সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

বাতিঘরের আলোয় একটা দিন : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৫ জুন ২০২০ ০০:৪৪

আপডেট:
১৩ জুন ২০২০ ০৩:২৫

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে। আমি সাধারণত সর্বসাকুল্যে একদিন বা দুইদিন। সারামাস জুড়ে পত্রিকার পাতা দেখে দেখে বইয়ের একটা তালিকা তৈরি করি। তারপর সেই তালিকা ধরে নির্দিষ্ট স্টলে যেয়ে বইগুলো কিনে আবার ফিরে আসি। এমনই একবারের মেলায় বই কেনা শেষ করে বের হয়ে আসতেছিলাম। সন্ধ্যা সমাগত। হঠাৎ দেখলাম একটা গাছের তলায় বেশ কজন শিশু কিশোর জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সাধারণত যেকোনো প্রকারের জটলা দেখলে কেটে পরি কিন্তু এই জটলাটার দিকে এগিয়ে গেলাম কারণ জটলাকারি সবাই বয়সে শিশু অথবা কিশোর। জটলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম একজন মানুষ হাটু মুড়ে বসে সেই শিশু কিশোরদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার পাশের একজন কিশোরীও হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক একটা অটোগ্রাফ দেয়া শেষ করে যেই মুখটা উপরের দিকে তুলেছেন আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো কারণ আমার হাত ভর্তি তখন উনার সেই বইমেলায় প্রকাশিত সবগুলো বই। আমি পিছিয়ে এসে শিশু কিশোরদের লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

অপেক্ষার সময়টুকু বিভিন্ন রকমের কল্পনায় অতিদ্রুত কেটে গেলো। তারপর একসময় উনার কাছাকাছি চলে আসলাম। উনার সামনে হাটুগেড়ে বসে পড়লাম অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। আমার দিকে তাকিয়ে উনি নাম জানতে চাইলেন। আমি তখন ভিতরে ভিতরে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। এমন পরিষ্কার এবং অন্তর্ভেদী দৃষ্টি শক্তির মানুষ জীবনে সেই প্রথম দেখলাম। উনার দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম উনি আমার মনের ভিতরটাও পড়তে পারছেন। বাতিঘরের আলোয় যেমন সবকিছু দেখা যায় ঠিক তেমনি উনার দৃষ্টিতে আমার অন্তরটা তখন সত্যিকারের আলোকিত হলো অবশ্য তার অনেক আগে থেকে এই আলোকিত হওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিলো কিন্তু সামনাসামনি দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতার কোন তুলনা নেই। উনার অটোগ্রাফ নেয়া শেষ করে পাশে দাঁড়ানো কিশোরীর দিকে অন্য একটা বই এগিয়ে দিলাম কারণ উনার বই পড়ে উনার পরিবারের সকলকেই আমার চেনা। কিশোরী শুরুতে ইতস্তত করলেও উনার পরামর্শে অটোগ্রাফ দিতে রাজি হলেন।  এই ছিলো বাতিঘরের সাথে প্রথম সামনাসামনি দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা।

 

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সাথে লেখক

 

বেশ কবছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছি। অমর একুশে বইমেলা আসে বইমেলা চলে যায় কিন্তু আমার আর বইমেলায় যাওয়া হয় না। সেটার অভাব পূরণ করি বইয়ের অনলাইন দোকানগুলোর মাধ্যমে আর সিডনির স্থানীয় বাংলাদেশিদের দোকানগুলো থেকে বই কিনে। তাই দেশ থেকে সাতসমুদ্র তের নদীর দূরত্বে থেকেও বাতিঘরের সমস্ত বই আমার পড়া হয়ে গেছে। ঠিক সেই একইরকম আবেদন নিয়ে উনার বইগুলো পড়ি। অন্য যেকোনো বই কখোনওই একবারে শেষ করতে পারিনা কিন্তু উনার বই একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ছাড়ি না।

এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন বাতিঘরের উপর হামলার খবর পেলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়। তারপর শুরু হলো সীমাহীন উৎকন্ঠা। মনেহচ্ছিলো এক একটা দিন যেন এক একটা বছর। ক্যাম্পাসের এক জুনিয়র সঞ্জীব সূর্যের মাধ্যমে উনার সার্বিক অবস্থার আপডেট নিচ্ছিলাম ঘন্টায় ঘন্টায়। যতদিন উনি হাসপাতালে ছিলেন প্রত্যেকটা দিন ছিলো ভয়ংকর রকমের মন খারাপ করা। তারপর উনি একসময় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে চলে গিয়েছিলেন উনার প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে। সেখানে উনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দ্যেশ্যে যে ভাষণ দিলেন সেটা সরাসরি দেখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা একজন মানুষ কিভাবে অবলীলায় এমন কথা বলতে পারে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম আর নিজের অজান্তেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মকে একাই আলোকিত করে গেছে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদেরকে উনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুঝিয়েছেন। বুঝিয়েছেন কেন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। আবার উনি এটাও বলছেন, আমাদের প্রজন্ম চাইলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে পারবেন কিন্তু কখোনওই একজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না তাই মনের মধ্যে কিছুটা আফসোসও কাজ করে সবসময়। পাশাপাশি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন বাংলাদেশের শিক্ষার মান, শিক্ষানীতি এবং বিভিন্ন প্রকারের অলিম্পিয়াড নিয়ে। আসলে উনার ঠিক কোন কাজটা ছেড়ে কোন কাজটার কথা বলবো কারণ তালিকাটা আসলেই অনেক দীর্ঘ।

বাতিঘরের সাথে আমার পরিচয় আমার ছাত্রীদের মাধ্যমে। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সবাই যখন ঢাকা চলে গেলো আমি তখন সংগত কারণেই কুষ্টিয়া থেকে গেলাম। হাবিব ভাই বললেন আমি একটা টিউশনি ঠিক করে দিচ্ছি। ছাত্রী তোমার এক ব্যাচ জুনিয়র ওকে পড়ালে তোমার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও একই সাথে নেয়া হয়ে যাবে। ছাত্রীরা তিন বোন। তাদের বাবা মা দুজনেই কলেজের শিক্ষক। মা শিরিন ম্যাডাম ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারী গার্লস কলেজের জীববিজ্ঞানের প্রফেসর। একটু কড়া টাইপের ভাব ধরে থাকেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে একজন চঞ্চল কিশোরীর মন উনার আর বাবা আমার দেখা অন্যতম ভালো মানুষদের একজন। আমি পড়াতে গেলেই উনি কিছু না কিছু একটা বানিয়ে এনে আমাকে খেতে দিতেন। আমরা ছিলাম তিন ভাই তাই বোনদের জগৎ কেমন হয় সেই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না। তিন বোন স্বাতী, শুক্তি এবং তৃণা সারাক্ষণই কোন না কোন উছিলায় চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। স্বাতী এবং শুক্তি পিঠাপিঠি তবে তৃণা ওদের তুলনায় বেশ ছোট কিন্তু দুষ্টমিতে সবার সেরা। সারা বাড়ি তিন কন্যা মিলে সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াতো। এমনও অনেকদিন হয়েছে আমার ছাত্রী স্বাতী পড়ার মাঝখানে উঠে যেয়ে অন্য দুজনকে কিল দিয়ে আসছে।

 

নাগরিক সন্ধ্যায় সিডনির প্রবাসী প্রজন্মের সাথে মুহাম্মদ জাফর ইকাবাল ও ডঃ ইয়াসমিন হক

 

ওরা তিন বোনই ছিলো বইয়ের পোকা। ওদের কাছ থেকে সন্ধান পেলাম বাতিঘরের। যার বই আমার চিন্তার জগত আমূল পরিবর্তন করে দিলো। উনার বই পড়েই প্রথম বুঝতে পারলাম দেশপ্রেম কোন উদ্বায়ী পদার্থ নয় এটা একটা অনুভূতি আর সেটাকে কাজে পরিণত করাটাই হচ্ছে জীবনের লক্ষ। দেশের এতো এতো সমস্যার মধ্যেও দেশটাকে নিয়ে ঠিক কিভাবে গর্ব করতে হয় সেটাও জানতে পারলাম। তিন বোনের কাছ থেকে ধার নিয়ে বাতিঘরের তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই পড়ে ফেললাম পাশাপাশি অন্যান্য বইও ধার নিতাম। আমি একবার ওদের কোন এক বোনের জন্মদিনে স্যারের একটা বই উপহার দিয়েছিলাম বাতিঘরের লেখা প্রিয় গগন এবং অন্যান্য। বইটা পেয়ে ওরা বলল স্যার এটাতো উনার নিয়মিত বই না। এটা হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা উনার কলামের সংকলন। পরে বইয়ের দোকান থেকে সেই বই বদলে এনে দিয়েছিলাম কি না এখন আর মনে নেই। স্বাতীকে পড়ানো অবস্থায়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো।

