সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু (পর্ব ১) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৬ জুলাই ২০২০ ২৩:০৯

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ২২:৪২

ছবিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

 

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত আকস্মিকভাবে ঘটেনি। আধুনিককালের অন্যান্য সক্রিয় আন্দোলনের মত এরও একটি পশ্চাদভূমি ও মানসিক প্রস্তুতির পটভূমিকা ছিল। যদিও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন সক্রিয়ভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে, তথাপি দেশ বিভাগে পূর্বেই বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে সচেতন মানসিকতার পরিচয় নিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক পত্র-পত্রিকা এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্রসমূহ বাঙালী মুসলিম লেখক সমাজের এক সচেতন প্রয়াসের স্বাক্ষর বহন করে চলেছিল।

লাহোর প্রস্তাবের পর পাকিস্তান সৃষ্টিই এই উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের আন্দোলনের একমাত্র বিষয় ছিল। ধর্মীয় উন্মাদনা পাকিস্তান প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশসমূহের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান ও ভাষাগত পার্থক্যকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। অবশ্য শিক্ষিত সমাজ যে এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না তা নয়। স্বাধীনতা আস্বাদনের সম্ভাবনা নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা নীরব ছিলেন মাত্র।

১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষণার পর ভাবী পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যার সাথে সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। আলোচনা কতকটা উত্তেজনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। কারণ শতকরা ৫৬ জন লোকের মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চক্রান্তের কথা ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। বাঙালী লেখকবৃন্দ এ বিষয় নীরব থাকতে পারেননি। তারা এ অশুভ প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বিরোধিতাপূর্ণ যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন। বাংলার সপক্ষে তারা দৈনিক, মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় জোরালো প্রবন্ধ লিখে প্রচার কার্য চালিয়ে যান। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ' ও ‘দৈনিক আজাদ' এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালী মুসলমানদের ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটতে পারে সে বিষয়ে বাঙালী শিক্ষিত সমাজ অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাঙালী মুসলমানগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তাহলে সরকারী চাকরি, ব্যবসা ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে উর্দুভাষীরা অগ্রাধিকার পাবে এবং আস্তে আস্তে বাঙালীদেরকে গ্রাস করে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে। এর অর্থই হল বাঙালী সত্তার সমাধি, অন্য কথায় পূর্ব পাকিস্তানবাসীদেরকে পুনরায় পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধকরণ। তাদের এই আশংকা যে অমূলক ছিল না, পরবর্তীকালে রক্তাক আন্দোলনের ফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও পঁচিশ বছরের পাকিস্তানী রাজত্বই তার প্রমাণ দিয়েছে।

সেদিন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাঙালীরা ভাষার প্রশ্নে যে স্বাতন্ত্রবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেটাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকাই জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের প্রথম সোপান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

প্রতিবাদ ও ভাষাবিক্ষোভ থেকে ভাষা আন্দোলন। এ পর্যায়ে ছোটবড় প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় কখনও ছেদ পড়েনি, যা শেষ পর্যন্ত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিস্ফোরক চরিত্র অর্জন করে। ভাষার দাবিতে প্রথম সংগঠিত আন্দোলন শুরু ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এ আন্দোলনেরও উপলক্ষ তৈরি করে পাক শাসকগোষ্ঠী। কারণ পাক গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেসসদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৩ ফেব্র“য়ারি গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব আনেন। কিন্তু মুসলিম লীগের বাঙালি-অবাঙালি সদস্যদের বিরোধিতায় সে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এ প্রস্তাব সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের বিরোধিতার ভাষা ছিল রাজনৈতিক বিচারে আপত্তিকর।

এ ঘটনায় ঢাকার ছাত্রসমাজে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষায়তনের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। এ পর্যায়ে ছাত্রদের আবেগ ছিল লক্ষ করার মতো। সে আবেগের টানে সংঘটিত সভা, মিছিল, শ্লোগান ও কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য বৈঠক ইত্যাদি শেষে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ১১ মার্চ (১৯৪৮) দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

এ কর্মসূচিতে প্রাধান্য পায় পিকেটিং। কর্মসূচি সফল করার উদ্দেশ্যে ২ মার্চ ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। এবার আহবায়ক শামসুল আলম। এ সংগ্রাম পরিষদেও ছিল মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন মত ও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও এতে ছিল তমদদ্দুন মজলিসের প্রাধান্য।

