সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

একটি সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া (এবং সপ্তেন্দ্রিয়) : সম্বুদ্ধ সান্যাল


প্রকাশিত:
২ জুন ২০২০ ০০:৪৫

আপডেট:
২ জুন ২০২০ ০০:৪৮

 

 “পালং শাকের চচ্চরীর মধ্যে এটা কি! চিকেন!!”

প্রশ্নটা শুনেই আমার ভিরমী খাওয়ার জোগার। আঁতকে উঠে ছুটলাম ডাইনীং টেবিলের কাছে। নন্দিনীর চোখগুলি দেখছি বিষ্ফারিত।

“কই, দেখি।” বলে মাংসের বাটি হাতে নিয়েই নাক মুখ কুঁচকে উঠলাম, “যাঃ... এ হে হে হে হে, ছি ছি ছি।”

“যেটা পারবে না, সেটা করতে যাবে না। দিলে তো লাঞ্চের বারোটা বাজিয়ে। এমন শীতের রোববারে একটু ভাল করে খাব, সব শেষ করে দিলে তুমি। চিকেনের মধ্যে পালং শাক দেওয়ার আগে একবার দেখে নেবে না কি দিচ্ছ?”

“না... মানে... আমি তো... ধনেপাতা দিয়েছিলাম। পালং শাক এল কোত্থেকে বুঝতে পারছি না তো। একেবারেই খাওয়া যাচ্ছে না ওগুলো বেছে? লবণ টবণ ঠিকই আছে। একবার চেখে দেখো তো।”

চামচে করে অল্প একটু ঝোল পালং শাকগুলোর মাঝখান থেকে নিয়ে নন্দিনী মুখে তুলল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম দ্বিতীয় কমপ্লিমেন্টের জন্য। প্রথমটায় একেবারে সেমসাইড করে ফেলেছি।

“নাহ্‌, দূর, পালং শাকের গন্ধটাই নাকের মধ্যে লেগে আছে। শাক বেছে রাখলে কি আর তা যায়? ঝোলটাও কেমন ট্যালটেলে করেছ। মশলার কোনও গন্ধই নেই, লবণটাও ঠিকঠাক দাওনি। এ কি খাওয়া যায়? বাইরে ফেলে দিলে কুকুরেও খাবে না। প্রথম থেকে বলছিলাম আজ ছুটি কাটাই। এখন দয়া করে বাইরে বেরিয়ে দেখ হোটেল থেকে কিছু জোটে কিনা।”

আজকে আমার প্রথম চিকেন রান্নার দিন। এই ইন্টারনেটের যুগে নারী-পুরুষেরা অন্তত রান্নাঘরে সমানাধিকার পেয়েছে বহির্জগতে যাই হোক না কেন। সেইমতো প্রতিদিনের রান্নার রাঁধুনীকে বাদ দিয়ে আজ আমারও একটু ইচ্ছে জেগেছিল চিকেন রান্না করার। তা সকালেই নন্দিনীকে বললাম, “হ্যাঁ গো, প্রতিদিন তো মাসিই রান্না করে যায়, আজ চলো না আমরা দুজনেই কিছু করি মাসিকে ছুটি দিয়ে। আমি বাজার করে আনছি, তুমি লিষ্ট করে দাও কি কি আনতে হবে। তবে মাংসটা কিন্তু আজ আমিই রাঁধব। কাল রাতে নেট থেকে একটা দারুণ রেসিপি পেয়েছি।”

