সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

চিল : ছন্দা বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১৬ জুলাই ২০২০ ২২:৫৩

আপডেট:
১৬ জুলাই ২০২০ ২৩:৪১

 

এক

হেলা বিমল সাতাশেই সংবাদ  শিরোনামে চলে এল। সকালে খবরের কাগজটাতে চোখ বোলাতেই দেখি প্রথম পাতায় জ্বল জ্বল করছে লেখাটা - গোষ্ঠী সংঘর্ষে কুখ্যাত সমাজবিরোধী হেলা বিমল নিহত!

হেলা বিমলকে আমি চিনতাম একেবারে হাফ প্যান্ট পরা বয়স থেকে। ক্লাশ ফাইভ থেকে ও আর আমি এক সেকশানে পড়তাম। ছোটবেলা থেকেই  ও কেমন যেন দাদাগিরি ভাব করত। ক্লাশে কে কোন বেঞ্চে বসবে ওই ঠিক করে দিত। ক্লাশে কেউ দুষ্টুমি করছে দেখলে দুইজনের মাথা এক জায়গায় এনে জোরসে  ঠুল দিয়ে তাদেরকে শান্ত করত। তার এই দাদা দাদা ভাব দেখে আমাদের ক্লাশ টিচার কেষ্টবাবু বিমলকে মনিটর বানিয়ে দিলেন। কেষ্ট স্যার আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন। ক্লাশে এসে রোল কল করেই খাতাটা টেবিলের এক কোনে রেখে বলতেন, “শব্দরূপ আর ধাতু রূপ লেখো- নর, মুনি, পতি, লতা, সাধু এবং লেখ, পঠ, গম, ভূ।"

কথাটা বলেই তিনি টেবিলের নীচেয় পাটা বাড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে নাক ডাকতে  শুরু করে দিতেন। তার ঘুমের যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্যে তিনি বিমলকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন যাতে বাচ্চারা কোনোরকম গোলমাল  না করে।

বিমল স্যারের এই প্রস্তাবটা লুফে নিল। কঠিন ক্লাশ ওয়ার্ক থেকে ত সে রক্ষা পেল। ওইসব ধাতুরূপ  শব্দরূপ কখনই  তার  মুখস্ত হতো না। কোথায় বিসর্গ, কোথায় হসন্ত আর কোথায় ঐ না ঔ কার বসবে- সব গুলিয়ে যেত।

আশিজন ছাত্র নিয়ে আমাদের ‘এ’ সেকশানে ক্লাশ হতো। ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’ তে সেই একই অবস্থা। আমাদের ক্লাশ রুমের দুইদিকে সার সার করে ছয়টা ছয়টা করে মোট বারোটা বেঞ্চপাতা ছিল। প্রতিটা বেঞ্চে পাঁচজন করে ছাত্র বসার কথা। কিন্তু যেদিন ছাত্র সংখ্যা বেশী হয়ে যেত সেদিন ছয়জন করেও বসতে হতো। যে ছেলেটি ধারে বসত তার একটা পা সবসময় বাইরে বেরিয়েই থাকত। সেদিন বসার জায়গা  নিয়ে ঠেলাঠেলি পড়ত। আমরা তাই নটা বাজতে না বাজতেই  স্নান করে তাড়াতাড়ি খেয়ে স্কুলের পথে পা বাড়াতাম। দেরী করে ঢুকলেই ঠেলাঠেলি, জায়গা নিয়ে মারামারির কবলে পড়তে হত। আর তখনি ডাক পড়ত বিমলের। ওই এসে একরকম  মধ্যস্থতা করে দিত। কেউ যদি বেশি তেরিবেড়ি করত বিমল একটা ছোটো বঙ্গলিপি খাতায়  তাদের নাম টুকে রাখত। পরে কেষ্ট স্যার এলে সেই খাতাটা স্যারের হাতে তুলে দিলে স্যার যে কী ভয়ানক শাস্তি দিতে পারেন সেটার ভয়ে সকলে চুপ করে যেত।

কেষ্ট স্যারের ক্লাশে প্রথম তিনটে বেঞ্চের ছেলেরা বেশ  মন দিয়েই লিখত। তারপরের দিকের বেঞ্চে কেউ কাটাকুটি খেলত, কেউ বা হাবিজাবি যা  খুশি তাই করত চুপিচুপি, শব্দ না করে। বিমলের কথা হল, নিঃশব্দে যা খুশি তাই করতে পারো। ঘন্টা পড়তেই কেষ্ট স্যার বেশ লম্বা চওড়া একটা হাই ছেড়ে দুই হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে পরের দুই পাতা পড়ে আসবে বলে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যেতেন। ভাত ঘুমটা রোজ আমাদের ক্লাশেই সেরে নিতেন জম্পেশ করে। ক্লাশ ওয়ার্ক টা কোনোদিনই তার দেখার সুযোগ ঘটত না।