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিমাফিক ঢাকায় সচিবালয়ের বিভিন্ন গেট, পলাশি ও নীলক্ষেত ব্যারাক, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এবং রমনা পোস্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন শামসুল হক, নঈমুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, আজীজ আহম্মদ প্রমুখ। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাও এতে অংশ নেয়।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন জেলে।

১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু কতিপয় সহকর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগের গোড়াপত্তন করেন। ঐ একই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। তখন এ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সাহসীকর্মী ও সংগঠকরূপে আবির্ভূত হন।

ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে সম্প্রতি কথা বলা হচ্ছে। বাঙলা একাডেমী কর্তৃক ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ‘একুশে  ফেব্রুয়ারি স্মৃতিচারণ' নামক পুস্তিকায় জনাব মোহাম্মদ তোহা লিখেছেন, “১৯৪৮ সালের ১৭ জানুয়ারি তারিখে ছাত্রদের উত্তেজিত করে দেশের লাঠি-পেটা খাওয়ানো ছাড়া শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলনে আর কোন ভ‚মিকা ছিলনা। এ প্রসংগে বদরুদ্দীন উমর লিখিত বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি শীর্ষক বইটির বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের অবদানকে শুধুমাত্র খাটো করে দেখবার প্রয়াসই লক্ষণীয় নয় বরং সেখানে অশালীন ও অভদ্রভাবে শেখ মুজিবকে আক্রমণ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এসব কথা মনে রেখে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভ‚মিকা নিরূপণের জন্য বিষদ আলোচনা করা হোল।

পাকিস্তান সৃষ্টি হবার সাথে সাথেই যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এমন নয়। অন্যান্য আন্দোলনের মতো ভাষা আন্দোলনও হঠাৎ করে একদিনে গড়ে ওঠেনি । এর পেছনে আছে বিস্তৃত প্রস্তুতি ও ইতিহাস। বস্তুত দেশ ত্যাগের পূর্বেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চলছিল।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্ট ব্যাটনের কল্পনায় দেশ বিভাগের ঘোষণার পর ভাবী পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যার সংগে ভাষার এসে যায়। কেননা, তখন এদেশের বুদ্ধজীবীরা বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের করা ৫৬ জন লোকের মুখের ভাষা বাংলাকে দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা উর্দুকে একমাত্র ভাষা করা হচ্ছে। মুহম্মদ আবদুল হকের বাংলাভাষা বিষয়ক প্রস্তাব' শীর্ষক প্রবন্ধে গত গণতন্ত্রের সপক্ষে বক্তব্য পেশ করা হয়। ঐ সময়ে সাপ্তাহিক মিল­াতের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “একটি দেশকে পুরোপুরি দাসত্বে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের যত রকম অস্ত্র আছে, তারা মধ্যে সবচাইতে ঘৃণ্য ও মারাত্মক অস্ত্র হইতেছে সেই দেশের মাতৃভাষার পরিবর্তে একটি বিদেশী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা। মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব এই ঘৃণ্য দাসত্বের শৃংখলে বাঁধিতে কেউ যদি বাসনা করে, তাহা হইলে তাহার সেই উদ্ভট বাসনা বাঙালির প্রবল জনমতের ঝড়ের তোড়ে তৃণখন্ডের মত ভাসিয়া যাইবে।'

দৈনিক আজাদ এক সম্পাদকীয়তে এই অভিমত প্রকাশ করেছে, “যে দিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার দাবীই সবচেয়ে বেশী।”

ডঃ এনামুল হক লিখলেন ঃ “উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানীর মরণ, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দু-ওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র, যেমন—ভারত ছিল ইংরেজী রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র। কাজী মোতাহার হোসেন উর্দুকে চাপিয়ে দেবার বিরোধিতা করে বললেন, “শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে।” ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষারূপে উর্দু গ্রহণ করার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, “ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।”