প্রথম প্রথম নন্দিনী একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে এক বৈবাহিক রোমান্টিকতার উৎসাহে সে রাজি হয়ে লিষ্ট করে দিয়েছিল, আমি বাজার। কিন্তু তার যে এমন পরিণতি হবে শেষে তা কখনই ভাবতে পারিনি। আসলে চিকেনের মধ্যে ধনে পাতা দেওয়ারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রাতের পালং পনীরের জন্য রাখা শাকের সঙ্গে ধনে পাতার পার্থক্যটা রবিবাসরীয় উন্মাদনায় ভুলেছি। তবে মাংসটাকে চচ্চড়ি বলায় মনটা একটু খারাপ হলেও সেটা দেখতে মোটেও তেমন হয়নি। অবশ্য নিজের রান্নার স্বাদ প্রত্যেকেরই বরাবর সবচেয়ে ভাল লাগে। আমিও খেয়ে দেখলাম সেখান থেকে, বেশ স্বাদ এসেছে, নতুনত্ব। কিন্তু তা বার বার বলাতেও নন্দিনী খেতে রাজি হলো না আর। অগত্যা হোটেল। খেলে যে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো বুঝলাম না।

বছর দশেক আগে যখন রঙ দে বাসন্তী সিনেমা রিলিজ করলো, তখন আনন্দবাজারে তার একটা সমালোচনা বেরলো ‘পত্রিকা’য়। সিনেমা দেখার আগে সমালোচনা পড়ে গল্পের খানিক আঁচ সেই সময় পেয়ে যেতাম এর মাধ্যমে। হেডলাইনে লিখেছে দেখলাম, ‘হতাশ করলেন এ.আর.রহমান’। মনটা ভেঙে গেল রহমানের ফ্যান হিসেবে। গানগুলি আমাদের বেশ ভালই লেগেছিল। ভেবেছিলাম সেটা অবশ্য গুরুদেবের গান হিসেবেই লেগেছে, আনন্দ যা বলছে তাই আসলে সঠিক। কিন্তু লুজ কন্ট্রোল সমেত অন্য গানগুলিও যখন নানা মেডিয়ায় যথেষ্টই জনপ্রিয় হয়ে উঠল, তখন বুঝতে শিখলাম, আচ্ছা, সেটা আসলে আনন্দবাজারের সমালোচনা ছিল। তার পর থেকে নানা কাজে সমালোচনামূলক নানা সমস্যার সন্মুখীন হয়েছি এ যাবৎ, এবং শেষে মানতে বাধ্য হয়েছি এই জাতিটির প্রত্যেকেই একজন সুচারু সমালোচক।

বাঙালি সমাজের কোথায় সমালোচনা নেই তা খুঁজতে গেলাম একবার সান্দাকফুতে। বহু কষ্টে উপর অবধি পৌঁছালাম আমরা পাঁচজন। যাতায়াতের পথে জোগারযন্ত্রের যাবতীয় ভার ছিল আমার উপর। মানেভঞ্জনেতে পৌঁছানোর পর থেকেই বুঝতে শুরু করলাম কর্মের গাফিলতিগুলো। সমস্ত মেনে নিয়ে এগোতে লাগলাম। পথে যেতে যেতে প্রত্যেকের ডিম খাওয়ার শখ হলো হঠাৎ। আগের থেকেই সেদ্ধ করা ছিল সেগুলি। বল্টুর ব্যাগের থেকে বেরলো ডিমের ট্রে। গুনে দেখা গেল পাঁচজনের জন্য সেখানে বরাদ্দ আছে নয়টি। সবাই এর ওর মুখ চায়, পরিশেষে সবাই আমার দিকে। আমারও পরিষ্কার মনে আছে দশটি ডিমের কথাই। কিন্তু ডিমগুলি ব্যাগে ঢোকানোর সময় বল্টুই আগ বাড়িয়ে সেই ট্রে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। এখন দেখি সেই সবার আগে আমার কর্মে কি গাফিলতি, তা বোঝাতে লেগেছে। কি আর করি, সব মেনে নিলাম একটি মাত্র ডিম হাতে।

সান্দাকফু পৌঁছে শুনি তেমন ওয়েদার নাকি গত এক বছরে দেখা যায়নি, এত পরিস্কার দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। অন্য সময় তার পেটের কাছে সকালের পর মেঘ জমে গেলেও সেদিন একেবারে ঝকঝকে। প্রত্যেকেই চুপচাপ পটাপট ছবি তুলে চলেছে নানারকম ক্যামেরায়। আমরাও খাদের একটি ধারে পাঁচজন মিলে বসে দেখতে লাগলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা।

