সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

জেনারেল ওসমানীঃ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি না সর্বাধিনায়ক? : সায়েদুর রহমান তালুকদার


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪৭

আপডেট:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২২:১১

ছবিঃ বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জেনারেল ওসমানী

 

মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর জেনারেল এম এ জি ওসমানীর পদবি নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক না মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নাকি প্রধান সেনাপতি ছিলেন এ নিয়ে সৃষ্ট অহেতুক বিতর্ক আমাদের ভাবমূর্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার কথা না থাকলেও হয়েছে এবং হচ্ছে। কেন, কীভাবে হচ্ছে তা আলোচনা করা দরকার।

আলোচনার শুরুতেই বলা দরকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত তাঁর অফিসিয়েল পজিশন ছিল Commander in Chief (C-in-C)। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, স্মৃতি চর্চা প্রভৃতি সবকিছুতে Commander in Chief বা C-in-C পদবাচ্যটি ছিল তাঁর সাংবিধানিক পদবি। কর্নেল ওসমানী হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত এই সেনানায়ক মুক্তিযুদ্ধে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে যুদ্ধকালে প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও যেমন কোনো পদোন্নতি পাননি তেমনি যুদ্ধোত্তর কালেও সরকার কর্তৃক পাননি কোনো খেতাব। তবে বাংলার জনগণ তাঁর মূল্যায়নে কোনো কার্পণ্য করেনি।তিনি জনগণ কর্তৃক ‘বঙ্গবীর’ খেতাবে ঠিকই ভূষিত হন।

১৯৯৫ খ্রি. পর্যন্ত জেনারেল ওসমানীর সর্বাধিনায়কত্ব নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সূচিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি সামনে আসে। প্রশ্ন আসে জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক না প্রধান সেনাপতি ছিলেন। অপ্রত্যাশিত এ সমালোচনার সূত্রে তখন কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা পরিস্থিতির ঘোলাপানিতে সন্তরণের অভিপ্রায়ে বিষয়টির প্রতি সর্বসাধারনের দৃষ্টি কাড়েন।কিন্তু দিবালোকের মতো স্পষ্ট এ বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ না থাকায় তাঁরা কৌশলে পদবিবাচক ইংরেজি Commander in Chief-এর ভাষান্তরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। Commander-এর বাংলা সেনাপতি শব্দকে গ্রহণ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা সেসব সুশীলগণ বিপক্ষমত স্তব্ধ করার জন্য মাথার উপর খাড়া রাখেন ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ নামের খড়গ।সুতরাং সাধু সাবধান।

সর্বাধিনায়কত্বের প্রশ্নে অনেকে সংবিধানের দোহাই দিতে কার্পণ্য করেন না। সংবিধানের ব্যাখ্যা বিজ্ঞ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞগণের বিষয়।মোটাদাগে একজন নাগরিকের তৎবিষয়ক মূল্যায়নের আগে মনে রাখা দরকার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা এসেছে একাত্তরের ২৬ মার্চ; আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ হয়েছে ১৭ এপ্রিল; মন্ত্রিপরিষদ সভায় Commander in Chief হিসেবে কর্নেল ওসমানীর নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনুমোদন করেন ২৯ এপ্রিল এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর।পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা ও গণপরিষদে বিধিবদ্ধ হয়েছে ৪ নভেম্বর।

সর্বাধিনায়কত্ব সম্পর্কে সংবিধানে (ধারা-৬১) বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হইবে এবং আইনের দ্বারা তাহার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হইবে।’ এখানে ইংরেজি Supreme Command of the defence services অর্থে সর্বাধিনায়কতা বলা হয়েছে।অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির সর্বাধিনায়কত্বের আওতা কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রীক নয়Ñ সমস্ত প্রতিরক্ষা বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত এবং তা মুক্তিযুদ্ধের সমধিককাল পরবর্তী সময়ে বিধিবদ্ধ।

প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর ওসমানী সাহেবের নিয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, Col. Osmani of the Bengal Regiment, who had retired from active service some time before the flare-up in East Bengal, was appointed the General Officer Commanding-in-Chief of the ‘Mukti Fauj’. ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং অর্পিত দায়িত্বের বলে Commander-in-Chief হিসেবে কর্নেল ওসমানীর নিয়োগ অনুমোদন করেন। এতে বলা হয়েছে: The appointment of Colonel M. A. G. Osmany as the Commander-in-Chief of Bangladesh Forces with the status of a Cabinet Minister is hereby approved.

