সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


কেমন হলো সিডনির করোনাকালীন দুর্গা পূজা : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
২৮ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১২:১০

 

শরৎকাল, শিউলি ফুল, কাশফুল, দুর্গা পূজা একই সূত্রে গাঁথা আর আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা। বাংলীদের সবচেয়ে বড় এবং সার্বজনীন উৎসবের নাম দুর্গা পূজা তাই শরৎকাল আসলেই বাঙালি জীবনের উৎসবের সাজ সাজ রব পরে যায়। কবে কখন কিভাবে দুর্গা পূজার চলন হয়েছিলো আমরা সে গবেষণায় যাচ্ছি না বরং দুর্গা পূজাকে উপলক্ষ করে বাঙালি জীবনে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয় আমরা সেদিকেই মনযোগ দিবো। সেই মহালয়া থেকে শুরু করে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী হয়ে বিজয়া দশমীতে যেয়ে পূজা শেষ হয়। এরমধ্যে অনেক আনুষ্ঠানিকতা আছে। প্রত্যেকটা আনুষ্ঠানিতার সাথেই আবার দিনের বিশেষ লগ্ন বা ক্ষণ জড়িত। লগ্ন বা ক্ষণ মেনে পূজা পালনের পাশাপাশি চলে উৎসবের আমেজ। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ দুর্গা দেবীকে দর্শণ করতে আসেন বলেই হয়তোবা দুর্গা পূজাকে সার্বজনীন দুর্গা পূজা বলা হয়।    

পূজার প্রস্তুতি চলতে থাকুক আমরা একটু স্মৃতিচারণ করে আসি। আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমানের বসবাস একেবারে পাশাপাশি। আমরা ছোটবেলায় বুঝতেই পারিনি আসলে উৎসবেরও রকমফের আছে। সব উৎসবই আমরা সমানভাবে আনন্দ নিয়ে পালন করতাম। আর উৎসবের অনুষঙ্গগুলোই এমন যে সেখানে হিন্দু মুসলমান একেবারে মিলেমিশে একাকার। মুসলমনাদের ঈদের সময় নতুন কাপড় ধোয়া এবং ইস্ত্রি করার জন্য যেতে হতো পাশের বাড়ির হিন্দু ধোপাদের বাড়িতে। আবার ঈদগাহে নামাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় মিষ্টান্ন কেনার চল আছে আবহমান গ্রাম বাংলায়। আর আমরা ছোটরা কিনতাম পাঁপড় ভাজা। ঈদগাহের বাইরে রাস্তার পাশে সারধরে এই দোকানগুলো বসতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে এইসব দোকানগুলো ছিলো আমাদের পাড়ার হিন্দু পালেদের দোকান। পাড়ার গান বাজনা থেকে শুরু করে থিয়েটারের চর্চা চলতো হিন্দু বরগীদের বাড়িতে। 

দুর্গা পূজা আসলেই বরগী বাড়িতে ব্যস্ততা বেড়ে যেতো। কুষ্টিয়া শহরের অনেক প্রতিমা তৈরি হতো বরগী বাড়িতে। এছাড়াও নিজেদের জন্যও একটা প্রতিমা আলাদা করে রাখা হতো। শুরুতেই বাঁশের সাথে বিচালি বেঁধে প্রতিমার একটা প্রাথমিক আকার দেয়া হতো। এরপর তারউপর কাদা লেপে প্রতিমা প্রতিমা তৈরি করা হতো। আমরা ছোটরা যেয়ে বরগী কাকাদের পাশে বসে বসে উনাদের নিপুণ হাতের কারুকাজ দেখতাম। কিভাবে সামান্য বাঁশ, বিচালি আর কাদা থেকে একটা মূর্তি তৈরি হচ্ছে। একেবারে রুটিন করে প্রতিদিন সকালে উঠে যেয়ে বসে থাকতাম আমরা। আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম কোন মূর্তিটার কতখানি অগ্রগতি হয়েছে বা এরপর কোন মূর্তিটার কোন অংশ তৈরি হবে। মাঝেমধ্যে কাকারা আমাদের কাছে এটা সেটা এগিয়ে চাইলে আমরা খুবই খুশি হতাম। এভাবে পুরো পাড়াময় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো।  

