সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক বর্ণিল ব্যতিক্রমী প্রতিভা

খসে যাওয়া এক তারা- ইরফান খান : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২১:০৪

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:২৯

ছবিঃ ইরফান খান

 

প্রবাহমান সময়ের ছোট্ট ছোট্ট ফাঁকফোকর গলে কীভাবে ঢুকে পড়ে সব অসহায় মুহূর্তেরা, আমরা কেউই তা বুঝতে পারিনা। যে কোন অকাল  মৃত্যুই পরম বেদনার বিষয়। ২০২০-২১ এর করোনর আবহে অকালে চলে গেছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ ও নানান পেশার বরণীয় গুণীব্যক্তিত্ব। সাজানো-গোছানো সংসার, সুখীগৃহ কোণ, প্রিয়জন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। সমাজ-সংসারে-জাতীয় জীবনে তাঁদের উপস্থিতি শুধু আলাদা মাত্রাই যোগ করেনি, নিজেদের উজাড় করে তাঁরা শিখিয়ে গেছেন নতুন করে বাঁচার মানে, শিল্পের হাত ধরে বাঁচার উল্লাস- বর্ণিল আনন্দ। অকালে প্রত্যেকের চলে যাওয়া পরিবার-পরিজন, দেশ-সমাজের কাছে অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু শেষ দেখারও অবকাশ মিলল কই? যাঁদের প্রয়াণে থেমে যাওয়ার কথা মহানগরের প্রশস্ত রাজপথ, যাঁদের সম্মান জানাতে ভিড়ে তৈরি হওয়ার কথা জনঅরণ্য, সেই সব রাজপথ আজ শুনশান। আসলে হানাদার অতিমারি কেড়ে নিয়েছে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের একান্ত ব্যক্তিগত অধিকারও।

গতবছর আমরা এক এক করে হারিয়েছি প্রণম্য সেই সব নানান ধরনের পেশার কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বকে-বাঙালির মননে, চিন্তনে দেশকালের সীমান্তরেখা পেরিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার আলো, তিনি বিশিষ্ট মুক্তমনা সমাজচিন্তক, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক দুই বাংলার সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান। অন্তরিনের সময়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আর রেখে গেলেন বিপুলা এই বর্ণময় পূথিবী। এরপর চলে গেলেন  'তিস্তাপারের বৃত্তান্তের' অমর স্রষ্টা বাঙালির হৃদয়ের মানুষ সাহিত্যিক দেবেশ রায়, আমরা আবার হারালাম বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হরি বাসুদেবনকে, ফুটবলের বরপুত্র প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (পি, কে), চুনী গোস্বামী, জনপ্রিয় চিত্র অভিনেতা তাপস পাল (দাদারকীর্তি, সাহেব, শ্রীমান পৃথীরাজ), সন্ত মুখোপাধ্যায়, জনপ্রিয় সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য (নাচনী, মেমসাহেব), ছোটগল্পকার-উপন্যাসিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় (রসিক)। বাঙালি বারবার জয় করেছে নানা ক্ষেত্রে। তেমনি এক জ্যোতিবিজ্ঞানী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অকালে হারিয়েছি, সেই সাথে হারালাম চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়কেও ('ছোটি সি বাত', 'সারা আকাশ')। তিনি অমর হয়ে থাকবেন দূরদর্শনে জন্য 'বোমকেশ বক্সী' পরিচালনার মাধ্যমে। একে একে হারালাম ঋষি কাপুর, ইরফান খান, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী কবি প্রতিমা ঘোষকে। এ-বছরে এপ্রিলের শেষে হারালাম তরুণ প্রজন্মের এক অসম সাহসী অসাধারণ জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক রোহিত সারদানা (জি নিউজ, আজতক), ডাঃ অরবিন্দ কুমার, বিশিষ্ট ওড়িয়া ও ইংরেজী সাহিত্যিক মনোজ দাস, প্রাবন্ধিক হোসেনুর রহমান এবং আরো বহু গুণী মানুষজন। তালিকা ক্রমশ প্রলম্বিত। কোথাও কমা নেই, নেই পূর্ণচ্ছেদ। খসে যাওয়া তারাদের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু তাঁদের কাজও  দীর্ঘতর। কিছু কিছু মানুষ স্বল্প সময়ে ছাপ-প্রভাব ফেলে যান। তেমনি এক খসে যাওয়া এক তারা ইরফান খান। বিশ্বজুড়ে শুধু মৃত্যুর মিছিল। এক মোহময়ী চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। যে কোনো সময় অচিনপুরের যাত্রী হতে পারি। না ফেরার দেশের মানুষগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তি নন, তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহীরুহ। সেই সব মানুষের প্রতি আমরা নতজানু। 

