সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের পদযাত্রা, বিস্মৃত এক মুক্তিযুদ্ধ : সালেক খোকন


প্রকাশিত:
১৩ জুন ২০১৯ ০৭:১০

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২১:২৭

সালেক খোকন

 

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। খোলা হয় শরণার্থী শিবির। প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্ধিরা গান্ধী সরকারের ওপর। ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারকে চাপ দিতে থাকে। 

ঠিক ওই সময়েই পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ আয়োজনের। এতে অংশ নেয় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বাংলাদেশের ৩৮জন শিক্ষিত যুবক। ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। 

পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে জনসভা করতেন। গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর। তাঁদের সকলের হাতে হাতে শোভা পেত- ‘আমাদের এক কথা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা’,  ‘মুজিবের মুক্তি চাই’ সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা। ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত । দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর। এভাবে  মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ^ বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

পদযাত্রী দলের ডিপুটি লিডার-০২ ছিলেন কামরুল আমান। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। আলাপচারিতার শুরুটা তাই গণহত্যা দিয়েই। 

‘২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের মধ্যেই ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কারফিউ চলছিল। তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই নারায়গঞ্জ থেকে রওনা হলাম ঢাকার দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে ৭-৮জনের গলাকাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানেন না। দেহ তখনও কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কব্জি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারি পট্টিতে। আহারে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারি পট্টির প্রবশেমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে তার চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!’

আর্মিরা নারায়নগঞ্জ দখলে নিলে কামরুলসহ কয়েকজন ট্রেনিংয়ের জন্য কুমিল্লার রামকৃষ্ণপুর হয়ে চলে আসে আগরতলার গোকুননগর রিক্রুটিং ক্যাম্পে। ট্রেনিং শুরুর দেরি দেখে কামরুল চলে যান কলকাতায়।

কলকাতায় সিপিএম অফিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় দেবেন সিকদারের। তাঁর পরামর্শেই তিনি কাজ শুরু করেন যশোরের বেনাপোলে, ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরে। সীমান্ত এলাকার শরণার্থীদের সেবা ও সাহায্য করাই ছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ। তাদের মাধ্যমেই তিনি রিক্রুট হন ‘বিশ^ বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটিতে।

সে ইতিহাস শুনি কামরুল আমানের জবানিতে- 

‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মন্ডল’ নামের একটি সংগঠন। এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর  অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ৮টি সংগঠনের সম্মিলনে। এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিচ ফাউন্ডেশন। পদযাত্রার মূল উদ্যোগতা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ন এবং আহবায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জী।

কামরুল আমান, ১৯৭১-এ বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রীদের ডিপুটি লিডার-০২

আমাদের ৩৪জন বাছাইয়ে কাজ করেন যশোরের শাহ্ হাদিউজ্জামান, মরহুম এম রওশন আলী, বিমল রায় চৌধুরী ও শেখ মোখলেসুর রহমান খোকন। বনগ্রাম থেকে ১৪ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখে আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছি। সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য শপথ নিই। বাকী ৪জন পরে এসে যোগ দেন মুর্শিদাবাদে।’

পদযাত্রীদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন-

‘লিডার ছিলেন আবদুল খালেক। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের ছাত্র। ডেপুটি লিডার-১ খুলনার একরামুল ইসলাম। আমি ছিলাম ডেপুটি লিডার-২। বাকিরা হলেন: রফিকুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, মুরারী মোহন সরকার, বিনয় কুমার বিশ্বাস, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ আবু বকর, পরিতোষ কুমার ম-ল, আব্দুল লতিফ(১), আব্দুল লতিফ(২), সৈয়দ রবিউল হক, দুলাল দত্ত ম-ল, ওহিদুজ্জামান চাকলাদার, তুষার কান্তি সুর, শেখ আনোয়ার কামাল, সুভাষ চন্দ্র বসু, অমিত দেব, ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, আনন্দ মোহন রায়, প্রদীপ কুমার শীল, আব্দুস সামাদ, আনোয়ারুল কাদির, পরিতোষ কান্তি কবিরাজ, দেলোয়ার হোসেন, অনিল কুমার বিশ্বাস, মইন উদ্দিন, সহিদুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সাহা, সমীর কুমার বসু,ওমেদ আলী, আবু বকর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিলাল দাস, অহিভূষণ চক্রবর্তী, সনৎ কুমার বিশ্বাস, আশরাফ হোসেন, দিলিপ কুমার নাগ।’