এমন সময় পেছন থেকে কন্ঠস্বর পেলাম, “আজকের দিনটা সত্যিই কি পরিষ্কার, সবাই বলছে জানো যে এমন পরিস্কার গত এক বছরে দেখা যায়নি।”

পরের কন্ঠটি খানিক গম্ভীর। প্রত্যুত্তরে বলতে শুনলাম, “হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তবে যদি সূর্যের আলোটা আর ষোল ডিগ্রী কোন করে ওই পান্ডিমের উপর পড়ত, তবে তার বরফের থেকে আলো রিফ্লেক্ট করলে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যা দেখাত না... উফফফ।”

শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একদম আপাদমস্তক হনুমান টুপি, সোয়েটার, কম্ফোর্টারে ঢাকা এক নিপাট বাঙালি দম্পতি।

বাঙালি প্রকৃতির সমালোচনা করতেও বাদ দেয় না। আমাদের স্কুলেই তার নমুনা আছে। পশুপতি স্যার একবার ক্লাসে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বলেছিলেন, “জানিস তো। ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সময়েই একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে আছে।  এই পৃথিবীটা যদি আর পাঁচ হাজার নয়শ সাতান্ন কিলোমিটার দূর অবধি ছিটকে যেত, তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে চিন্তা আরও পাঁচশ বছর পরে করলেই হত। ব্যাড লাক।”

সমালোচনায় পড়লে আমি সব সময় ঈশ্বরকে স্মরণ করে খানিক ভরসা পাই। এই প্রসঙ্গে আমার একখানি গল্প শোনা ছিল। ঈশ্বর একবার বঙ্গ পরিভ্রমণে এসেছেন। উপর থেকে দূরবীন দিয়ে তাঁর ঝকঝকে কলকাতা শহরটাকেই চোখে পড়ায় ল্যান্ড করলেন সেখানে। শহীদ মিনারের পাশের মাঠে দেখতে পেলেন একজন ক্রমাগত ভগবানকে দোষারোপ করে চলেছে তার অসহায়তার জন্য। উদ্গ্রীব হয়ে ভগবান এগিয়ে গিয়ে তার সমস্যা জানতে চাইলেন, “কি বাছা? তোমার কীসের এত মনোঃকষ্ট?”

“আপনি কে মশাই, যাত্রাপাড়ার হীরো নাকি?” ব্যাক্তিটি জবাব দিলেন।

“না, আমি এই ব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা, দেবাদিদেব মহাকালেশ্বর মহামহিম মহেশ্বর। তোমার সব দুঃখ আমি এক নিমেষেই হরণ করতে পারি। বলো বাছা, তোমার কি চাহিদা?”

ব্যাক্তিটি এমন অফার সামনে পেয়ে তার সমস্ত ক্ষোভের কারণ ঈশ্বরের সামনে ব্যাক্ত করলো। ঈশ্বরও নিমেষেই তার সমস্ত দুর্ভোগ এক লহমায় সমাধান করে ফিরে গেল অমরাবতীতে।

এর বছরখানেক পরের ঘটনা। ব্যাক্তিটি এখন গলফগ্রীণের একটি বহুতলে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে সুবর্ণপালঙ্কের উপর সভাসদ সন্মুখে উপবিষ্ঠ। মুখটি তার বড়ই উদাস। তার ভক্তজনের মধ্যে একজন হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “হে মহাকবি, কদিন যাবৎ দেখতে পাচ্ছি আপনার মুখটি বড়ই উদাস। ঈশ্বরপ্রদত্ত হয়ে ফিরে এসেছিল আপনার কবিত্ব শক্তি, তার উপর ভর করে প্রবল বিক্রমে আপনি সারা ভারত প্রেমী। তবুও আপনি এত উদাস কেন?”

