সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

১৯৭১: যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবাদ : সালেক খোকন


প্রকাশিত:
২ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫৩

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১০

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে নানাভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন কিছু মানুষ। ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়েই বিশ্বকে তারা আহবান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া তেমনি কিছু প্রতিবাদের কথা তুলে ধরা হলো:

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মানুষ। বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর থেকে অস্ত্র নিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ জাহাজ ‘পদ্মা’। ১৪ জুলাই ১৯৭১ তারিখের ঘটনা। একদল শ্রমিক ও স্থানীয় জনসাধারণ যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়। এ ছাড়া কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতকগুলো ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজের গতিপথও বন্ধ রাখে। এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস খান। তার সঙ্গে ছিলেন মি. ডিক টেলর, স্যালি উইলবি, স্টেফানি হলিম্যান, চার্লস গুডউইন, ওয়েইন লাউসার প্রমুখ। সেদিন এ আন্দোলনের কারণে তাদের গ্রেফতার করা হলেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করা যায়নি। এরপরই ধর্মঘট ডেকে বসে পোর্ট শ্রমিকেরা। ‘রক্তমাখা টাকা নেব না’- এমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানি জাহাজে মালপত্র তোলা থেকে বিরত থাকে। `No arms to Pakistan,’ `End all Us Aid to pakistan’- লেখা ফেস্টুন নিয়ে তারা সেদিন ধর্মঘট করে। এ আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচার করে গণমাধ্যমগুলো। ফলে মার্কিন জনগণ ভিন্নভাবে জেনে যায় বাংলাদেশে সংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা।

সাহসী এক লোকের নাম হার্ব ফিথ। অস্ট্রেলিয়ান। মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন তিনি। সময়টা মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তান সেনারা তখন ঢাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে। বন্দি করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সারাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। তারা নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালিকে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এ খবর প্রচার হতে থাকে গুরুত্বের সঙ্গে।

এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া’ ছিল প্রথম বিদেশি মিডিয়া, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ গণহত্যার নানা খবর প্রচারিত হতো। সে খবরগুলো স্পর্শ করে হার্ব ফিথ ও তার বন্ধুদের। ফিথকে প্রধান করে তারা তখন গঠন করে ‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ’ একটি কমিটি। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এ কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য লিফলেট, পোস্টার ও সেমিনারের মাধ্যমে প্রচার করে এবং বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে চাপ দিতে থাকে।

ছবি: একাত্তরে অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবাদের তৎকালীন সংবাদ

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে `Asia’s Flashpoint, 1971: Bangladesh’ শিরোনামে একটি বক্তব্য প্রদান করেন হার্ব ফিথ। সেখানে তিনি পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্থোলেমিড গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করে এর নিন্দা জানান। পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় লাভ এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায়যুদ্ধ তা স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়ে বক্তব্যে বিশদভাবে তুলে ধরেন।

হার্ব ফিথ ছাড়াও একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জনমত গড়ে তুলেছিলেন একদল অ্যাকটিভিস্ট। গণহত্যার প্রতিবাদে তারা মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কিলোমিটার দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডেভিড এলিস। আরও ছিলেন মাইক ক্রেমার, ডক্টর অ্যালেক্স রস প্রমুখ। অসুস্থতা, দুর্বলতা, সানস্ট্রোক ও পানিশূন্যতার কারণে অনেকে পদযাত্রা শেষ করতে না পারলেও লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন সাতজন। পদযাত্রাটি একাত্তরের ২০ নভেম্বর তারিখে শুরু হয়ে ৭ ডিসেম্বর ক্যানবেরায় এসে শেষ হয়। সেখানে ফেডারেল পার্লামেন্টের সামনে তারা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারকে বাংলাদেশের মানুষের নৈতিক অধিকারের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানান।

ছবি: সংগৃহীত

 

সালেক খোকন
লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top