বাহাত্তরের নভেম্বরে সংবিধান অনুমোদিত হওয়ায় এর পূর্ববর্তী কার্যক্রমকে সংবিধানের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধানে [১৫০: ৩(১)] বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে এই সংবিধান-প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত সকল আইন, স্বাধীনতার ঘোলণাপত্র বা যে কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত কর্তৃত্বের অধীন অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রযুক্ত সকল ক্ষমতা বা কৃত সকল কার্য এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইবে।’ সেমতে ২৯ এপ্রিল’৭১ তারিখে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী সমূহের Commander-in-Chief নিয়োগ ও তৎকর্তৃক পরিচালিত সকল কার্যক্রম নিঃসন্দেহে সংবিধানসম্মত।

জেনারেল ওসমানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই। বাংলাদেশের চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তিনি একজন কর্নেল হিসেবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, যদিও যুদ্ধোত্তর কালে তাঁকে সরাসরি জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তারা কেবলমাত্র প্রটোকলগত কারণে আমাদের প্রধানের সাথে এক টেবিলে বসে মতবিনিময় করেননি। প্রসঙ্গত ভারতীয় কোনো কোনো কর্মকর্তা জানান যে, তোমাদের সরকার ওসমানী সাহেবকে ‘জেনারেল’ পদমর্যাদা দিয়ে দিলেইতো প্রটোকলগত সমস্যা নিরসন হয়।প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অবগত থাকা সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেননি।

সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতির সর্বাধিনায়কতা Supreme Command of the defence services অর্থে আর জেনারেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক Commander-in-Chief of Bangladesh Forces অর্থে। কেন যে এ দু’য়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি হল তা বোধগম্য নয়। আভিধানিক ও তত্ত্বগত বিশ্লেষনে এতে কোনো পার্থক্য আছে কিনা, থাকলে কতটুকু তা নির্ণয়ের ভার সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং পাঠকের।আমাদের বিষয় মোটাদাগে প্রধান সেনাপতি ও সর্বাধিনায়কের ব্যবধান কিঞ্চিৎ আলোচনা করা।  

জেনারেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নাকি প্রধান সেনাপতি সে বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ভেবে দেখুন, ইংরেজি ভাষায় ওসমানী সাহেবকে Commander-in-Chief বলতে কারো দ্বিধা নেই। যত সমস্যা হচ্ছে ভাষান্তরে।‘কমান্ডার’ ইংরেজি শব্দ আর ‘অধিনায়ক’ ও ‘সেনাপতি’ হচ্ছে সংস্কৃতিজাত বাংলা শব্দ।মুসলিম শাসনামলে অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি।ব্রিটিশরা তা পরিবর্তন করে ইংরেজিকে প্রতিষ্ঠিত করে।পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাউত্তর কালেও তা বহাল ছিল।মুসলিম শাসনামলে আরবি-ফার্সি এবং ব্রিটিশদের দ্বারা বাংলা ভাষায় যেসব ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, কমান্ডার তেমনি একটি ইংরেজি শব্দ।প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহারের কারণে এসব শব্দ সরাসরি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ভাষান্তরের বিষয়ে অভিধান ও প্রশাসনিক পরিভাষার আশ্রয় নিলে দেখা যায়, বাংলা একাডেমির (ইং-বাং) অভিধানে Commander-এর বাংলা করা হয়েছে, ‘সেনাপতি, আদেশপ্রদানকারী বা নিয়ন্ত্রণকারী অফিসার’। Commander-in-Chief Ñ সর্বাধিনায়ক।(বাং-ইং)অভিধানে অধিনায়ক-এর ইংরেজি করা হয়েছে Commander। বাংলা সেনাপতি এবং অধিনায়ক দু’টিরই ইংরেজি প্রতিশব্দ Commander।প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে কোন অর্থটি গ্রহণ করা হবে সেটিই বিবেচ্য।দেখা যায় মুক্তিবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সাধারণ প্রয়োগ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে Commander অর্থে বাংলায় অধিনায়ক গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন Sector Commander-এর বাংলা গ্রহণ করা হয়েছে আঞ্চলিক অধিনায়ক। এক্ষেত্রে কেউ বাংলায় আঞ্চলিক সেনাপতি বলেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।তাছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদবির বাংলায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অধিনায়কই বলা হয় সেনাপতির’র প্রয়োগ নেই। যদি এসব ক্ষেত্রে কোনো বিতর্ক বা দুষ না থাকে তবে Commander-in-Chief অর্থে সর্বাধিনায়ক বললে গাত্রদাহ হবে কেন সে প্রশ্ন আসতেই পারে।

