সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

তেলিয়াপাড়া থেকে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের স্থান প্রস্তাব প্রসঙ্গ : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার


প্রকাশিত:
১৬ মে ২০২২ ২২:১১

আপডেট:
১৭ মে ২০২২ ০২:৪৫

ছবিঃ মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার

 

আমরা সকলেই জানি ১৭ এপ্রিল ‘৭১ তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করত সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ, নবগঠিত সরকারের শপথ গ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বিষয়ে এমন কিছু অজানা তথ্য রয়েছে যা- আজও ইতিহাসে অনালোচিত। তাই প্রথম সরকার গঠন প্রক্রিয়াটির সংক্ষিপ্ত বিবরন জানা দরকার। ইতঃপূর্বে আলোচনা হয়েছে, সেনা কর্মকর্তাদের তেলিয়াপাড়া সভায় সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সরকার গঠনের জোর তাগিদ আসে। ভারতীয় কর্মকর্তারাও সে বিষয়ে যারপরনাই তাগিদ দিয়েছিলেন। যে কারণে সংশ্লিষ্ট সভায় এ ব্যাপারে সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে দায়িত্ব প্রদান করলেও তারা নিজেরাও যার যার অবস্থান থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি গুরুত্ব সহকারে আহবান জানিয়েছেন।
মেজর খালেদ মোশাররফ ওই দিনের সেনাসভা শেষে শ্রীমঙ্গল এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে সিলেটের জননন্দিত নেতা ও নির্বাচিত এমএনএ দেওয়ান ফরিদ গাজীর সাথে তাঁর দেখা ও মতবিনিময় হয়। তখন তাঁর কাছে মেজর খালেদ অত্যন্ত উদ্বিঘœ হয়ে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার গঠন না করলে আমরা সরকার গঠন করতে বাধ্য হবো‘।
এ কে খন্দকার তেলিয়াপাড়া সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,‘সেখানে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি সরকার গঠন করতে হবে। এই সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এবং সেই সরকারের অধীনেই তাঁদের শুরু করা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধ চালানো এবং স্বাধীন সরকার গঠনের জন্য বাঙালি সৈনিকদের পক্ষ থেকে তখনই একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান তৈরি হয়।‘ তিনি আরও বলেন, ‘৪ এপ্রিল সেনা কর্মকর্তাদের সভায় সরকার গঠনের বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তটি ছিল যুগান্তকারী। ---যখন জাতি নেতৃত্বহীন এবং নেতারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন সেনা কর্মকর্তাদের এ সুপারিশ অস্থায়ী সরকার গঠন ও যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।’
৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সেনাসভার সময়কাল পর্যন্ত দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ কিংবা নির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ সরকার গঠনের কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হননি। এমতবস্থায় বিদ্রোহী সেনাবাহিনী এই রাজনৈতিক শূণ্যতার কারণে অহেতুক কালক্ষেপন না করে নিজেদের উদ্যোগেই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তারা নিজেদেরকে সামরিক অভ্যুত্থানের দায় থেকে সুরক্ষার জন্য কৌশলে দু‘জন সেনা কর্মকর্তা যাঁরা তখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও ছিলেন; তাঁদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ দু‘জন কর্মকর্তার একজন ছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী এমএনএ এবং অপরজন ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) এম এ রব এমএনএ। সত্তরের সাধারণ নির্বাচেনে একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন সিলেট থেকে অপরজন হবিগঞ্জ থেকে। তাই তখন পর্যন্ত কোনো সরকার গঠন দূরের কথা সামান্যতম রাজনৈতিক কর্মকান্ডও দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সেনাসভা এই চরম ক্রান্তিকালে সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং লে. কর্নেল এম এ রবকে উপসর্বাধিনায়ক মনোনীত করে। পাশাপাশি তাঁদেরকে সংসদীয় মহলে যোগাযোগ করে দ্রæততম সময়ের মধ্যে সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যও সভার পক্ষ থেকে তাগিদ প্রদান করা হয়।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। এই শূণ্যতার সুযোগে কী হতে পারতো আর কী না হতে পারতো সে ভাবনার ব্যাখ্যায় বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। আপাতত মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে হয় এ জন্যে যে, আকস্মিক এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোনো নেতা কর্তৃক নির্দেশের অপেক্ষা না করেই সর্বস্তরের মানুষ পতঙ্গের ন্যায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেয়ার সাহস পেয়েছিল। তাদের সে সাহস দ্বিগুণ বেড়ে যায় যখন বাঙালি সেনারা অকস্মাৎই দেবদূতের ন্যায় তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বলতে দ্বিধা নেই এই সাহসের মন্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। দীর্ঘ রাজনৈতিক তৎপরতায় তিনি বাঙালি মননে যে মুক্তির চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন তারই প্রভাবে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে স্বেচ্ছায় সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯০৫ থেকে সাতচল্লিশ পেরিয়ে ধাপে ধাপে সত্তরের বাঁকে এসে মুক্তির আন্দোলন একাত্তরের মোকাবেলা করে। এ আন্দোলন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণতি লাভ করবে সেটিই ছিল সকলের কাম্য। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অস্বাভাবিকতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় তৎকালীন স্বেচ্ছাচারী বর্বর শাসকচক্র। মুক্তির সংজ্ঞা তখন রাষ্ট্রীয় বিভক্তির আবেদনকে সাদরে বরণ করতে বাধ্য হয়। ফলত প্রত্যাশার স্বাদ বিস্বাদে পরিণত হয় বারুদ আর রক্তের গন্ধে। এই একাত্তর দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ অধ্যায় আর রক্তঝড়া মুক্তিযুদ্ধ তারই উপসংহার মাত্র। ইতিহাস বড় নির্মম। সে অনেক সময় এমন অনেক পাঠ শেখায় যা প্রত্যাশাকে অনায়াশে পদদলিত করে। দুঃখজনক বা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ভাগ্যের অনিবার্যতায় এই উপসংহার রচনায় প্রথমেই কলম ধরতে হয় সেনাবাহিনীর বাঙালি অংশকে। তখন যদি সাময়িক রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি না হতো তাহলে হয়তো রাজনীতিই সে উপসংহার রচনায় প্রথম কলম ধরতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি।
যাহোক পাকবাহিনীর হামলা ও রাজনৈতিক নেতাদের আত্মগোপনের জন্য সৃষ্ট ক্রান্তিকালে তাদেরকে খুঁজে সময় নষ্ট না করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়ার পথে সীমান্ত অতিক্রম করেই ভারতীয় সরকার প্রধানের সাথে যোগাযোগের চেষ্ঠা করেন। তিনি কেবলমাত্র ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের জন্য যান। সেখানে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। কাকতালীয়ভাবে এই ৪ এপ্রিলই ইন্দিরা-তাজউদ্দীন প্রথম বৈঠক অনুষ্টিত হয়। সভা শেষ হওয়ার পরপরই তিনি জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বিষয়ে বিএসএফ‘র মাধ্যমে জ্ঞাত হন। ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে এর পূর্বেই যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল তার কিছুই তাজউদ্দীন আহমদ তখন পর্যন্ত জানতেন না।
৪ ও ৫ এপ্রিল দুইদিন তাঁদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠককালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে সরকার গঠন বিষয়ে কিছু পরামর্শ প্রদান করেন। একই সাথে বিএসএফ‘র তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি গোলক মজুমদারকে ভারত সরকারের সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। গোলক মজুমদার প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায় : ‘আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সরকার গঠন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী এবং সমরপ্রধান নিয়োগ করতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সুযোগমত ওই দেশেরই কোনো স্থানে প্রকাশ্য সভায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ, সরকার গঠন, মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য যুবশক্তিকে যোগদান করতে আহবান প্রভৃতি অনুষ্ঠান ও প্রচারের আয়োজন সম্পূর্ণ করতে হবে।‘
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় তাজউদ্দীন আহমদ জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে প্রেরণের কথা। ঐ সভায়ই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রস্তাবিত বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের অভ্যন্তরে থেকে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার অলিখিত অনুমতি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়েও তখন আলোচনা হয়। তাই তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক দিল্লীতে বসেই রাজনৈতিক সরকার গঠনের পদক্ষেপ নেন। সেখানে অবস্থানরত রেহমান সুবহান, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখের সহায়তায় স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র ও প্রয়োজনীয় দলিলাদির খসড়া প্রণয়ন করা হয়। ওই সময়েই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতার ভাষণ প্রদানের জন্য একটি খসড়া প্রণয়নপূর্বক তা রেকর্ডও করা হয়। সংশ্লিস্ট রেকর্ডপত্রে ‘১০ এপ্রিল‘ তারিখটি যুক্ত করে চুড়ান্ত করা হয়েছিল। সে মতে আগরতলা এসে সেখানকার সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের তেলিয়াপাড়া থেকে আনুষ্ঠানিভাবে ঘোষণা করার কথা ছিল। অতঃপর তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে পরামর্শের জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন।