তাঁকে দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকা- ইরফান খানের অভিনয়ের দাপট এমনই। সামান্যতম চরিত্রে দর্শককে কাঁদিয়েছেন, ভাবিয়েছেন বারবার। বাঙালি ও বাংলা ভাষা মানুষের সঙ্গে তাঁর অমলিন সম্পর্ক কোন দিন হয়তো ভোলার নয়। তিনি ছিলেন বাঙলা ও বাঙালির আত্মার আত্মীয়। ইরফান খানের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন দুই বিদুষী নারী, একজন গর্ভধারিণী মা, অন্যজন সহযোদ্ধা স্ত্রী- বাঙালি কন্যা সুতপা শিকদার।

শৈশব জুড়ে ছিল অস্বচ্ছলতার আঁচ। স্বাধীনতা প্রিয়, সমস্ত ধরনের সংস্কার- প্রথা বিরোধী এক সম্পূর্ণ মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, মনুষ্যত্ব, মানবতা আর শুদ্ধ বিবেক ছিল জীবনের শেষ আশ্রয়ভৃমি। অভিনয়ের ময়দান নিজের করে নিয়েছিলেন শুধু শানিত মেধা আর কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে। ইরফান খানের অভিনয় জ্ঞান, কমিক সেন্সও প্রখর। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তীব্র টান। 'পান সিং তোমর', ‘রুহদার' থেকে শুরু করে ইরফানের 'পিকু' (সত্যজিৎ রায়ের অনন্য সৃষ্টি) বারবার দর্শককে বিশ্বাস করায় যে, প্রতিভা থাকলে সব জয় করা যায়। দুঃখের বিষয় মাত্র ৫৩ টি বসন্তেই জীবন থেমে গেল। তাঁর অকালপ্রয়াণ আজও বড়ো বাজে বুকের মাঝে! করোনার আবহে ঝরে যাওয়া তারারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহীরুহ ও অনন্য, তবু আমার হৃদয়ের মানচিত্রে ইরফান খান যেন এক বর্ণিল ব্যতিক্রমী জীবনশিল্পী- খসে যাওয়া তারা।


একবিংশ শতাব্দীর বলিউডের সেরা অভিনেতা ইরফান খান। সতজিৎ রায়ের অত্যন্ত পছন্দের অভিনেতা, সম্ভাবনাময় জীবনশিল্পী। বছর করোনার আবহে অকাল মৃত্যু হয়েছিল। এ-বছর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হোল একেবারেই আরম্বড়হীন ভাবে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে আবির্ভব। আবার নিঃশব্দে অচিনপুরের যাত্রী হওয়া। একটি মৃত্যু, অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল! আসলে কিছু মৃত্যু মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। তেমনি একজন হলেন ইরফান খান।
এহেন এক জন কিংবদন্তি অভিনেতার অভিনয় জীবনটা শুরু হয়েছিল অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে। মাত্র ২৩৭ টাকার জন্যও এক বার হাত পাততে হয়েছিল তাঁকে! তাঁর প্রত্যেকটা সিনেমাই যেন মানুষকে কিছুনা কিছু অবশ্যই শেখাতো। আজ ভাবলেই কেন জানিনা বিশ্বাস হয়না যে, এই মানুষটা আজ আর আমাদের মধ্যে আর নেই, চলে গেছেন আমাদের ফেলে কত কত দূরে--
সত্যি বলতে কি, গত বছর  এমনি  সময়ে যখন  জানতে পারলাম যে তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই, বিশ্বাস করুন খুবই কান্না পাচ্ছিলো সেদিন। মনে হচ্ছিলো যেন, নিজেরই কোনো এক স্পেশাল মানুষ সারাজীবনের মতো হারিয়ে গেছে।