দুই               

বহু বছর হয়ে গেল কৈশোরের সেই  শহরটা ছেড়ে চলে এসেছি। কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।  মাঝে মাঝে ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। কুশল বিনিময় ছাড়াও টুকটাক  নস্টালজিয়া- ব্যস, এই পর্যন্তই। কাছের বন্ধুদের সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয় ছুটির দিনে। তখনই  নানান কথা উঠে আসে। পারিপার্শ্বিক  নানান খবরাখবর পাই  তাদের কাছ থেকে। পূজার ছুটিতে কয়েক বছর অন্তর অন্তর দুই একদিন দেশের বাড়ীতে কাটিয়ে আসি। তবে এখন আর সেখানে কেউই  থাকে না। তবু বাড়ী থেকে ফেরার সময়ে কী এক  মন ভার করা কষ্ট হয় বুকের মাঝে।  বুঝতে পারি, কেউ নেই  এই  কথাটা একদম ভুল বলা হল। কেউ তো আছেই, নইলে পাড়ার সেই  রাস্তা, খোকনের মুদি দোকান, বাশঝাড়, পুকুরঘাট, রেল লাইন, খেলার মাঠের জন্যে  মন কেমন করবে কেন? কেনই  বা লাল রঙের ঐতিয্যমন্ডিত  স্কুল বাড়ীটার দিকে তাকালে বুকের ভিতরটা হুহু করে ওঠে? স্টেশান থেকে ট্রেনটা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে কেন জানালা দিয়ে পরিচিত কেউ আছে কিনা দেখার জন্যে অবাধ্য চোখদুটো অবিরত খোঁজার চেষ্টা করে?

পরিচিত কারো দেখা পেলে খুশিতে দুই চোখে খুশী উপচে পড়ে। না পড়লে বেদনায় দীর্ণ হতে হয়।

 তারপর ট্রেনের হুইসেলের সাথে মিশে যায় সেই দীর্ঘশ্বাস। ওদের সকলের সাথে একটা আত্মিক যোগাযোগ তো আছেই। শিকড়ের টান বলে কথা!

ছেলেবেলায়  আমাদের বাড়ীটা বছরের অধিকাংশ দিনই আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ এবং মুখর থাকত। বেশির ভাগই দেশের বাড়ী থেকে  নয়তো বাংলা দেশ থেকে বাবার তুতো সম্পর্কের নয়তো মায়ের দিককার কেউ। কে যে অনাত্মীয় আর কারা যে আত্মীয় সে সময় কিছুই বুঝতে পারতাম না। শুনতাম অমুক গায়ের অমুক এসেছে। মা বাবা কী সুন্দর তদের সাথে গল্প করতেন। বাবা মা সঠিক করে বলতেও পারতেন না আমাদের তারা কে হন। ওই  অমুক পিসিমার ভাইয়ের ছেলের খুড় শ্বশুর, নয়তো তমুকের নাতি, মামার নাতজামাই  ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা ছোটোরা তখন অতসবের ধার ধারতাম না। লোকজন এল ভালমন্দ খাওয়া হত, বাবা কিম্বা মা সেই কদিন পড়াশূনার দিকে বিশেষ লক্ষ্য করত না, কতটা সময় পড়ছি সেটা তখন ভাববার সময় কোথায়।  মায়ের কথায় ,”অতিথি হলো নারায়ণ।“ তাই মন দিয়ে সেই নারায়ণ সেবাতেই  নিজেকে ব্যস্ত রাখত।

তখন আমি ক্লাশ এইটে পড়ি। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরের দিকে  কলতলার পাশে ফজলি আমগাছ থেকে  বড় সাইজের একটা  আম পেড়ে ঝিনুক দিয়ে খোসা ছাড়াচ্ছিলাম। ঝিনুকটা আগেই  দেওয়ালে ঘসে ঘসে মাঝখানটা ফুটো করে সেটা দিয়ে ( পিলারের  মত  ) ছাড়াচ্ছিলাম।  আলুর চিপসের মতো পাতলা পাতলা টুকরোগুলোকে একটা বাটিতে রাখছিলাম। পরে সেগুলো নুন, চিনি,  গন্ধরাজ লেবুর পাতা দিয়ে আর আম কাসুন্দি দিয়ে মেখে খাবো ঠিক ছিল। কেউ আম মাখছে দেখলে আশেপাশের বন্ধুরা ভিড় জমাত। তখন খেজুরের কাটা  দিয়ে ফর্ক বানিয়ে দারুন মজার  গল্প করতে করতে সকলে মিলে আম মাখা খাওয়া হতো। সে বড়ো সুখের দিন ছিল তখন। এখন কার মতো তো আর ইদূর দৌড় ছিল না। ছিল অফুরন্ত অবসর আর নির্ভেজাল বন্ধুদের নিয়ে হইহই করে কাটানোর সময়।

এই রকমই একটা দিনে বাবার এক তুতো ভাই বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে হাজির হলেন আমাদের বাড়ী।  শুনলাম বাংলাদেশ থেকে বি এস সি পাশ করেছে।  এখন  এদেশে ক্লাশ নাইনে ভর্তি  হওয়ার জন্যে বাবাকে  খুব করে  ধরেছে।  অতো বড় একজন ধাড়ি ছেলে নাইনে পড়বে শুনে আমার বেশ হাসি পেয়ে গেল।  আমাদের স্কুলে কয়েকজন স্যার আছেন প্রায়  ওনার বয়সী হবে। তারা কিছুদিন হল চাকুরিতে জয়েন করেছেন।

সন্ধ্যেবেলায়  যখন সবে পড়তে বসেছি, তখন সেই কাকা আমার  পড়ার টেবিলের সামনে এসে বেশ হাসি হাসি মুখে দাড়াল। তারপর পকেট থেকে একটা  কলম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, ”এইডা দিয়ে তুমি লেখবা, কেমন?”