বুদ্ধিজীবীদের এসব বিবৃতি ও প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে গণ আজাদী লীগ গঠিত হয়। আশু দাবিতে বলা হয়  “বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাস্তিানের রাষ্ট্রভাষা।” গণ আজাদী লীগের সংগে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে এসে এই জাতীয় আন্দোলনের সমর্থন জানালেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে উগ্র ইসলামপন্থীদের অনেকেই নানাবিধ কারণে বাংলা ভাষার সপক্ষে জোরালোভাবে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে তমদ্দুন মজলিশের কর্মকর্তা ও কর্মীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব এই মজলিশকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থনদান করেন।

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র এবং অধ্যাপকের উদোগে নিজেদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়। এই মজলিশ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা না উর্দু' শীর্ষক একটি পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য জোরালো ভাষায় বক্তব্য পেশ করেন এবং প্রয়োজনবোধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে আহবান জানান। উক্ত পুস্তিকার প্রবন্ধগুলোতে নানা যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা হয় যে, বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত।

পরবর্তীকালে এই তমদ্দুন মজলিশ যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, তবু ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুসলিম সংস্কৃতি বলতে যে আরবীয় সংস্কৃতির চিন্তা এদের মনে ছিল, বাংলা জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকট হবার সাথে সাথে তার সাথে তাদের গরমিল দেখা দিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে এরা আর সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। যা হোক, ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিশের উদ্যেঅগে ফজলুল হক হলে ভাষার প্রশ্ন আলোচনার জন্য এক সভার আয়োজন করা হয। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। সভায় যারা বক্তৃতা করেন তাদের মধ্যে ছিলেন কবি জসিম উদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কাশেম এবং কয়েকজন মন্ত্রী। এ সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান করাচীতে বসে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এতে বাংলা ভাষাভাষীদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ফলে মজলিশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালীরা  একাত্মবোধ করে। তারা আস্তে আস্তে ইউনিভার্সিটির নিকটস্থ মজলিশের অফিসে আসতে শুরু করে। “এই অফিসেই মজলিশ কর্মীদের এক বৈঠকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তদানীন্তন মজলিশ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নূরুল হক  ভূঁইয়া সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কনভেনর নির্বাচিত হন।”

(সৈনিক, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩, শহীদ সংখ্যা, পৃঃ ৫-৬)

 

এই সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা প্রথমে ফজলুর রহমানরে সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে এক তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রী কর্মীদের সঙ্গে কতকটা অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করেন।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উক্ত সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষার দাবি জ্ঞাপন একটি স্মরকলিপিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে এবং কয়েক হাজার স্বাক্ষরসহ সেটি সরকারের নিকট প্রেরিত হয়। এ ব্যাপারে অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবও অক্লান্ত পরিশ্রমে ব্রতী হন।

 

“১৯৫১ সনে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা কালেই স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন” মণিসিংহ, মার্চ ১৭, ১৯৭৩।

সূত্র ঃ দৈনিক সংবাদ, মার্চ ১৮, ১৯৭৩।

 

অতঃপর সংগ্রাম পরিষদের এই আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। সরকারের এই হীন প্রচেষ্টার বর্ণনা দিতে গিয়ে ১৯৫৩ সালের শহীদ সংখ্যা (২১শে ফেব্র“য়ারী) ‘সৈনিক' লিখেছে ঃ

“আন্দোলন এইভাবে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে ইহাকে মূলেই পণ্ড করিয়া দিয়া ইহার মধ্য দিয়া স্বার্থোদ্ধারের জন্য জোর চেষ্টা হইতে থাকে। এই সময় বড় বড় বক্তৃতা দিয়া মোহাম্মদ আলী সাহেব, তোফাজ্জল আলী সাহেব ও নসরুল্লাহ সাহেব প্রভৃতি এমএলএ বাংলাভক্ত হইয়া ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হইয়া উঠেন।

তৃতীয় আর একদল এই আন্দোলনকে স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য, ইহারা কমবেশি ছাত্র ফেডারেশনের সভ্য ছিল।  

এইভাবে সরকারী গুপ্তচর, মন্ত্রিত্বলোভীরা এবং তথাকথিত প্রগতিশীলরা একজোট বাঁধিয়া ভাষা আন্দোলনকে স্যাবেটোজ করার কাজে লাগিয়া যায় এবং নানারূপ অবান্তর প্রচার করিয়া জনমত বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করে। অনেক এমএলএ বড় বড় কথা বলিয়া নেতা হইয়াছেন এবং তাহারা আন্দোলনের সুযোগে রাষ্ট্রদূতের পর বা মন্ত্রিত্ব লাভ করেন (জনাব মোহাম্মদ আলী ও জনাব তোফাজ্জল আলী সাহেব)। ইহারাই মন্ত্রিত্ব পাইয়া প্রকাশ্যভাবে বাংলার বিরুদ্ধাচরণ করিতেও লজ্জাবোদ করেন নাই।”