জনপ্রিয় অভিনেতা সাহাবজাদা ইরফান আলী খানের জন্ম হয় ৭ই জানুয়ারী ১৯৬৭ সালে, রাজস্থানের জয়পুরের অন্তর্গত টঙ্ক জেলায়। তাঁর বাবার নাম ছিলো জাগিরদার খান, যিনি কিনা একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত টায়ারের ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মায়ের নাম ছিলো বেগম খান।
এই “সাহাবজাদা” নামটি ইরফানের বিশেষ পছন্দের ছিলো না, তাই তিনি পরবর্তী সময়ে এসে নামটাকে বাতিল করে দেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর পরিবারের দেওয়া এই পরিচয়টি  তাঁর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে উঠতে পারে এইজন্য।


অভিনয় জগতে আসার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না ইরফান খানের। চেয়েছিলেন ক্রিকেট নিয়েই কেরিয়ার গড়বেন। কিন্তু ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় স্কলারশিপ পাওয়ার পর নিজেকে অভিনেতা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্রতী হন ইরফান।
স্নাতোকত্তর পড়তে পড়তেই তিনি স্কলারশিপ পেয়ে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় পড়তে শুরু করেন। ড্রামাটিক আর্টে তাঁর ডিপ্লোমা রয়েছে। শোনা যায়, এখানে ভর্তির জন্য টাকা যোগার করার পরেও তাঁর দরকার ছিল ২৩৭ টাকা। সে সময় ইরফানের বাবার মৃত্যু হয়েছিল। পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছিলেন তাঁর দাদা। প্রথমে দাদার কাছেই টাকাটা চেয়েছিলেন। কিন্তু দাদা তাঁকে সাহায্য করেননি। তার পর ছোটবেলার এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি গিয়ে হাজির হন ইরফান। কিন্তু সেই বন্ধুও তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর ক’দিন আগে এলে তাঁর কাছে টাকা ছিল, এখন আর নেই। বন্ধুর এই উত্তরে কষ্ট পেয়েছিলেন ইরফান। শেষে টাকার ব্যবস্থা হয় যদিও। তাঁর বোন নিজের জমানো পুঁজি থেকে ইরফানকে সাহায্য করেছিলেন।
মুম্বই শহরে আসার পর কিন্তু তিনি এয়ারকন্ডিশনার সারানোর কাজ শুরু করেন। এমনকি শোনা যায়, প্রথম কাজ হিসাবে তিনি রাজেশ খান্নার বাড়িতে এসি সারাতে গিয়েছিলেন।
ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে পাশ করার পর ইরফান খান মুম্বইয়ে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি টেলিভিশন সিরিয়াল দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেন। যদিও প্রথম দিকে তাঁকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে কাজ পেতে। তিনি প্রথম দিকে পড়ানোর কাজও করেছিলেন।