আমি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সুচারুরূপে গোপন করে মাথাটা নেড়ে  বললাম, ”আচ্ছা।“

কাকা চলে যেতেই  কলমটা হাতে তুলে নিয়ে  ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম।  মনে হল  আমার হাতের ভিতরে একটা  নক্ষত্র  ধরে আছি। উজ্জ্বল নীল রঙের কলমটার  মাথায়  গোল্ডেন কালারের একটা ঈগল পাখি। পৃথিবীর গ্লোবের উপরে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। কলমটা যত দেখছি  ততই আমার ভালোলাগাটা বেড়ে  যাচ্ছে। এতো সুন্দর উপহার এর আগে আমাকে কেউ দিয়েছে বলে মনে করতে পারছি না।

দশটা বাজতেই  মা ডাক দিল, ‘বাবু খাবি আয়’।

আমি খেতে যাওয়ার আগে আরো একবার খাতার পাতায়  আলতো করে একটা দাগ টেনে দেখলাম, কী সুন্দর দাগ পড়ছে।  নীল রঙের সরু রেখাগুলো যেন আমার মনের আকাশটাতে খুশির দাগ কেটে চলেছে। কলমটা কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছি না। একবার টেবিলে, একবার বইএর আলমারিতে, একবার ড্রয়ারে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিচ্ছি।

মা আবার ডাকছে, “কিরে, খাবি না?”

এবারে কলমটা বুক পকেটে গুজে খেতে গেলাম। কিছুতেই হাতছাড়া করতে ইচ্ছা করছিল না। মনে হচ্ছিল সারাক্ষণ হাতেই ধরে রাখি। রাতে শোওয়ার  সময়ে বালিশের পাশে রেখে দিলাম।  ভাবছিলাম কখন সকাল হবে, বন্ধুদের দেখাবো।

তিন

ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।  জনালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকতেই  ধড়পড় করে উঠে গেলাম। তারপর  ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগলাম। মনকে বললাম, আর একটু ধৈর্য ধরতে। সেদিন দশটা বাজার আগেই বেরিয়ে পড়লাম।  হাঁটার গতি অন্যদিনের তুলনায় বেড়ে গেছে। আমাদের স্কুলে যাওয়ার পথে তিনটে মোড় পড়ে । সবে প্রথম মোড়টা পেরিয়েছি, হঠাৎ পেটের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠল। একটা খিচ ব্যাথা। প্রথমে অতটা পাত্তা দেইনি। কিন্তু দ্বিতীয় মোড়টা আসতেই  এমন কামড়ে কামড়ে ব্যথা করতে লাগল যে বুঝতে পারলাম বাড়ী  ফেরা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই।  মনে পড়ে গেল কলমের চিন্তায় আজ সকালে টয়লেটে যেতেই  ভুলে গেছি।

এবারে ছুটতে ছুটতে কোনোমতে গেট খুলে বাড়ি, বিশাল উঠোণ, উঠোন পেরিয়ে কলতলা, তারপর  বাথ রুম পেরিয়ে একেবারে বাড়ীর শেষ সীমানায় আমাদের পায়খানা ঘর। এদিকে আমার আর সবুর সইছে না। কোনোরকমে প্যান্টটা খুলেই দৌড় দিলাম। এখান থেকে  আবার স্কুলে যেতে হবে এবং ঢুকতে হবে প্রেয়ারের আগে, সেই চিন্তাও মাথায়  আছে। তাড়াতাড়ি  নীচু হয়ে  মগে করে জল তুলতে গিয়েই ঘটে গেল সর্বনাশ।

ঈগল কলম পকেট থেকে লাফিয়ে  কখন যেন প্যানের ভিতরে পড়ে গেছে।  ব্যাপারটা বোঝা মাত্র আমার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন বাষ্প হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। কান মাথা তখন  ঝন ঝন করছে। কী হবে এবার? এর চাইতে আমি নিজে প্যানের ভিতরে পরে গেলেও বুঝি এতটা কাতর হতাম না।

সমস্ত ঘেন্না ত্যাগ করে নীচু হয়ে প্যান থেকে কলমটা তুলে প্রথমে জল দিয়ে তারপর সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে  নিলাম।  তবু  মনটা ভীষণ খুত খুত করতে লাগল। ভারাক্রান্ত  মনে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে আবার স্কুলের পথে পা বাড়ালাম।

বেশ দেরী হয়ে গেল আজ স্কুলে পৌছাতে। সামনের বেঞ্চে যথারীতি  জায়গা পেলাম না।  বসতে  হল সেই  পিছনের বেঞ্চে।  ক্লাশের এইসব ছেলেদের সাথে  আমার সেরকম সম্পর্ক ছিল না। শুরু হয়ে গেল জায়গা নিয়ে ঠেলাঠেলি। কলম নিয়ে কাড়াকাড়ি।  এ ওরটা নিচ্ছে, এ ওর চুল ধরে টানছে, কেউ পিছন দিক থেকে সামনের  জনের গায়ে  চুপিচুপি কালি ছিটিয়ে তার দুধ শাদা জামাটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। সে বেচারা কিছুই টের পাচ্ছে না।  বুঝতে পারলাম এ খেলা প্রতিদিনই চলে।

সেদিন স্কুল থেকে আমি বেশ বিষণ্ণ মনে ফিরছি। গেটে র মুখে বিমলের সামনে পড়তেই বিমল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,”কী হয়েছে রে তোর আজকে? কেউ কি মেরেছে তোকে?”

হেলা বিমল হেলানো মাথাটা আরো একটু হেলিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

আমি কাঁদো  কাঁদো গলায় বললাম,”আমার কলমটা না পাচ্ছি না” ।

বিমল আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,”কোন কলমটা? সেই  ঈগল কলমটা? যেটা সবাই দেখাদেখি করছিল?”

“হ্যা, ওটাই ত। একেবারে নতুন কলম। গতকালই আমার কাকা বাংলাদেশ থেকে কলমটা আমায় এনে দিয়েছে” ।

বিমল  মাথাটা বিজ্ঞের  মত নাড়তে  নাড়তে বলল, “আজ তো কিছু করা যাচ্ছে  না, স্যারেরা সবাই  চলে  যাচ্ছেন, কাল দেখা  যাবে, তুই কিচ্ছু ভাবিস না। তবে একটা কথা বলত, তোর ডানদিকে  আর বাম দিকে কে কে  বসেছিল?”

