সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ কয়েকটি দিন : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২০ ২০:৫৩

আপডেট:
১৪ আগস্ট ২০২০ ০৫:৩৫

ছবিঃ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

 

জানা যায়, নিহত হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর বেশিরভাগ সময় কেটেছে সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততায়। গণভবনে যাওয়া, ফাইলপত্র দেখা ও সাক্ষাৎকার সবই ছিল। এরপরও তিনি গভীর চিন্তামগ্ন থাকতেন। ৯ আগস্ট আবু সাইদ চৌধুরী মন্ত্রীপদে শপথ নেন, ১০ আগস্ট চালনা বন্দর শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠনের আদেশে স্বাক্ষর দান, বন্দর শ্রমিকদের মজুরি ৮৫ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়। ১১ আগস্ট ছোট বোনের বিয়েতে যান। ১২ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বেলগ্রেড সফরে গেলে তাঁর হাতে প্রেসিডেন্ট টিটোকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। ১৪ আগস্ট কোরীয় প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত মি. সোয়ান চু-এর সাক্ষাৎকারের ছবিটি তাঁর সর্বশেষ সরকারি ছবি। ১৫ আগস্ট সকাল ৯টায় তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে যাবার কথা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়।

কথা ছিল বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষন দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতি চলছে। উপাচার্য আব্দুল মতিন চৌধুরী তাঁর প্রাক্তন ছাত্রকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য ব্যাপক আয়োজন করেছেন। উপাচার্য আব্দুল মতিন চৌধুরী শেখ হাসিনাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তিনি জার্মানি যাবেন। তাই বিশ্ববিদ্যায়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ২৯ জুলাই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

অবশ্য সেদিনের কাগজ পাঠকের হাতে পৌঁছায়নি। ১৬ আগস্ট পত্রিকা প্রকাশিত হলেও বিলি করা হয়নি। ১৭ আগস্ট ৪ পৃষ্ঠার কাগজ প্রকাশিত হয়। এদিন বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, পূর্ণ মর্যাদায় পরলোকগত রাষ্ট্রপতির দাফন সম্পন্ন (হেডিং)। খবরটি হলো পরলোকগত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ গতকাল (শনিবার) বিমানে করিয়া তারার নিজ গ্রামে টুঙ্গিপাড়ায় (ফরিদপুর) লইয়া যাওয়া হয় এবং তাঁহাদের পারিবারিক গোরস্থানে পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয়। একজন সরকারী মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বাসস, এ খবর জানিয়েছে ।

 

যেভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে মাত্র এক ঘন্টার অপারেশনে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। সেই অল্প সময়েই খুন করে ১৮ জনকে। সেই বর্বোরিচিত হত্যাকাণ্ডের পাষণ্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল, শিশু বাবু, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা বধূও। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ১৫ আগস্ট ভোর ৬টা পর্যন্ত কীভাবে সেই হতাযজ্ঞ ঘটে, তা নিয়েই এই প্রতিবেদন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেওয়া বিভিন্নজনের সাক্ষ্য ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদের বই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথার আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিশেষ প্রতিনিধি।

 

১৪ আগস্ট ১৯৭৫

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। দিনটি খুব ভালো ছিল না। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিল খামাখাই উত্তেজনা। পরদিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা সতর্কতা নিয়েই। কিন্তু কে জানত সে সময়ই উত্তরপাড়ায় চলছে বঙ্গবন্ধু হত্যার মহড়া। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়ে উঠল সেনাবাহিনীল টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট যানগুলো। রাত ১০ টায় বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে জড়ো হলো বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ বিরান মাঠে। জড়ো হলো ১৮ টি কামান ও ২৮ টি ট্যাক। রাত সাড়ে ১১টায় জড়ো হলো মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদসহ ঘাতকরা। ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহর রাত সাড়ে ১২ টায় পরিকল্পনা ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। এই প্রথম সবাই জানতে পারল সে রাতেই হত্যা করা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

 

তখন মণি পত্রিকা পড়ছিলেন

তখন ভোর সোয়া ৫টা। আক্রান্ত হয়েছে ধানমন্ডি। চারদিকে ছুটছে বুলেট। ভোর ৫টা ১০ মিনিটে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হয় ধানমন্ডির শেখ মণির বাসার গেটে। প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো তখন ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ড্রয়িং রুমে বসে পড়ছিলেন পত্রিকা। খোলা দরজা দিয়ে সটান ঢুকে পড়ে মোসলেম। কিছু বলতে চাইছিলেন শেখ মণি। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে গর্জে উঠল মোসলেমের হাতের স্টেনগান। লুটিয়ে পড়লেন শেখ মণি। চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ব্রাশফায়ারে প্রাণ হারালেন তিনি। কেবল প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজল শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

 

