সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা কি আছেন ভারতের সংখ্যালঘুদের মতন'ই? : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০২১ ১৮:৫১

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪৮

 

রাজনীতিতে 'ধর্ম' আর ধর্মে 'রাজনীতি', দাবা খেলার এই দুই মন্ত্রী অসাধারণ রাজনৈতিক প্রকৌশলে এ যাবৎকাল পর্যন্ত তরতাজা জীবনগুলোকে ছিনিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের। প্রায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ছেড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঐক্যকে, সুখ-শান্তিকে, বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে।
আর এ তো রাজ-রাজাদের এক প্রাচীন খেলা, যা আজও বহাল তবিয়তে, সুস্থ-সবলভাবে হেঁটে-দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের গণতন্ত্রের প্রসস্ত বুকে, ও বোধকরি ভবিষ্যতে লম্ফ-ঝম্ফ করার সম্ভাবনাটাও নেহাৎ কম কিছু হবে না।
ক্ষেত্রবিশেষে সংঘবদ্ধ ও সামগ্রিকভাবে যেভাবেই হোক দেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক হর্তা-কর্তা বিধাতাদের ব্যক্তিগত ঈর্ষা, হিংসা, লোভ-লালসা, আকাঙ্ক্ষা, রাগ ও দ্বেষ যখন দৈর্ঘ্যে ওঠে হয়ে বড়, তখন তিলে তিলে ও প্রায় প্রতিবারেই জন্ম নেয় অনিবার্য এক মহাপ্রলয়, আর এর গন্ডা গন্ডা উপযুক্ত প্রমাণও ভারতে আছে বৈকি। এরই এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তের অতিত ও বর্তমানকে আজ চেষ্টা করলাম পুনর্জন্ম দিতে।
ভারতীয় উপনিবেশে অবাধে কর্তৃত্বের আয়ু যে হয়ে এসেছে সীমিত, এ ব্যাপারটা ব্রিটিশরা বেশ হাড়ে-হাড়ে বুঝে গেছিল সেই ১৯৪৫ সাল নাগাদ'ই। যাইহোক, ব্রিটিশ-ভারতের অখন্ড ভূমিতে দাঁড়িয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত মায়ের মর্মান্তিক অঙ্গচ্ছেদে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর আন্তরিক সমর্থন এক্ষেত্রে ছিল ঠিক কতটা পরিমানে, বা আদৌ ছিল কি না? কিংবা এই পরিস্থিতির জন্যে তাঁরা ছিলেন কি পরিমাণে দায়ী?
সর্বরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে দ্বিতীয়বার সফল হওয়া সেই বঙ্গ ভঙ্গকে তাঁরা রোধ করতে পারতেন কি না, বা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন কি না?
এদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে, যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নাকি সে সময়ে অন্তর থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্যে। কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মধ্যে লখনৌ চুক্তিতে যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহে অংশ নিলে, সেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহই ১৯২০ সালে পদত্যাগ করেন কংগ্রেস থেকে।
অন্তরে গেঁথে থাকা দেশের প্রতি আদর্শ যেভাবেই হোক কিভাবে যে পাখি হয়ে হঠাৎ উড়ে যায় অজানা এক দেশে, কে জানে? এখন এই ঘটনার পর থেকেই মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবিকে সামনে রেখে মহম্মদ আলী জিন্নাহ'র প্রধান উপলক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের বিরোধিতা করা কি না?
বিশেষত তৎকালীন অখন্ড ভারত গর্ভ থেকে শুরু করে বর্তমান ভারত পর্যন্ত গর্বে ভরা তাঁকে 'পাকিস্তানের জনক' আখ্যা বহন করে চলেছে ঠিক কতটা পরিমাণে মর্যাদার পরিচয়?
এসব না হয় এবারে থাক যুক্তিসহ বিশ্লেষণ বহির্ভূত হয়েই। তবে পরবর্তীতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে কংগ্রেসের একটা বড় অংশ যে মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক ভারতের একটা অঙ্গ এবং বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সাম্প্রদায়িক বাতাবরণকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা না করে, বরং রাজনৈতিক হিংসা-বিবাদের স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপান্তরিত করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে এমনকি ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের একেবারে সরাসরি 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' নামক দেশব্যাপী এক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ডাক যে সত্যিই দিয়েছিলেন এবং তা বাস্তবে সংঘটিত হয়েওছিল কলকাতার রাজপথে হাজার-হাজার হিন্দু-মুসলমানের টাটকা রক্ত ও রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহের বিনিময়ে , তা নিয়ে আজ আর সামান্যতম সন্দেহ বোধহয় নেই।