পদযাত্রা শুরুর আনুষ্ঠানিকতা জানালেন কামরুল আমার। তাঁর ভাষায়-

‘শুরুর আগের দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর, ১৯৭১ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে র‌্যালিসহ একটি জনসভায় প্রথমে আমাদের অভিনন্দন জানানো হয়। রাজ্যের প্রাক্তণ মূখ্য মন্ত্রী প্রফুল্য চন্দ্র সেনের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গান্ধীপন্থী লেখক মৌলভি রেজাইল। অতঃপর আমরা ইয়াহিয়া খানের বর্বর আক্রমণের বর্ণনা তুলে ধরি। বক্তব্য দেন, মোহাম্মদ একরামুল, শ্রী দেশাই, আবদুল খালেক প্রমুখ । পরদিনই বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ আমরা বহরামপুর হতে গোকরনার দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি।

বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা। প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হত। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হত জনসভার। উঠোন বৈঠকও হয় অগণিত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়। এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তি নিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রাণিগঞ্জ, আসানশোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লাখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে। 

৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধী প্রয়াণ দিবস। ওই দিন দিল্লীর রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে-এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগেই স্বাধীনতা লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়।’

২২ অক্টোবর ১৯৭১, শান্তি নিকেতনের পথে পদযাত্রার দল

পদযাত্রা নিয়ে ওইসময় ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

কামরুল আমান বলেন-‘পদযাত্রায় স্থানীয় জনগনই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। পাটনাতে যখন গেলাম ওখানকার চিফ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়। বক্তৃতায় বললাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা, গলা কাটা লাশ, বিশ^বিদ্যালয়ে লাশের মাটিচাপা, পুরনো ঢাকার মানুষ পোড়ানো, মানুষের চর্বি গলানো মেঝেতে নিজের পায়ের ছাপ। লিডার খালেক বললেন, রাজশাহীতে গণহত্যার বর্বরতার কথা। আমাদের বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে ট্রানসেল্ট করে বলা হচ্ছিল তখনই দেখলাম ওখানকার মানুষ হু হু করে কাঁদছে। 

লাখনৌ ইউনির্ভাসিটিতে আমাদের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মিলায় ছাত্রছাত্রীরা। মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে তারা। সেইদিনই বুঝেছিলাম আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা আসলে মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে।’

ভিন্ন অভিজ্ঞতাও ছিল কামরুলদের। তাঁর ভাষায়-

‘মুর্শিদাবাদে এক উঠোন বৈঠকে ভারতীয় একদল মুসলমান আমাদের ওপর বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান ছিল একটা মুসলমানের জায়গা। তোমরা সেটা ভেঙে দিতেছ। এক কোটি লোক আইসা আমগো উপর খাইতাছ। আমগো ভারতও ধ্বংস করবা তোমরা। যুদ্ধ তোমাদের। কিন্তু সৈন্য মরে আমগো। এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নাই। বিদায় হও তোমরা।’ আমরা ধৈর্য হারাই না। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। মুসলমান ব্যাপার না, আসল বিষয় শোষণ আর নির্যাতনের। শুধু কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই ছাড়া ভারতের মুসলমান গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সময় বেশ কনফিউজড ছিল।’ 

বিশ্ব ভারতী মিলনায়তনে বক্তব্যরত কামরুল আমান

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশ তখন স্বাধীন। ১৮ ডিসেম্বর লাখনৌতে বিশাল আয়োজনে উদযাপিত হয় বিজয় দিবস। ভারতীয় বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী, ক্যাডেট, স্কাউট, গার্লসগাইড ও জনসাধারণের সাথে বাংলাদেশের ডেলিগেট হিসেবে জাতীয় পতাকাসহ অংশ নেয় পদযাত্রার দলটি। উক্ত অনুষ্ঠানের সংবাদ ওইসময় ভারত ও বিদেশি রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশে ফিরে আসে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ দলটির যুবকেরা। 

কামরুল আমান আক্ষেপের কথাগুলোও জানালেন-

মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ, সেটি ভারতীয়সহ  বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল আমাদের কাজ। আমার কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। আজ যদি দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে এই ৩৮জনকে কিন্তু গুলি করে মারা হতো। কই, দেশ তো আমাদের মনে রাখেনি। কোনো আফসোস নেই, কিন্তু কষ্ট আছে। যেসকল ভারতীয় নেতারা ‘বিশ্ব  বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমান সরকার তাদের এনে সম্মাননা দিয়েছেন। সেটিও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যারা প্রত্যক্ষভাবে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন রাস্ট্র তো তাদের ইতিহাসটুকুই সংরক্ষণ করল না। এ প্রজন্ম জানেই না ‘বিশ^ বিবেক জাগরণ পদযাত্রার’ ইতিহাসটি। এমন কষ্ট বুকে নিয়ে কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছেন একরামুলসহ পদযাত্রা দলের কয়েকজন। পদযাত্রার ইতিহাসটাই আজ বিস্মৃতি। এটা তো আমরা আশা করিনি!

 

সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক
www.salekkhokon.net

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top