পাশেই সাহাপাড়াতেও মন্দিরে দুর্গা পূজার আয়োজন চলতো। এছাড়াও বাঁশের সাঁকোয় খাল পার হয়ে আমরা দেখতে যেতাম চৌড়হাঁসের পূজা। এই তিনটা পূজায় আমরা পালাকরে দেখতাম তবে আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বরগীদের বাড়ি কারণ ওখানে বাড়তি পাওনা হিসেবে প্রতিমা গড়া দেখা যেতো। পূজা শুরু হলে সারা পাড়া ঢাক আর কাঁসার তালে যেন নেচে উঠতো। ধূপের গন্ধে সারা পাড়া ঢাকা পড়ে যেতো। প্রতিদিন পূজার পর প্রসাদ ছিলো আমাদের বাড়তি আকর্ষণ। একটা দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসে। বিজয়া দশমীর দিন আসলেই দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দেয়া হতো। তার আগে বরগী বাড়ির দাদি যাকে আমরা কর্তা বলতাম তিনি শেষবারের মতো পূজাটা সেরে নিতেন। দেবী দুর্গার ঠোঁটে বিভিন্ন রকমের খাবার একটু একটু করে গুঁজে দিতেন আর শাড়ির আঁচলে বারবার চোখ মুছতেন। ঘটনাটা আমার শিশুমনে দাগ কেটেছিলো তাই হয়তোবা এখনও পরিষ্কার মনে আছে।  

কুষ্টিয়া থেকে ফিরে আসি সিডনিতে। বাংলাদেশিরা বিশ্বের যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই একটা ছোট বাংলাদেশ তৈরি করে নিয়েছেন আর পালন করে চলেছেন বাঙালির সব রকমের উৎসব। সিডনি আসার পর আমরা সব ধরণের উৎসব পালন করলেও দুর্গা পূজা আর ঢাক এবং কাঁসার বাদ্যটা খুব করে অনুভব করছিলাম। হঠাতই একদিন সন্ধান পেয়েছিলাম পাশের সবার্ব গ্লেনফিল্ডে আগমণী অস্ট্রেলিয়ার দুর্গা পূজার। গত বছর থেকে শঙ্খনাদ নামের আরো একটা সংগঠন ক্যাম্পবেলটাউন এলাকায় দুর্গোৎসব পালন করে যাচ্ছে এবং আমরা যথারিতি এ মন্ডপ থেকে সে মণ্ডপে দলবেঁধে পূজা দেখে বেড়াই। পূজার সময় অফিস থেকে বাসায় ফিরে প্রথম কাজ বাচ্চা দুটোকে নিয়ে দুই মণ্ডপে ঢুঁ মারা এবং প্রসাদ খাওয়া ছিলো আমাদের নিত্যদিনের রুটিন কিন্তু করোনাকালে এইবার আর সেটা সম্ভবপর হয়নি।

করোনার কারণে এইবার সমস্ত উৎসবাদী বাতিল করা হয়েছে। দুর্গা পূজাও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। করোনার প্রথম ধাক্কাটা অস্ট্রেলিয়া বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কাটাতে একটু বেশামাল হয়ে গিয়েছিলো। অবশেষে সেটাও এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে বলা চলে। সব ধরণের জনসমাগম নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়াতে হল বুকিং বাতিল করে দেয়া হয়েছিলো কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন বিধি নিষেধের শর্তে অনুমতি দেয়া হয়। প্রত্যেকটা মণ্ডপেই জনসমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়। মন্ডপের বাইরে ছিলো শরীরের তাপমাত্রা মাপার মাস্ক সরবরাহের ব্যবস্থা। এভাবেই এবার পূজা পালন করেছে অস্ট্রেলিয়ান বেঙ্গলি হিন্দু এসোসিয়েশন, আগমণী অস্ট্রেলিয়া এবং শঙ্খনাদ। অবশ্য আগমণী অস্ট্রেলিয়ার প্রতিমা স্থাপনের অনুমতি ছিলো না তাই বলে পূজার আনন্দে কোন ভাটা পড়েনি।   