রক্ষা পায়নি চার বছরের বাবুও

ভোর ৫টা ১৫ মিনিট। ধানমন্ডির আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে এক প্লাটুন সৈন্য। পাহারারত পুলিশকে নিরস্ত্র করতে ছোড়া হয় গুলি। গুলির শব্দে জেগে ওঠেন সেরনিয়াবাত। ব্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন কররতে। সে সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ঘাতকরা। ড্রয়িং রুমে জড়ো করা হয় সবাইকে। তারপর নির্দয়ভাবে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাতের ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগনে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই) তিন অতিথি এবং চার কাজের লোককে। কেবল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান সেরনিয়াতের বড় ছেলে হাসনাত।

 

শেষ লক্ষ্য সেই ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি

তখন ভোর সাড়ে ৫টা। পুরো অপারেশন শেষ করে ঘাতকদের ভিড় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর সেই ৬৭৭ নম্বর বাড়ির গেটে। ততক্ষণে আবদুর রব সেরনিয়াবতকে হত্যার খবর জেনে গেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রধান গেটেও চলছে হট্টগোল। বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরের বারন্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন দুই গৃহকর্মী মোহাম্মদ সেলিম (আবদুল) ও আবদুর রহমান শেখ (রমা)। নিচতলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম। মহিতুলকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা। কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না মহিতুল। চেষ্টা করতে থাকে গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে।

 

আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব

গোলগুলির শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন গৃহকর্মী আবদুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে এসে দেখেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত রমা বাড়ির ভেতরে এসে দেখেন, লুঙ্গি পড়া আর গেঞ্জি পরা বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন। রমা দোতলায় উঠে গেলেন। দেখলেন, আকঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন বেগম মুজিব। রমা এবার চলে যান তিনতলায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। পিছু  পিছু সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে আসেন রমা। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান। বাইরে তখন গোলাগুলি। নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধু। তার সমানেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকে মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে মহিতুলের কাছ থেকে রিসিভার টেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব। ব্যস, এ পর্যন্তই। কথা শেষ হলো না তার। জানালার কাচ ভেঙে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে অফিসের দেয়ালে। এক  টুকরো কাচে ডান হতের কনুই জখম হয় মহিতুলের। টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। কাছে টেনে শুইয়ে দেন মহিতুলকেও। এর মধ্যেই আবদুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থামলে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। পাঞ্জাবি ও চশমা পরেন। অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করছ? এ কথা বলেই উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু।

 

হ্যান্ডসআপ!

বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই নিচে নামেন শেখ কামাল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন। শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নূরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে মেজর নূর, মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা হ্যান্ডসআপ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যান নূরুল ইসলাম খান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনিও ওদেরকে বলেন। মহিতুল ঘাতকদের বলেন, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংকক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ। প্রাণ হারান তিনি। একটা গুলি এসে লাগে মতিতুলের হাঁটুতে, আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে।

 

ক্যান ইউ গেট আউট?

নিচতলার বারান্দা তখন রক্তে ভাসছে। বন্ধ ঘরের ভেতরে ফোনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে বলেন, জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল­াহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন, সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। ফোনের ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, আই এ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?

 

পৌঁছা হলো না জামিলের

বঙ্গবন্ধুর কথা শোনার পর ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা দেন কর্নেল জামিল। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েন উদ্দিন মোল্লা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছা হলো না তার। পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েন উদ্দিন। তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে লম্বালম্বি লাইনে দাঁড়ানো মহিতুল, নূরুল ইসলাম, আবদুল মতিন ও পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ কয়েকজন। ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করে। তারপর গুলি করতে করতে চলে যায় ওপরে। সেখানে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া আবদুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ আব্দুল সিঁড়ির পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।

 

তোদের এত সাহস

ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনিসহ বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলাতানা কামাল ও রোজী জামাল। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাতকরা। ততক্ষণে গোলাগুলি থেমে গেছে। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে ঘাতকরা। নামিয়ে আনতে থাকে নিচে। সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, তোরা কী চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস? মেজর হুদা বলে, আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি? বঙ্গবন্ধু বলেন, তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কী করেছিস? উত্তরে হুদা বলে, স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে। আর আপনি তুই তুই করে বলবেন না। আপনি বন্দি। চলুন। এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, কী, তোদের এত সাহস! পাকিস্তানী আর্মিরা আমাকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।

 

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে রক্তের স্রোত

সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সিঁড়ির নিচে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও মেজর নূর। নূর কিছু একটা বললে সরে দাঁড়ায় মহিউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে হুদা ও নূরের হাতের স্টেনগান। আঠারটি গুলি ঝাঁজরা করে বঙ্গবন্ধুর বুক ও পেট। বিশালদেহী মানুষটি ধপাস করে পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। রঙ্গবন্ধু তখন মৃত। তার বুকে রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের স্রোত। নিচে রক্তক্ষরণে বিবর্ণ সুলতানা কামালের মুখ। কিছুক্ষণ পরই দোতলায় উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা। গুলি আর ধাক্কায় একসময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম মুজিব।

সবাইকে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দেয় ঘাতকরা। নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার দিয়ে বলেন, আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল। শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেগম মুজিবকে। তারপর সেই ঘরে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন একে একে গুলি করে হত্যা করে বেগম মুজিবসহ শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁদিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে আসে সুলতানা কামালের মুখ।

 

পানি...পানি...