দিল্লি থেকে ৮ এপ্রিল কলকাতা ফিরে ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে আওয়ামী লীগ ও যুব নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন। সেখানে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের বিস্তারিত বিষয় অবহিত করলে তাঁকে তীব্র প্রতিবাদের মোকাবেলা করতে হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ যখন দিল্লিতে বসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে পরামর্শক্রমে যাবতীয় বিষয়াদি চুড়ান্ত করেন তখন যুবনেতৃত্বের প্রভাবাধীন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বৃহৎ অংশ কলকাতায় সমবেত হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র‘-এর আশ্বাসপুষ্ট হয়ে কোনো সরকার গঠন না করে ‘রেভলুশনারি কাউন্সিল‘ গঠনপূর্বক যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য এর কারণ ছিল, ইন্দিরা-তাজউদ্দীন বৈঠকের বিষয়টি তাঁদের ধারণায় ছিল না। এ ব্যাপারে ‘র‘-এর ধারণাকেই তাঁরা ভারতীয় সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ভেবেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ কলাকাতায় তাঁদের সাথে মিলিত হয়ে ইন্দিরা-তাজউদ্দীন বৈঠক ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বিবৃতি দিলে তাঁদের এ ক‘দিনের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। তাই তাঁরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তাজউদ্দীন আহমদের পরিকল্পনার সাথে তীব্র দ্বিমত পোষণ করেন। এতে নির্ধারিত ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে কোন বিবেচনা থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনকে অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবে উপস্থিত করেন তা ও ব্যাখ্যা করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার যৌক্তিকতা অথবা দিল্লি আলোচনার পদ্ধতিগত উপযোগিতা সম্পর্কে তেমন জোড়ালো প্রশ্ন না তোললেও অধিকাংশই বিতর্ক তুলেন মূখ্যতঃ তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি মন্ত্রিসভা গঠনেরই বিরোধিতা করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার গঠন সংক্রান্ত তাজউদ্দিনের প্রস্তাবিত বেতার বক্তৃতা বন্ধ করার দাবি জানান। শেখ মনি ও সিরাজুল আলমের পক্ষ হতে দাবি ছিল মন্ত্রিসভার পরিবর্তে ‘রেভলুশনারি কাউন্সিল‘ গঠনের। এ সকল কারণে সে সময়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
দিল্লিতে বসে এসব বিষয় চুড়ান্ত করার সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ মনে করেছিলেন যে, দলীয় ফোরাম তাতে তেমন কোনো বাঁধার সৃষ্টি করবে না। তাই তিনি ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া থেকে সরকারের আত্মপ্রকাশ এবং তারপর কোনো গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে হিসেবে ভাষণ প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিএসএফ‘র আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ভাষণের কপি বেতারে প্রচারের জন্য তখনই গোলক মজুমদারের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী শিলিগুড়ির একটি জঙ্গলে স্থাপিত গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ১০ এপ্রিল ভাষণটি প্রচার করার কথা ছিল। অতঃপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে এটিকে প্রচার করে এর বরাতে আকাশবাণী’র নিয়মিত কেন্দ্রসমূহ থেকে পূনঃপ্রচারিত হবে। পাশাপাশি অন্যান্য মিডিয়ায়ও এর প্রচার করা হবে। উক্ত সংবাদটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কর্ণগোচরেও ছিল।
৮ এপ্রিলের সভায় অবস্থা এমন এক প্রতিকুল পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় যে, জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সকল উদ্যোগ, সকল স্বপ্ন, সকল সম্ভাবনা চরম সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। ওই সভায় তিনি সম্পূর্ণ একঘরে অবস্থার শিকার হন। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে অবশেষে সংকট মোকাবেলা করে পরিস্থিতিকে জয় করেন। তিনি নিরাশ না হয়ে আগরতলা গিয়ে এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের প্রস্তাব করলে তাতে সকলে সম্মত হন। এক্ষেত্রে তাঁর বিরোধী পক্ষের ধারণা ছিল তারা ‘র‘-এর সাহায্যে ইন্দিরা গান্ধীর মাধমে এ প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে পারবেন। যদি তা নাও হয় তাহলে আগরতলা গিয়ে সকলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।