প্রসঙ্গত সেনাপতি শব্দের প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যুদ্ধবিগ্রহ ছিল প্রধান বিষয়। যুদ্ধের জন্য নিয়োগকৃত সেনাদের অধিনায়ক ছিল সেনাপতি। বিভিন্ন সংখ্যক সদস্যভিত্তিক ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত শীর্ষ সৈন্যাধ্যক্ষের পদবি ছিল প্রধান সেনাপতি। সাম্রাজ্য বা দেশভিত্তিক যেমন প্রধান সেনাপতি ছিল তেমনি কোনো নির্দিষ্ট যুদ্ধভিত্তিকও প্রধান সেনাপতি নিয়োগ হতো। তৎকালে বর্তমানের মতো স্থল, জল ও আকাশযুদ্ধের জন্য পৃথক পৃথক বাহিনী প্রধান ছিল না। সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, ঐরাবত ইত্যাদি বাহিনী ছিল।নৌ-যুদ্ধ না হলেও প্রত্যেক সেনাবাহিনীতেই প্রধানত রসদসামগ্রী ও সেনাবাহিনী স্থানান্তর এবং প্রয়োজন ক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নৌ-ইউনিট ছিল।আকাশ যুদ্ধ ছিলই না।মোগল আমলে বাংলার বারভূঁইয়াদের দমন অভিযানে পদাতিক, অশ্বারোহী, ঐরাবত সেনা ও নৌ-ইউনিট যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন সেমত যুদ্ধ করেছে। ভূঁইয়াগণও তাদের প্রতিটি ইউনিটকে প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত বাহিনী নিয়ে প্রাণপন লড়াই করেছেন।

বাংলায় রাজতন্ত্রের অবসান হয় ইংরেজদের দ্বারা ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ইংরেজরা ব্যবসাসূত্রে এদেশে আসলেও এখানকার স্বার্থান্বেষী উঁচু মহলের অর্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক অতিলোভ ও পরশ্রীকাতরতার চোরাপথে সামরিক শক্তির চর্চা শুরু করে।তাদের কাছ থেকে ভাষা-সংস্কৃতি-শাসন-শোষনের কায়দা-কানুন আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। ইংরেজি কমান্ডার শব্দটি তাদের কাছ থেকে পাওয়া। তাদের শাসন-প্রভাবে বাংলা সেনাপতি শব্দটি কমান্ডারের মধ্যে হারিয়ে গেলেও বিশুদ্ধ বাংলায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিনায়ক শব্দটির প্রয়োগ নিশ্চিত হয়।এখন যদি সেনাপতি শব্দকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে কেবল জেনারেল ওসমানীকে শিখণ্ডী না বানিয়ে সর্বক্ষেত্রে এর চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধানকে সর্বাধিনায়ক না বলে প্রধান সেনাপতি বললে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃতি ও আবেদনকে পলাশীর প্রান্তরে ঠেলে দেওয়া হয় কিনা সেটা যেমন ভাবতে হবে তেমনি সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণকেও আঞ্চলিক সেনাপতি বলতে হবে। তা নাহলে সেই বিশেষ যুক্তি অসততা বা গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ-দুষ্ট গণ্য হতে বাধ্য।  

স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী, নিয়মিত বাহিনী, সেনাবাহিনী ইত্যাদির অস্তিত্ব সম্পর্কেও বিতর্ক তথা পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা শুরু হলে, জেনারেল ওসমানী নিজে বিষয়টি স্পষ্ট করেন।এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী।এর ভেতর স্থল, জল, বিমান, তিনটিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে মুক্তিবাহিনী শব্দে ভুল করেন। তারা মনে করেন শুধু গেরিলাদের বুঝি মুক্তিবাহিনী বলা হতো। আসলে তা নয়।বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুরোটা মিলিয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী। এর দুটো অংশ ছিল (১) নিয়মিত বাহিনী এবং (২) গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা এই শেষোক্ত অংশকে বলতেন এ্রফ.এফ অর্থাৎ ‘ফ্রীডম ফাইটার’।কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তো সবাই।আর গণবাহিনীর ও নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর একই ছিল।’

জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের নাকি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এমন বিতর্কও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ ও যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়টি অতি সংক্ষেপে বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত সেনা সভায় যখন তাঁকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, তখন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ সরকার নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। জাতীয় অস্তিত্বের আবেদন ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার চাপে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন বাধ্য হয়ে সামনে এগুতে হয়। ২৫ মার্চ আমাদেরকে সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করালে প্রতিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক ছায়ার শূণ্যতায় সেনাবাহিনী যুদ্ধকে একক কমান্ডে এনে আনুষ্ঠানিক ভাবে তেলিয়াপাড়া থেকে যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক ভাবে বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় ঐ সভা জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কর্নেল ওসমানীকে রাজনৈতিক সরকার গঠনের তৎপরতার জন্য দায়িত্ব প্রদান করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় এবং কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে সে সরকারের আনুগত্য মেনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সাথে অভিবাধন গ্রহণ করেন।

ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সভায় সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল ওসমানীর দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র নবম খণ্ড, পৃ.১৭৫) তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ গ্রন্থে (পৃ.৯১) বলেন, ‘এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে।’

ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠাকিভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকার বিকল্পহীন সময়ে কর্নেল ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পর সে সরকারের অধীন তাঁর আনুগত্য প্রকাশের সময় থেকে তিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের সর্বাধিনায়কত্ব দেয়ায় মুক্তিযুদ্ধ সে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়। ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাংলাদেশ বাহিনীসমূহের Commander-in-Chief হিসেবে কর্নেল ওসমানীকে নিয়োগ করায় মুক্তিবাহিনীতে তাঁর একক নেতৃত্ব এবং সর্বাধিনায়কত্বের বিষয়টি সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে।

জেনারেল ওসমানীর নিয়োগে যে বাংলাদেশ ফোর্সেস শব্দের প্রয়োগ হয়েছে সে বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনী এই তিনটি পৃথক বাহিনী এবং প্রতিটি বাহিনীর পৃথক পৃথক প্রধান রয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধকালে তেমন ছিল না। মুক্তিযেুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বাহিনীর সম্মিলিত রূপ ছিল মুক্তিবাহিনী তা আমরা ইতঃপূর্বে জেনেছি। বাংলাদেশ বাহিনীসমূহ বলতে তৎকালীন সময়ের সশস্ত্র বাহিনীকেই বুঝায় এবং তা মুক্তিবাহিনীর বৃহৎ পরিসরের অন্তর্ভুক্ত। ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে বিভক্ত ছিল বাংলাদেশের প্রথম সামরিক কাঠামো। ব্রিগেডসমূহ নিয়মিত এবং সেক্টরসমূহ গণবাহিনী, গেরিলা বা অনিয়মিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রক ছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৌ ও বিমান বাহিনীর যেসব বাঙালি সদস্যরা পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন তারা প্রথমে বিভিন্ন সেক্টরের অধীন গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। পরে নৌবাহিনীর সদস্যগণেকে নিয়ে ১৩ মে একটি নৌ-কমাণ্ডো বাহিনী গঠন করা হয়। যুদ্ধকে ১১টি সেক্টরে বিভক্তকালে নৌ-যুদ্ধের জন্য ১০নং সেক্টর ঘোষণা করা হলেও কোনো অধিনায়ক নিয়োগ না হওয়ায় তারা বিভিন্ন সেক্টরের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডারগণের অধীনে যুদ্ধ করে। তখন দেশের মুক্তাঞ্চলে কোনো বিমান বন্দর বা যুদ্ধবিমান না থাকায় তারা বিভিন্ন কমান্ডো আক্রমণে অংশ নেয়। সদর দপ্তরে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার ও বিমান বাহিনীর অপরাপর সদস্যদের আগ্রহে ২৮ সেপ্টেম্বর একটি বিমান উইং গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এসমস্ত মিলেই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বা মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো ছিলÑ যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী।

মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক বিষবৃক্ষ ডাল-পালা মেলেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষেত্রবিশেষে সেসবকে প্রশ্রয়ও দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয় স্বার্থে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সবকিছুকে সুশৃঙ্খল করা হয়েছে।কর্নেল ওসমানীর দায়িত্ব পালন ও দিকনির্দেশনায় কোনো শিথিলতা বা ত্রুটি ছিল না। তাঁর নিয়োগ এবং ভূমিকায়ও কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে কাঙ্খিত সময়ের মধ্যেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন।তবু একটি বিশেষ মহলের রোষনলে ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর অবমূল্যায়নের বিষয়টি অবগত হয়ে তাঁকে কর্নেল থেকে সরাসরি জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করেন। যেহেতু জেনারেল ওসমানীর সর্বাধিনায়কত্ব সম্পর্কে সাংবিধানিক ও দালিলিক সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান সেহেতু কোনো ভাবেই তাঁকে আবেগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না। এতে পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কের পথ ধরে কোনো অপ্রিয় তথ্যের উপস্থিতি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

 

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, হাওরের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা): এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top