আমি খানিকটা ভেবে বললাম, ”আমার ডানদিকে শ্যামল, বাবলু আর বাম দিকে বিজিত আর রামু বসেছিল” ।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোর কি  মনে হয়, কলমটা কে নিতে পারে বলতো?”

“আমি কি জানি, সবাই মিলেই ত দেখছিল”, কথাটা বলে বিমলের মুখের দিকে তাকালাম।

“ঠিক আছে দেখছি, কলমটা ঠিক পেয়ে যাবি” বলে আমাকে আশ্বস্ত করে বিমল এগিয়ে গেল।

পরেরদিন স্কুলে এসেই বিমল আমাকে নিয়ে সোজা হেডস্যারের  ঘরে নিয়ে গেল।

স্যার  আলমারীর সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা কাজ করছিলেন।

“স্যার, আসবো” বলতেই হেড স্যার উত্তম কুমার টাইপ ঘাড় বেঁকিয়ে কর্নার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”

বিমল বলল, “ স্যার,  এর নতুন কলমটা না কাল  চুরি হয়ে গেছে।  রা মু কাল ওর পাশে বসেছিল। কলমটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।  তারপর ছুটির সময়ে খেয়াল করে ওর ব্যাগে কলমটা নেই । রামুই  কলমটা চুরি  করেছে স্যার।  এরা না খুব গরীব। ওর আর কোনো কলম নেই।  ও কাল খুব কাঁদছিল।  তখন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল।  তাই  আপনার কাছে  আসতে পারিনি”।

হেড স্যার দেখি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন , “কি,  ও ঠিক বলছে তো?”

কে নিয়েছে সেটা আমি জানি না কিন্তু কলম হারানোটা তো সত্যি। তাই  আমি কাদো কাঁদো মুখে ঘাড় কাত করলাম। হেড স্যার গম্ভীর মুখে বললেন,”কে রামু? যাও এক্ষুণি তাকে ডেকে নিয়ে এসো”।

বিমল রামুকে ডাকতে চলে গেলে হেড স্যার টেবিলের উপর থেকে একটা বলপেন আমার হাতে দিয়ে বললেন, ”এটা দিয়ে লিখতে থাকো ।”

কথাটা বলে তিনি নিজের কাজে মন দিলেন।

বিমল একেবারে চিলের মত ছুটে গিয়ে ক্লাশ রুম থেকে রামুকে  ধরে নিয়ে এলো। আমি হেড স্যারের ঘর থেকেই দেখতে পাচ্ছি বিমল আর রামু হন্তদন্ত হয়ে এদিকে আসছে। রামুর মুখটা শুকিয়ে পাংশুটে হয়ে গেছে।  রামু কাদো কাদো মুখে হেড স্যারের সামনে এসে দাড়ালো। স্যার বললেন,”তুমি ওর কলম নিয়েছ?”

রামু কাদো কাদো মুখে বলল,” সবাই দেখাদেখি করছিল তাই আমিও একটু দেখছিলাম স্যার, দেখে আবার ওকে ফেরৎও দিয়েছিলাম। কি দিয়েছিলাম না বল?”

রামু  আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে  মাথা নীচু করে থাকল। স্যার বেশ ব্যস্ত ছিলেন সেদিন। একের পর এক পাতা উলটে ফ্যাটাফ্যাট  সই করছিলেন একগাদা কাগজে। আমার কথা শোনার আগেই হেড স্যার কোনোরকম মুখ না তুলে সই করতে করতেই বললেন, “ ওকে ওর কলমটা ফেরৎ দেবে। আর এরকম কাজ কোনোদিন করবে না,  বুঝলে?”

রামু কাদো কাদো মুখে আবারও বলল, “স্যার, সত্যি বলছি  আমি  ওর কলম নেই নি। আমার কাছে কলমটা নেই”।

হেডস্যার বেশ রাগত স্বরে বল্লেন, “যাও, ক্লাশে যাও। আর যা বললাম তাই করো”

বিমল হেডস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে  এসে করিডোরে দাড়িয়ে রামুকে বলল , “কলমটা যদি তুই  এনে দিতে না পারিস, তার দামটা অবশ্যই তোকে দিতে হবে”।

আমি নিজেও জানতাম না ঈগল কলমের কত দাম। বিমলই দামটা ঠিক করে দিল। বলল , “কুড়ি টাকা দিয়ে দিবি ওকে বুঝলি?”

“কুড়ি টাকা?”

কথাটা বলতে বলতে রামু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। হাতের চেটো  দিয়ে বারবার চোখ মুছতে লাগল। রামুর  মুখের দিকে তাকিয়ে আমার খুব কষ্ট হল। আমার মনে হল না রামু  চুরি করেছে। কিন্তু হেডস্যার  ওকে কলমটা ফেরৎ  দিতে বলেছেন। আর বিমল বলেছে কলম ফেরৎ দিতে না পারলে কলমের দাম দিতে হবে। সুতরাং টাকাটা ওকে দিতেই হবে।  আমি জানি ওরা কত গরীব। ওর বাবা রেল গেটের কাছে  গম ভাঙ্গানো দোকানে কাজ করে। কতই বা টাকা পায়। ওদের ছোট একটা  মাটির বাড়ি । ওর মা আমাদের পাড়ায়  আসে মুরগীর ডিম আর ঘূটে বেচতে।

আমি আস্তে  আস্তে বললাম, “কুড়ি টাকার দরকার নেই, দশ টাকা দিলেই হবে”।

বিমল দেখি রসগোল্লার  মতো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

পরে বিমলের কাছে  ধাতানি খেয়েছিলাম, কুড়ি টাকার বদলে দশ টাকা বলার  জন্যে। ও বলল, ”খুব প্যাকনা হয়েছে  না তোর? আমি তো একটা ভেবেচিন্তেই দামটা বলেছি  না কী? ভাবলাম, তোর দশ আর আমার দশ। তুই  একেবারে কেচে দিলি? ওরা গরীব না  বড়োলোক সেটা তোকে দেখতে বলেছি?”

