরিবেশ। কে জানত সব পরিকল্পনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে সহসাই। ক্লাসে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা আমার রচিত একটি শ্লোগান শেখে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দলবেঁধে সে শ্লোগান  বলতে বলতে বাড়ি যায় ছুটির সময়।
শ্লোগানটি হলো-
"আমার স্কুল, আমার দেশ
পরিষ্কার রাখবো পরিবেশ।"
মুজিববর্ষ উপলক্ষে নতুন শ্লোগান যোগ করেছিল।
"মুজিববর্ষের অঙ্গীকার
দেশটা রাখবো পরিষ্কার।"
শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি করেছিলাম নানা সামাজিক কাজের কর্মসূচী। তার মধ্যে একটি ছিল বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে আরো শক্ত করে তার ওপর রঙ্গিন কাগজ লাগিয়ে ডাস্টবিন তৈরি করা। সেখানে নানা সচেতনামূলক বাণী লিখে স্কুলের সামনে এবং আশেপাশে যেসব দোকান আছে সেখানে দিয়ে আসা। যাতে চিপস,চকলেট, আইসক্রীম বা অন্যান্য কিছু খেয়ে প্যাকেটগুলো রাস্তায় না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলে।
১৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্মরণে সকলে যার যার পছন্দ আর সাধ্যমতো  একটি ভালো কাজ করবে। যা তারা নিজ নিজ জন্মদিনেও করে থাকে। না, কিছুই করা হযনি। সেই যে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা থেকে চলে গেল শিশুরা আর কোলাহলে মুখর হলো না বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম।
লেখাপড়া আর পরীক্ষার নামে শিশুদের যে শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছিলাম, এপ্লাসের দৌড়ে যে অনৈতিক প্রতিযোগিতায় শুধু শিশুদের নামিয়েই দেইনি, শিক্ষক -অভিভাবক সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তারই প্রতিশোধ নিয়েছে এবার প্রকৃতি।এখন শূন্য বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, শ্রেণিকক্ষ আমাদের উপহাস করছে।
অন লাইন ক্লাসের জন্য  শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হলো  মোবাইল। সারাদিন ঘরবন্দী শিশুদের বিনোদনের জন্যও দেয়া হলো মোবাইল।  ফলশ্রুতিতে তারা আসক্ত হলো পাবজী আর ফ্রি ফায়ারের মত গেইমে। যা খেলতে টাকা লাগে।

অভিভাবকের চেয়ে মোবাইলের প্রযুক্তি ব্যবহারে শিশুরা এগিয়ে। ফলে ক্লাস করে, না অন্য কিছু করে তা বুঝা অনেক অভিভাবকের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।করোনা এমন কোন দুর্যোগ নয় যা কিছুদিন পরেই চলে যাবে বা কবে যাবে তা বলা সম্ভব।করোনাকে সাথে নিয়েই চলতে হবে এ পৃথিবীর। এটা একটা প্রকৃতিক প্রতিশোধ। এই শাস্তি মানুষের প্রাপ্য। সুতরাং ঘরবন্দী নয়। করোনাকে সাথে নিয়ে কীভাবে চলা যায় সে পথ খুঁজতে হবে।
শুরুতে মানুষ ভয় পেয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ যখন আরো মানবিক হয়েছিল আমাদের দেশের কতিপয় মানুষের মুখোশ তখন উন্মোচন হয়েছিল নগ্নভাবে। আমরা মানবিক পুলিশ,  মানবিক ডাক্তার,  মানবিক নার্স এবং মানবিক সাধারণ মানুষ যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি মা বাবাকে ফেলে যাওয়া অপদার্থ সন্তান। স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেওয়া হিংস্র শ্বশুর বাড়ি। ভাড়াটিয়াকে বের করে দেওয়া অমানবিক বাড়িওয়ালা।
ধীরে ধীরে মানুষের ভয় কেটে গেছে।  গার্মেন্স খোলার পর মানুষের ঢল দেখে আতংকিত হয়েছিল দেশবাসী।  সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমতে তেমন কিছু হয়নি। করোনাকে সাথে নিয়ে আমরা কীভাবে চলতে পারি তার পরিকল্পনা করার জন্য যথেষ্ট সময় আমরা পেয়েছি কিন্তু আজীবনের মত আমাদের সব পরিকল্পনায়ই সেই তুঘলকি কান্ড। আজ একটি তো কাল অন্যটি। চোর সামলাতে সামলাতেই এক বছরের বেশি সময় চলে গেল।
স্কুল বন্ধ করে দিলেও  শুরুতে কওমি মাদ্রাসা আবাসিক এই অযুহাতে খোলা রাখা হলো। চুপে চুপে কিছু কিন্ডারগার্টেনও চললো। কোচিংসেন্টারও চুপে চুপে চললো। শুধু বন্ধ থাকলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কাজ না থাকায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের গ্রামে নানী, দাদীর কাছে পাঠিয়ে দিল। শিক্ষকবৃন্দ ফোনে ফোনে যতটুকু পারে যোগাযোগ রাখলো। পড়া দিল।
অনেকে না জানিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হলো অথচ উপবৃত্তির টাকা আর বিস্কুট নিল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।
স্থান ভেদে সমস্যা আর সমাধান আলাদা। রাজধানী এবং জেলা শহরগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ে।
এরা পড়ালেখার পাশাপাশি নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কাজও করে থাকে পরিবারের অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য।
যখন মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন  এলাকার  ভিতরে গোপনে গোপনে চলতে থাকে তখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সমাজে  যায়।
গত সেপ্টেম্বর মাসে আমি নিজ প্রচেষ্টায় আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের একমাসের পড়া কাগজে লিখে ফটোকপি করে দেই। ঐ লেখা লিখে জমা দেবার সময় তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী শেষ পৃষ্ঠায় একটি মেয়ের ছবি এঁকে পাশে লিখে দেয় _-- "করোনা মানি না, মানবো না। স্কুল খুলতে হবে।"
মাঝে মাঝে নানা কাজে যখন স্কুলে যাই তখন দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায় রাস্তায় খেলতে থাকা শিশুরা। কেউ কেউ দূরত্ব না মেনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায় কবে স্কুল খুলবে। তাদের চোখে স্কুলে ফেরার আকুতি। করোনার ভয় নেই একটুও।
এক সাথে এতো দীর্ঘ সময় পৃথিবীর কোন দেশেই আমার জানামতে,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি।
মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত হযে পড়ছে অনেকেই।
শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও ঘরে থেকে থেকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হচ্ছেন। অন লাইন ক্লাস যতটা উপকার করছে, তার চেয়ে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি করছে বেশি। দরিদ্র অভিভাবকদের নেট, স্মার্টফোন এবং এর যথাযথ ব্যবহার যেমন  সবার জন্য সম্ভব নয় তেমনি শিক্ষকদের মধ্যেও যারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নন, বয়স্ক তাদের জন্য  অন লাইনে ক্লাস নেওয়া কঠিন।
শিক্ষক শুধুমাত্র লেখাপড়াই শিখান না। নৈতিকতাও শিখান। দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় শিক্ষাও শিক্ষকের কাছেই পায় শিক্ষার্থী। মা বাবার কাছ থেকে দূরে থাকা সন্তানের বিকাশের জন্য যেমন অন্তরায়, তেমনি শিক্ষকের কাছ থেকে দূরে থাকাও শিক্ষার্থীর শিক্ষা এবং নৈতিকতা গঠনের পথে অন্তরায়। একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অবলীলায় সর্বত্র যেখানে যাওয়া যাচ্ছে সেখানে করোনার ভয় অর্থহীন।
যদি সবকিছু বন্ধ রাখা সম্ভব হতো। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যদি না চলতো, শিশুরা যদি ঘর ছাড়া আর কোথাও যেতে না পারতো, তাহলে হযতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার  যুক্তি ছিল।
এলাকা ভেদে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মতামত নিয়ে, যার যার সুবিধা মতো  স্কুলগুলো খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবী। এ ক্ষেত্রে আমরা যা করতে পারিঃ

১) শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী  দুটো দলে ভাগ করতে পারি।
২) পনেরো দিনের জন্য একদল শিক্ষক তাদের দলের শিক্ষার্থীদের দলে ভাগ করে  একদিন করে স্কুলে আনবে। পরের পনেরো দিন অন্যদল শিক্ষক তাদের দল নিয়ে একই নিয়মে ক্লাস করবে।
৩) মাসে একদিন বা দুদিন ক্লাস করলেও তারা শিক্ষক এবং শ্রেণিক্ষের সান্নিধ্যে আসলো।
৪) এসময়ে মাস্ক এবং বারবার হাত ধোয়া নিশ্চিত করবে শিক্ষক।
৫) এক বেঞ্চে একজন করে বসবে।
৬) যেসব অভিভাবক  তার সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না  তাদের ওপর চাপ সৃস্টি করা যাবে না। স্ব প্রণোদিত হয়ে যারা আসবে কেবল তাদেরই ক্লাস নিতে হবে।
৭) যারা বাসায় বসে পরীক্ষা  দিতে বা অ্যাসাইনমেন্ট করতে চায় তারা বাসায়ই থাকবে।
৮) যারা ক্লাসে আসবে তারা ফরমে স্বাক্ষর দিবে এইমর্মে যে, তারা স্ব ইচ্ছায় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। কোন সমস্যার জন্য তিনি কারো প্রতি অভিযোগ করবেন না।
৯) শিক্ষার্থীদের ওপর লেখাপড়া বা অন্য কোন ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।
১০) তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা, হাত ধোবার জন্য সাবান এবং স্যানিটাইজার রাখতে হবে।
১১) কোন এলাকায় করোনা রোগী বেড়ে গেলে সাথে সাথে বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, শিশুরা তার শিক্ষকের কথা যতোটা শোনে, মা বাবার কথাও ততটা শোনে না। সুতরাং করোনার ব্যাপারে মা বাবা এবং মিডিয়া তাদের যা শোনাতে পারেনি, শিক্ষক তা সহজেই  শোনাতে পারবেন।
বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার চেয়েও শুরুতে মানসিকভাবে তাদের আনন্দদানের চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘ বিরতির পর বিদ্যালয়ের পরিবেশে নিজেদের খাপ খাওয়াতে বিনোদনমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত করতে হবে।
এক বছরের শূণ্যতা মাথায় রেখে সেভাবেই তাদের নিয়ে আগাতে হবে। সব শিক্ষার্থীর  মেধা,শিখন দক্ষতা এক নয়। শিক্ষকই ঠিক করবেন তার শিক্ষার্থী নিয়ে তিনি কীভাবে আগাবেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ শিক্ষার্থী সম্পর্কে শিক্ষক যতটা জানেন, তারা ততটা জানেন না।
মা বাবার পরই একমাত্র ব্যক্তি শিক্ষক, যিনি নিজের চেয়ে উঁচুতে শিক্ষার্থীকে দেখতে চান। সুতরাং মা বাবার থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখা যেমন অন্যায়, তেমনি শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে রাখাও অন্যায়। বিদ্যালয়গুলো নিয়ম মেনে সীমিত আকারে খুলে দিয়ে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্যে ফিরিয়ে দেবার জন্য বিনীত অনুরোধ  করছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।


শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক, কলামিস্ট ও কবি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top