অপরদিকে তাজউদ্দীন সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনাকালে দলীয় সমর্থনের যে নিশ্চয়তা তিনি দিয়েছিলেন কিছুটা কালক্ষেপন করে হলেও তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এই বিচক্ষণতার অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে, চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আগরতলায় যাওয়ার প্রস্তাব করা। দিল্লি থেকে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তেলিয়াপাড়া থেকে ১০ এপ্রিল নতুন সরকার গঠণের ঘোষণা প্রদানের জন্য মনস্থির করেই কলকাতা এসেছিলেন। তাই তিনি কৌশলে লক্ষ্যস্থিত ১০ এপ্রিল আগরতলায় গিয়ে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক বেতার ভাষণ প্রচারের প্রস্তাব করলে উত্যপ্ত সভা সাময়িক ভাবে কিছুটা শান্ত হয়। বিবধমান দু‘পক্ষই নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সময়ক্ষেপনের সুযোগকে স্বাগত জানান। ৮ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে সময় মাত্র অত্যন্ত টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ৯ এপ্রিল তথা একদিন। সভা শেষে তাই দলীয় নেতাদের সাথে মতবিনিময়ে করে এ সময়টুকু অত্যন্ত ব্যস্ততার সাথে পার করেন।
অপরদিকে বিরোধীপক্ষের যুব নেতৃত্ব ভেবে দেখলেন যেহেতু তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ম্যান্ডেন্ট নিয়ে এসেছেন সেহেতু সেখান থেকেই বিষয়টির যবনিকাপাত করতে হবে। তাই তারা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুবনেতার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ‘র‘-এর মাধ্যমে তরিৎগতিতে একটি প্রতিবাদ লিপি দিল্লিতে প্রেরণ করে আগরতলা যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী এই দলীয় কোন্দলের বিষয়টিকে আমলে নেননি।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র‘-এর প্ররোচনায় সৃষ্ট দলীয় বিরোধিতায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনায় যে অশুভ ছায়া তখন প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে তাজউদ্দীন আহমদ কিছুটা মর্মাহত হলেও তিনি যেহেতু নিজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে মতবিনিময় করে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন সেহেতু তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, এসকল বাধা শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করা সম্ভব হবে। তাই তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ও দূরদর্শীতার সাথে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। বিষয়টি আরো এগিয়ে নেন তাঁর সহকারী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। তিনি সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চুড়ান্ত না হওয়া সত্তে¡ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ যথাসময়ে প্রচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্ববাসীর কাছে যেমন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হবে তেমনি দলীয় ফোরামে বিভক্তির দেয়াল টপকানোর পথও সহজ হয়ে যাবে।
১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর বেতার ভাষণটি প্রচার হতে পারতো। সে লক্ষ্যেই তিনি কলকাতা এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পরামর্শ করে আগরতলা যাবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কলকাতায় সৃষ্ট নানা প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে সাহসের সাথে পরদিন ১০ এপ্রিল সকালে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে একটি পুরানো ডাকোটা প্লেনে করে প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট সদস্যদের খুঁজতে বের হন। কিন্তু মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা ও শিলচর হয়ে সেদিন আগরতলায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর আগে তাঁকে শিলিগুড়িতেই রাত কাটাতে হয়। তখন তাঁর সাথে শেখ মনিও ছিলেন।
৮ এপ্রিলের সভার সিদ্ধান্ত ছিল ১০ এপ্রিল সকলে আগরতলায় গিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারিত হবে। কিন্তু আগরতলায় পৌঁছানোর আগেই ওই দিন দিবাগত রাত সাড়ে ন‘টায় ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের পরিকল্পনা মতো শিলিগুড়ির জঙ্গলে স্থাপিত একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক রেকর্ডকৃত ভাষণটি প্রচারিত হয়ে যায়। অতঃপর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আব্দুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ১১ এপ্রিল আগরতলা পৌঁছেন। খন্দকার মোশতাক এবং জেনারেল এম এ জি ওসমানী আগরতলা অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে বিশ্বের কাছে বার্তা পৌঁছে যায় বাংলাদেশের জন্য একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। অগত্যা শেখ মনি তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আগরতলায় গেলেও এই অনাকাঙ্খিত ঘোষণায় বিরক্ত হয়ে সেখানকার সংশ্লিষ্ট সভায় যোগদান করেননি। আগরতলা পৌঁছেই তিনি সীমান্তবর্তী কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।