নিচে দাঁড় করানো হলো শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে। শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে? অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। গুলি করা হয় সেখানে। অসহায় নাসেরের গুলিবিদ্ধ দেহ গড়াতে থাকে মেঝেতে। এ সময় পানি... পানি... বলে গোঙাতে থাকেন তিনি। পানি নয়, ঘাতকরা আরেকবার গুলিবর্ষণ করে তার ওপর।

 

ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?

রমাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও। অসহায় শিশুটি প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো? কোন জবাব নেই রমার মুখে। মহিতুল বলেন, না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না। একথা শুনে শিশুটি তার মায়ের কাছে যেতে চায়। দোতলায় নিয়েও যাওয়াহয় তাকে। কিন্তু মা নয়, পাঠানো হয় মৃত্যুর কোলে। গুলি করে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসে। থেঁতলে যায় মাথার পেছনের অংশ। নিথর রক্তমাখা একরত্তি দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।

 

বেঁচে থাকেন দুই মেয়ে

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তাই বেঁচে যান তারা।

 

বঙ্গবন্ধুর দাফন

আব্দুল হাই ছিল গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়ার শেখ সাহেরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়।

প্রায় ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী দিতে গিয়ে এতোদিন বুকে চেপে থাকা লাশ দাফনের স্মৃতিকথা তুলে ধরেছিল আদালতে।

তার বর্ণনামতো জাতির পিতার দাফন সম্পাদন করতে ১৯৭৫ এর ১৬ আগস্টে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ সমবেত হতে চেষ্টা করেছিল টুঙ্গিপাড়ার সেই বিষাদময় থমথমে পরিবেশে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাধার মুখে তারা সেখানে থাকতে পারেনি।

বলা হয়েছিল, কোনো গোসল না করিয়েই রক্তাত বঙ্গবন্ধুকে দাফন করা হবে। স্থানীয় সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার, সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং অফিসার ইন-চার্জ সেটি মানতে রাজি হননি। তারা বলেন বঙ্গবন্ধু একজন মুসলিম। তাঁকে গোসল না করিয়ে দাফন করা যাবে না।

পরে আব্দুল মান্নাফ শেখ. কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম, ইমামউদ্দীন গাজি, নুরুল হক শেখ এবং কেরামত হাজি কাছের দোকান থেকে আনা ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান।

আব্দুল হাই এবং মৌলভী আব্দুল হালিম তাঁকে রেড ক্রিসেন্টের তিনটি মার্কিন কাপড়ের শাড়ি দিয়ে কাফন পরান। মাওলানা আব্দুল হালিম বঙ্গবন্ধুর ভিটামাটিতে অল্প কিছু মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ান। সেনা সদস্যদের নির্দেশ পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়েছিল মাত্র দশ মিনিটে!

কথাগুলো বলতে গিয়ে আব্দুল হাইর চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল।

 

বঙ্গবন্ধুর মাজার (মৃত্যুর পর)

টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির সামনে আঙিনায় পূর্ব-দক্ষিণ দিকের খোলা আকাশের নিচে প্রায় ২০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বঙ্গবন্ধুর মাজার। লম্বায় ১০ ফুট পাশে ৫ ফুট। ১৯৮৮ সালে ১৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা মাজারটির সংস্কার করান। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাপ-মার কবর বাঁধানোর জন্য যে সাদা পাথর কিনেছিলেন, তার বেশ কিছু টুকরো বেঁচে যায়। শেখ হাসিনা সেগুলো দিয়েই মাজারে পাথর সেট করিয়ে নেন। কবরের উপরের অংশে খোলা সবুজ ঘন ঘাস ও ফুল গাছ লাগানো আছে। মাজারের চারপাশে গ্রীল দিয়ে ঘেরা।

ছবিঃ বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল

সারারাত বিদ্যুতের বাতি জ্বলে একটা। ফুল ও ফল গাছ লাগানো আছে মাজারের চারদিকে। টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের মাজার জিয়ারত করতে প্রতিদিন মানুষ আসে। ১৫ আগস্ট হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। শিরিষ-কদম-নিম-নারকেল-তাল-তমাল-বকুল গাছের নিভৃত ছায়ায়, সবুজ প্রকৃতির ­স্নিগ্ধতায় বঙ্গবন্ধুর মাজার। মধুমতির ভেজা বাতাস তাঁর প্রিয় ছিল। যে মাটিতে তাঁর জন্ম, যার ­স্নেহ-মমতা মেখে তিনি বড় হয়েছেন, যে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ পরিপুষ্ট করেছে তাঁকে, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, সে মাটিতেই তাঁর রক্তাক্ত দেহ আজ শায়িত, সমাহিত।

 

সূত্র : ১) দৈনিক ইত্তেফাক ২) ইন্টারনেট/প্রকাশ ১৫ আগস্ট ২০১৬

 

(শাহান আরা জাকির পারুলের ‘মহাকাব্যের অমরগাঁথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ বইয়ের অংশ বিশেষ)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top