সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

অনুভূতির জলছাপ : আসিফ মেহ‌দী


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০২০ ২৩:১৪

আপডেট:
১৫ জুলাই ২০২০ ২৩:১৬

 

এক.

অফিসের কর্মচারী মোছাদ্দেককে তার দপ্তরপ্রধান দুই চোখে দেখতে পারেন না। কারণ, মোছাদ্দেক অতি মাত্রায় সৎ। ওপরের দিকে উপরি চালান করে মূলত অধস্তনরা। মোছাদ্দেক থাকায় সুবিধা করতে পারছেন না বর্তমানের অফিসপ্রধান তকদির সাহেব। ক’দিন আগে উচ্চমার্গীয় তদবিরের বদৌলতে ঢাকার অফিসে বদলি হয়ে এসেছেন। এসেই দেখলেন বেগতিক অবস্থা। স্পিড মানির কোনো গতি নেই মোছাদ্দেক নামক ব্যক্তিটির জন্য। কূল-কিনারা না পেয়ে মোছাদ্দেককে একটি পাহাড়ি অঞ্চলে চালান করার জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। বিভিন্ন সময়ে অফিসের একই চেয়ারে বসা সব কর্মকর্তার সততা একরকম না। এর আগে যিনি মোছাদ্দেকের স্যার ছিলেন, তিনি নিপাট সৎ মানুষ ছিলেন। তকদির সাহেব আসায় মোছাদ্দেকের তকদির পুড়তে চলেছে।

মতিঝিলের অফিস থেকে শেখেরটেকের বাসায় লোকাল বাসে যেতে ব্যস্ত সময়ে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। তাই মোছাদ্দেক আজ বিকেল পাঁচটার বদলে চারটায় রওনা দিতে চাচ্ছে। বিশেষ উপলক্ষে আজকে আগে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই উপলক্ষ এই স্যারকে বলা যাবে না। ভালোভাবে নেবেন না। অসৎ মানুষ সবকিছুর হিসাব কষে টাকা দিয়ে। জীবনের হিসাব যে শুধু টাকায় হয় না, তা তারা বোঝেন না। হাতে কোনো কাজ নেই; তারপরও এক ঘণ্টা আগে অফিস ত্যাগের কথা শুনে তকদির সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘আপনি তো সর্বদা রাষ্ট্রের সেবা করে চলেছেন! রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোথাও যেতে চাইলে তো বাধা দিতে পারি না।’

মোছাদ্দেক বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘স্যার, তেমন কিছু না। বিশেষ একটা উপলক্ষে পরিবার নিয়ে একটু রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা আছে।’

বিনয়ের মূল্য নেই তকদির সাহেবের কাছে। তিনি বললেন, ‘রেস্টুরেন্টে গিয়ে কী করবেন? শুনেন নাই যে দুনিয়ায় ভালো লোকের খাওয়া নাই। আপনি ভালো মানুষ। রেস্টুরেন্টে তো হাওয়া খাওয়ার জন্য গিয়ে লাভ নাই।’

‘স্যার, রেস্টুরেন্টে একবার খাওয়ার মতো বেতন তো পাই।’

‘দেখেন, আপনার কথা শুনে খারাপ কথা মুখে থুতুর মতো চলে আসছে। এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, গেলাম শুধু খাইয়া ও হাগিয়া-এই স্টাইলে চললে হবে? জীবনের অন্যসব মজা তো নিতে হবে নাকি?’

মোছাদ্দেক বিব্রত। মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, অসৎ উপায়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’

তকদির সাহেব আরও জেঁকে বসলেন, ‘শোনেন, ভাইরাস না ধরলে যেমন পেনড্রাইভের মজা পাওয়া যায় না, তেমনি স্বভাবে ভাইরাস না ধরলে জীবনের আসল মজাটা পাবেন না।’

ইদানিং এই অফিসে ঢুকলেই মোছাদ্দেকের দম বন্ধ হয়ে আসে। স্যারের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সে বলল, ‘আমি আসছি স্যার। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তকদির সাহেব বললেন, ‘জি, অবশ্যই আসুন। ধন্যবাদ। আবার আসবেন।’

দুই.