ব্যাক্তিটি উত্তর দিয়েছিলেন, “ধুর, কীসের ঈশ্বর? আমি কলম না ধরলে ঈশ্বর আমার‍ কবিতা লিখে দিতেন? আর ঈশ্বর টিশ্বর কিছুই নয়, ব্যাটা স্রেফ ফাঁকিবাজ। সারাজীবনে যত কবিতা লিখেছি, তা সবই সমাদর পেয়েছে তা তোমরা জানই। এতদিন এইভাবে কাটিয়ে দেখলাম, কী আছে এই ভোগবিলাসে? আমি কী আর বাবুঘাটের গঙ্গার হাওয়া পাই এখন? কিম্বা বকখালি সমুদ্রের ছিটে? যেখানেই যাই, খালি মেডিয়া আর প্রচার। ঈশ্বর যদি সত্যিই তিনি হতেন, তবে আমার সবদিক বিবেচনা করেই বরটা দিতেন। এমন উদাস হয়ে কাটাতে হতো না আমাকে। এখন আমি বুঝতে পারি ওটা সত্যিই ঈশ্বর ছিল না। মহা ফাঁকিবাজি দিয়ে নাম কিনে নিয়ে গেছে সেই সময়ে।”

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি কাহিনীও মনে পড়ল এখন। একদিন এক অভাগা এসেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। তার বড়ই কষ্ট, যদি কোনও সুরাহা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন কী সমস্যা। লোকটি উত্তর দিলেন, “বাবু, আমার বড়ই কষ্ট। এই বয়াসে আর খ্যাটে খাওনের ক্ষ্যামতা নাই। পোলাডা অর বউডারে লইয়া ছাইর‍্যা গ্যাছে। মাইয়াডাও পলাইছে তার মাস্টরের সনে। এখন আমার আর বউডার খুব কষ্ট বাবু, কিসু যদি উপায় করেন...”

রবীন্দ্রনাথ বিচক্ষণ মানুষ। তিনি কলম নিয়ে খসখস করে একটি কাগজের উপর যত্ন করে একখানি কবিতা লিখে দিয়ে নিপাট গ্রাম্য বললেন, “অ্যাই ন্যা র‍্যা। তর জন্যি অ্যাই কোবতাডা লেইখ্যা দ্যালাম। এইডা তর কাছে রাইখ্যা দ্যা। এই কোবতাডাই তর খাওনের বন্দোবস্তি করপানে।”

বেশ কদিন বাদেও তার দুঃখ দুর্দশা না ঘোচায় সে আবার কবিগুরুর কাছে গিয়ে সমস্ত সমস্যা আবার বলল। কবিগুরু সব শুনে বললেন, “করছস কী, কোবতাডা বেচস নাই? কনে রাখছিস ওইডা। ব্যাচলে অনেক পয়সা পাইতিস।”

লোকটি সব শুনে তো হাঁ, বলল, “আবনে আগে কইব্যান ত ওডা ব্যাচতে হবেক। আমি আর আমার বউ মেইল্যা তো ওটা জল দিয়্যা খায়া ফেলাইছি। বড়ই বিস্বাদ লাগছিল, তবু ভাবলাম আপন্যার মত ভগবানের দান যহন, নিশ্চই কিছু হবে। কই মশাই, কিছুই ত হল না। খানিক বাদেই খিদ্যা পেয়্যা গেল। আবনে আগে কইব্যান ত যে ওডা ব্যাচতে হবে!”

কবিগুরু স্তম্ভিত। বললেন “করছস কী, ওডারে খাইত্যা গেলি কেন? কি জ্বালা!”