আমি বললাম, “সে তুই  যাই বলিস না কেন, আমি তো  জানি ওরা কতটা গরীব। দেখিস না ও যে জামাটা পরে আসে তার বগলের কাছটা ছেড়া। প্যান্টটাতেও কত জায়গায় সেলাই  খুলে গেছে। পায়ের চটীতে সেফটিপিন লাগিয়ে পরে”। 

বিমল আমার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে এগিয়ে  এল। টিফিন পিরিয়ডে ক্লাশের প্রায়  সবাই  যখন মাঠে গিয়ে খেলছে,  রামুকে দেখলাম হাই বেঞ্চে দুই হাতের উপরে মাথা রেখে মনমরা হয়ে আছে। আমি চারিদিক একনজর তাকিয়ে দেখে নিলাম বিমল ধারে কাছে আছে কি না।  তারপর রামুর কাছে গিয়ে দাড়াতেই  ও কাদতে কাদতে বলল, “আমি না একসাথে দশ টাকা কিছুতেই দিতে পারবো না।  বাবা জানতে পারলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে”।

রামু একসাথে দশ টাকা দিতে পারবে না শুনে আমি বললাম, “তুই ভেঙ্গে ভেঙ্গেও দিতে পারিস”।

রামু এরপর প্রতিদিন আমাকে পচিশ পয়সা করে দিত। তবে সকলের আড়ালে। পয়সাটা দিয়েই ছুটে পালিয়ে যেত । সেদিন  শুধু একটা কথাই আমাকে  বলেছিল, “কথাটা আর কাউকে বলিস না”।

ঈগল কলমের দৌলতে আমার টিফিনটা বেশ ভালোই  হচ্ছিল।  তখন দশ  পয়সায়  ঝাল মুড়ি, আলু কাবলি  আর নারকেল দেওয়া দুধ আইস ক্রীম পাওয়া যেত।  তিন পয়সা দিলে কচু ভাজা,টিকটিকি লজেন্স, সবুজ মটর, ছোলা ভাজা আর  লাল, সবুজ হলুদ রঙের আইস্ক্রীম পাওয়া যেত। যেগুলো খেলে  মুখ আর ঠোট সব রঙ্গীণ হয়ে যেতো। কদাচিৎ ভাগ্য ভাল  থাকলে  মার কাছ থেকে পাচ পয়সা পাওয়া যেত। সেখানে প্রতিদিন পঁচিশ পয়সা! আমি ভাবতে পারছিলাম না কীভাবে খরচ করবো।

আমাদের স্কুল গেটের ঠিক সামনে ছিল বিশাল বড়ো একটা বটগাছ।  তার বয়সের কোন মাথামুণ্ডু ছিল না। লোকে  এই জায়গাটাকে বলতো ‘ বুড়ো বটতলা’।  তার ছায়ায়  একটা চায়ের দোকান ছিল। সেখানে চা ছাড়াও , ঘুগনী , বাটার টোসট, ডিম পাউরুটি পাওয়া যেত। আসতে যেতে ঘুগ্নির গন্ধটা  নাকে যেতেই  মনে মনে ভাবতাম কবে যে জিভ এই অমৃতের আস্বাদ পাবে।

রামুর পয়সাটা আমার এতদিনের সুপ্ত বাসনাটাকে পরিপূর্ণতা দিল। কুড়ি পয়সায় সেই সময়ে  এক প্লেট ঘুগনি আর দুই পিস পাউরুটি মিলত। আরো পাচ পয়সা আমার হাতে থাকত। কোন কোন দিন বিমল পাওনাদারের মতো  এসে আমার খাবারে ভাগ বসাত। আমি কিছু বলতে পারতাম না। কারন ওর দৌলতেই তো আমার পয়া  খুলেছে।

টিফিনটা বেশ ভালই হচ্ছিল। বেশ কিছুদিনের ভিতরে দশ টাকা শোধ হয়ে গেলো। হঠাৎ একদিন ধরে লক্ষ  করলাম  রামু স্কুলে আসছে না। খোজ নিয়ে  জানলাম ও নাকি পড়া ছেড়ে দিয়েছে।  আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। স্কুল থেকে বাড়ী  ফেরার পথে সেদিন কেবলি  মনে হতে লাগল, ওর এই  অবস্থার  জন্যে  আমি কিছুটা হলেও দায়ী।  ও যদি সত্যি কলমটা না নিয়ে  থাকে,  তাহলে তো এই  চুরির অপবাদ  ওকে বয়ে বেড়াতে হবে। সেই জন্যেই  কি ও স্কুল ছাড়লো?