মোছাদ্দেকের একটিমাত্র সন্তান। মেয়ের নাম ছায়মা। কোনো এক অজানা কারণে মোছাদ্দেকদের বংশের সবার নামকরণে ‘ছ’ বর্ণের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার বাবার নাম মোকছেদ এবং দাদার নাম ছামছুল। এভাবে চৌদ্দ বংশ ওপরে গেলেও দেখা যাবে, ছ বর্ণটি আছে বহাল তবিয়তে। ছায়মার নামেও অজানা নিয়মটি অনুসৃত হয়েছে। ক্লাস ফোরে পড়ে ছায়মা। গতদিন তার সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষার ফল দিয়েছে। ফার্স্ট হয়েছে ছায়মা। পেয়েছে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর। সর্বমোট নম্বর থেকে মাত্র দুই নম্বর কম পেয়েছে! ক্লাসে দ্বিতীয় যে হয়েছে, সে ছায়মার থেকে তেইশ নম্বর কম পেয়েছে। মোছাদ্দেক কন্যাকে কথা দিয়েছিল, প্রতিবারের মতো এবারও পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে কোনো নামকরা ফাস্টফুড শপে নিয়ে যাবে। সে যা খেতে চাইবে, তা-ই খাওয়াবে। গতদিন রেজাল্ট কার্ড নিয়ে হাজির হয়ে মেয়ে আবদার করল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাওয়া মানে বেতনের পাঁচ ভাগের এক ভাগই খরচ হয়ে যাওয়া! তারপরও মেয়েটির ইচ্ছাপূরণ করবে মোছাদ্দেক।

সততার কারণে দারিদ্রের সঙ্গে বসবাস মোছাদ্দেক-পাপিয়া দম্পতির; তবে সংসারে সুখের কমতি নেই। আর্থিক দিক দিয়ে তারা দুর্বল কিন্তু দুজনের বোঝাপড়ায় নেই দৈন্যতা। অনুভূতির একই গলিতে তাদের চলাফেরা। কতদিন পর এই পরিবারটি বাইরে খেতে যাচ্ছে! মেয়ের এমন রেজাল্ট মোক্ষম উপলক্ষ বটে। পাপিয়া পরল বিয়ের শাড়ি। এই শাড়ি পরে কয়েকটি অনুষ্ঠানেও গেছে পাপিয়া। সচরাচর বিয়ের শাড়ি যেমনটি হয়, এটি তেমন ঝকমকে সৌন্দর্যের না। পাপিয়ার গয়না আছে এক সেট-দুই হাতের দুটো চুরি, গলার চেইন আর কানের দুল। যেকোনো উপলক্ষে সেগুলোই তার সাজগোজের সঙ্গী।  

রাস্তায় নেমেই ছায়মা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে চাইল। পাপিয়া একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর মেয়েকে বলল, ‘সিএনজির ভেতরে আলো-বাতাস পাওয়া যায় না। আমরা বরং রিকশায় যাই, মা। হাওয়া খেতে খেতে যাব।’ রিকশা ঠিক করে মেয়েকে কোলে নিল মোছাদ্দেক। খালি হাওয়া আর খাওয়া হলো না। মাঝপথে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। তিনজনই ভিজল; তবে কাকভেজা নয়, শাকভেজা বলা যেতে পারে অর্থাৎ কিঞ্চিৎ ভেজা। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড ধরে এগিয়ে চলল রিকশা। হঠাৎ রাস্তার পাশেই ছায়মা একটি আলিশান বিল্ডিংয়ে রেস্টুরেন্ট দেখে সেটাতে খাওয়ার বায়না ধরল।

রেস্টুরেন্টের ভেতরের পরিবেশ অতি চমৎকার; বেশ রাজকীয়! জ্যান্ত রঙিন মাছের অ্যাকুরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে ছায়মা কিছুক্ষণ বিস্ময়ে মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। অ্যাকুরিয়াম থেকে কিছুটা দূরেই আছে একটি কৃত্রিম ঝরনা। স্থানে স্থানে এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের বিশাল আকৃতির ফুলদানি ও তাতে বাহারি ফুল রাজসিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে! মাথার ওপরের ঝাড়বাতিগুলো বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। একসময় একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে দেখা যেত, ‘কী তামশা, সব ফকফকা’! সেই ফকফকা আলো যেন রেস্টুরেন্টজুড়ে। এত আলোর মাঝেও মেন্যু হাতে নিয়ে দুশ্চিন্তায় মোছাদ্দেকের হাত-পা ঘামা শুরু করেছে।

 মেয়েকে হাসিমুখেই মোছাদ্দেক জিজ্ঞেস করল, ‘কোন স্যুপ খাবি মা?’

বাবার কথা ছায়মার কানে গেল না। অদূরেই টেবিলের ওপর সারিবদ্ধভাবে রাখা ব্যুফে আইটেমগুলো থেকে লোকজন খাবার নিচ্ছে। সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছায়মা। খানিক পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘বাবা, আমি ওগুলো খাব।’

মোছাদ্দেক একবার ঢোক গিলল। তাদের টেবিলের ওপরে রাখা একটি স্ট্যান্ডে ইংরেজিতে লেখা আছে-ব্যুফের মূল্য জনপ্রতি এক হাজার চার শ টাকা! শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই রেস্টুরেন্টে বসেও মোছাদ্দেকের গা দরদর করে ঘামা শুরু করল। পাপিয়া বলল, ‘থাকগে মা, ওসব আরেকদিন খাব।’

‘আরেকদিন কবে খাব, মা?’

মোছাদ্দেক বলল, ‘ওগুলো কি তোমার খুব খেতে ইচ্ছা করছে, মামণি?’

