সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


জো বাইডেনের অভিষেকে কবি আমান্ডা গোরম্যানের ইতিহাস : মু: মাহবুবুর রহমান


প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:৩৩

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২৩:৫০

ছবিঃ কবি আমান্ডা গোরম্যান

 

২০১৭ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ পোয়েট লরিয়েট’ নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন ২০৩৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। আর এবার মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী (২২ বছর) কবি হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে গড়লেন ইতিহাস। বলছি কৃষ্ণাঙ্গ কবি আমান্ডা গোরম্যান এর কথা। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্র এখন আলোচনা এই তরুণ কবিকে নিয়ে।   

মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে এর আগে রবার্ট ফ্রস্ট, মায়া অ্যাঞ্জেলু এবং রিচার্ড ব্লাংকোর মতো খ্যাতিমান কবিরা কবিতা আবৃত্তি করেছেন। কিন্তু মাত্র ২২ বছর বয়সেই অভূতপূর্ব এই সম্মান পেয়ে লস অ্যাঞ্জেলসের কবি এবং অ্যাকটিভিস্ট আমান্ডা গোরম্যান পারফরম করলেন তাঁর নিজের লেখা কবিতা ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ (The Hill We Climb)। তাঁর ৫ মিনিটের কবিতা আবৃত্তির সময় অবাক, স্তব্ধ ছিল পুরো ক্যাপিটল ভবন। পিনপতন নীরবতায় যেন তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ গেঁথে যাচ্ছিল সব দর্শক শ্রোতার মনে।

আমান্ডা যখন কবিতা আবৃত্তি করছিলেন তখন তাঁর দুই পাশে বসে ছিলেন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে, সহজাত ভঙ্গিতে, হাত নাড়িয়ে কবিতা পড়ে যান আমান্ডা গোরম্যান। বাইডেনের বক্তব্যের মতোই বার্তা প্রকাশ পায় আমান্ডার নিজের লেখা কবিতায়। কবিতার পংতিমালায় আমেরিকাকে পুনর্নির্মাণ, পুনঃসংস্কার ও পুনরুদ্ধারের কথা বলেন তিনি। কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পায় আমেরিকা ও এর মানুষের সৌন্দর্যগাথা। আর জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে ‘ঐক্য ও একতার’ ডাক দিয়ে প্রশংসার সাগরে ভাসছেন আমান্ডা।

অনুষ্ঠানে ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ কবিতার মাধ্যমে আমান্ডা উচ্চারণ করলেন-

“যখন দিন আসে, আমরা নিজেদের কাছে জানতে চাই
এই অন্তহীন অন্ধকারে কোথায় পাবো আলো?”

এখানে তিনি ৬ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে ভয়াবহ নৃশংসতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আমান্ডা আবৃত্তি করলেন –

“সেই শক্তিকে দেখেছি আমরা, 
যা আমাদের দেশকে সবার মধ্যে বিলিয়ে না দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে 
গণতন্ত্রকে বিলম্বিত করার মাধ্যমে দেশকে ধ্বংস করে দেবে।”

বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে তার সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবনে যে নৈরাজ্য, তান্ডব লীলা চালিয়েছে সেসব নিজের কবিতায় তুলে ধরেন আমান্ডা। তার কণ্ঠ ছিল তেজোদীপ্ত। ট্রাম্প সমর্থকরা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে ক্যাপিটল ভবন দখলের যে চেষ্টা করেছিলেন তা নিয়ে আমান্ডার দৃপ্ত উচ্চারণ-

“সেই প্রচেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল প্রায়
কিন্তু গণতন্ত্রও পর্যায়ক্রমিকভাবে বিলম্বিত হতে পারে 
তাই বলে গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে পরাজিত করা যায় না কখনো।”

নিজের এই কবিতায় আমান্ডা নিজেকে পরিচয় দেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসেবে। তিনি বলেন-

“দাসদের মধ্য থেকে উঠে আসা পাতলা গড়নের কৃষ্ণাঙ্গ এক মেয়ে, 
যাকে তার মা একাই লালন-পালন করেছেন, 
যার স্বপ্ন একদিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার; 
যে আজ এক প্রেসিডেন্টের জন্য আবৃত্তি করছে।”