বুয়েটে ভর্তি হবার পর আউট বই পড়ার অভ্যাস একেবারে পূর্ণতা পেলো। বিভিন্ন বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে, হলের লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে আর ছাত্র ছাত্রীদের বাসা থেকে ধার নিয়ে বিভিন্ন ধরণের বই পড়া শুরু করলাম। সেখানেও অগ্রগামী ভূমিকা রাখলো আমার ছাত্রীরা। তিথীরাও তিনবোন তিথি, তপা আর টুম্পা। ওরাও বাতিঘরের ভীষণ ভক্ত। ওদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আবারো উনার বই পড়া শুরু করলাম। বুয়েটে আমার বালিশের তলায় সবসয়ই কোন না কোন গল্পের বই থাকতো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে গল্পের বইয়ের পাতা উল্টানো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলো একসময়। সেই অভ্যাস এখনও ধরে রাখার চেষ্টায় আছি যদিও ফেসবুক সেখানে ভাগ বসিয়েছে।     

আগেই বলেছি উনার লেখা থেকে উনার পরিবারের সকল সদস্যের পরিচয়ও জানা। উনার স্ত্রীকেও তাই চেনা। উনাদের পরিচয় বিবাহ সব বিষয়ের কথায় জানা হয়ে গেছে উনার বই পড়ে। আমি বলি আসলে উনাদের পুরো পরিবারটাই বাঙালি জাতির জন্য একটা বাতিঘর যার শুরুটা হয়েছিলো উনার বাবা মায়ের হাত ধরে তারপর বড় ভাইও ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক আর ছোটভাইও দেশের সেরা কার্টুনিস্ট। যাইহোক উনার স্ত্রীও একসময় একটা বই লিখে ফেললেন উনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মময় জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে যার নাম সাস্টে ২২ বছর। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেটাও জোগাড় করে পড়ে ফেললাম। এরপর জীবন তার নিয়মেই চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ একদিন খবর পেলাম উনি এবং উনার স্ত্রী আসছেন উনার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাসী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে যোগদান করতে। তাই সাজ্জাদ ভাইকে বলে রাখলাম আমাকে যেন দুটো টিকেট দেয়া হয়। আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়া যাবো। সাজ্জাদ ভাই বললেন সমস্যা নেই। উনাদের নিয়মিত অনুষ্ঠানের বাইরেও উনারা একটা অনুষ্ঠান করবেন সাধারণ মানুষদের জন্য। আমি বললাম তাহলে তো খুবই ভালো হয়। তাহিয়া এখানে যেহেতু ইংরেজিতে পড়াশোনা করে তাই ওর জন্য স্যারের ইংরেজি অনুবাদ করা বই দেশ থেকে আনিয়েছিলাম মোনা ভাবিকে দিয়ে। বইটার নাম, রাশেদ মাই ফ্রেন্ড। অনুবাদ করেছেন উনার মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল। বইটা পড়তে যেয়ে তাহিয়া মাঝেমধ্যেই খিলখিল করে হেসে উঠতো ঠিক যেমন ছোট বয়সে আমি উনার বই পড়তে যেয়ে হো হো করে হাসতাম আর মা সন্দেহের দৃষ্টিতে জানতে চাইতেন হাসির কারণ কি? বইটা পড়া শেষ করে তাহিয়া বললো এটা অনেক ভালো বই। ওকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আমি বললাম, তুমিও বড় হয়ে আমার প্রকাশিত বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করবে ইয়েশিমের মতো তাই তোমাকে বাংলা ভাষাটা ভালোমতো শিখতে হবে কারণ আমার লেখালেখির সবই বাংলাতে। সে সমঝদারের মতো মাথা নাড়লো অবশ্য সে প্রতি রোববার ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে যায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা এবং চর্চার জন্য।

পাশাপাশি ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে উনাদের আনার ব্যাপারে আশফাক ভাইও সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে উনাদের বাংলা স্কুলে আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয় আগের দিন রাত্রে। তখন থেকেই মনের মধ্যে আবারো এক ধরনের অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করা শুরু করলো। সেই কবে বইমেলাতে উনাকে দেখেছিলাম এইবার আবারো কাছ থেকে উনাদের দেখতে পাবো ভেবেই শিহরিত বোধ করছিলাম। অবশেষে ২৮শে এপ্রিল ২০১৯ তারিখে উনারা বাংলা স্কুলে আসলেন। আসার সময় সাথে করে এনেছিলেন বাংলা স্কুলের সোনামণিদের জন্য একগাদা বই। উনারা বললেন উনাদের জন্য নির্ধারিত ওজনের মধ্যে যতগুলো পেরেছেন বই নিয়ে এসেছেন। বাংলা স্কুলের ক্ষুদে সোনামণিদের উদ্দেশ্যে উনারা কিছু কথা বললেন। আমি ব্যস্ততার কারণে উনাদের দুজনের করোও কথা পুরোপুরি শুনতে পারিনি বলে মন খারাপ হচ্ছিলো। পরে আমার মেয়ে তাহিয়ার কাছ থেকে শুনলাম উনারা ঠিক কি বলেছিলেন।