(সৈনিক, শহীদ সংখ্যা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩, পৃঃ ৫-৬)

এদিকে প্রগতিবাদী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যুবকগণ কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগ এই দুই যুব প্রতিষ্ঠান গঠন ও যুব সমাজে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার অধিকার অর্জনের প্রয়াসে অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব ছিরেন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা।

প্রতিষ্ঠার স্বল্পকারের মধ্যেই ছাত্রলীগ দু'টো দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহ আজিজুর রহমান এই দলটিকে মুসলিম লীগের লেজুর হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং এরমধ্যে সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে প্রাধান্য দেবার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক নীতির উপাসক শেখ মুজিব এতে বাধ্য প্রদান করেন এবং পরিণামে এই দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব, আজিজ আহমদ, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ব্যক্তির নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' বলে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এর আহবায়ক নির্বাচিত হন মিঃ নঈমুদ্দিন। ভাষা আন্দোলনে এই দল একটি বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে। তমদ্দুন মজলিশের সাথে হাত মিলিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ও এই আন্দোলনকে একটি সার্বিক ছাত্র ও গণআন্দোলনে উন্নীত করতে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। প্রথমদিকে কতকগুলো রাজনৈতিক কারণে ছাত্রলীগের নামের পূর্বে ‘মুসলিম' শব্দটি ব্যবহার করলেও এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী ছিল। পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই এই ‘মুসলিম' শব্দটি তুলে দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ' নামে দলটির নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমে এই ছাত্রদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।

যেমন দেশে একটি সুষ্ঠু যুব আন্দোলন গড়ে তুলতে, তেমনি বাংলা ভাষাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ মুজিবের অক্লান্ত নেতৃত্ব বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ১৯৪৮ সালের ৫ই ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারী বাসভবন তৎকালীন বর্ধমান হাউসে এবং বর্তমান বাংলা একাডেমীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির একটি বৈঠক বসে। প্রধানতঃ ভাষার ব্যঅপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণই এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্যে ছিল। বৈঠক চলাকালে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের একটি মিছিল সেখানে বাংলা ভাষার দাবি জানিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবও এই মিছিলের নেতৃত্ব দান করেন।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট মুসলিম লীগের কর্তৃত্বকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে বামপন্থী কর্মীরা ঢাকা শহরে একটি কর্মী সম্মেলন আহবান করেন। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প নামে এই সম্মেলন মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব এই সম্মেরনে নেতৃত্ব দান করেন এবং বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক স্বার্থে দেশের যুবশক্তি ও বামপন্থীদের সংঘবদ্ধ করতে কতকগুলো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ইংরেজী ও উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর এই প্রস্তাবের সমর্থনে কয়েকজন সদস্যও বক্তৃতা দেন। কিন্তু এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং লিয়াকত আলী খান পযৃন্ত ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধিতে তিনি তাঁর ভাষণে হিন্দু প্রাধান্যের সূত্র সন্ধান করেন। তিনি বলেন ঃ

“প্রথমেই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”

(নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ, ১৯৪৮)

বলাবাহুল্য, লিয়াকত আলী খানের বক্তৃতায় হিন্দু সদস্যদের প্রতি কটাক্ষপাত বিদ্যমান।

ঐ অধিবেশনে পূর্ব বাংলার খাদ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর সপক্ষে একটি উদ্ভট রায় প্রকাশ করেন। তিনি বরেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।”

(নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ, ১৯৪৮)

২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে অনুষ্ঠিত গণপরিষদে প্রদত্ত খাজা নাজিমুদ্দিনের এই বক্তৃতার যখন পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রদেশের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ' ২৭শে ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা ভাষা ও পাকিস্তান' শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেন ঃ

“খাজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভোট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না। আমাদের মতে, তাঁর উপরোক্ত উক্তি মোটেই সত্য নয়। আমরা বিশ্বাস করি, গণভোট গ্রহণ করিলে বাংলা ভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯ ভোটের বড় কম হইবে না। এই অবস্থায় এমন গুরুতর ব্যাপারে তিনি (খাজা নাজিমুদ্দিন) এইরূপ একটি দায়িত্বহীন উক্তি করিয়া শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থেরই ক্ষতি করেন নাই, এদেশবাসীর পক্ষে আপন প্রতিনিধিত্বের অধিকারের মর্যাদাকেও ক্ষুন্ন করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থকে এভাবে বিকাইয়া দেওয়া কি এতই সহজ?”

মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাকে  পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়, এমনকি গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি পর্যন্ত অগ্রাহ্য হওয়ার সংবাদ ঢাকায় প্রকাশিত হওযা মাত্র প্রগতিবাদী ছাত্র ও বুদ্দিজীবী মহল তীব্র অসন্তোষের ফেটে পড়তে থাকে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক ধর্মঘট পালন করা হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার ছাত্র সমাজ বাংলা ভাষার সমর্থনে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। পরে বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবুল কাশেম। এখানে উলে­খযোগ্য যে, এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান করেন।

শেখ মুজিবসহ সকল প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। এই উদ্দেশ্যে এদেশের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা ২রা মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাশেম, রণেশ দাশ গুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সভায় গণপরিষদ সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি সর্বদরীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দু'জন করে প্রতিনিধি দান করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হন শামসুল আরম। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সদূরপ্রসারী। 

সংগ্রাম পরিষদ ১১ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিন সারা পূর্ব বাংলায় এক প্রবল গণবিক্ষোভের উত্তাল তরঙ্গে সরকারের ভিত কেঁপে উঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনেরÑতথা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নব অধ্যায়ের সূচনা করে।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা করা হয। দিবসটিকে সফল করার জন্য ছাত্র-জনতা বের হয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা, বরিশালে চাত্রদের নিয়ে সমাবেশ করেন।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আসবেন ঢাকায়।

১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্ররা এক সভা করে। এতে বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা তুলে ধরেন। জিন্নাহকে জানিয়ে দিতে হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির কথা।

১৯ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন।

২১ মার্চ জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত  আত্মজীবনীতে' লিখেছেন, ‘আমরা প্রায় চার পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সময়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলো ‘মানি না'। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে জিন্নাহ যখন আবার বললেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। তখন ছাত্ররা তার সামনে বসেই চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না'।

... এই প্রথম তার মুখের উপরে তার কথার প্রতিবাদ করলো ছাত্ররা।

ছাত্রদের এ নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি নিয়ে কথা বলায় তাঁকে কারাগারে বন্দি করা হয়।

১৬ই মার্চ-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই সভা সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দিন উমর তাঁর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' গ্রন্থের ৯০ পৃষ্ঠায় বলেছেন ঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ সভার নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেরা দেড়টার সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারো শেরওয়ানী এবং জিন্না টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতলবিহীন চেয়ারে সভাপতির আসন অধিকার করে বসেন (তোয়াহা'র ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। সেই সময় তাঁর সবাপতিত্ব করার কোন কথা ছিল না কারণ ঢাকার তৎকালীন ছাত্র-আন্দোলনের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিলো নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সত্তেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সভাপতির চেয়ার দখল করেন (তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। তিনি আরও লিখেছেন প্রস্তাব গ্রহণের পর শেখ মুজিবুর রহমান অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেন। সেই এলোপাতাড়ি বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিল না (তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। অল্পক্ষণ এইভাবে বক্তৃতার পর তিনি অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ ‘চলো চলো অ্যাসেম্বরী চলো' বলে শ্লোগান দিয়ে সকলকে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য আহবান জানান (তোহায়া ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। সেদিনকার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিছিলের কোন কথা ছিল না। কিন্তু এই হঠাৎ উদ্ভুত পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব হল না। কাজেই ছাত্ররা সরকার বিরোধী এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হল।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল করেজ এবং পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী চৌমাথার কাছে মিছিলটি পৌঁছালে পুীরশ তাঁদেরকে বাধা দান করে। এরপর ছাত্ররা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তারের বেড়া পার হয়ে কলেজ এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই অবস্থান করে। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিত্বের পদত্যাগ দাবি এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে থাকে।