কিছুদিন বাদে সেকথা ভুলেও গেলাম।  যত উপরের দিকে উঠছি  ততই দেখছি প্রতিবছর কত ছেলেরা স্কুল ছেড়ে কেউ দোকানে কাজ করছে, কেউ বা মাঠে কাজ করছে, কেউ আবার বাউন্ডূলে হয়ে   ঘুরে ঘুরে কাটাচ্ছে। এদের ভিতরে বিমল একজন। দুদিনেই তার চেহারা ছ বি পালটে গেল।  ঘাড় পর্যন্ত চুল, প্যারালাল প্যান্ট, হাতে স্টীলের বালা পরে  বিমল  শহরময় টোটো করে বেড়াচ্ছে।  ক্লাশ  এইটের পরে ওকে আর স্কূলে দেখা গেল না। কদিন দেখলাম ব্রীজের নীচেয় হরেক মালের দোকান দিয়েছে। পরে শুনলাম ওগুলো  নাকি লোক দেখানো।  আসলে ও স্ম্যাগ্লিং করে। বাংলাদেশ বর্ডারে  যত লরি যাতায়াত করে প্রত্যেক লরি  পিছু পঞ্চাশ টাকা করে তোলা আদায় করে। এ ছাড়া আরও নানান কু কর্মের কথা শোনা গেলো। সীমান্ত শহর বলেই  এখানে বিভিন্নজন নানান অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করে । দিনের বেলা এক চিত্র আর রাতের চিত্র – চরিত্র একেবারেই  উল্টো । শাদা – কালোয় মেশানো মানুষ গুলোকে চেনা সত্যিই  অসম্ভব ।

চার

এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলকাতায় চলে এসেছেন মা বাবা আমাকে নিয়ে।  আমার পড়াশুনার ব্যাপারে তারা বেশ এখন চিন্তিত । প্রথমে দুই  কামরার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ছিলাম বেশ কিছুদিন। তারপর সেটাই মালিকের কাছ থেকে কিনে নিলাম একদিন। ভাড়া বাড়ীটা যেদিন রেজস্ট্রি করে নিজের বাড়ী হল সেদিন কীযে ভাল লেগেছিল।  মা প্রতিদিন পূজো দেওয়া সত্বেও সেই  একই  ঘরে বড়ো করে নারায়ণ পূজো দিলেন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে।

সামনেই ডাব্লিউ বি সি এস এর এগজ্যাম।  আমার তখন নাওয়া  খাওয়ার সময় নেই। যে করেই হোক ‘এ’ গ্রুপে আমাকে  চান্স পেতেই হবে। বন্ধুদের সাথে খেলা, বিকেলের আড্ডা , রেডিওতে অনুরোধের আসর, শুক্রবার সন্ধ্যের লোভ নীয়  নাটক – সব বাদ পড়ে গেল। একটাই পাখির চোখ , চান্স পাওয়া।

যেদিন য়্যাডমিট কার্ড হাতে পেলাম পরীক্ষার সেন্টার দেখে সত্যি অবাক হয়েছিলাম।

আমাদের হাইস্কুলে সেন্টার পড়েছে দেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল।

অনেক দিন বাদে  আবার স্কুল প্রাঙ্গণে পা রাখলাম। ব্ল্যাকবোর্ড থেকে রোল নম্বর দেখে ঘর খুঁজতে এতটূকু বেগ পেতে হয়নি। শুধু ঘরটাতে  ঢুকে তাজ্জব বনে গেছিলাম।  এই তো আমাদের সেই  ক্লাশ রুমটা। যেখানে আমরা ক্লাশ এইটে ক্লাশ করেছি। সেই  শাদা দেওয়ালটার এ কী ছিরি হয়েছে! যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি পেন্সিল দিয়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাল,  সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ থেকে  শুরু করে সেনযুগ, গুপ্তযুগ, মোঘল যুগ, সিপাহী বিদ্রহের ব্যার্থতার কারণ ও ফলাফল, আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তি কলাপ , সবিস্তারে লেখা আছে। যেন একটা গোটা ইতিহাস বইএর পাতা ছিড়ে দেওয়ালে সেঁটে রেখেছে।

একটু  তফাতে ভুগোল, ভৌত বিজ্ঞান, আর  জীবন বিজ্ঞানের সচিত্র বর্ণনা। পাশেই  সম্পাদ্য , উপপাদ্য , কঠিনতর জ্যামিতিক সমস্যার সমাধান।  এই  ঘরে বসে পরীক্ষা দিতে হবে ভাবতেই লজ্জা করছিল। প্রশ্ন পত্র ছেড়ে একটু ঘাড় ঘোরাতেই  মনে হচ্ছিল আমি বুঝি টুকলি করছি ।

ফার্স্ট হাফের পরীক্ষা হয়ে গেছে।  এরপর সেকেন্ড হাফ  শুরু হবে।  আমার সিট পরেছে  দ্বিতীয় বেঞ্চের কোণায়,  মানে দেওয়ালের পাশে। বসে পরের পরীক্ষার কথা ভাবছি , হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল  বাম দিকের দেওয়ালে। দেখি দেয়ালের গায়ে  একটা ফুটো । আর সেই  ফুটোর ভিতরে একটা কাগজ দলা করে ঢোকান আছে।  আমি কৌতূহলী  হয়ে কাগজটা টান দিতেই সেটা বেরিয়ে  এলো। ফুটোর ভিতরে তাকিয়ে দেখি কী যেন একটা ঢোকান আছে। কি আছে  ওখানে? আমার কৌতূহল হল। আমি পেন্সিল ঢুকিয়ে জিনিসটা  বাইরে বের করে এনে দেখি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া  ঈগল কলম!

ঈগল কলম!

কলমটা হাতে পেয়ে আমার ভিতরে অদ্ভুত উত্তেজনা হচ্ছে। বুকের ভিতরে দ্রিম দ্রিম শব্দ টের পাচ্ছি । আজ এতটা বছর এতো ছেলে এই ঘরে ক্লাস করেছে অথচ কারো চোখে পড়েনি?