১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলা পৌঁছে সেখানকার সার্কিট হাউজে প্রথমেই জেনারেল ওসমানীর সাথে বৈঠক করে তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত সেনাসভা ও এর আনুসঙ্গিক বিষয়াদি অবগত হন। অতঃপর সকলের উপস্থিতিতে রাতে সভা শুরু হয়। আগরতলা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২. তাজউদ্দীন আহমদ ৩. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ৪. এম মনসুর আলী ৫. খন্দকার মোশতাক আহমদ ৬. ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ৭. আব্দুস সামাদ আজাদ ৮. আব্দুল মান্নান ৯. ডঃ টি হোসেন ১০. এম আর সিদ্দিকী ১১. জহুর আহমদ চৌধুরী ১২. তাহের উদ্দিন ঠাকুর ১৩. মাহবুব আলম চাষী ১৪. আব্দুল মালেক উকিল ১৫. মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৬. কর্নেল ওসমানী ১৭. লে. কর্নেল আব্দুর রব ১৮. মমতাজ বেগম ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের এমপিএ, এমএনএ গণ উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রিসভার খসড়া, ক্ষমতার পরিধি, যুদ্ধের পরবর্তী কর্মপন্থা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনা-বিতর্কের পর তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃক প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার কাঠামোকেই চুড়ান্ত করা হয়। তবে এই মতৈক্যে পৌঁছুবার স্বার্থে মন্ত্রিসভার ক্ষমতার পরিসরে কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়। সে অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সদস্য হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে ড. কামাল হোসেনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তিনি তখন বন্দি থাকার কারণে বাদ পড়েন। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ বা সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হয়।
অতঃপর ১০ এপ্রিল তারিখটি যুক্ত করেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার কাঠামো সর্বসম্মতিক্রমে নীতিগত ভাবে সমর্থন করা হয়। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলেও অনুমোদিত খসড়া অনুযায়ী ১০ এপ্রিল তারিখটিই বহাল থাকে।
এর আগে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র সিংহের কার্যালয় থেকে ৯ এপ্রিল জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ১০ তারিখে আগরতলা আসবেন। তারপর বাংলাদেশ ভূখÐের তেলিয়াপাড়ায় গিয়ে শপথ নিবেন। এ সংবাদটি রাতের মধ্যেই মাধবপুর পৌঁছে যায়। পরদিন ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া বাংলোতে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় সেনা বৈঠকের সময় সেখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেদিন সেখানে তা হয়নি।
১০ এপ্রিল সরকার গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ অবশ্য তেলিয়াপাড়ার পরিবর্তে তা আগরতলায় বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। তিনি ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয়। এবং তা “মুক্তি বাহিনী” পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। মাত্র ছ‘দিন পরে, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল, নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিষয়টি আগরতলায় বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।‘
অপর দিকে আব্দুস সামাদ আজাদ এক সাক্ষাৎকারে ১১ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকার গঠন সম্পর্কিত সভার বরাত দিয়ে বলেন : ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, আবুল মনসুর, কামরুজ্জামান, আমি সবাই মিলে ঠিক করলাম কি রকম সরকার হবে, কোথা থেকে ঘোষণা হবে ইত্যাদি। মনিদেরও বলা হলো। কিন্তু ঘোষণার জায়গা কোথায় হবে সেটা বলা হলো না। প্রথমে বলা হয়েছিল সিলেটের মনতলা থেকে প্রবাসী সরকারের ঘোষণা দেয়া হবে। ইন্ডিয়ান এডভাইজারদের সাথে কথা হলো। তারা বললেন, মনতলা থেকে করা হলে তা বিশ্বকে জানানো কষ্টকর হবে। বিচ্ছিন্ন জায়গা।‘
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জনাব সফিউল্লাহ বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিষয়টি তেলিয়াপাড়ার পরিবর্তে আগরতলায় বাস্তবায়িত হওয়ার কথা এবং আব্দুস সামাদ আজাদ মনতলার কথা বলেছেন। তেলিয়াপাড়া এবং মনতলা একই উপজেলার পাশাপাশি ইউনিয়নে অবস্থিত। এর সাথে সহমত পোষণ করেই বলা যেতে পারে যে, ইন্দিরা-তাজউদ্দীন বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। সে জন্যেই ৮ ও ৯ এপ্রিল কলকাতায় সৃষ্ট প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তাঁরা কলকাতা থেকে সুদূর আগরতলায় আসেন। ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় পূর্ব নির্ধারিত দ্বিতীয় সেনা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদি সেনাবাহিনীর ঐ দ্বিতীয় বৈঠক সরকার ঘোষণার জন্য তাঁদের টার্গেট না হতো তাহলে তখনকার বাস্তবতায় অত্যন্ত কষ্টসাধ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিস্থিতির মারাত্মক চাপ সত্তে¡ও নিকটবর্তী মেহেরপুর তথা সমগ্র বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে একদিনের ব্যবধানে তেলিয়াপাড়ার অদূরবর্তী আগরতলায় আসার কী-ই বা কারণ ছিল?