তাহিয়াকে রাত্রে জিজ্ঞেস করাতে সে বললঃ বাবা ম্যাডাম বলেছেন তোমরা খুবই ভাগ্যবান যে প্রবাসে বেড়ে উঠেও বাংলা ভাষা তোমরা শিক্ষা করতে পারছো। আমি কিন্তু পারিনি। আমার বাবার পোস্টিং ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানে আমার স্কুলে কোন বাঙালি মেয়ে ছিলো না। আমিই ছিলাম একমাত্র বাঙালি মেয়ে তাই আমি না চাইলেও আমাকে উর্দু শিখতে হয়েছিলো। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তোমরা খুবই ভাগ্যবান কারণ বাংলা স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান তোমরা পেয়েছে বাংলা ভাষা শিক্ষা করার জন্য। আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এরপর আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন আমেরিকাতে জন্ম নিয়েছিলো তখনও আমরা একটা বাংলা ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভব করেছিলাম। পরে অবশ্য দেশে ফিরে আসার পর আর সমস্যা হয়নি।

 

ছবি : অটোগ্রাফ

 

আর স্যার বলেছেন, আমি আমার বক্তব্য মোটেও দীর্ঘ করবো না কারণ আমি তোমাদের মনের কথা বুঝতে পারি। আমি জানি দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা শুনতে তোমাদের মোটেও ভালো লাগে না। তারচেয়ে তোমাদের বেশি ভালো লাগে খেলাধুলা করতে। তোমরা জানো আমাদের ভাষাটা অনেক সুন্দর এবং শক্তিশালী একটা ভাষা। যেমন ধরো আই লাভ ইউ মানে কি? তখন আমরা উত্তর দিয়েছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন উনি বললেন আমি তোমাকে ভালোবাসি এখানে মোট তিনটা শব্দ যেগুলোকে মোট ছয়ভাবে সাজানো যায় যেমনঃ আমি ভালোবাসি তোমাকে, তোমাকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে আমি। তুমি যেভাবেই শব্দগুলোকে বলো না কেন সেগুলো তোমার মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম কিন্তু ইংরেজিটাকে যদি তুমি সামান্য একটু উলটপালট করে বলো তাহলে কিন্তু কোন অর্থই প্রকাশ করে না যেমনঃ আই ইউ লাভ বা ধরো ইউ আই লাভ। তাই তোমরা তোমাদের স্কুলের ইংরেজি ভাষাভাষী সহপাঠীদের বলতে পারো শোন ভাই তোমাদের ইংরেজি ভাষাটা বেশ দুর্বল, সেটা শক্তিশালী করার জন্য কিছু একটা করো। বলেই উনি হাসি দিয়েছেন সাথে আমরা অনেক এসেছি। আমি তখন মনেমনে ভেবে দেখলাম আসলেই তো তাই। আর আমরাই মনেহয় বিশ্বের বুকে একমাত্র জাতি যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম।

আমি এইবার শুরু থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্যার আর ম্যাডামের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়া ছাড়া অন্য কোনকিছু করবো না বরং যতটুকু পারি তাদেরকে দেখবো তাদের কথা শুনবো তাদের চলাফেরা অবলোকন করবো কারণ স্যার তার অবিশ্বাস্য সুন্দর জীবন বইতে লিখেছেনঃ " আজকাল স্মার্টফোন নাম একটা বিচিত্র যন্ত্র বের হয়েছে, যখন মানুষের কোন কিছু করার থাকে না তখন বেশিরভাগ মানুষ এই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করে। কিন্তু তারা যদি একবার চোখ খুলে চারপাশের তাকাতো, তাহলে তারা দেখতো চারপাশের জগৎটা কত জীবন্ত, কত চমকপ্রদ, কত চিত্তাকর্ষক।" তবুও স্যারের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়ার সময় মোনা ভাবি সেটা তার স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখলেন। আমি ম্যাডামের কাছ থেকে তাঁর লেখা সাস্টে ২২ বছর  বইটাতে আমার গিন্নির জন্য অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। আমি বাতিঘরের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবী বইটাতে নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবীর জন্য অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। তাহিয়া রাশেদ মাই ফ্রেন্ড বইটাতে বাতিঘরের অটোগ্রাফ নিয়ে নিলো। এইভাবে আমাদের সকালের পর্ব শেষ হলো।   

