সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সব ‘জলপাই শাখা’ কিন্তু শান্তির দ্যোতক নয় : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ২০:০০

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:০৫

 

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই যখন করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত, ঠিক তখন বিশ্ব রাজনীতিতে তোলপাড় পড়ে যাওয়ার মত একটা ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু অতটা উত্তাল হলনা দেশকাল৷ একটা কারণ অবশ্যই করোনাময় আবহ, আর অন্য কারণটা তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এই ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে। ঘটনাটি কি খুলেই বলা যাক: মার্চ মাসের আঠারো তারিখে ইসলামাবাদে নিরাপত্তা রক্ষা সম্পর্কিত এক সভায় পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশীদ বাজওয়া বিবৃতি দিয়েছেন, "ভারত এবং পাকিস্তানের উচিত অতীতের বিরোধকে কবর দিয়ে সম্প্রীতি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করা।" শুধু সেনাপ্রধানই নয়, একই অনুষ্ঠানে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশীর গলাতেও একই স্বর শোনা গেছে। এখন প্রশ্ন হল, পাকিস্তান হঠাৎ এই নরম সুরে কথা বলছে কেন। এটা নিয়ে খুব সোচ্চার না হলেও আন্তর্জাতিক মহলে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পাকিস্তান সেনাপ্রধানের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য যতটা না ভারতের কানে, তার থেকে অনেক বেশি আমেরিকার কানে পৌঁছে দিতে চাইছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের অবস্থা বেশ কোণঠাসা। তারা নগদ অর্থের চরম সংকটে ভুগছে। সংযুক্ত আরব এমিরেটস, সৌদি আরব ঋণের টাকা ফেরত চাইছে৷ আমেরিকা থেকে যে অর্থ আসত তাতেও ঘাটতি পড়েছে। এমতাবস্হায় আমেরিকার সঙ্গে পড়তি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে পাকিস্তান সবকিছু করতে প্রস্তুত, কারণ আর্থিক সংকটাবস্থা কাটাতে আই.এম.এফের গ্রান্টই হোক কিংবা পশ্চিমী বিনিয়োগ সব কিছুতেই আমেরিকার হস্তক্ষেপ জরুরি।

চীনের সাথে তাদের মাখামাখি ভারত এবং আমেরিকা ভালো চোখে দেখছেনা। সেই ব্যাপারে সাফাই দিতে জেনারেল বাজওয়া তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, "যদিও আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য চীনের সাথে আর্থিক করিডোর (সিপিইসি) তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে, কিন্তু শুধু সিপিইসি-র কাঁচ দিয়ে পাকিস্তানকে দেখা ঠিক হবেনা"। তবে চীন পাকিস্তানের অবকাঠামো প্রকল্পে ৪৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও, তার বেশিরভাগটাই হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, নগদ অর্থ নয়। উপরন্তু এই টাকা ভবিষ্যতে শোধ করার চাপটাও পাকিস্তানকে নিতে হচ্ছে। তাই চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা তাদের আর্থিক সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো কাজে আসেনি৷

ওদিকে আমেরিকার প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলের নীতিতে পাকিস্তান কোথাও নেই, সেখানে ভারত একেবারে মধ্যমণি। এটা তাদের পক্ষে হজম করা কঠিন হয়ে পড়ছে। চীন যতই পাকিস্তানের তৈরি পোশাকের জন্য বাজার খুলে দিক, তাদের পোশাকের আসল বাজার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ভারতের বিশাল বাজার তাদের কপালে খুলে গেলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবে৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ কিছুটা হলেও বোধগম্য হয়।

প্রধানমন্ত্রী খান এবং সেনাপ্রধান বাজওয়া দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক প্রতিস্থাপনে ন্যায়ের চেয়ে ব্যবসায়িক সুবিধার দিকেই বেশি ইঙ্গিত করেছেন। খানের কথায়, আঞ্চলিক শান্তি ভারতকে মধ্য এশিয়ার ধনী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের পথ খুলে দেবে। বাজওয়া প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরেই বলেন, ভারত এবং পাকিস্তান দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, তাই এই দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক উভয়কেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লাভবান করবে। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা এখন নীতি গল্পমালায় পড়া সেই রাখাল বালকের মতো যে মিথ্যে বাঘ আসার খবর রটিয়ে আশপাশের মানুষকে বিব্রত করত। সেকারণেই ভারত এবং আমেরিকা বাজওয়ার কথায় বেশি উৎসাহিত না হয়ে ধীরে চলো নীতি অবলম্বনে বাস্তব অবস্থাটা বুঝে নিতে চাইছে।

বক্তব্যে বারংবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। জেনারেল স্বীকার করেছেন, “ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার মূলে রয়েছে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ। তাই কাশ্মীর সমস্যা সমাধান না হলে উপমহাদেশের শান্তি আর বোঝাপড়া রাজনৈতিক বাকবিতন্ডার স্তরেই রয়ে যাবে”। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী খান জানিয়েছেন, "কাশ্মীর নিয়ে দ্বিপাক্ষিক শান্তি স্থাপনে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে, অন্যথায় তাদের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব হবেনা।" দুজনেই তাঁদের বক্তব্যে বলেছেন, “বল এখন ভারতের কোর্টে”৷ এই কুটনৈতিক চালে গোটা বিশ্বের নজর ভারতের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন৷