জনাব বদরুদ্দিীন উমর-এর বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা প্রপাকাণ্ড লেখার বিষয়গুলো জনাব মযহারুল ইসলাম তার লেখা “ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু” বইতে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। বিষয়গুলি তুলে ধরা হোল-

জনাব তাজউদ্দিনের এই ডায়েরীতে এমন তথ্য কোথাও নেই যে, শেখ মুজিবুর রহমান জোরপূর্বক চেয়ার টেনে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। জনাব তোয়াহার দোহাই টিকতে পারে না। কেননা, তাঁর বক্তব্যের কোন প্রমাণ জনাব বদরুদ্দিন উমর তাঁর গ্রন্থে উপস্থিত করেননি। সুতরাং জনাব উমর ১৬ই মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার বিবরণে শেখ মুজিবের যে চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন, তা সমর্থন করা যায না। উক্ত সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে জনাব আবদুল মোমেন, জনাব কে জি মোস্তফা এবং বাহাউদ্দিনের সাথে আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। সেদিনের ভাষা আন্দোলনের সাথে এই তিনব্যক্তি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, জনাব উমর যে বণৃনা নিয়েছেন, তা সত্য নয়। উক্ত সভায় শেখ মুজিবের নাম যথারীতি প্রস্তাবিত ও সমর্থিত হয়েছিল এবং তিনি যথানিয়মে সভায় সভাপতিত্ব করেছিরেন। সভায় কোনরূপ হট্টগোল হয়নি। এছাড়া অ্যাসেম্বরী ভবনে মিছিল যাবার ব্যাপারে যদিও কমিটি অব অ্যাকশনের কোন পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল না তথাপি সভায় উপস্থিত সকল বক্তা ও শ্রোতার বিশেষ আগ্রহ বার বার ব্যক্ত হয়েছিল বলেই সভাপতি অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিবের সংগ্রামী ও অকুতোভয় চারিত্র্যের একটি নিদর্শনও এ থেকে উপলব্ধি করা যায়। তিনি শুধু গরম বক্তৃতা দিয়ে বা সাবইকে মিছিলে উদ্বুদ্ধ করেই তাঁর দাযিত্ব শেখ করেননি মিছিলের পুরোভাগে থেকে সমগ্র মিছিল তিনি পরিচালনা করেছিলেন। জনাব উমর কৌশলে এ কথাটি উলে­খ করতে তুলে গেছেন।

জনাব উমর আরো একটি কথা বলেছেন, “ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিক ছিল নিতান্ত নঘন্য।” অন্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই। উমরের নিজস্ব বর্ণনা থেকেই প্রমাণ দেয়া যায় যে, শেখ মুজিব সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দিন উমরের এই ভক্তি সত্যকে বিকৃত করেছে। এখানে আমি জনাব উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' গ্রন্থ থেকেই প্রমাণ দেব।

“১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোস্টেলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর নিকট এ সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি প্রদানের জন্য তিনি জোরালো চাপ সৃষ্টি করেন। “সেই স্মারকলিপিটির খসড়া তৈরির ভার অর্পিত হয় কমরুদ্দিন আহমদের উপর।” (ঐ, পৃঃ ১৬৭)

১৯৪৮-এর প্রথম দিকেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দান করেন শেখ মুজিব। “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী অর্গানাইজিং কমিটির” যে ক'জন সদস্য নির্বাচিত হন তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

রাজনৈতিক কারণে মুসলিম নামটি সংযুক্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৪৯ সালের ৮ই জানুয়ারী ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস' পালন করা হয়।

ঢাকা কলেজে আংশিক ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে বেলা দু'টার সময় মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবিসমূহ বিবেচনা করে সেগুলোকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য সরকারকে একমাসের সময় দেয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন কর্মচারীদের ধর্মঘটে সহানুভুতি জানিয়ে যাঁরা নেতৃত্ব দান করেন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদেরই একজন। এর ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। একথা জনাব উমরও স্বীকার করেছেন।

জনাব উমর আরও স্বীকার করেছেন :

“যে সমস্ত কর্মীরা পুর্ব বাংলায় নতুন রাজনীতি গঠন চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান, শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আওয়াল প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য । পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য কয়েকজনও কলকাতা থেকে আসার পর সেই রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।”