একে একে অভিনয় করলেন 'চাণক্য', 'ভারত এক খোঁজ', 'সারা যাঁহা হামারা', 'বানেগী আপনে বাত', 'চন্দ্রকান্ত', 'শ্রীকান্ত'। স্টারপ্লাসের ‘ডর’ নামক এক সিরিজের প্রধান ভিলেন ছিলেন ইরফান। এতে তিনি কে কে মেননের বিপরীতে এক সাইকো সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
তাঁর প্রথম কাজ 'সালাম বম্বে' ছবিতে, যেটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তখন তিনি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় শেষ বর্ষের ছাত্র। ছবিটি অ্যাকাডেমি পুরস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিল। ছবিতে তাঁর ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে একটা সমস্যা হওয়ার কারণে তাঁর অংশটি কেটে ছোট করে দেওয়া হয়েছিল।
আশির দশকের শেষে সহপাঠী  হিসেবে সুতপার সাথে আলাপ দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-য়। প্রথম থেকেই ইরফান খান চেয়েছিলেন অভিনেতা হতে। সুতপার ঝোঁক ছিল পরিচালনা এবং সংলাপ লেখায়। পরবর্তী কালে বলিউডে পরিচিত পাওয়ার লড়াইয়ে দু’জনে দু’জনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন ।
পঁচিশ বছরের দাম্পত্যের অনেক আগে থেকেই ইরফান আর সুতপা সহযোদ্ধা। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র দিন যখন শেষ হল, তত দিনে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন এ বার বাকি জীবনটাও থাকতে হবে একসঙ্গেই। থাকতে শুরুও করে দিলেন। দু’জনেই তখন ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
দুই বাড়ি থেকেই মেনে নিয়েছিল তাঁদের সম্পর্ক। ১৯৯৫ সালে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেন তাঁরা। শুধু স্ত্রী নন, সুতপা ছিলেন ইরফানের প্রিয়তম বন্ধু-ও। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কী ভাবে লড়াইয়ের প্রথম দিন থেকে তাঁর পাশে ছিলেন সুতপা। নিজে যে জায়গায় পৌঁছেছিলেন, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্ত্রী সুতপাকেই দিতেন ইরফান।
কেরিয়ারের শুরু থেকেই অনেক কাজ একসঙ্গে করেছেন ইরফান আর সুতপা। ইরফানের ‘মাদারি’ এবং ‘করিব করিব সিঙ্গল’ ছবির প্রযোজকও ছিলেন সুতপা। পাশাপাশি তিনি অন্য ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘শব্দ’ এবং নানা পটেকর, মনীষা কৈরালার সুপারহিট ছবি ‘খামোশি’-র সংলাপ সুতপারই লেখা।
২০০১ সাল হয় সেই বিশেষ বছর, যেই বছর থেকে তাঁর ভাগ্যের চাকা অবশেষে ঘুরতে শুরু করে। সেই বছর তিনি অভিনয় করেন “ওয়ারিয়র” নামের একটা সিনেমায়। ব্রিটিশ পরিচালক আসিফ কাপাডিয়া সেই সিনেমাতে কোনো প্রতিষ্ঠিত হলিউড অভিনেতার খরচ বহন করতে সক্ষম ছিলেন না, তাই অচেনা কোনো প্রতিভাবান অভিনেতা খুঁজছিলেন।
সেই সিনেমা, বাফটায় (British Academy of Film and Television Arts) সেরা ব্রিটিশ ফিল্ম হিসেবে আলেক্সান্ডার কোরডা পুরস্কার পায়। এরপর হলিউডে তাঁর অভিনয় দেখে শোরগোল পরে যাওয়ার পর, তা জানতে পেরে বলিউড কর্তাদেরও তখন টনক নড়ে। একের  পর এক সিনেমার অফার তাঁর কাছে তখন আসতে শুরু করে।
তাঁর অভিনীত বিখ্যাত কিছু বলিউড সিনেমা হলো যথাক্রমে- পান সিং তোমার, লাইফ ইন আ... মেট্রো,হায়দার, দ্য নেমসেক, জাজবা, মাদারি, তলয়ার, বিল্লু, দ্য লাঞ্চবক্স, পিকু, হিন্দি মিডিয়াম, মাকবুল, আংরেজি মিডিয়াম প্রভৃতি।
ইরফান খান অভিনীত 'লাঞ্চবক্স' একমাত্র ভারতীয় ছবি যেটি টরোন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে 'ক্রিটিকস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছিল। একাধিক ব্লকবাস্টার হলিউডি ছবি যেমন-- 'জুরাসিক ওয়র্ল্ড', 'লাইফ অফ পাই', 'দ্য অ্যামাজিং স্পাইডার ম্যান' ও 'স্লামডগ মিলিওনিয়ার'-এ অভিনয় করেছেন ইরফান।
ইরফান খান প্রথম কোনও অভিনেতা যিনি 'লাইফ অফ পাই' ও 'স্লামডগ মিলিওনিয়ার'-এর মতো দু'দুটো অ্যাকাডেমি পুরস্কার জেতা ছবিতে অভিনয় করেছেন।