ছায়মা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মোছাদ্দেক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, যাও খাবার নিয়ে এসো।’

পাপিয়া বলল, ‘মেন্যুটা দাও তো। আমি আমার জন্য রাইস আর চিকেন অর্ডার করি।’

মোছাদ্দেক পাপিয়ার হাত ধরল। বলল, ‘না, তুমিও ব্যুফে নাও।’

পাপিয়া বলল, ‘আর তুমি?’

‘অফিসে দুপুরের পর মিটিং ছিল। দুটো সিঙ্গারা খেয়েছি। একদম ক্ষুধা নেই। এক কাপ চা খাব আমি।’

পাপিয়া আর ছায়মা ব্যুফে আইটেম আনতে উঠে গেল। মোছাদ্দেক চায়ের অর্ডার দিল। এখানে চায়ের দামও আকাশমুখী। এক কাপ দুধ চা এক শ সত্তর টাকা! চা বলতে নিয়ে এল এক কাপ গরম পানি, একটি টি-ব্যাগ, এক পাত্রে তরল দুধ এবং আরেক পাত্রে চিনি। মোছাদ্দেক দুধ-চিনি মিশিয়ে চা তো খেলই; তারপর পাত্রে রাখা বাড়তি দুধটুকুও ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল।

পাপিয়া আর ছায়মা প্লেটভর্তি খবার নিয়ে এল। খাবার নিয়ে ফিরতে তাদের প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেছে। দুজনের মুখই আনন্দে চকচক করছে। এত বাহারি রেসিপির খাবার দুনিয়াতে আছে, সেটাই জানা ছিল না। কী সুন্দর সুন্দর নাম; খাবারগুলো দেখতেও সুন্দর-বিফ সিজলার, চিলি প্রন, চিকেন পিনাট কোকোনাট কারি ক্রিম! তাছাড়া খাবারগুলো নেওয়া যাবে যতবার খুশি, ততবার! পাপিয়া যতটা ভেবেছিল, ততটা খেতে পারল না। দুই-তিনটি আইটেম ছাড়া বাকিগুলোতে স্বাদ লাগল না। দ্বিতীয়বার জোর করে কয়েকটি আইটেম নিল কিন্তু খাওয়া জমল না। ছায়মা প্রথমবারেই খাবার নষ্ট করল; পরে কিছু মিষ্টান্ন নিল কিন্তু সেগুলোও নষ্ট করল। ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জসহ বিল এল প্রায় তিন হাজার সাত শ টাকা! মোছাদ্দেক আজ ব্যাংক থেকে তুলেছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। ভাগ্যিস, পকেটে কিছু টাকা ছিল! তা নাহলে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হয়ে যেত।

তিন.
আপাতত বৃষ্টি নেই। খুশিতে ছায়মার হাঁটার ভাবভঙ্গিই পাল্টে গেছে। রাস্তায় নেমে মোছাদ্দেক বলল, ‘মামণি, আমরা এখন হেঁটে হেঁটে শহর দেখতে দেখতে বাসায় যাব!’ নতুন অভিজ্ঞতা ছায়মার জন্য। এভাবে কখনো শহর দেখা হয়নি। তার যাওয়া-আসা বাসা আর স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ; মাঝের পথটুকু কাটে স্কুলভ্যান নামক মিনি কারাগারে! খুশিমনে ছায়মা হাঁটা ধরল। কিছুদূর যেতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। ছাতাটা আনা হয়নি। আগের মতোই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি বলে এ যাত্রাতেও রক্ষা পাওয়া গেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার পাশের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকল মোছাদ্দেক, পাপিয়া ও ছায়মা। হঠাৎ একটি দোকানের পোস্টারের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে ছায়মা বলল, ‘বাবা, ওই আইসক্রিমটা খাব।’

পাপিয়া মেয়েকে বলল, ‘মা, এখন আইসক্রিম খেলে ঠাণ্ডা লাগবে।’ পাপিয়া এক হাত দিয়ে মেয়েকে ধরল; আরেক হাতে ধরল মোছাদ্দেকের হাত। হালকা বৃষ্টিতে কারও বোঝার সাধ্য নেই; কিন্তু মোছাদ্দেকের চোখের পানি পাপিয়ার চোখ এড়ায়নি। মেয়েকে অল্প ক’টাকার আইসক্রিম কিনে দিতে না পারায় মোছাদ্দেক কষ্ট পাচ্ছে। তার পকেটে কোনো টাকা অবশিষ্ট নেই। দৃশ্যমান আবেগ-অনুভূতির ছাড়াও মানুষের আছে জলছাপের মতো অস্পষ্ট অনুভূতির জগৎ। মোছাদ্দেকের অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো পড়তে পারে বলেই হৃদয়ের দিক থেকে ঐশ্বর্যশালী এই মানুষটিকে এত ভালোবাসে পাপিয়া।

 

লেখক: আসিফ মেহ্দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top