আমরা সপরিবারে দেখতে গিয়েছিলাম বাসার সবচেয়ে কাছের শঙ্খনাদের পূজা। ইঙ্গেলবার্নের গ্রেগ পারছিভাল হলে আয়োজন করা হয়েছিলো পূজার। হলটা আয়তনে বেশ বড় তাই নিয়ামানুযায়ী সেখানে বেশকিছু মানুষের সমাগম একসাথে করা সম্ভব হয়েছিলো। মণ্ডপে ঢোকা এবং বের হওয়ার রাস্তা ছিলো আলাদা। আর ঢোকার মুখেই আমাদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে মাস্ক দিয়ে দেয়া হলো। ভিতরে যেয়ে আমরা দেবী দর্শণ করে ছবি তুলেই বেরিয়ে এলাম কারণ আমাদের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তখন পর্যন্ত আয়োজনের পুরোটা শেষ হয়নি। এরপর একেবারে সন্ধ্যার পর গেলাম ঢাকের বাদ্য শুনতে। সত্যি কথা বলতে ঢাক এবং কাঁসার বাদ্য সরাসরি না শুনলে আমার কাছে দুর্গা পূজার আনন্দ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মণ্ডপের ভিতরে ঢুকেই কানের তালা লেগে গেলো ঢাক আর কাঁসার বাদ্যে। অন্য কোন শব্দে কানে তালা লেগে গেলে অস্থির থাকে কিন্তু ঢাক আর কাঁসার বাদ্যে কিছু একটা আছে যেটা সারা শরীর মনে এক ধরণের দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়। বাদ্যের তালে তালে চলছে দলবেঁধে নৃত্য। কখনও ছেলেরা আবার কখনও মেয়েরা দলবেধে নৃত্য করার পর ছেলেরা ধুপের ধুনি হাতে নিয়ে নাচলো। বাসায় ফেরার তাড়া থাকাতে আমরা প্রসাদ নিয়ে চলে আসলাম। এভাবেই শেষ হলো আমাদের এইবারের দুর্গা পূজা।

সময়ের অভাবে এইবার আর আগমণীর পূজা মণ্ডপে যেতে পারিনি। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান বেঙ্গলি হিন্দু এসোসিয়েশনের পূজা মণ্ডপ আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে হওয়াতে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও জনসমাগম এড়াতে এবার অনেকেই পারিবারিকভাবে পূজা পালন করেছেন। পাল পরিবার, সেন পরিবার পারিবারিকভাবে এই প্রথমবার পূজা পালন করেছেন। অবশ্য তাতে সব ধরণের আনুষ্ঠানিকতায় যতদূর সম্ভব পালন করা হয়েছে। সব পূজাতেই করোনাকাল পেরিয়ে সুস্থ্য স্বাভাবিক সময়ের জন্য দেবী দুর্গার কাছে প্রাথর্না করা হয়েছে। প্ৰত্যেবার পূজা উপলক্ষেই প্রকাশ করা হয় পূজা স্মরণিকা। শঙ্খনাদ এইবার তাঁদের স্মরণিকাটা প্রকাশ করেছে অনলাইনে তবে যে কেউ চাইলে সেটা ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে পড়তে পারবেন। এভাবেই সীমিত পরিসরে পূজার সকল আনুষ্ঠানিকতা যতদূর সম্ভব সম্পন্ন করা হয়েছে।

দেবী দুগা বিজয়া দশমীতে যেমন অসুরকে পরাজিত করে দুষ্টের দমন শিষ্টের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তেমনি এইবার সবাই দেবী দুর্গার কাছে করোনাকাল থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন। আমরাও আশাকরি খুব শীঘ্রই করোনাকালের এই দীর্ঘ দমবন্ধ পরিবেশ পেরিয়ে বইবে শরৎকালের স্নিগধ বাতাস। যে বাতাসে গাছ থেকে দলে দলে ঝরে পড়বে শিউলি আর গ্রাম্য কিশোরী ফুলের ডালি কাকে নিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে আনবে দুর্গা পূজার জন্য। বাতাসে দুলে উঠবে কাশের ফুল যেমন ঢাকের কোণায় দোলে কাপড়ের তৈরি কাশফুল। আর আকাশে উড়ে বেড়াবে পেঁজা তুলোর দুরন্ত মেঘ। সকলকে শারদীয় শুভেচ্ছা। দেবী দূর্গা আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।  

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top