সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


বাংলাদেশের স্বর্নালী সময়ের

বরেণ্য এক কন্ঠ সঙ্গীতশিল্পী'র নাম-আন্জুমান আরা : অশ্রু বড়ুয়া


প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৫:৪০

ছবিঃ আন্জুমান আরা

 

গত ১১ জানুয়ারি ছিল স্বর্নকন্ঠী এই সঙ্গীত শিল্পীর ৭৮তম জন্মদিন
-----------------------------------------------------------------------

ইংরেজি ১৯৬৪ সাল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথা- সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক প্রথমবারের মতো গানের জন্য কথা সাজালেন। তা-ও আবার বরেণ্য চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত'র পরিচালনায় 'সুতরাং' চলচ্চিত্রের জন্য। সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক লিখলেন-

  • তুমি আসবে বলে-কাছে ডাকবে বলে...

এ গানের কথায় সুরারোপ করলেন প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা। জনপ্রিয় এই গানটির শিল্পী ছিলেন আন্জুমান আরা।

ইংরেজি ১৯৬৮ সাল। সুভাষ দত্ত ফের নির্মান করলেন 'আয়না ও অবশিষ্ট' চলচ্চিত্র। এবারও এ চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম বারের মতো গান লিখলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুরকার যথারীতি সত্য সাহা। গানের নেপথ্য কন্ঠের জন্য আবারও ডাক পড়লো শিল্পী আন্জুমান আরা'র। এই চলচ্চিত্রের গানের জন্য গাজী মাজহারুল আনোয়ার সাজালেন-

  • আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল...

অসাধারন গীতিকবিতায় শ্রুতিমধুর সুর আর গায়কীমদির বিহ্বলতায় যে গানটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানের 'একটি' হয়ে যে কারো মনকে সহজেই নাড়া দিয়ে যায় এখনও।

এমনই অসংখ্য গানের শিল্পী আন্জুমান আরা। আজ স্বর্নকন্ঠী এই কন্ঠশিল্পীর ৭৮তম জন্মবার্ষিকী। আজকের এদিনে বরেণ্য শিল্পীর প্রতি রইল এক হৃদয়ের অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অফুরান।

ইংরেজি ১৯৪২ সাল। তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ১১ জানুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন আন্জুমান আরা। পিতার নাম-কাসির উদ্দিন তালুকদার এবং মা-জিয়াউন্নাহার তালুকদার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন আন্জুমান আরা'র পিতা ডা. কাসির উদ্দিন তালুকদার মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধ সরবরাহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৯ মে তিনি শহীদ হন।

উচ্চ শিক্ষিত ওই পরিবারের রক্তেই যেন মিশে আছে সঙ্গীত। আন্জুমান আরা'র বড় বোন জেবুন্নেসা জামাল ছিলেন একজন স্বনামধন্য গীতিকার। আরেক বোন মাহবুব আরা রেডিও-টেলিভিশনের নামকরা সঙ্গীত শিল্পী। সঙ্গীতশিল্পী জিনাত রেহানা তাঁরই ভাগ্নি এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লা তাঁর আপন চাচাতো বোন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা আন্জুমান আরা

ষোল বছর বয়সেই প্রথম চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্যে কন্ঠ দেন। বরেণ্য চিত্র পরিচালক এহতেশাম পরিচালিত উর্দুভাষায় 'চান্দনী' চলচ্চিত্রের 'চান্দনী ভিগি ভিগি হাওয়া' তাঁর কন্ঠের এ গানটি ওই সময় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আন্জুমান আরা- মূলত ষাটের দশকের একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। ওই সময় রেডিও, টেলিভিশন, গ্রামোফোন রের্কড ও চলচ্চিত্রে বরেণ্য এ শিল্পীর সতেজ কন্ঠের আওয়াজ শোনা যেতো সর্বত্র। বিশেষ করে রেডিওতে আধুনিক, নজরুলগীতি, লোকগীতি ছাড়াও সেমি- ক্লাসিক্যাল, দেশাত্মবোধক, গজল পরিবেশন করতেন তিনি।

  • তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে
  • আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল
  • স্বনার্লী ক্ষণ হয়ে আনমন
  • মধুর আবেশে ভরা এই ক্ষণ
  • নামের বড়াই করো নাকো
  • কে মরনের প্রান্তরে
  • খোকন সোনা
  • সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই
  • ঘুম ঘুম আঁখি দুটি
  • কে যেন খুশীর নেশা
  • একবার এসো গো সখা
  • মাঝ পথে রেখে চলে গেছো
  • কার ঐ বাঁশরী বাজে
  • আমার এই গান শেষ গান
  • এক যে ছিল রাজার কুমার
  • ওগো অমন করে আর বেজো না
  • মরন রে তোর স্বাদ যে কেমন
  • চোখ কি কথা বলে যায়

-এ রকম বহু কালজয়ী ভালোবাসার গান গেয়েছেন এই শিল্পী। তাইতো দীর্ঘ এই সময়ে এসেও গানগুলো শ্রোতার মনে নতুন ভাবে দোলা দিয়ে যায়।

১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গানে কন্ঠ দেন আন্জুমান আরা। রেডিও-টেলিভিশন ছাড়াও অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দিয়েছেন গুণী এ শিল্পী। আন্জুমান আরা-১৯৬১ সালে হারানো দিন, ১৯৬২ সালে চান্দা ও জোয়ার এলো, ১৯৬৩ সালে তালাশ ও নাচ ঘর, ১৯৬৪ সালে সুতরাং ও মেঘ ভাঙ্গা রোদ, ১৯৬৫ সালে আখরি ষ্টেশন, ১৯৬৭ সালে অভিশাপ, নয়নতারা, আনোয়ারা ও উলবন, ১৯৬৮ সালে আয়না ও অবশিষ্ট, ১৯৬৯ সালে মলুয়া, ১৯৭০ সালে আপনপর, ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানা, ১৯৭৫ সালে বাঁদী থেকে বেগম, ১৯৭৮ সালে অঙ্গার, ১৯৮৪ সালে নতুন পৃথিবী-সহ বহু চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দিয়েছেন। যা মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে। তাঁর গাওয়া চলচ্চিত্রের চির-সবুজ অনেক গানই গাইছেন এ প্রজন্মের শিল্পীরাও।

ব্যাক্তিগত জীবনে আন্জুমান আরা মাসুদ আলম সিদ্দিকী'র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর পুত্র তারিক মাসরুর দ্য ডেইলি ষ্টার পত্রিকার উপ-সম্পাদক এবং কন্যা উমানা এ্যান্জেলিন এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির লেকচারার।

সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে গুণীজন পুরষ্কার এবং ২০০৩ সালে শিল্পী আন্জুমান আরা'কে একুশে পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া তারকালোক পুরষ্কার ও কলধ্বনি পদক পান তিনি।

২০০৪ সালে ২৯ মে আন্জুমান আরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

অশ্রু বড়ুয়া
গীতিকবি, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক
বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top