সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


না ফেরার দেশে

কিংবদন্তী সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী: লতা মঙ্গেশকর : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০১:৫১

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১০

ছবিঃ লতা মঙ্গেশকর

 

জীবন যুদ্ধে হেরে চলে গেলেন সুর সম্রাজ্ঞী শ্রীমতী লতা মঙ্গেশকর। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। সংগীত জগতে তারঁ অনুপস্থিতি কখনো পূর্ণ হবে কিনা জানা নেই। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। সশ্রদ্ধ প্রণাম। আজ আমাদের দেশ তথা ভারত বর্ষ একজন নক্ষত্র কে হারাল। ভারতীয় সঙ্গীতে একটা যুগের অবসান।
কিংবদন্তী সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে কার অবদান সবচেয়ে বেশি, এই প্রশ্ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে একটি নমুনা সমীক্ষা করা হয়েছিলো ‘ইন্ডিয়া টু ডে’ পত্রিকার পক্ষ থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাঠক–পাঠিকাদের ভোটের ফলে দেখা গেছে লতা মঙ্গেশকরের নাম সবার শীর্ষে। সেখানে মকবুল ফিদা হুসেন, ভীমসেন যোশী, রাজকাপুর, সত্যজিৎ রায়, এমন কি অমিতাভ বচ্চনের মতো দিকপালেরাও স্থান পেয়েছেন লতার নিচের সারিতে। আড়াই ঘণ্টার একটা ছবিতে গান থাকে মোটামুটি কুড়ি পঁচিশ মিনিট। নারী কন্ঠের গান অর্ধেক সময় অর্থাৎ দশ বারো মিনিট। ঐ সামান্য সময়ে কী অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে লতা মঙ্গেশকর তিন প্রজন্মের শ্রোতাকে মুগ্ধ আবিষ্ট করে রেখেছেন। এমন উচ্চতায় লতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, আজ থেকে শত বৎসর পরেও হয়তো এই উপ মহাদেশের কোনো প্রান্তে কিংবা ইউরোপ আমেরিকায় কাউকে না কাউকে গেয়ে উঠতে হবে লতার গানের কলি। এখানেই সময়কে অতিক্রম করে লতা আজো অনন্যা। সুর ও সঙ্গীতের ভুবনে লতা মঙ্গেশকর এক আশ্চর্য বিস্ময়। জীবন্ত কিংবদন্তী। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী হয়ে রইলেন। লতা মঙ্গেশকরের যুগের যেন শেষ হবে না।
লতা মঙ্গেশকর এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন। এছাড়া ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তারই। লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোর (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর একজন মারাঠি ও কোঙ্কিণী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন। তার মাতা শেবন্তী (পরবর্তী নাম পরিবর্তন করে সুধামতি রাখেন)।
শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অফিসার দে লা দি’অনার’ প্রদান করেছে সে দেশের সরকার।
বোম্বাইয়ের ফিল্মিস্থান কর্ণধার, তৎকালীন এক মুভি – মুঘল শশধর মুখার্জির কাছে সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের হাত ধরে পঞ্চদর্শী কিশোরী লতা গিয়েছিলেন গান গাইবার সুযোগ পেতে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেদিন অসহায় পিতৃহারা কিশোরীকে ফিরতে হয়েছিলো শূন্য হাতে। তেরো বছরের কিশোরী লতাকে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেবার সূত্রে হায়দার লতাকে চিনতেন।
তিনিই নিলেন অনুঘটকের ভূমিকা। গোলাম হায়দারের সঙ্গীত পরিচালনায় লতার রেকর্ডিঙে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দিকপাল সঙ্গীত পরিচালক খেমচন্দ্র প্রকাশ, নৌশাদ এবং অনিল বিশ্বাস। এই তিনজনই লতার সুরেলা কণ্ঠস্বর এবং গায়কীর স্বতঃস্ফূর্তিতে আকৃষ্ট হয়ে সুযোগ দিলেন নিজেদের সুরে গাইবার। শঙ্কর জয়কিষণ বরসাত ছবিতে মিরাকল করে দিলেন। এরপর এদের কাউকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় সকল সুরকারই বাঁধা পড়ে গেলেন লতাকণ্ঠের ফাসে।
ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশ ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ উতলা করে দিয়েছিলো শ্রোতাদের মন৷ পঞ্চান্নয় ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়েছিলো সারা দেশের হৃদয়, সাতান্নতে ‘আজারে পরদেশী’ ডাক দিলো দুনিয়ার সঙ্গীত রসিকদেরকে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর। ক্রমাগত সুপার ডুপার হিট বহু গানের দৌলতে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রী মাথায় তুলে নিলো লতাজীকে। সঙ্গীত পরিচালকদেরও নয়নের মণি হয়ে উঠলেন তিনি।
গানের ভাব অনুযায়ী গায়কীকে তৈরি করে নেবার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল লতার মঙ্গেশকরের। একই ছবিতে তিনজন নায়িকার কণ্ঠে গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, গাইবার ভঙ্গী প্রতিক্ষেত্রেই পাল্টে নিয়ে। নার্গিসের মতো প্রায় প্রৌঢ় নায়িকার কণ্ঠে যিনি মানানসই, সেই লতার কণ্ঠ অবলীলায় মিলে যায় ‘ববি’র কিশোরী ডিম্পলের সঙ্গে। শিশুকণ্ঠের গান, বিরহের বা উচ্ছ্বাসের গান, শিশুকে ঘুম পাড়ান মায়ের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান যাই হোক না কেন সিকোয়েন্সের সব পুরোপুরি মিটিয়ে প্রার্থিত ভাবটি অতি নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন কিন্নরকণ্ঠী লতা।
একবার নৌশাদ বলেছিলেন – ‘লতার মতো সঙ্গীত প্রতিভা আমি আর পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমেই এক একজন আসেন, যাঁর মাথায় ঈশ্বর হাত রাখেন , লতা তেমনই একজন। ‘সাধনা, সংগ্রাম, শৃঙ্খলা, সততা, সঙ্গীতে জীবন উৎসর্গ করার মানসিকতার সঙ্গে স্বকীয় প্রতিভার জোরেই ঈশ্বরের এই আশীর্বাদ পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন লতা মঙ্গেশকর’।
লতা মঙ্গেশকর নিজেকে ফিল্মী গানে এমন অপরিহার্য করে তুলেছিলেন যে, শঙ্কর জয়কিষণ বলতেন ‘লতাজীর হাঁচি হলে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির সর্দি লেগে যায়’। হিন্দী সিনেমার গ্রেট শো – ম্যান রাজকাপুর বলেছেন ‘আমরা সৌভাগ্যবান যে লতার সময় ছবি করতে পেরেছি। এমন প্রতিভা শতাব্দীতে একজন জন্মায় কি না সন্দেহ’।
ত্রিশ হাজারেরও অনেক বেশি গান গাইবার বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী লতা মঙ্গেশকর। বহু গান শিল্পীর নিজের সংগ্রহেই নেই। সম্পূর্ণ তালিকা উদ্ধারই বেশ শক্ত কাজ। ১৯৫৯ সালেই সপ্তাহে গড়ে তিরিশটি করে গান রেকর্ড করতে হয়েছে লতা মঙ্গেশকরকে। একাত্তর সালের মধ্যে আঠারোশো সিনেমায় লতা মঙ্গেশকর রেকর্ড করে ফেলেছেন প্রায় পঁচিশ হাজার গান।
আকাশছোঁয়া খ্যাতির পথে হাঁটতে হাঁটতে অজস্র পুরস্কার সম্মানের মিছিল লতার মঙ্গেশকরের দরজায় কড়া নেড়েছে। কোলাপুর, খয়রাগড়, হায়দ্রাবাদ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট খেতাব (সম্মানসূচক), শঙ্করাচার্যের দেওয়া ‘স্বরভারতী উপাধি, ইলকরঞ্জী প্রদত্ত রাষ্ট্রভূষণ তিরুপতি দেব স্থানমের দেওয়া ‘আস্থাবিদ্বান খেতাব পেয়েছেন। তেইশ বার শ্রেষ্ঠ প্লে – ব্যাক সিঙ্গার পুরস্কার অর্জন করেছেন। মধ্যপ্রদেশ সরকার দিয়েছেন ‘তানসেন পুরস্কার’। লতা মঙ্গেশকরকে ভারত সরকার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ এবং ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।
২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার “ভারতরত্ন” পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর। মধ্যপ্রদেশ সরকার এবং মহারাষ্ট্র সরকার লতা মঙ্গেশকরের নামেই চালু করেছেন লক্ষ টাকার পুরস্কার। কোনো জীবিত ব্যক্তির নামে এমন পুরস্কার ঘোষণার নজির সারা ভারত ও বিশ্বে নেই।
লতা মঙ্গেশকর তার কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯), তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে (১৯৬৯) ভূষিত হয়েছেন। এই সঙ্গীতশিল্পীকে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করেছে। এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯), এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী কালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।