আশা করি এতক্ষণ জনাব বদরুদ্দিন উমরের নিজের তথ্য থেকেই তাঁর এই উক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়েছি যে, “ঢাকায় তঃকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল নিতান্ত নগণ্য। বস্তুত ১৯৪৭ থেকে এদেশে একটি অসাম্প্রদাযিক গণআন্দোরন গড়ে তুলতে শেখ মুজিব যে ভূমিকা পালন করেছেন, তারই ফলশ্রুতিতে হিসেবেই তিনি এদেশের অবিসম্বাদিত নেতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। অসীম ত্যাগ, অনেক সাধনা, সুচতুর কর্মপন্থা প্রভৃতি তাঁকে সাফল্যের স্বর্ণসিংহদ্বারে নিয়ে এসেছে। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নামে যে নতুন রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন হয়েছিল শেখ মুজিবের নাম সেখানে সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাবিত ও “সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।”

মনে রাখা দরকার যে, শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে এই সম্মান দেয়া হয়। একথা সত্য যে, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বের নিদর্শন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ পযৃন্ত সমগ্র আন্দোলনে অনুপস্থিত। সে রকম আশা করাও দুরাশা, কেননা এই সময়টি ছিল তাঁর নেতৃত্বের প্রস্তুতিপর্ব। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সর্বপ্রকার আন্দোলনেই তিনি যথাসাধ্য অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে তাঁর সম্ভাবনা সূচিত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। আর এভাবেই ভবিষ্যতের একজন নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার প্রস্তুতি-পর্ব তিনি অতিক্রম করেছেন। ১৬ই মার্চে সে মিছিলটি অ্যাসেম্বরী ভবনে গিয়ে অবস্থান করছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে সন্ধ্যার দিকে এই মিছিলের উপর লাঠিচার্জ করা হয় এবং এতে ১৯ জন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হয়। রাত্রে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে ফজলুল হক মুসলিম হলে। ১৭ তারিখে এদেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্র সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোরন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা, মিছিল আর শ্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।' দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগল। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ওতপ্রোত সম্পর্কে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেবার বেলায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এমনকি তাঁর প্রেরণাতেই ৭৬ বছরের বৃদ্ধ শেরে বাংলা ফজলুল হক পর্যন্ত এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশ নেন।

বিচ্ছিন্ন যুবশক্তিকে সংঘবদ্ধ করতে এবং ভাষা আন্দোলনকে একটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করতে শেখ মুজিব যতই নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে শুরু করলেন, ততই দ্রুত তিনি সরকারের কোপানলে পতিত হতে লাগলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে অসাম্প্রদাযিক যুবনেতৃত্ব এবং ভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা, এই দু'টো কারণেই তাঁকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকার পুনরায় কারারুদ্ধ করে। শেখ অম্লানবদনে এই নিয়তিকে স্বীকার করেন।

১৯৪৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পরপরই শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে প্রতিবাদস্বরূপ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাজউদ্দিন আহমদ, তোয়াহা প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ভাষা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলেন।

ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় পড়াশুনার সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন, যদি তিনি ভবিষ্যতে ভারো হয়ে চলবার ‘বণ্ড সই' করে দিতেন। মুজিব এতে রাজী হননি। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “শেখ মুজিব আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আসবে তবে ছাত্র হিসেবে নয়, একজন দেশকর্মী হিসেবে।” শেখ মুজিব তাঁর ওয়াদা পালন করেছিলেন। আড়াই বছর পর আবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তোরাঁয় ফিরে এসেছিলেন। তবে ছাত্র হিসেবে নয় একজন দেশকর্মী হিসেবেই। তিনি তখনও আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা।

একদিকে যুব আন্দোলন এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন ইত্যাদি কারণে নতুন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি আসন্ন হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ৩রা জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। তখন এই দলের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৭০ সালের ১১ই মার্চ গণআন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। দেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে পূর্ব বাংলার তৎকালীন নূরুল আমীন সরকার দমননীতির মাধ্যমে আন্দোলনের কণ্ঠবোধের প্রচেষ্টা চালালেন। ১১ই মার্চের সংগ্রাম দিবসের কর্মসূচীর প্রধান উদ্যোক্তা শেখ মুজিবকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয়।

(চলবে)

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top