এ প্রসঙ্গে সর্বধর্ম সমন্বয় কেন্দ্রিক রাষ্ট্রেও তাই উদ্ভব ঘটে যায় দ্বিজাতি তত্ত্ব-এর মতন সেই বিধ্বংসী মারণ ভাইরাসের। তবে সিংহভাগ হিন্দু অধ্যুষিত কংগ্রেস নেতাদের বৈষম্য এবং অবদমনমূলক আচরণকেও এর জন্যে দায়ী করাটা ভুল কিছু হবে তো নাই, বরং হবে বেশ যুক্তিসংগত।
সেই বেদনাবিধুর অতীতের রাস্তা ধরে এবারে না হয় চলে আসা যাক বর্তমানে। দেখা যাক ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সেই পাকিস্তান নামক অঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের মনোভাবজনিত কার্যকলাপ সংখ্যালঘুদের উপরে এখন ঠিক কেমন? বর্তমান বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে , মুসলমানরা লাভ করে আসছেন ঠিক যতটা সম্মান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন , উপভোগ করে আসছেন যে ভারতীয় সুখ-শান্তি কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরাও পাচ্ছেন কি ঠিক ততটাই?
সঠিক উত্তর হবে না, কোনো দিনও পাননি, ও পাচ্ছেনও না। বিগত কয়েক দশকে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ব্যাপক হারে, কারণ?
কারণ, প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে পাকিস্তানের সরকার থেকে সেনাবাহিনী , কিংবা উগ্রবাদী জনগণের ইচ্ছেস্বাধীন ও পরিকল্পিত আগ্রাসন।
The Human Rights Commission Of Pakistan এর সেই কোন ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতিমাসে সে দেশে অপহরণের স্বীকার হয় ২৫ জন হিন্দু মেয়ে, লুকিয়ে রাখা এর প্রকৃত সংখ্যাটা আরো বেশি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, আর বর্তমানে?
পাকিস্তানে বসবাসকারি মোট হিন্দু জনসংখ্যার প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই বাস করে সিন্ধু প্রদেশে। পাকিস্তানি রাজনীতিতে কোনো জায়গায় তো নেইই, এমনকি সরকারি উচ্চপর্যায়েও হিন্দু বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেই বিশেষ তেমন কোনো উপস্থিতি বা গুরুত্ব। বহু কমে এসেছে পাকিস্তানে মন্দিরের সংখ্যাও।
সেই দ্বিজাতি তত্ত্ব নামক ভাইরাসের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করলেও, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও শিখ সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও কিন্তু থেকে গিয়েছেন সে দেশে।
প্রাণে বাঁচার একান্ত তাগিদে বহু সংখ্যালঘু পরিবারকে বাধ্য হয়ে গ্রহণ করানো হয়েছে মুসলমান ধর্ম।
এছাড়া খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বেমালুম মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া তো বোধহয় লঙ্ঘন করেছে এর আধিপত্যের সীমা সেই কবেই।
সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার যেভাবে ক্রমবর্ধমান, আগামীতে অন্য কোনো জাতির অস্তিত্ব পাকিস্তানে আদৌ টিকে থাকবে কি না, তা অবকাশ রাখে যথেষ্ট সন্দেহের। আর এটাই তো বোধকরি মনে-প্রাণে চায় পাকিস্তান নামক এই ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের সংবিধানে তো সংখ্যালঘুরা ব্রাত্য ছিলই, আছেন এবং বোধহয় থাকবেনও।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের অবৈধ নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ ইস্যু থেকে সীমান্তে ও এ দেশে বিভিন্ন কৌশলে পরিকল্পনামাফিক হামলা তো কম-বেশি আছে ও থাকবেও।
পাশাপাশি ভারতীয় সংখ্যালঘুরা ঠিক কেমন আছেন, তা আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোনো অপেক্ষা বোধহয় রাখেনা।
তবে এ দেশের উগ্রবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের থেকে বিশেষভাবে শেখার বোধহয় এটাই যে, দৃঢ়সংকল্প ও সংঘবদ্ধ হয়ে, রাগ-হিংসাকে যে কোনো প্রকারে পুষ্টি দিয়ে কিভাবে বা কোন কোন পদ্ধতিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখতে হয় বাঁচিয়ে?
কিভাবে বা কোন কোন সময়েই বা করতে হয় এর যথার্থ প্রয়োগ?
এ দেশ যেন আজ প্রায় সমগ্র বিশ্বের বাকি সব রাষ্ট্রের কাছে আছে এক অনন্য নজির হয়ে।


তন্ময় সিংহ রায়
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top