বাংলা গানের উত্তরণে যার নাম বারবার ফিরে আসে, তিনি অবশ্যই সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। 'রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে', এই গান রেডিওতে বাজলে তামাম বাঙালি আবেগপ্লুত হয়ে পড়ে আজও। বাংলা ছবিতে তাঁর গান থাকা মানে সেই ছবি হিট, তা বলাই যেতে পারে। ভাল রেকর্ডার কেনার টাকা সেসময় না থাকলেও মানুষের মনের গভীরে তিনি এখনও একইভাবে বিরাজ করেন। আজও তার গাওয়া গান নিয়েই তামাম বাঙালি ভোরে উঠে রেওয়াজে বসে। 'ভালোবাসার আগুন জ্বেলে কেনও চলে যাও' গেয়ে মঞ্চ কাঁপায় লতা কণ্ঠীরাও। সলিল সেন পরিচিত 'মণিহার' বাংলা ছবিতে সন্ধ্যা রায়ের লিপে মুক্ত হয়ে ঝরে লতার 'নিঝুম সন্ধ্যায়'। কিংবা 'শঙ্খবেলা' থেকে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, 'আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব', লতার এই গান শুনেও মায়বী যাদুতে পথ হেঁটেছে বাঙালি। এছাড়া 'বাঁশি কেন গায়' থেকে শুরু করে 'ও মোর ময়না গাঁও' সব গানেই আলাদা মেজাজে লতা মঙ্গেশকর। ১৯৭৩ সালের বাংলা ছবি সোনার খাঁচায় 'বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি', গানেও তিনি মোহিত করেছেন সবাইকে। বাংলাগানে মেলোডি কুইন তাঁর কণ্ঠ দিয়ে সবাইকেই ভাসিয়েইছেন। তবে তাঁর একটি গান অবশ্য অতিবিখ্যাত না হলেও সময়ের থেকে বেশি এগিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। যে গানটি বেশ অন্যরকম। লতা ভক্তরা গানটিকে সযত্নেই তুলে রেখেছেন। সেটা হল 'প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে "
বিখ্যাত এই গায়িকার গান শুনতে মানুষ কী না করেছেন। নেতাজি ইণ্ডোরে লতার শো হলে অনেক আগেই তার টিকিট হাওয়া হয়ে যেত। এতটাই দ্রুত বিক্রি হত, যে অনেকেই জানতেই পারতেন না। তবে পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্যবার স্টেজ পারফর্ম করেছেন লতা মঙ্গেশকর। গেয়েছেন মুক্ত মঞ্চেও। তখন অনেকেরই দেখার এবং শোনার সাধ মিটিছে।
দশকের পর দশক ধরে তাঁর কন্ঠের সুরেলা ছোঁয়া মন জয় করেছে সকলের। তিনি পেয়েছেন সুর সম্রাজ্ঞীর খেতাব। তাঁর গাওয়া শত শত হিট গানের মধ্যে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘জাগো মোহন প্যায়ারে’ গানটি বেশ খ্যাত। তিনি রাজ কাপুরের ছবির জন্য এই গানটি গেয়েছিলেন। ছবির নাম জাগতে রহো। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া হিট গানগুলোর আলোচনা করতে গেলে এই গানটি আসে সবার আগে। ‘জাগো মোহন প্যায়ারে’ গানটির মিউজিক ডিরেক্টর সলিল চৌধুরী। লতাজির গাওয়ার সেরা গানগুলোর মধ্যে আরও একটি হল ‘আজা পিয়া তোহে প্যায়ার দুন’ গানটি। একবার এই গান প্রসঙ্গে আশা পারেখ বলেছিলেন, ‘এটি আমার সবচেয়ে প্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি।’ গানের সুর দিয়েছিলেন আর ডি বর্মন। ‘আজা পিয়া তোহে প্যায়ার দুন’ গানটি সে সময় এতটাই সফল হয়েছিল যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লতাজির গলায় ‘লগ জা গলে সে’ গানটি শোনেনি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দায়। লতাজির অন্যতম জনপ্রিয় গান এটি। এই গান প্রসঙ্গ লতাজি একবার নিজে বলেছিলেন, তাঁর হতাশার দিনে মন ভালো করে তোলে এই গান। ‘ওহকৌন থি’ ছবির জন্য তিনি এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন।
‘জিস পথ পে চলা উস পথ পে মুঝে আঁচল তো বিছা দে’ ‘ইয়াদগার’ ছবির এই গান বেশ সাফল্য অর্জন করেছিল। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘ইয়াদগার’ সিনেমাটি। এস আর শর্মা পরিচালনায় এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মনোজ কুমার, প্রেম চোপড়ার অভিনেতারা। সে সময় লতাজির কন্ঠে ‘জিস পথ পে চলা উস পথ পে মুঝে আঁচল তো বিছা দে’ গানটি মন ছুঁয়ে গিয়েছিল সকলের।
লতাজির গাওয়া আরও একটি হিট গান হল ‘ছোট সে সারি দুনিয়া কিসিকে লিয়ে ইয়ে মুনাসিব না আদমি কে লিয়ে’। ‘সরস্বতীচন্দ্র’ ছবির গান এটি। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি। সে সময় লতাজির কন্ঠে এই গান বেশ সাড়া ফেলেছিল। লতা মঙ্গেশকের কন্ঠে একটি হিট বাংলা গান হল ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’। এই গান বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িত। গানটির মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন ভুপেন হাজারিকা। আর লিরিক্স পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। লতাজির সুরেলা গলায় এই গান বাঙালি মনকে সব সময় ব্যাকুল করে তোলে। লতাজির গাওয়া আরও একটি বাংলা হিট গান হল ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’। সতিনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এই গানটি গিয়েছিলেন তিনি। গানটি মুক্তি পেয়েছিল বহু দিন আগে। তবে, আজও এই গানের খ্যাতি রয়েছে সর্বত্র। যে কোনও অনুষ্ঠানে বাঙালি কন্ঠে আজও শোনা যায় লতাজির গাওয়া আকাশ প্রদীপ জ্বলে গানটি।
‘প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে’, গানটি নিশ্চয়ই আমরা শুনেছি। এখনও সেরা বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে গানটি। গানটির মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর লিরিক্স গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের। মহব্বতে ছবির হিট গান ‘হাম কো হামিসে চুরালো’। এই গানটি লতাজির গলায় আরও একটি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। এই গানে লতা মঙ্গেশকের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন উদিত নারায়ন। গানটি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া দিল তো পাগল হ্যায় ছবিটি সেরা বলিউড ছবিগুলোর মধ্যে একটি। এই ছবির দিল তো পাগল হ্যায় গানটি মন কেড়েছিল সকলের। লতাজির গাওয়া এই গানটি সেরা গানগুলোর মধ্যে একটি।
১৯৫০ থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক ‘কোকিলকণ্ঠী’র গান মুগ্ধ করেছে দেশবাসীকে। আয়েগা আনেওয়ালা, প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, আল্লা তেরো নাম, কঁহি দীপ জ্বলে – ছ,সাতের দশকে এসব গান জনপ্রিয়তার যে শিখর ছুঁয়েছিল, তা আজও অম্লান। বহু স্বনামধন্য সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন সুরসম্রজ্ঞী। এমনকী বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নিজের তৈরি গান লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক এ আর রহমান নয়ের দশকে ‘দিল সে’ ছবিতে তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ান। ‘জিয়া জ্বলে’ গানটিতে আজও একক এবং অদ্বিতীয় লতা মঙ্গেশকর, তাঁর সুরে বুঁদ করে দেওয়ার জাদুতে।

দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিক ভাবেই সমাদৃত ও প্রাসঙ্গিক লতাজিরগান। তাঁর গান ভারতবাসীর এক আকাশ অহংকার। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা -যমুনা- কাবেরি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, সময় পাল্টেছে, রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে দর্শকদের মানসিকতা পালটে থাকলেও আজও লতাজির গান এখনও ঝড় তোলে ভারতের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মধ্যে। সময়ের মালিন্যে কোন দিন গ্রাস করতে পারবে না তাঁর কালজয়ী গানের কলি।এক রোমান্টিক জগতে নিয়ে যায় তার সুরেলা কিন্নর কন্ঠী। আমাদের শৈশব কেটেছে লতাজির গান শুনে।আজো নতুন প্রজন্মের তরুন-তরুণীদের কাছে তাঁর গান মাদকতা সৃষ্টি করে। দেশ-কালের সীমারেখা মুছে দিয়ে তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে। দুই বাংলার বাঙালির প্রাণের সমস্ত উৎসব জুড়ে অন্যদের সঙ্গে লতাজির গান সমানভাবেই সমাদৃত। আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র লতা মঙ্গেশকর, শুধু এ- প্রজন্মেরও অনেক শিল্পীর অনুপ্রেরণা ও প্রেরণাভূমি তিনি। স্বর্ণযুগের এই কালজয়ী এই কন্ঠ শিল্পী সবছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। দৈহিক ভাবে তাঁর মৃত্যু হলেও আত্মিক ভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন উপমহাদেশের সঙ্গীত প্রেমিক মানুষের হৃদয়ে চিরদিন। 'আকাশ প্রদীপ জ্বলে,’ ‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে' এই কালজয়ী গান দুটি কোন দিন ভুলতে পারবেনা সমস্ত বাঙালি। এক নস্টালজিয়া আজো আচ্ছন্ন করে রাখে। চিরদিন লতা মঙ্গেশকরকে বাঙালি মনের মণিকোঠায় অমর করে রাখবে।

তথ্যসূত্রঃ আনন্দ বাজার পত্রিকার আর্কাইভস, ইন্টারনেট

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, ছোটগল্প, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ কাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top