বাসায় ফিরে বিকেলে উনাদের নাগরিক সন্ধ্যায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। অবশেষে বিকেলে ব্যাংকসটাউনের ব্রায়ান থিয়েটারে পৌঁছে গেলাম। সেখানে শুরুতেই ম্যাডাম কথা বললেন। ম্যাডামের বলা প্রায় সব কথায় উনার লেখা সাস্টে ২২ বছর বইটাতে আছে কিন্তু তবুও সামনাসামনি সেই কথাগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগছিলো। তখন আমি আবারো নতুন করে বাতিঘরের বলা কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পারলাম। আসলেই আমাদের চারপাশের জীবনটা কত জীবন্ত, কত চমকপ্রদ, কত চিত্তাকর্ষক। কারণ একজন মানুষ যখন সামনাসামনি কথা বলেন তখন তার অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়া যায়, তার হাসি শুনতে পাওয়া যায়, কথা বলার সময় তিনি কিভাবে হাত পা নেড়ে কথা বলছেন সেটাও দেখা যায়।

বাতিঘরের বলা প্রায় সব কথায় বাতিঘরের লেখা কোন না কোন বইয়ে পড়েছিলাম তবুও এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। শৈশবে উনার বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কাহিনী পড়েছিলাম আধ ডজন স্কুল বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতাও পড়েছিলাম অন্য কোন একটা বইয়ে। তবে নতুন যে কথাগুলো শুনলাম সেগুলো উনি বলেছিলেন প্রশ্নোত্তর পর্বে। তার মধ্যে একটা হলো ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সি যেমন গুগুল বা ফেসবুক কারণ তাদের তথ্যভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। তাই দেখা যাবে হঠাৎ করে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পরবে তাই আমাদেরকে বেশি বেশি করে মানবিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানবিক কাজগুলোর গুরুত্ব কখনওই কমবে না তাই এই শিক্ষাগুলো একদিকে যেমন আত্মার খোরাক যোগাবে অন্যদিকে জীবিকারও সংস্থান করবে। আর একটা কথা বলেছিলেন সেটা হলো প্রবাসীরা অনেকসময় মনোকষ্টে ভুগেন দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিয়ে অবশেষে প্রবাসে পারি জমানোর কারণে। উনি বললেন এতে মনোকষ্টে ভোগার দরকার নেই কারণ বর্তমান পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে গেছে। আর প্রবাসে পারি জমলেই যে দেশের সাথে সব বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায় এমন না বরং বিদেশে থেকেও দেশের জন্য অনেক কাজ করা যায়। উনি আরো বলেন তোমরা বিদেশে এসে বাংলাদেশের রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি না করে বরং সেখানকার রাজনীতি করা শুরু করো। সে দেশের এমপি হও, মন্ত্রী হও তাতেই দেশের নাম উজ্জ্বল হবে বিদেশের মাটিতে। বাতিঘরের আলোয় এভাবেই কেটে গেলো সাদামাটা একটা দিন কিন্তু মনের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো হাজারো রঙ যার প্রভাব থাকবে আমরণ।     

বাতিঘরের কথা দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই। অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবী বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছেঃ "আমি স্ট্রেচারে শুয়ে আকাশের দিয়ে তাকিয়েছি। আকাশে ভরা একটা চাঁদ ঠিক মাথার ওপরে আমার দিকে স্নেহভরে তাকিয়ে আছে। নির্মেঘ আকাশে বিশাল একটা চাঁদ, জোৎস্নার আলোতে চারপাশ থইথই করছে, কী আশ্চর্য একটি দৃশ্য। আমি বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হলো, কী অবিশ্বাস্য সুন্দর এই পৃথিবী! এই অপূর্ব সৌন্দর্য আমি দেখতে পাবো? সৃষ্টিকর্তা এই অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য দেখার জন্যে আমাকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবেন?" এটা ছিল উনার উপর হামলা করার কিছু মুহূর্ত পরের ভাবনা যখন উনাকে নিয়ে জমে মানুষে টানাটানি শুরু হয়েছে। আমাদের প্রজন্ম সত্যিই ভাগ্যবান যে আমরা বাতিঘরের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। তাঁকে সামনাসামনি দেখতে পেরেছি। আমি আশাবাদী উনার লেখা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও পথ দেখাবে। তাই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যেন আরো বহু বছর উনি আমাদের মাঝে সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন আমাদের বাতিঘর মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top