সবশেষে আমান্ডা উচ্চারণ করলেন 

“সর্বদাই আলো আছে, 
যদি কেবল তা আমরা দেখতে যথেষ্ট সাহসী হই
যদি কেবল আমরা নিজেদেরকে তার ভিতর সপে দেই।”

আমান্ডার শব্দ চয়ন, আবৃত্তির দ্যুতি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য মূল শপথ অনুষ্ঠান থেকে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল উপস্থিত অতিথি ও অনলাইনে লাইভ অনুষ্ঠান দেখা বিশ্ববাসীর। অভিষেক অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার পর অনুভূতি প্রকাশে কবি আমান্ডা বলেন, “কবিতা পড়ার সময় এবার যেটা করেছি আমি, আমার চোখ বন্ধ করলাম এবং বললাম, আমি কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের মেয়ে। আমরা এসেছি আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের কাছ থেকে, যারা শিকল ভেঙে ফেলেছিল এবং পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল।”

যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে জন্ম নেয়া সিঙ্গেল মাদারের সন্তান আমান্ডা ছোটবেলা 'কথা বলতে ভয় পাওয়া' রুগী ছিলো, জড়তা আর তোতলামি এসে যেতো বক্তব্য শুরু করলে। কিন্তু শৈশব থেকেই সে কবিতা লিখতে পছন্দ করতো। জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে তরুণ কবি একটি আংটি পরেছিলেন অলংকার হিসাবে যাতে খাঁচার মাঝে একটি পাখীর ডিজাইন ছিলো। এটিকে অনেকে বাক স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কবিতা আবৃতির সময় অ্যামান্ডা প্রাডার ডিজাইনের 'হিমু' হলুদ স্যুট ও লাল রঙের চে গুয়েভারার ইন্সপাইরেশনের ‘ক্যাপ’ পড়েছিলেন। 

শপথ অনুষ্ঠানে আমান্ডার কবিতার প্রশংসায় টুইট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, আরেক সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন, মার্কিন উপস্থাপক ও অভিনেত্রী অপরাহ উইনফ্রেসহ আরো অনেকে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন তো আমান্ডার কবিতার ভক্ত। তিনিই এই তরুণ কবিকে বেছে নেন প্রেসিডেন্টের অভিষেকে কবিতা পাঠ করার জন্য।

জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদানের আগে কবিতার বিষয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, “আমি আসলে আমার কবিতায় একতা, সহযোগিতা এবং একত্রিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন  শব্দের ব্যবহার করেছি। কবিতাটির মাধ্যমে আমি সবাইকে একত্রিত করার এবং বিভাজনকে অতিক্রম করার বার্তা দিতে চেয়েছি। আমি মনে করি এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন অধ্যায় এবং তা ভবিষ্যতের জন্যও।” আমান্ডা জানান, যখন তাঁকে বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে  আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন খুশিতে তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি আরো জানান যে, শপথ অনুষ্ঠানের কবিতাটি একদম নতুন লেখা একটি কবিতা। এই অনুষ্ঠানের জন্যই তিনি কবিতাটি লিখেছেন বলে উল্লেখ করেন আমান্ডা।

ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে জন্ম নেয়া কবি আমান্ডা  কাব্যচর্চায় যুক্ত হয়ে অল্প বয়সেই সুনাম অর্জন করেন। পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৫ সালে তাঁর কবিতার বই ‘দ্য ওয়ান ফর হুম ফুড ইজ নট এনাফ’ প্রকাশিত  হয়।  ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় যুব কবির সম্মান পান তিনি। এর আগে ২০১৪ সালে একই সম্মান পান লস অ্যাঞ্জেলস গভর্নর থেকে। শিশুদের জন্য তার লেখা  প্রথম বই ‘চেঞ্জ সিংস: অ্যা চিলড্রেনস অ্যানথেম’ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হবে বলে জানা গেছে। তিনি শুধু কবি নন, একজন সমাজকর্মীও। বর্ণবিদ্বেষ ও নিপীড়ন বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন আমান্ডা।

আমান্ডা গোরম্যান যদি তার স্বপ্নের পথে অবিচল থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানের কবিতা তিনি নিজেই আবৃত্তি করবেন। কারণ ২০১৭ সালেই আমান্ডা জানিয়েছিলেন, ২০৩৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চান।

 

মু: মাহবুবুর রহমান 
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top