তেলিয়াপাড়া থেকে সরকারের ঘোষণা আসার প্রশ্নে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছিলাম: দিল্লিতে ইন্দিরা-তাজউদ্দীন বৈঠকের আলোকে ১০ এপ্রিল আগরতলায় এসে সরকারের ঘোষণা দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচারের কথা ছিল বলে শোনা যায়। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, ঐদিন আগরতলার নিকটবর্তী তেলিয়াপাড়াতে এসে সেই নির্ধারিত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করার কথা ছিল। তা সঠিক কিনা? তিনি ‘না‘ সূচক উত্তর দিলে জানতে চাই, ‘তাহলে কলকাতায় ৮ ও ৯ এপ্রিলের বৈরি পরিস্থিতিতে অমিমাংশিত সরকার গঠন প্রক্রিয়ার চাপ উপেক্ষা করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সদলবলে আগরতলায় আসার প্রয়োজন কী ছিল?‘ তিনি এর উত্তর পাশকাটিয়ে জানান, ‘পূর্বাঞ্চলের নেতাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য আসা হয়েছিল।‘ তখনকার যোগাযোগ বাস্তবতা ও দলীয় মারমুখী বৈরীতার চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে তা সম্ভব এবং উপযোগীতা ছিল কিনা তা বিবেচনার ভার পাঠকের। তবে সে পরিস্থিতির একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলামের উত্তর কোনোভাবেই প্রত্যশিত ছিল না।
তেলিয়াপাড়ায় সরকার গঠন পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলা এসে প্রথমেই কর্নেল ওসমানীর সাথে বৈঠক করে এখানকার সার্বিক বিষয় অবগত হন। তিনি তেলিয়াপাড়ার ভৌগোলিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ও অবগত হন। আলোচনায় কর্নেল ওসমানী জানান যে, স্থানটি ঢাকা-সিলেট সড়ক ও রেলপথের সহ্নিকটে হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান। তাছাড়া পাকবাহিনী তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় জঙ্গীবিমান থেকে বোমা হামলা চালাতে গিয়ে তেলিয়াপাড়া অঞ্চল পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে থাকে। পূর্বদিন অর্থাৎ ১০ এপ্রিল সেখানে বোমা হামলার গোপন সংবাদ ছিল বলেও তিনি জানান।
এ সকল বিষয় বিচেনায় নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ জেনারেল ওসমানীর মতামত নিয়ে তেলিয়াপাড়ায় শপথ গ্রহণের বিষয়টি নাকচ করেন। কেউ কেউ এর দক্ষিণ দিকস্থ একই উপজেলার পার্শ্ববর্তী বহরা ইউনিয়নের মনতলায় শপথের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আগরতলা থেকে মনতলায় যোগাযোগের কোনো সহজ রাস্তা না থাকায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক মহলের অজুহাত দেখিয়ে তাতে অসম্মিত জ্ঞাপন করে। ফলে ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার সীমান্ত এলাকায় স্থান নির্ধারণপূর্বক ১৩ এপ্রিল তারা আগরতলা থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
যথেষ্ট গোপনীয়তা সত্ত্বেও বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ হয়ে যায়। যার প্রেক্ষিতে সেখানে পাকবাহিনী ব্যাপকভাবে বোমা হামলা চালালে সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। অতঃপর কঠোর গোপনীয়তার সাথে মেহেরপুর মহকুমার ভবেরহাট বৈদ্যনাথতলায় স্থান নির্ধারণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট স্থানটিকে ‘মুজিবনগর‘ নামকরণ করত সেখানে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দ্রæততার সাথে কলকাতায় ফেরত যাওয়া হয়।

 

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, হাওরের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা। সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা): এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top