“আবন্যাই ত সেদিন কইল্যান কোপ্তাডা রাইখ্যা দ্যা, কামে আইবে। আমি আর বউ মেইল্যা কোপ্তা ভাইব্যা খাইছি। ব্যাচবার কথা ত একবারেই কননি। তা হেগডু বিস্বাদ লাগছিল বড্যা, কিন্তু ভাইবল্যাম বড়মানুষদ্যার কোপ্তা, এমনই তার ট্যাস।”

এই শুনে কবিগুরুর মাথায় হাত।

যাক গে সে প্রসঙ্গ। সমালোচনার কথা বলতে গিয়ে সবার আগে যেটা মনে আসে, সেটা সবার শেষে বলি তবে। করিমপুরের নরহরি সেন বড়ই ভাল মূর্তি গড়েন। তবে তার ধরণে কোনও নতুনত্ব নেই। গরপরতা নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ সমেত মানুষের অবিকল প্রতিকৃতি। আমাদের কৃষ্ণনগরের এম.এস.এম.ই. দপ্তরে তার নিত্যি যাতায়াত এই প্রসঙ্গে। একদিন তিনি শুনলেন রাজ্য সরকার কর্তৃক হস্তশিল্প মেলার আয়োজন হয়েছে, জেলার থেকে নানা হস্তশিল্প অফিসে জমা নেওয়া হচ্ছে। তিনিও তার একটা মূর্তি নিয়ে গেলেন। মূর্তি জমা নেওয়ার ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন সেই সকাল থেকে। এমন সময় এক বাবু তাকে দেখতে পেয়ে কুশল জিজ্ঞেস করে তার তৈরি সামগ্রী দেখতে চাইলেন। নরহরি বাবু তার মূর্তিটি দেখাতেই বাবু বলে উঠলেন, “কি মশাই, এতদিন ধরে মূর্তি তৈরি করছেন, এবার একটু নতুনত্ব আনুন। একই মূর্তি বার বার নিয়ে আসেন!”

নরহরি বাবু ভোলাভালা মানুষ, শিল্প জগতের অত রীতিনীতি বোঝেন না। তিনি হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “তা বাবু, আপনেই বলে দেন কি করতে হবে আমার?”

“দেখিয়ে দিই তাহলে, আসুন এদিকে।” নরহরিকে নিয়ে বাবু এগিয়ে যান মূর্তির দিকে। মূর্তিটি দেখিয়ে বলতে থাকেন, “এই দেখুন, আপনি এই মূর্তি তৈরি করেছেন, এটা আর পাঁচটা মূর্তির মতই। এই যদি আপনি ধরুন মূর্তিটির নাকটি না রাখতেন, তবে মূর্তিটি কথা বলত। মানুষের আকর্ষণ বাড়ত দেখে।”

নরহরি বাবুর সঙ্গেই তার যন্ত্রপাতি ছিল। বাবুর কথামত তিনি মূর্তিটির নাকটি ভেঙে দিলেন। এরপর সেই মূর্তি চোখে পড়ল কেরাণী জ্যোতি চক্রবর্তীর। জ্যোতিবাবুরও একই কথা, মূর্তিটি আরও মিনিংফুল করে তুলতে হবে। তিনি বললেন ডান হাতটি ভেঙে দিলে ছবিটি আরও কথা বলে উঠবে। নরহরি বাবু সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতটিও ভেঙে দিলেন।

এরপর আসলেন সমিত সেন, তিনি বড় মাপের শিল্পবোদ্ধা। সব দেখেশুনে তিনি জানালেন এখানে নতুন এক পর্যায় যোগ করা যায়। যদি মূর্তিটিকে একপেয়ে বানানো যায়। বোদ্ধা মানুষ সমিত বাবু, নরহরি বাবু বিনা বাক্যব্যায়ে আরেকটি পাও ভেঙে দিলেন। এই ভাবে একে একে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে নানা জনের নানা কথায় মূর্তিটির মস্তকটিও বাদ দিয়ে দিলেন। সর্বোপরি যেটুকু পড়ে রইল মূর্তিটির, তা হল মাত্র একতাল সিমেন্ট, যার সাথে রাস্তায় যখন তখন পড়ে থাকা বোল্ডার পাথরের কোনও অমিল নেই। সবাই বললেন ‘এবার বড়ই মিনিংফুল’ মূর্তি গড়েছেন নরহরিবাবু।