দাপুটে ও গুণী অভিনেতা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই ছিলেন ইরফান খান। অভিনয়ের জন্য সব সময় নিজের পছন্দের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেন। দুর্দান্ত অভিনয় করতেন। যেসব নির্মাতার ছবিতে অভিনয় করার জন্য তারকারা মুখিয়ে থাকেন, তেমন পরিচালকের ছবিতেও না বলার মতো যোগ্যতা রাখতেন এই অভিনেতা।
হলিউডের আরও অনেক ছবির অফারই ফিরিয়ে দিয়েছেন ইরফান। যেমন- সর্বশেষ বিশিষ্ট পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘রবোপোক্যালিপস’ সিনেমার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন এই ভারতীয় অভিনেতা। প্রস্তাবিত ছবিতে স্কারলেট জনসনের বিপরীতে অভিনয় করার কথা ছিল তার। এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা জানিয়েছিলেন, ‘আমার মনে হয়নি, খুব বেশি সুযোগ ছিল। তাই ছবিটা ছেড়ে দিয়েছি।’
২০১৬ সালে অস্কার বিজয়ী পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের সায়েন্স-ফিকশন ছবি ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন ইরফান খান। এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা জানিয়েছিলেন, সময়ের অভাবেই ছবিটা করতে পারেননি তিনি। তবে নোলানের ছবি না করতে পারার আক্ষেপ ছিল তার। এছাড়া অস্কার মনোনীত ‘দ্য মারশিয়ান’ ছবিওতেও অভিনয়ের সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন ইরফান।
ইরফান খান অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ ছবিতে।
ব্রেন টিউমার নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে লড়াই করছিলেন তিনি। সুস্থ হয়ে 'আংরেজি মিডিয়াম' ছবির মধ্যে দিয়ে কামব্যাকও করেছিলেন।
দু’বছর ধরে তিনি মারণরোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। অথচ তাঁকে দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না যে, কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে অভিনয় চালাচ্ছিলেন তিনি। এতটাই ছিল অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা।
৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি ৫০টির বেশি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-সহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলে গণ্য করেন। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করে।
জীবনের প্রতিটা ধাপে একটু একটু করে এগিয়ে চলার পথে তাঁর মায়ের অবদানের কথাও একাধিক সাক্ষাৎকারে তাকে ব্যাক্ত করতে দেখা যায়। বড় দিদি থাকলেও কী ভাবে মা থাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাও বারংবার স্মরণ করেছেন তিনি।
মা সাইদা বেগম চলে গিয়েছিলেন ৯৫ বছর বয়সে, ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে মায়ের শেষ দর্শন সেরেছিলেন অভিনেতা। ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমেই যোগ দেন অন্ত্যেষ্টিতেও। আর তিনদিন পর ২৯ এপ্রিল, ২০২০ সালে মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুবাই আম্বানি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ইরফান মায়ের সঙ্গে শেষ দেখার হিসাব মিলাতে বড্ড তাড়াহুড়ো করে পাড়ি দিলেন ৫৩ বছর বয়সে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে যেনো নিজের প্রথম সিনেমার মত বিশ্বকে বলে গেলেন ‘সালাম বোম্বে’। বলে গেলেন মায়ের কাছে যাচ্ছি, ‘অ্যাংরেজি মিডিয়ামে’ আর দেখা হবে না কোনদিন।
চলচ্চিত্র হারালো শক্তিমান এক অভিনেতাকে। এখনও সিনেপ্রেমীদের কাছে ইরফান খান মানেই অভিনয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে তার অভিনয় দেখা এখনও বাকি দর্শকদের।
২০২১ সালেই মুক্তি পাবে অভিনেতা ইরফান খানের শেষ সিনেমা ‘দ্য সং অফ স্করপিয়নস’। প্রয়াত অভিনেতা রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী সুতপা শিকদার ও দুই পুত্র বাবিল ও অয়নকে। 