কিন্তু ভারতের প্রতিক্রিয়া ছাড়িয়ে যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে সেটা হল, জেনারেল বাজওয়া তাঁর ভাষণে ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথা বলেছেন, নাকি পাকিস্তানি সেনা নেতৃত্বের বৃহত্তর অংশের মত প্রকাশ করেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক চায় যেখানে কোনোধরনের সন্ত্রাস, বৈরিতা এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা থাকবেনা৷ ভারত একথাও জানিয়েছে, এর সাফল্য নির্ভর করছে পাকিস্তান এই বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান চায় কিনা তার উপর। ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখে দুই দেশের মিলিটারিরা শপথ নিয়েছে জম্মু-কাশ্মীর এবং অন্যান্য সীমান্তে অস্ত্রবর্জন নীতি মেনে চলবে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই 'বল এখন ভারতের কোর্টে' বিবৃতিটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাজওয়ার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পক্ষ থেকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "বাজওয়ার উচিত এই বুলিসর্বস্ব কথার জাল না বুনে দুদেশের শান্তিকামনায় সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে ভাবা"। তিনি জানিয়েছেন, "যখন খোদ ইসলামাবাদই নাশকতামূলক কাজে জঙ্গীদের মদত দেয়, তখন সেই জায়গা থেকে দেওয়া এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যে চিড়ে ভিজবেনা। যেখানে এখনও প্রতিদিন সীমান্তে আমাদের জওয়ান খুন হচ্ছে, ড্রোনে করে ভারতের বুকে অস্ত্র এবং নেশার দ্রব্য ফেলা হচ্ছে, সীমান্ত দিয়ে বেআইনি অনুপ্রবেশ হয়ে চলেছে, সেখানে প্রতিবেশী দেশের এই শান্তিপ্রস্তাব অনেকটা ছেলে ভুলোনো ছড়ার মত শুনতে লাগছে"। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে পাকিস্তানি আধিকারিকগণ কি তাদের পোষা সন্ত্রাসবাদীদের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছেন? আইএসআইকে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন?”

ভারতকে হঠাৎ করে পাকিস্তানের 'অলিভ ব্রাঞ্চ' দেখানো নিয়ে বিশ্ব-রাজনীতি মহল নড়েচড়ে বসেছে। এর আগেও বহুবার দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, কিন্তু তারপরও পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামার মত ঘটনা ঘটে গেছে। ‘ভারতের কোর্টে বল’ বলতে পাকিস্তান যদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের আগাম দায়িত্ব ভারতের একার কাঁধে চাপিয়ে দেয় তাহলে সেটা একটা অবাস্তব প্রস্তাব হবে। একটা দেশ চুক্তি না মেনে ইচ্ছেমতো নাশকতা চালাবে, আর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদেশকে চাপ দেবে, এমন বালখিল্য ভাবনা মানসিক অসঙ্কুলানের প্রকাশ৷ 'কোল্ড ওয়ার' সমাপ্তির আপোস আলোচনায় রোনাল্ড রেগন এবং মিখাইল গর্বাচেভ একই মতবিশ্বাস পোষণ করেছিলেন, "ট্রাস্ট, বাট ভেরিফাই"; পাকিস্তানের সাথে সমঝোতায় বিপ্রতীপ অর্থে বলতে হবে, “ডিসট্রাস্ট, বাট ভেরিফাই।"

খুব পরিষ্কার ভাবে দেখলে তাদের বক্তব্য থেকে দুটো বিষয় উঠে আসে। এক, কোনো দেশ অন্যদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবেনা, এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সীমান্তে বা প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে জোট করে ঝামেলা পাকানো থেকে বিরত থাকবে; আর দুই, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ভারতকে নমনীয় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বলাবাহুল্য, এই প্রসঙ্গে পাকিস্তান ২০১৯ সালে মোদী সরকারের ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজের প্রসঙ্গটি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

এই মুহুর্তে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে পাকিস্তানের অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। দেশটির পূর্বদিকে ক্রমবর্ধমান শক্তিধর ভারত, পশ্চিমে ক্রমশ ক্ষমতার খাপ খুলতে থাকা আফগানিস্তান এবং জটিল অর্থনীতির দেশ ইরান, উত্তরে সদাকর্তৃত্বময় চীন আর অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকা আমেরিকা যেন তাদের চারপাশে মাকড়সার জাল বুনে চলেছে। পাকিস্তান বুঝতে পারছে এই অবস্থায় ভারত এবং আমেরিকার সাথে সমঝোতায় যেতে না পারলে ধীরে ধীরে চীনের উপনিবেশে পরিণত হতে হবে।

প্রতিবেশী দেশের এই ছটফটানিতে ভারত সরকারের ভূমিকা তারিফযোগ্য। নিউ দিল্লী থেকে ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে কোনো পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয়নি। মোদী সরকার সাতবছরের শাসনকালে যুদ্ধের চেয়ে শান্তি ও সুস্থ রাজনৈতিক বাতাবরনের উপর জোর দিয়ে এসেছে। চীনের সাথে সীমান্ত সংঘর্ষে যুদ্ধ ঘোষণা না করায় সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু একটা কথা সমালোচকরা মনে রাখেনি, আধুনিক পারমাণবিক সময়ে একটা উন্নতিকামী দেশ যুদ্ধ নয়, শান্তি এবং সমঝোতার মধ্য দিয়েই উন্নয়নের গতিপথ চালু রাখায় বিশ্বাসী। ১৯৬৫-এর যে সরকার পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, তার তুলনায় বর্তমান সরকার অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই কিছু বিরুদ্ধ চাপ সহ্য করতে না পেরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার মত দূর্বল অবস্থা বর্তমান সরকারের নয়। পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার মতো বালখিল্যতা এই সরকার দেখাবেনা৷ মোদী সরকার এখন চুপচাপ ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানের পরবর্তী চালের অপেক্ষা করছে। দাবা বোর্ড তো সাজানোই আছে, চেকমেট চালের সমস্ত রকম দাওয়াই নিয়ে ভারত সরকার প্রস্তুত।

চিত্র ও তথ্যঋণ: ইন্টারনেট

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top