সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ছানি : আসিফ মেহদী


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২০ ০১:৩৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:০৯

 

এক.

‘পাঠানের গলি যাবা নাকি?’

‘ওইটা পাঠানের গলি না; কন পাঠান সাহেবের গলি’, রিকশাঅলা বিরক্তমুখে বলল।

সোবহান মিয়া সরল-সোজা মানুষ। বিনয়ের সঙ্গে মেনে নিলেন রিকশাঅলার কথা। এভাবে জীবনের অনেক ব্যাপারই তিনি হইচই ছাড়াই মেনে নিয়েছেন। বললেন, ‘ও আচ্ছা, তো যাবা পাঠান সাহেবের গলি?’

‘ওঠেন। এক শ আশি ট্যাকা।’

ভাড়া শুনে সোবহান মিয়া তৃতীয়বারের মতো ভড়কে গেলেন। অনেকদিন রাজধানী ঢাকায় আসা হয় না। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে শ্যামলীর পাঠান সাহেবের গলিতে যাবেন। এর আগে যে দুজন রিকশাঅলাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তারা চেয়েছে দুই শ টাকার বেশি! প্রথম ও দ্বিতীয় ভড়কানিদাতা তারাই। ঢাকা শহরে রিকশাঅলা ও সিএনজিঅলা ভাড়া চেয়ে ভড়কে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এমনটি ঘটে কিনা, কে জানে!

ঢাকার বিভিন্ন পরিস্থিতি হজম করতে বেশ কষ্ট হয় সোবহান মিয়ার। এটা তার সমস্যা নাকি শহরের সমস্যা-ঠিক বুঝতে পারেন না। শহরকে আপন করে নিতে পারেননি কোনোদিন। ছেলে সাজুর বাসায় সোবহান মিয়া খুব যে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি, তা নয়। কোনো এক অজানা কারণে বউমা তার সংসারে শ্বশুর-শাশুড়ির থাকা তো দূরের কথা, আসাটা ভালো চোখে দেখে না। ব্যাপারটি সরল মনের সোবহান মিয়াও বোঝেন। তাই অনেকটা দিন আসা বন্ধ ছিল। কিন্তু এবার খানিক বেকায়দায় পড়েছেন। চটের ব্যাগে কয়েকটা জামা নিয়ে শহরের বুকে হাজির হয়েছেন।

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’-বাক্যটি ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার অন্তরের কথা। সোবহান মিয়াও একটু ভালোভাবে বাঁচার আশা নিয়ে পা বাড়িয়েছেন ছেলের বাসার দিকে। একটি চোখে ছানি পড়ে বেশ খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। চশমা আছে সোবহান মিয়ার; তবে সেটি পরলেও ঝাপসা দেখেন। দিনের বেলায় রোদের মধ্যে ঝাপসার পরিমাণ বাড়ে। রাতে যানবাহনের বাতির দিকে তাকালে আলোটা ছড়িয়ে যায়! তখন একদমই দেখতে পান না। চোখের দেখা নিয়ে জীবনে এমন জটিলতায় পড়বেন, কখনো কল্পনা করেননি তিনি। মানুষ কত কিছুই তো কল্পনা করে না কিন্তু ঘটে যায়।

গত মাসের এক ছুটিতে গ্রামে প্রতিবেশী উপল ঘোষালের ছেলে পান্থ ঘোষাল বাবাকে দেখতে এসেছিল। পান্থ ঘোষাল চোখের মস্ত বড় ডাক্তার। সে-ই সোবহান কাকাকে দেখে বলল, ‘কাকা, আপনার চোখে বিশেষ ধরনের ছানি পড়েছে। সাধারণত এই ছানি হয় মধ্যবয়সে কিন্তু আপনার ভাগ্য ভালো; দেরিতে ছানি পড়েছে। একে বলে পোস্টেরিয়র সাব ক্যাপসুলার ক্যাটারাক্ট। ঢাকায় আমাদের হাসপাতালে একদিন চলে আসেন। আমি নিজেই অপারেশন করে দেব।’

‘কী বলো বাবা, চোখে ছুরি-কাঁচি চালাবা।’

‘ছুরি-কাঁচি কিচ্ছু নেই এই অপারেশনে। কোনো ব্যথা পাবেন না, কাকা। অপারেশনের পরেও কোনো জটিলতার আশঙ্কা নাই। দুই-তিনদিন পরই দেখবেন স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেছেন; সেইসঙ্গে চোখে দেখবেন একদম পরিষ্কার।’

‘ঢাকায় না গিয়া গ্রামের কাছাকাছি কোনো হাসপাতালে অপারেশন করা যাইব না, বাবা?’