গত বছর ২৯ এপ্রিল ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর হার মানেন ইরফান। এদিন বাবার কথা মনে করে ইরফানের ছেলে বাবিল (Babil Khan) একটি দীর্ঘ পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাবিল নিজের বাবার উদ্দেশে লিখেছেন, ইরফান খান ছিলেন বলিউডের একজন অন্যতম সেরা অভিনেতা। বাবিল লিখেছেন, 'বাবার জায়গা কেউ নিতে পারবেন না'। বাবিলের কথা বলিউডের হাজার হাজার দর্শকও এককথায় মেনে নেবেন। অবশ্যই ইরফান বলিউডের একজন অন্যতম সেরা অভিনেতা।

বাবিল নিজের বাবাকে উল্লেখ করেছেন নিজের, 'সেরা প্রিয় বন্ধু, সঙ্গী, ভাই এবং বাবা'। তিনি লিখেছেন, 'কেমো তোমাকে ভিতর থেকে পুড়িয়ে দিয়েছে, তাই খুশি খুঁজতে তুমি ছোট ছোট বিষয়ে নজর দিতে। নিজের টেবিল তৈরি করা থেকে জার্নাল লেখা। এর মধ্যে একটা পবিত্রতা রয়েছে যা আমি এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি। একটা লেগাসি তৈরি করেছেন আমার বাবা, যার শেষটাও তিনিই। একটা ফুল স্টপ। তাঁর জায়গা কেউ কোনও দিন নিতে পারবেন না।' 

সব কিছুই ছিল, ছিলনা শুধু  ইরফানের শারীরিক   উপস্থিতিটাই যা। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জীবনের সহযোদ্ধা সহধর্মিণী সুতপা শিকদারের ভাবনা ঠিক এই রকম-- 
'ইরফান তুমি নেই নেই ! আমি বিশ্বাস করি না। সময় নাকি সব মুছে দেয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে এনএসডি-তে পড়ার সময় সেই যে ইরফানের সঙ্গে দেখা হল, তারপর থেকে এতগুলো বছরের সব ঘটনা আমাকে ঘিরে থাকে রোজ। কিছুই মুছে যায়নি। অনেকে আমাকে বলেন, ঠিক আছ তো?...এ বার আবার লিখতে শুরু করো। আমাকে উজ্জীবিত করার জন্যই শুভাকাঙ্ক্ষীরা এ কথা বলেন জানি। কিন্তু আমি তো নেতিবাচক মনের ছিলাম না কোনওদিন। আজও নই। ইরফান স্পর্শকাতর ছিল, বিষণ্ণ ছিল, ব্যথাতুর ছিল। সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে হবে জেনেও আমি ইরফানে আচ্ছন্ন সম্পূর্ণ। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি! এত দ্রুত ইরফানের মৃত্যু হবে সেটা আমরা নিজেরাই আশা করিনি। মৃত্যুর দু’ মাস আগে আমরা বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা অবধি করেছিলাম। এ দিকে ইরফান পড়তে শুরু করেছিল নতুন স্ক্রিপ্ট। এক ফুটবল কোচ ট্রেনিং দিচ্ছেন একদল ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ ছেলেদের। টুর্নামেন্টে তারা লড়ে এবং শেষমেশ জেতে। এই কাহিনি থেকে সিনেমা করতে ইরফান খুবই উৎসাহী হয়েছিল।'  -অভিনয় না করতে পারলে পরিচালনা করবে,  এক বছর হলো ইরফান খান আর আমাদের মধ্যে নেই। ইরফানের শেষ কথাগুলোর মধ্যে একটি ছিল, 'মাঝে মধ্যে জীবন আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে নাড়িয়ে দেয়'।

ইরফান বরাবরই ছবির জন্য বিরল গল্প খুঁজতেন। এক বছর আগে মারা গেছেন, তবুও ইরফান যে আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী হয়ে আছেন তার প্রমাণ এ-বছরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ইরফান ছিলেন আলোচনায়, শ্রদ্ধায়, সিনেমায়, পুরস্কারের ঝলমলে আলোয়।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোক গবেষক,প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top