সে মূর্তি তো গেল শিল্পমেলায়। বড় বড় মান্যিগণ্যি লোকেরা এসে প্রশংসাও করলেন। রাজ্যের তরফ থেকে মস্ত অ্যাওয়ার্ডও পেলেন নরহরি বাবু। তার পর থেকে এখন আর তাঁকে অনেক ধৈর্য ধরে, রাতদিন এক করে নিখুঁত মূর্তি তৈরি করতে হয় না। তিনি কাদামাটি, সিমেন্ট, প্লাস্টার অফ প্যারিস- যাই হাতে পান না কেন, দলা করে কিছু একটা বানিয়ে দেন, আর তার গুণগ্রাহীদল নিজেরাই তার মধ্যে থেকে কল্পনায় কেমন আশ্চর্য আশ্চর্য ‘মিনিংফুল’ মূর্তি বানিয়ে নেয়। সেদিন একজনকে একটা চিঠি লিখতে গিয়ে ভুল হওয়ায় কাগজ দলা পাকিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললেন, সেই দলাটিও নাকি কি এক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বলে কদিন আগে ফলাও করে কাগজে বেড়িয়েছিল।

যাই হোক, বাড়ির কথায় আসি এবার। দুপুরের তৈরি মাংসটা শেষমেশ ফেলা যায়নি। আমিই সেটি নিজের অপারগতা স্বীকার করে খেয়ে ফেলেছিলাম। রাতে ছিল পালং পনীর, নন্দিনীর স্বহস্তে তৈরি। দুপুর থেকেই সে গজ গজ করে হোটেল থেকে আনা খাবার খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। আমিও সব ভুলে রাতের পালং পনীরের জন্যে অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম। টিভি চালিয়ে পাঁচটি রুটি সমেত বসলাম দুজনে। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে ঝোলে ডুবিয়ে মুখে তুলেছি... “অ্যাঃ... থু থু... এটা কি? ধনেপাতার চাটনী নাকি? পালং কোথায়?”

ততক্ষণে নন্দিনীও বুঝে গেছে কেলেংকারিটা। মাংসে পালংশাক দিয়ে দেওয়ায় যে ধনে পাতা কুচিয়ে রাখা ছিল, তা দিয়েই তৈরি হয়েছে পালং পনীর, থুড়ি ধনিয়া পনির। আর তার যা স্বাদ হয়েছে, তা অপার্থিব। কোনও রকমে বললাম তাকে, “এ কী করেছো, এবার খাব কি? হোটেলও তো বন্ধ!”

উত্তর এলো, “নিজে ভুল করে অন্যের ভুল ধরতে এসো না তো। দুপুরের মাংস খানিক বেঁচে আছে না? ওটাই খেয়ে নিচ্ছি না হয় আমি।”

খিদের মুখে চিঁ চিঁ করে প্রশ্ন করলাম, “আর আমি কী খাব?”

“কেন, দুপুরে আমি যেমন বাইরের থেকে আনিয়ে খেলাম, তুমিও তাই করে আমায় উদ্ধার কর। নইলে জল খেয়ে শুয়ে পড়।”

বউ বলে কথা, কী আর বলি। এখন বোধ হয় কোনও হোটেলও আর খোলা পাব না এত রাত্রে। এক গ্লাস জল খেয়ে শুতে শুতে মনে পড়ল সে পালং পনীর তৈরী করেছিল রাত আটটার সময়, ঠিক যখন ‘বাহারীর মা’ সিরিয়ালটি শুরু হয়।

আর কে না জানে সন্ধ্যেবেলায় সিরিয়াল চলাকালীন সমস্ত পার্থিব দুর্যোগ মুখ বুঁজে মেনে নেওয়াকেই বলে পত্নীবাদীত্ব। তাই দুটো মেরী বিস্কুট আর জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম অগত্যা।

 

সম্বুদ্ধ সান্যাল

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top