কে  রাখতে পারে এখানে  ভেবে আমি মেঝে  থেকে  গুঁজে দেওয়া কাগজটা তুলে আনি। দোমড়ানো কাগজটা মেলে দেখি তাতে আমাদের ক্লাসের দুষ্টু ছেলেদের নাম গুলো পরপর লেখা আছে।  আমার কানদুটো ততোক্ষণে গরম হতে শুরু করেছে। আমি  নিশ্চিত, এটা হেলা বিমলের লেখা। ওই আমাদের ক্লাসের মনিটর ছিলো। আর আজ যে জায়গায়  আমি বসেছি সেটা বিমলের বাঁধা জায়গা ছিল। কেউ ওর এই কোণার জায়গায়  বসার  সাহস করত না।

ঈগল কলমটা তাহলে বিমলই লুকিয়ে রেখেছিল? অথচ দোষটা রামুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিল?হেড স্যারের সামনে কেমন নির্ভেজাল মিথ্যে কথাটা বলল সেদিন? লজ্জায়, অপমানে এবং দুঃখে রামুর কান্নাভেজা মুখটার কথা আজ ভীষণ মনে পড়ছে।  চুরির অপবাদের জন্যে ও বোধহয় শেষ পর্যন্ত পড়াটাই  ছেড়ে দিল। কথাটা যতবার ভাবছি  ততবার  আমার কান  মাথা গরম হয়ে  যাচ্ছে । আমার ভিতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, যেটা বুঝিয়ে বলা যায় না।  একটা অপরাধ বোধ আমাকে  মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিল।  আমি খানিকটা সময় ডেস্কে মাথা রেখে মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করি। কোনোরকমে মাথা ঠাণ্ডা করে পরের পরীক্ষা দিলাম।

পরীক্ষা দিয়ে বাড়ির দিকে  যাওয়ার কথা ছিল। ওখানে আমাদের এক কাকা-কাকিমা থাকেন। তারাই  বাড়ীটার দেখভাল করেন। কিন্তু সে পথে না গিয়ে রামুদের বাড়ীর রাস্তা ধরলাম। আজ রামুর সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। কথাটা ওকে না  বলা পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার বুকের ভিতরটা ভার হয়ে আছে। সত্যি কথাটা ওকে জানাতেই  হবে। কলম চুরির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ওর উপরে যা অন্যায় করা হয়েছে তার জন্যে ওর কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। যদিও এই ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। মনে হচ্ছিল বিমলকে ডেকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই।

কিন্তু বিমল এখন এই শহরের ডন। বন্ধুদের মুখে শুনেছি বিভিন্ন অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। জাল নোট পাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন চোরা কারবারি, জোর জবদস্তি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা আদায় করা, বাংলাদেশ থেকে যে সব পণ্যবাহী ট্র্যাক আসে সেগুলোর আটকে মোটা অংকের টাকা নেওয়া। একেবারে শিকারী চিলের মতো ওৎ পেতে থাকে। তারপর সুযোগ বুঝে ছোঁ মারে শিকারের উপরে। 

রেলগেট পার হলে যে রাস্তাটা সোজা পাঁচবেড়িয়ার দিকে চলে গেছে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে বাঁদিকে  একটা পুকুর পরে, লোকে  এই পুকুরটাকে ‘ন্যাড়া পুকুর’ বলে। একটা সময়ে এখানেই নাকি মাথা ন্যাড়া করে ঘাট শ্রাদ্ধ করতেন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। আগে পুকুরটা বেশ বড়োসড়ো এবং সারাটা বছর প্রচুর জল থাকত তাতে। রামুদের বাড়ীটা ছিল এই পুকুরের ধারে। কলাগাছে  ঘেরা টিনের ছাউনি দেওয়া দোচালা মাটির বাড়ী।

 নোংরা আবর্জনায় প্রায় বুজে যাওয়া পুকুর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে রামুদের বাড়িটা যে জায়গায় ছিলসেখানে গিয়ে একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করি।

ছেলেটি হাত উঁচু করে দেখিয়ে দেয়,"ওই তো -”

দেখি জঙ্গল  জঞ্জাল আর আগাছায়  ভরে গেছে জায়গাটা। উঠোনের এককোণে দাড়িয়ে থাকা পরগাছা জড়ানো আমগাছটা এখনো আছে। আমগাছের শুকনো পাতাগুলো সড়সড় করে উড়ছিল বাতাসে। শুনলাম রামুরা এ জায়গা ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন আগেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। দেখি ছাউনি বিহীন মাটির বাড়িটা বর্ষার জলে ধুয়ে একটা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। একটা চিল বসেছিল সেই ভগ্ন স্তূপের উপরে। শ্যেন দৃষ্টি মেলে চারদিকটা দেখছিল।

পাঁচ

এরপরেও কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। আজ খবরের কাগজে সংবাদটা পড়ে  আবার সেই পুরানো ব্যথাটা খচখচ করে ওঠে।

সন্ধ্যে বেলা অফিস থেকে ফিরে নিউজ চ্যানলটা চালাতেই  অন্য কথা শুনি,  পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে বিমলের।

আমি ফোনটা নিয়ে বিজিতের নম্বরটা ডায়াল করি। বিজিত আমাদের সঙ্গে পড়ত। আমার সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ আছে।

বিজিতকে ফোন করে আরো একবার বিমলের সংবাদ পেলাম। ঘটনাটা সত্যি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছে বিমল।

বিজিত  কথা প্রসঙ্গে আরো জানায়, এবারে নতুন একজন পোস্টেড হয়েছে থানায়। খুব কাজের ছেলে। মাস  তিনেকের ভিতরে শহরটাকে শান্ত করে দিয়েছে। কর্মরত পুলিশ অফিসারের নাম রামেন্দ্র সুন্দর রায়।

" রামেন্দ্র সুন্দর রায়?”

