সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


নিউজিল্যান্ডে গণভোট: স্বেচ্ছামৃত্যু হাঁ, গাঁজায় না : মু: মাহবুবুর রহমান


প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০২০ ২১:৫৬

আপডেট:
২ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৯

 

যে দেশে কোনো অপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান নেই সেই নিউজিল্যান্ডে স্বেচ্ছায় মৃত্যু বৈধতা পেলো। গত ১৭ই অক্টোবর নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। একই দিন দেশটিতে ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ এবং বিনোদনের জন্য ‘গাঁজা’র ব্যবহার বৈধ করার ব্যাপারেও অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। সেই গণভোটের ফল পাওয়া গেলো ৩০ অক্টোবর। যাতে দেখা যায়, ৬৫ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ মানুষ গাঁজাকে বৈধতা দেয়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ স্বেচ্ছামৃত্যুতে হাঁ আর গাঁজা সেবনকে না বলে মত দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডাররা ।  

বিশ্বের ৭ম দেশ হিসাবে নিউজিল্যান্ডে কার্যকর হবে স্বেচ্ছামৃত্যু: 

স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া নিয়ে যুক্তি - পাল্টা যুক্তি বিশ্ব জুড়ে চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ইউথেনেশিয়ার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে তেমনি বিপক্ষেও যুক্তি কম নয়। ‘ইউথেনেশিয়া’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘ইউ' (eu) এবং ‘থানাতোস' (thanatos) থেকে এসেছে। ‘ইউ' অর্থ ভালো বা সহজ বা মঙ্গল জনক এবং ‘থানাতোস' মানে মৃত্যু । তবে ‘ইউথেনেশিয়া’র বাংলা করা হয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইচ্ছামৃত্যু।  

"জন্মিলে মরিতে হইবে" - এটি অমোঘ সত্য।   আমরা সবাই চাই আমাদের মৃত্য হোক যন্ত্রনাবিহীনভাবে।  কিন্তু যে মানুষটি রোগে ভুগতে ভুগতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে তাঁর জীবন যখন আর কারো কাজে লাগেনা , এমনকি নিজের কাজেও লাগেনা; উল্টো নিজেকে প্রতিদিন পরমুখাপেক্ষী হয়ে অসহায় জীবন যাপন করতে হয়, তখন রোগীর ইচ্ছায়, তাকে সসম্মানে পৃথিবী থেকে বিদায় জানাবার ব্যবস্থাই হল ইউথেনেশিয়া। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো নিউজিল্যান্ডে জাতীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে এক আবেগী বিতর্কের বিষয়  স্বেচ্ছামৃত্যুর স্বীকৃতি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিউজিল্যান্ডবাসী। ইউথেনেশিয়াকে স্বীকৃতি দিল দেশটির মানুষ। আগামী বছর নভেম্বর থেকে মৃতপ্রায় মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যু বেছে নিতে পারবেন দেশটিতে। বিলটি আইনে পরিণত হলে নিউজিল্যান্ডে দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি যাদের বড়জোর ছয় মাস বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে চিকিৎসকরা ধারণা পোষণ করেন, তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারবেন। তবে তাতে অবশ্যই চিকিৎসকদের অনুমোদন লাগবে। যদিও স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনটিতে সব পক্ষকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ বিরোধীদের। 

নিউজিল্যান্ডে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইন ‘এন্ড অব লাইভ চয়েস অ্যাক্ট ২০১৯’ বিল আকারে উপস্থাপন করা হয় গত বছর।  এর আগে নিউজিল্যান্ডের ম্যাট ভিকারস ও লেক্রেটিয়া সিলস দম্পতি স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে বিতর্কটি সামনে আনেন। স্বামী ম্যাট ভিকারসের সহায়তায় স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য আদালতে আবেদন করেন ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত আইনজীবী লেক্রেটিয়া সিলস। লেক্রেটিয়া সিলস তার মামলা জিতেননি এবং তার পরিবার ওয়েলিংটন হাইকোর্টের কাছ থেকে নেতিবাচক রায় পাওয়ার পর ২০১৫ সালে ৪২ বছর বয়সে মারা যান লেক্রেটিয়া। পরে ভিকারস স্বেচ্ছামৃত্যু আন্দোলন চালু রাখেন। 'লেক্রেটিয়া’স চয়েস : আ স্টোরি অব লাভ, ডেথ অ্যান্ড দ্য ল’ নামে একটি বইও লেখেন ভিকারস। 