‘ঢাকায় এখন খুব ভালো চিকিৎসা হয়, কাকা। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়। একে ফ্যাকো সার্জারি বলে। আমি নিজের হাতে করি। আমি থাকতে আপনি অন্য কোথাও যাবেন কেন?’

‘কিন্তু খরচ নিশ্চয়ই অনেক বেশি!’

‘কাকা, খরচ নিয়ে কেন ভাবছেন? আপনার ছেলে তো কত বড় চাকরি করে ঢাকায়! ছেলের বাসায় কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে যাবেন। দেখাসাক্ষাৎও হবে, ছানির অপারেশনও হবে। এমনিতে আমাদের হাসপাতালে এমন অপারেশনের জন্য ত্রিশ হাজারের মতো খরচ হয়; কিন্তু আপনার জন্য আমি ত্রিশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা করে দেব। হাজার বিশেক টাকা লাগবে।’

বিশ হাজার টাকা সোবহান মিয়ার কাছে এখন অনেক টাকা। একসময়ে গল্পের মতোই তার গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ছিল; কিন্তু এখন একমাত্র সম্বল একটি গাভি। ফ্রিজিয়ান জাতের গাভিটা থেকে প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ লিটার দুধ পান। দুধ বিক্রির টাকায় তিনি ও তার সহধর্মিনী হাসনা বেগম কোনোরকমে খাওয়া ও জীবনযাপনের খরচটা চালাচ্ছেন। বিশ হাজার টাকা একসঙ্গে জোগাড় করা রীতিমতো অসম্ভব।  

ডা. পান্থ ঘোষাল বলে চলল, ‘মানুষের চোখ হলো জীবন্ত ক্যামেরা! চোখের লেন্স ঘোলা হলেই আমরা তাকে ছানি পড়া বলি। আগে অপারেশনের জন্য ছানি পাকতে হতো অর্থাৎ ম্যাচিউর হতে হতো। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তি এতটাই উন্নত যে এখন ছানি যত নরম হবে বা প্রাথমিক অবস্থায় থাকবে, অপারেশন তত ভালো হবে এবং অপারেশন পরবর্তী জটিলতাও কমবে। তবে কাকা, আপনার ছানি প্রায় ম্যাচিউর স্টেজে চলে গেছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন করিয়ে নিন।’ পান্থর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সোবহান মিয়া। কোনো কথা তার মাথায় ঢুকল কিনা, তা তিনিই জানেন।  

চোখটাকে বাঁচাতে শেষমেশ ছেলের কাছেই আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সোবহান মিয়া। গাবতলী থেকে শ্যামলীতে লোকাল বাসে গেলে ভাড়া একদমই কম পড়ত। শহরের বাসে ওঠা-নামা করতে অসুবিধা হবে বলে বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশাতেই ছেলের বাসায় যাচ্ছেন। তার এক জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, সহধর্মিণী হাসনা বেগম ঢাকায় আসতে চান না। শেষমেশ হাসনাকে ছাড়াই ঢাকায় আসতে হলো। কিছুতেই স্ত্রীকে বোঝাতে পারলেন না, মানুষটি ছাড়া তার এক মুহূর্ত চলতেও ভীষণ কষ্ট হয়। ছেলে তো চিরকালই শিশুর মতো; কোন কালে কী বলল, তা ধরে বসে থাকা ঠিক না-এসব বলেও হাসনার মন গলানো গেল না। বেচারি অতি সহজ-সরল কিন্তু ছেলের বাসার কথা শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যান। ভূতের ভয় তাড়ানো যায় কিন্তু অপমানের ভয় তাড়ানো যায় না।

 

 

দুই.

ছেলের বাসায় বেশ ভালো একটি রুমে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে সোবহান মিয়ার। একেবারে বেডরুমের পাশের রুম। আফসোস একটাই, হাসনা এবার এল না। শেষবার বেশ অপমানিত হতে হয়েছিল তাদের। অবশ্য সাজুর তেমন কিছু করার ছিল না বলে মনে করেন সোবহান মিয়া। এই পাঠান সাহেবের গলিতেই অন্য একটি ছোট ফ্ল্যাটে সাজুরা ভাড়া থাকত তখন। তাতে রুম ছিল দুটো। একটিতে সাজুরা থাকত এবং আরেকটিতে কাজের মেয়ে থাকত বলে সেই রুমে আর বাবা-মাকে রাখেনি সাজু। ড্রইংরুমে ভালোই বন্দোবস্ত করেছিল; তবে বউমার কথাগুলো তীরের মতো বিঁধেছিল সেবার!

