সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ শ্রীলংকার পরিনতির দিকে এগুচ্ছে বলছে জ্ঞানপাপীরা : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
১৭ মে ২০২২ ০২:৪১

আপডেট:
১৭ মে ২০২২ ০২:৪৩

ছবিঃ মাহবুবুল আলম

 

'সার্ক' এর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ ছিল শ্রীলঙ্কা, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি ছিল। শ্রীলঙ্কার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক অনেক ভাল ছিল। দেশটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পরের বছরই প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় বিশ্ব ব্যাংক দেশটিকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকা থেকে নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নামিয়ে দেয়। এই ওঠা-নামার কারণ ছিল মূলতঃ রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক।
ইদিনংকালে আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ শ্রীলংকা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ দেশটির অর্থনীতি নানা কারণে ধসে যেতে বসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। জ্বালানি সংকট চরমে পৌঁছেছে। পেট্রোল পাম্পে সম্ভাব্য ক্ষুব্দ জনতার হামলা সামলানোর জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি করতে পারছে না বিধায় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কাগজের অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না। জ্বালানি তেল আর খাদ্য কেনার জন্য মানুষ যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কেন হলো একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের এই দুরবস্থা? এর বিভিন্ন কারণ খুঁজছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা!

আমাদের দেশের জ্ঞানপাপী সুশীল সমাজ, দেশের উন্নয়নে যারা খুশি নয় তারাই বলেন- চীনের ঋণ নিয়ে অর্থনীতিতে বাংলাদেশকেও শ্রীলংকার ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে, তারা এমন একটি দুঃসংবাদ শোনার অধির অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না চীনের নিকট শ্রীলংকার ঋণের পরিমান ৪০০% আর বাংলাদেশের তা ৬%। তাছড়া দেশটি দীর্ঘদিন জাতিগত সংঘাতে জড়িয়ে ছিল আর ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে বোমা হামলায় ২০০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়েছিল যার মধ্যে অনেক বিদেশি নাগরিকও ছিল। সেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও কোভিডের জেরে শ্রীলংকার পর্যটন খাত থেকে জিডিপির ১৫% থেকে ২০% আয় কমে যাওয়া এবং পরিবারতন্ত্রের জালে আটকে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে আজ শ্রীলংকার অর্থনীতির এই হাল হয়েছে।

যেসব কারণে শ্রীলংকার অর্থনীতির এ পরিনতি হয়ে তার প্রধান প্রধান কারণ হলো দেশটির সরকারগুলো কখনোই উৎপাদন খাত, সেবা খাতে বিনিয়োগ বা নজর দেয়নি। আর এজন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা দাতা গোষ্ঠীর পরামর্শ সব সময়ই শ্রীলংকার দুর্বল সরকারগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছে। ২০০৯ সালের পর থেকে অর্থনীতি একটু চাঙ্গাভাব চলে শ্রীলংকায় বিদেশি বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক। বিরোধী দলীয় ‍উপনেতা (জি এম কাদের) আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রীলঙ্কার বিষয়টি নিয়ে, এটি বাস্তব। তবে আমরা সরকার গঠন করার পর থেকে এ পর্যন্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যত ঋণ নিয়েছি তা সময়মতো পরিশোধ করছি। বাংলাদেশ একটি দেশ, যে দেশ কোনোদিন ঋণ পরিশোধে ডিফল্টার হয়নি, হবেও না। সেদিক থেকে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত। আমি বলে রাখতে চাই, আমরা অত্যন্ত সতর্ক।"

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে বলেন- ঋণ পরিশোধের দায়ের দিক থেকে বিপজ্জনক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে, পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ। সুতরাং আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা, আইএমএফের হিসাবে এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই বিপদ। তবে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ থেকে এখন থেকেই কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক খাত যতটা বহুমুখী দেশ হিসেবে শ্রীলংকা ততটা নয়; চা, দারচিনি, নারকেল, মশলা, মূল্যবান রত্ন-পাথর, রাবার আর তৈরি পোশাক ছাড়া রফতানিযোগ্য পণ্য বিশেষ নেই। সবই এই দ্বীপরাষ্ট্রে আমদানি করতে হয়। দেশটির বিরাট সংখ্যক প্রবাসী বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকে আর পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার।

গত এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানি করা পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মজুতদাররা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট তদারকের জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

গাড়ি, স্যানিটারি আইটেম, কিছু ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি সরাসরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। কারণ, দেশটি এখন ‘অর্থনৈতিক ধস’-এর সম্মুখীন। বেশ কয়েক মাস ধরে ভয়ংকর খাদ্যসংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে। অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হারও দিন দিন বাড়ছে। শ্রীলঙ্কান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল ১ ডলারে ১৯০ রুপি, গত এক মাসে সেটা বেড়ে ২৩০ রুপিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতেই হবে। এর মানে, শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন দেশটির এ দেউলিয়াত্ব ডেকে এনেছে করোনা মহামারিসহ আরও কিছু অদূরদর্শী কারণ; কয়েক বছর ধরে উল্টোপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষি খাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। গোতাবায়া দেশের কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করা অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া—এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! এ কারণে এক অভূতপূর্ব ফলন বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে এল এক-চতুর্থাংশে।

অন্যদিকে, করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনল শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দুই বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ের আরও দুটি প্রধান সূত্র এলাচি ও দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দুই বছরে। এ কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যেখানে–সেখানে প্রকল্প গ্রহণের উচ্চাবিলাসি সিদ্ধান্তের কারণে শ্রীলংকার অর্থনীতির দুরাবস্থার
জন্য দায়ী বলে মনে করছে অর্থনৈতিক বিশ্লেশকরা।

আন্তর্জাতিক বাংলা সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি-'শ্রীলংকার এ সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে এ সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারছে ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। এর মধ্যে অন্যতম উৎস্য হচ্ছে সার্বভৌম বন্ড। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে। একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরণের সার্বভৈৗম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরণের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেয়া হয়। শ্রীলংকা সেটাই করেছে। কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি।'

পরিশেষে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। কেননা, রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি এবং আমদানী বাণিজ্যে দিন দিন ব্যয় বাড়ছে। তাছাড়া প্রবাসীদের রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভেও টান পড়বে। এ কারণে বড় প্রকল্পে অর্থ ব্যয়, দায় পরিশোধ ও সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক নিয়ে সতর্ক থাকার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সতর্কতা ছিল না বলেই সীমাহীন বিপদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশবাসীর আশা শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে দ্রুত অগ্রগতির দিকে আরো নেবেন এবং জ্ঞানপাপী
সুশীল ও সরকারবিরোধীদের অপপ্রাচারের মোক্ষম জবাব দিতে শ্রীলংকার মত ভুল করবেন না।

[সূত্র: ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রনালয় ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন]

 

মাহবুবুল আলম
কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top