নিউজিল্যান্ডে এন্ড অব লাইভ চয়েস অ্যাক্ট কার্যকর হলে গুরুতর অসুস্থ এবং ৬ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মারা যেতে পারেন এমন ব্যক্তিরা চাইলে স্বেচ্ছামৃত্যু বেঁছে নিতে পারবেন। অর্থাৎ, আগামী বছরের শেষ থেকে নিউজিল্যান্ডের মানুষ ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে পারবেন। তবে সকলে নয়। আইনসভা জানিয়েছে, কেবল মৃতপ্রায় ব্যক্তিরাই এই আইনের সহযোগিতা নিতে পারবেন। দুজন চিকিৎসক ওই ব্যক্তিকে পরীক্ষা করবেন এবং রোগীর স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়ে চিকিৎসকদেরও সম্মতি লাগবে। তবে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনকারীকে অবশ্যই নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী বা অভিবাসী হতে হবে।   

৩০ অক্টোবর ঘোষিত গণভোটের প্রাথমিক ফলে প্রবাসীসহ আনুমানিক ৪ লাখ ৮০ হাজার ভোটারের রায় যুক্ত হয়নি; এগুলো যুক্ত হলে ভোটের শতকরা হিসেব সামান্য এদিক ওদিক হলেও তা স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধতার পক্ষে থাকা গণরায় পাল্টাতে পারবে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন এবং বিরোধীদলীয় নেতা জুডিথ কলিন্স দুজনই স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছামৃত্যুর গণভোটের ফলাফলকেও সমর্থন জানিয়েছেন জেসিন্ডা আরডর্ন । 

আগামী বছরের নভেম্বর থেকে নিউজিল্যান্ডে ‘এন্ড অব লাইফ চয়েজ’ আইনটি কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেরকম হলে নিউ জিল্যান্ড স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ এমন স্বল্প সংখ্যক দেশের তালিকায় যুক্ত হবে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৬ টি দেশ স্বেচ্ছামৃত্যুকে পূর্ণাঙ্গ বৈধতা দিয়েছে। দেশগুলো হলো সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, কলম্বিয়া ও কানাডা। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (কিছু প্রদেশ), অস্ট্রেলিয়া (কিছু প্রদেশ) সহ আরো অনেকগুলো দেশে স্বেচ্ছামৃত্যুর আংশিক বৈধতা রয়েছে।   

এবার আসি বাংলাদেশ ও ভারত প্রসঙ্গে।  বাংলাদেশে স্বেচ্ছামৃত্যু নিষিদ্ধ, কারণ ইসলামে এটাকে অবৈধ বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে ‘জীবনের অধিকার’ (Right to Life) কে আইনগত মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও স্বেচ্ছামৃত্যুকে  স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বাংলাদেশে দেশীয় আইন অনুযায়ী গর্ভপাত বৈধ।  আর ভারতে ২০১৮ সালে পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটবে তিনি নিজে এক্ষেত্রে কোনো ধরনের মত রাখতে পারবেন না। বস্তুত মতামত রাখার মতো অবস্থায় যদি তিনি থাকেন, তবে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত হবেও না। একমাত্র কোমা বা ভেজিটেটিভ পর্যায়ের কোনো রোগীর আত্মীয় আবেদন জানালে বিশেষ মেডিক্যাল বোর্ড এবং রাজ্য সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী হাই-কোর্টের অনুমতি নিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটানো যেতে পারে। এই মৃত্যুও হবে কোনো অভ্যাসরত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই। পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের বক্তব্য ছিল এরকম, 'সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু মানুষের অধিকার।' 

 

নিউজিল্যান্ডে বিনোদনের জন্য গাঁজার ব্যবহার কার্যকর হচ্ছে না: 

নিউজিল্যান্ডে ১৭ই অক্টোবর অনুষ্ঠিত গণভোটে বিনোদনের জন্য গাঁজার ব্যবহার বৈধ হবে কিনা, সে প্রসঙ্গে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। প্রাথমিক ফলে গাঁজা বৈধকরণের ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ ভোট পড়তে দেখা গেছে। পক্ষে পড়েছে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। তবে প্রবাসীসহ পোস্টাল ভোট গণনার পর এই ফলাফল বদলেও যেতে পারে। 

সদ্য পুন:নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন তার নির্বাচনি ইশতেহারে মানসিক প্রফুল্লতার জন্য গাঁজা সেবনকে বৈধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে বিরোধী দলীয় নেতা জুডিথ কলিন্স অবশ্য নিউজিল্যান্ডে গাঁজা বৈধ করার বিপক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।  তাঁর মতে গাঁজা সেবনে দেশের যুবসমাজের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।  

বিশ্বের কিছু দেশ যেমন কানাডা, মেক্সিকো, উরুগুয়েতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গাঁজা সেবন বৈধ। আর এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে গাঁজা বৈধ করেছে থাইল্যান্ড। 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top