বেডরুমে একাকী শুয়ে আছেন সোবহান মিয়া। ঢাকা শহর নিয়ে তার মনের মধ্যে নানা ভয়াল ধারণা- এই শহরে একা থাকাই নিয়ম কিংবা গল্প করে সময় নষ্ট করার মতো ঘটনা এখানে ঘটে না। ভাগ্যিস, সোবহান মিয়ার মনকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তা না হলে, ঢাকায় এলে মনও যে মরে যেত! মনের গহীনে স্মৃতিরোমন্থন করে চলেছেন সোবহান মিয়া। একসময় ছেলেকে ঢাকায় রেখে পড়াতে গিয়ে একে একে সব বিক্রি করেছেন। বিয়ের ব্যাপারেও ছেলের পছন্দকে সম্মান করেছেন। সেসময়ে হাতের পাঁচ, তার ভরণপোষণের অন্যতম উৎস আট বিঘা মাঠাল জমি বিক্রি করে আশপাশের চার গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন। মূলত, ছেলেকে ভালোবাসার পাশাপাশি তিনি শ্রদ্ধাও করেন। বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার বংশে এত ওপরে আর কেউ উঠতে পারেনি। কিন্তু ছেলের বউ কড়া মেজাজের। সাজুর সুখের কথা ভেবেই তিনি এবং হাসনা বেগম ছেলের সংসার থেকে যতটা দূরে থাকা সম্ভব, ততটা দূরে থাকার চেষ্টা করেন।

উপার্জন করে কখনো বাবা-মাকে কিছু দেয়নি সাজু। নিজের উপার্জনের পয়সা পিতামাতাকে দিতে হবে, এমন কোনো সংবিধিবদ্ধ সতর্কবার্তা কোথাও নেই। নাতি হওয়ার পর ছেলে আর কখনোই বাড়ির দিকে পা বাড়ায়নি। হাসনাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসে সোবহান মিয়া নাতির মুখ দেখে গেছেন। কী মায়ামায়া চেহারা! হাসনা বলেই ফেললেন যে নাতিটা দেখতে তার দাদার মতো। দেখতে এক হলেই যে দাদার প্রতি নাতির টান তৈরি হবে, এমন কোনো জাগতিক নিয়ম নেই। জগতে এমন একটি নিয়ম থাকলে মন্দ হতো না! মহাকর্ষ আছে, অভিকর্ষ আছে; তেমনি এমন কোনো আকর্ষণ থাকলে ভালো হতো যা দাদা-নাতির মধ্যে বন্ধন পাকা রাখবে। বরং প্রকৃতিতে এমন নিয়ম আছে, যা মন খারাপ করে দেয়- প্রিয়জন চোখের আড়াল হলে নাকি মনেরও আড়াল হয়ে যায়! আজ সোবহান মিয়া যখন ছেলের বাসাতে এলেন; সামনে দিয়েই ছোটাছুটি করছিল ছয় বছরের নাতি আদিল। বারান্দা থেকে আকাশের প্লেন দেখে আদিলের উচ্ছ্বাসে জোয়ার এল; অথচ আপন দাদার দিকে সে ঠিকমতো তাকালোও না।

স্মৃতিরোমন্থনে থাকা সোবহান মিয়া হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন বউমার কণ্ঠস্বরে। অফিস থেকে ফিরতে সোফিয়ার রাত হয়েছে। তাই আজকে বউমা সোফিয়ার সঙ্গে সোবহান মিয়ার সামনাসামনি দেখা হয়নি; তবে তার কথা ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে। সোবহান মিয়ার চোখের চিকিৎসা নিয়ে ছেলে ও বউমার মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। আড়াল থেকে তিনি শুনতে পাচ্ছেন সেসব কথা। এই বাসার দেয়ালটি বড্ড পাতলা; পেটে কথা ধরে রাখতে পারছে না। দেয়াল গলে এক রুম থেকে অন্যপাশের রুমে কথাগুলো চলে আসছে তার কানে। ছানির কারণে চোখে পরিষ্কার না দেখলেও কানে পরিষ্কার সব শুনতে পান সোবহান মিয়া। তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন বউমার কথা, ‘বুড়ালোক চোখে কম দেখবে এটাই স্বাভাবিক। এই বয়সে সে তো আরেকটা বিয়েতে বসবে না যে ঝকঝকে-তকতকে চোখ লাগবে!’   

সোবহান মিয়ার মনে হলো তার ছেলে এই কথার প্রতিবাদ করল; তা না হলে কেমন একটা আওয়াজ শোনা গেল কীসের! বউমা বলল, ‘ছানি অপারেশন তো দুই-এক টাকার ব্যাপার না। বললেই হলো?! সামনে আদিলের জন্মদিন। এবার ওর জন্মদিনের প্রোগ্রাম বড় করে করবে বলেছিলে, সেই খেয়াল আছে?’

