সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নকল ও নিম্নমানের ওষুধ: জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে : অন্জন কুমার রায়


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২১ ২২:১৪

আপডেট:
৩১ আগস্ট ২০২১ ২২:১৭

 

জন সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওষুধ প্রয়োজন। কিন্তু সে ওষুধ যদি জীবন রক্ষার পরিবর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে তাহলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। ওষুধ ভাল নাকি মন্দ, নকল না আসল তা যাচাই করার ক্ষমতা আমাদের সাধারণ জনগণের থাকে না। মানসম্পন্ন ওষুধ কিংবা ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কেও আমাদের ধারণা থাকার কথা নয়। তবে সাধারণ জনগণের স্বভাবসিদ্ধ ধারণা, ওষুধ তৈরিতে গুণগত মান বজায় থাকে। নকল পণ্য তৈরি হলেও নকল ওষুধ তৈরি হতে পারে কিংবা ওষুধের গুণগত মান নিম্ন হতে পারে তা আমাদের মতো সাধারণ জনগণের মাথায় কখনো আসে না। তাই, যে কেউ যে কোন জায়গা থেকে ওষুধ ক্রয় করে। এমনকি খোলা বাজার থেকেও। আমাদের অতি বিশ্বাসের স্থানেই ঘটে বিপত্তি। ফলে ক্রেতার কাছে সহজেই চলে যায় নকল বা ভেজাল ওষুধ। শুধু তাই নয়, ভেজাল ওষুধের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে এক শ্রেণীর বিক্রেতা। এ সকল মেয়াদোত্তীর্ণ এবং মানহীন ওষুধ ব্যবহারের ফলে রোগীর আরোগ্য লাভের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরণের নতুন রোগে আপতিত হয়।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় নকল এবং ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশ পায়। রাজধানীসহ কিছু এলাকায় নকল ওষুধ তৈরি কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে আছে নামি-দামি ব্র্যাণ্ডের নকল ওষুধ। এসব ওষুধ বিপণনের জন্য রয়েছে বিশেষ নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কই সকল ধরণের কাজ করে থাকে। ভাল মানের কোন ব্র্যাণ্ডের ওষুধের লেবেল হুবহু নকল করে তুলনামুলক কম দামে বিক্রি করা হয়। প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধও তালিকায় রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)’র তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যে ওষুধ বিক্রি হয় তার শতকরা ১৫ ভাগ ওষুধ নিম্নমানের, ভেজাল বা নকল।
আশির দশকে কয়েকটি ওষুধ কোম্পনীর তৈরি প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে অনেক শিশু মারা যায়। জানা যায়, এ সকল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে শিশুদের কিডনী বিকল হয়ে গিয়েছিল। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর পরীক্ষা করে তাতে ক্ষতিকারক ‘ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল’ নামের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পায়। ক্ষতিকারক ডাই-ইথিলিন গ্লাইকলের প্রভাবে কিডনী যে কোন সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। ২০০৯ সালেও এমন ঘটনা ঘটে। উৎপাদন ব্যয় কমাতে কিছু ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘প্রোপাইলিন গ্লাইকলের’ পরিবর্তে বিষাক্ত ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করে। ডাই- ইথিলিন গ্লাইকল’ রাসায়নিক রং, বলপেনের কালি, সিলপ্যাডের কালি, মুদ্রণ কালি, প্লাস্টিকে দ্রবণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রেফ্রিজারেটরে অ্যান্টি-ফ্রিজ, শীত প্রধান দেশে অ্যান্টি হিমায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ওষুধের সিরাপে ব্যবহারে শিশু মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিন্তু, তা সত্তে¡ও এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী ওষুধের সিরাপে ক্ষতিকারক ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করে। আবার সিরাপে ‘প্রোপাইলিন গ্লাইকল’ থাকার দরুণ সিরাপের স্বাদ তেতো লাগে। প্রোপাইলিন গ্লাইকলের পরিবর্তে দামে সস্তা ডাই- ইথিলিন গ্লাইকল মিশালে সিরাপের স্বাদও মিষ্টি হয়।
খোলা বাজারে কিংবা গ্রামাঞ্চলে চর্ম এবং যৌন রোগের ভেজাল ওষুধ বিক্রির রমরমা ব্যবসা হয়ে থাকে। এ সকল ওষুধ কতটুকু মানসম্পন্ন তাই বিবেচ্য। সচেতনতার অভাবে অনেকেই ভেজাল ওষুধ বুঝতে না পেরে রোগ সারানোর দায়ে বারবার একই ওষুধ কিনে। যার ফলে ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব শরীরে বিদ্যমান থাকে। এ সকল ভেজাল ওষুধ ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এমনকি ক্যানসারের উপসর্গও দেখা দিতে পারে। ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
কিছু কিছু ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করায় ক্রেতারা ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের প্যাকেট বদল কওে নতুন প্যাকেটে করে বাজারজাত করণ করে। তাতে ক্রেতারা সহজেই প্রতারণার শিকার হয়। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকে। বোতলজাত ওষুধের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ সহজে চোখে পড়লেও ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের স্ট্রিপে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ জন সাধারণের দৃষ্টি গোচরে আসে না। ফলে বেশির ভাগ ক্রেতাই ট্যাবলেট কিংবা ক্যাপসুলের স্ট্রিপে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখতে পায় না।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকাশমান ও বিস্তৃত শিল্প। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ব্যাপক সুখ্যাতি থাকায় এদেশের ওষুধ অনেক দেশে রপ্তানী করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ইউরোপ- আমেরিকায়ও রপ্তানী হয়। এমন সব দেশে ওষুধ রপ্তানী হয় যারা মানের ব্যাপারে শত ভাগ আপোষহীন। ওষুধের গুণাগুণ ভাল বলেই বহির্বিশ্বে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু, কোন কারণে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হলে ওষুধ শিল্পের রপ্তানীখাত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য কিংবা ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। তারপরও এগুলো থামানো যাচ্ছে না। যদিও নকল, ভেজাল ও নিম্ন মানের ওষুধ বন্ধে কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পনীর লাইসেন্স বাতিল করেছে সরকার। আরো কয়েকটি কোম্পনীর কয়েকটি ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করে সতর্ক করা হয়।
এমনিতে প্রতিদিন খাবারের নামে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ভেজাল মিশে যাচ্ছে। ফলে শরীর বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। তার উপর ওষধের গুণাগুণ রক্ষিত না হলে রোগ- বালাই বাড়তে থাকবে। তাই, জনস্বার্থে নকল বা ভেজাল ওষুধ বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

 

অন্জন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top