নামটা শুনে আমি চমকে উঠি। বলি,"আমাদের রামু নয়তো?”

"ঠিক ধরেছিস। তোর মনে আছে দেখছি।"

আমি মনে মনে বললাম, "আমি এতোটা বছর খুঁজে বেড়িয়েছি রামুকে।"

আমার মনের ভিতরটা তোলপাড় করছে। উত্তেজনা গোপণ রেখে আস্তে আস্তে বললাম, " রামুর কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা জোগাড় করা যায়?”

বিজিত বলল, " এ আর এমন কি ব্যাপার। আমাদের পুরানো বন্ধুদের একটা হোয়াটস য়্যাপ গ্রুপ আছে। চাইলে তুইও যোগ দিতে পারিস। দাঁড়া আমি আমাদের য়্যাডমিনকে বলে তোর নামটা ঢুকিয়ে দোবো। তুই রামুর সঙ্গে কথা বলিস।"

আমি বিজিতকে বললাম, "আমার একটু পার্সোনাল দরকার আছে। তুই ওর নাম্বারটা পারলে আমায় পাঠিয়ে দিস। "

বিজিত পার্সোনাল হোয়াটস য়্যাপে রামুর নাম্বারটা পাঠিয়ে দিল।

আজ রাতের দিকে রামুর নম্বরে ফোন করলাম। রাত দশটা বাজতে চলেছে।

পুরো রিং হল।

আননোন নাম্বার বলেই হয়তো রামু ধরল না। হয়তো ব্যস্ত থাকতে পারে।

আমি অপেক্ষা করলাম। পরেরদিন আবার করলাম।

একবার নয়, দুইবার। রিং ব্যাকও করল না।

না, কোনোদিন ধরেবে না জানি। হয়তো আমার নাম্বারটা ও ব্লক করে দিয়েছে।

তবে কি ট্রেস করতে পেরেছে আমাকে? হয়তো গ্রুপে সদ্য জয়েন করেছি দেখেছে আমায় ।

পরেরদিনই হোয়াটস য়্যাপ খুলে দেখি গ্রুপে জ্বলজ্বল করছে 'রামু হ্যাজ লেফট''।

লেখাটা পড়ে হঠাৎ হোঁচট খেলাম।

আমার আগমণই কি রামুর প্রত্যাগমণের কারণ?

কথাটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।

হতে পারে। আজও হয়তো ও আমাকে ঘৃণা করে। স্বাভাবিক। তবে সত্যিটা জানলে হয়তো করতো না।

সেদিন রাতে চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে সাততলা একটা প্রজেক্টের কাজ চলতে চলতে থেমে গেছে। পায়রা আর ঘুঘু সারাটাদিন ঘুরে বেড়ায়। এখন পায়রার ডাক কানে আসছে। রাতে তো ওরা কখনও ডাকে না?

কার্ণিশে একটা বড় পাখি ঘাপটি মেরে বসে আছে। কী পাখি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে কিছুদিন একটা চিলকে বসে থাকতে দেখেছি।

এ সব দেখতে দেখতে রামুর কথাই ভাবছিলাম। আমাদের স্কুল ছেড়ে দিয়ে নিজের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে ভর্তি হয়েছিল নিশ্চয়ই।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।

দেখি স্ক্রীণে জ্বলজ্বল করছে রামুর নাম।

 কানে দিতেই ওপাশ থেকে একজনের ভারী গলা শুনতে পেলাম। পরিচয় না দিলে বুঝতেই পারতাম না। এতো বছর বাদে সেই বাচ্চা ছেলেটা এখন থানার বড়ো অফিসার। তার গলায় কথায় আলাদা গাম্ভীর্য তো থাকবেই।

প্রাথমিক আলাপ পরিচয় সেরে আমি আসল কথায় আসি। রামুকে আমার সেই বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ঈগল কলমের খোঁজ পেয়েছি জানাই। কীভাবে পেলাম সেটাও বললাম। এটা যে বিমলের কাজ সেটাও বলি।

রামু মন দিয়ে সব কথা শোনার করে শুধু একটা কথাই বলল, "আমি জানতাম।"

আমার বুকের উপর থেকে এতোটাকাল চেপে বসে থাকা পাথরটা মুহূর্ত্যের ভিতরে সরে গিয়ে অনেকটা হাল্কা বোধ করছি এখন। এরপর টুকিটাকি অনেক কথা হল।

বিমলের প্রসঙ্গে রামু আর একটা শব্দ উচ্চারণ করল না।

"গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেলি কেন?”

সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞাসা করি।

রামু সাময়িক চুপ থেকে বলল,”বিমলের মৃত্যু নিয়ে গ্রুপে অনেক কথা চালাচালি হচ্ছে। দেখেছিস নিশ্চয়ই। আমি চাই না,-

তারপর আস্তে আস্তে জানাল, "আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে। লালগড়, মেদিনীপুর।।"

"লালগড়! এতো তাড়াতাড়ি? এই তো সবে জয়েন করলি?”

 শুধু মনে মনে বললাম, সে তো মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল!

বিমল নীরব রইল।

পাখিটা হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে ডানা মেলে উড়তে উড়তে  দূরে বহুদূরে মিলিয়ে গেল।

পাখিটা যে চিল সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

 

ছন্দা বিশ্বাস
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top