ছেলের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন না সোবহান মিয়া। তার ছেলেটি হয়তো বউমার কথায় এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে! শৈশব ও কৈশোরে বাবা-মায়ের কোলে, ঘরের আঙিনায়, গ্রামের মাঠের সবুজে যে ঋণে জড়িয়েছে তার একমাত্র ছেলেটি, সেসব কথা নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি! বাবা কখন বাসায় ফিরবে, বাবার কোলে ওঠার জন্য যে ছেলে উন্মুখ হয়ে থাকত; মা কখন এক নলা ভাত মুখে তুলে দিবে, সেই স্বর্গীয় আনন্দের জন্য যে ছেলে পিটপিট করে তাকাত; সেই আদরের মানিক নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বউমার গলা থামছে না, ‘তুমি বরং বাবাকে বুঝিয়ে বলো, বাড়ি চলে যেতে। আর কয়টা দিন বাঁচবে! এই কদিনের জন্য চোখের ছানির অপারেশন করার দরকার কী? এই বয়সে শরীর অপারেশনের ধকল সহ্য করতে পারে না-এসব বলে বাবাকে একটু বোঝাও। তার তো আর বোঝার শক্তি কমে যায়নি।’  

সোবহান মিয়ার বোঝার শক্তি আসলেই কমে যায়নি। তিনি মনেমনে আল্লাহর কাছে অসংখ্যবার শুকরিয়া আদায় করলেন, হাসনা সঙ্গে না আসার জন্য। এখানে এলে এসব দেখেশুনে বেচারির মুখ চুপসে যেত। সোবহান মিয়া গ্রামের মানুষ হতে পারেন কিন্তু তিনি আত্মমর্যাদা নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি অবশ্যই গ্রামে ফিরে যাবেন; তবে হঠাৎ তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন তার হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলোতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে! রক্তের টান যেমন বড় টান, তেমনি রক্তের অপমান বড় অপমান! পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়েও ভারী পিতার আত্মসম্মানে সন্তানের আঘাত! হঠাৎ সোবহান মিয়ার মন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে; কিছুতেই তিনি নিজের অন্তরকে জাগিয়ে রাখতে পারছেন না। ছেলের বাসাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাত না হলে তিনি এখনই বেরিয়ে পড়তেন।

অনেকদিন পর নির্ঘুম একটি রাত পার করলেন সোবহান মিয়া। ভোরের আলো ফুটতেই কাউকে না জানিয়েই রওনা দিলেন গ্রামের পথে। বাড়িতে গিয়ে তিনি মাথা গুঁজে দিতে চান তার সহধর্মিনীর কোলে, যে কোলটি জীবনভর শত ঝড়-ঝঞ্ঝায় তাকে আগলে রেখেছে একটি ছোট্ট শিশুর মতো।

 

 

তিন.

সাজুর হয়তো কিছুটা বোধোদয় ঘটেছে। তা নাহলে বাবা ঠিকমতো গ্রামে পৌঁছেছেন কিনা, সেই খোঁজ নিত না। অবশ্য তারপর আবার যোগাযোগ বন্ধ। সে যে বেখেয়াল, তা নয়। ধুমধামে ঢাকার বুকে পালিত হলো সাজুর ছেলে আদিলের জন্মদিন। সেই খবর যাতে গ্রাম অব্দি না পৌঁছায়, সেদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে সাজু! জন্মদিনের পরদিন রাতে ঠিকই গ্রাম থেকে ফোন এল। রহমত চাচা জানালেন যে সাজুর বাবা অর্থাৎ সোবহান মিয়া গুরুতর অসুস্থ। সাজু যেন দেরি না করে গ্রামের পথে রওনা দেয়।

সাজু গ্রামে যাওয়ার কথা সোফিয়াকে বলামাত্র সে তেঁতে উঠল, ‘এত রাতে গ্রাম থেকে কল দিল আর অমনি দৌড়াতে হবে? এর আগেও একবার তোমার বাবার অসুস্থতার কথা বলে তোমাকে গ্রামে নিয়ে গেছে; অথচ সেবার কিছুই ঘটেনি।’

বেশ অস্থিরতা ভর করেছে সাজুর মধ্যে। অনেকদিনের চাপা অপরাধবোধের উদগিরণ হয়তো ঘটে চলেছে তার অন্তরে। সাজু বলল, ‘এবার রহমত চাচার কথা শুনে মনে হলো বাবার শরীর সত্যিই খারাপ। এখনই আমার রওনা দেওয়া উচিত।’

স্বামীর মনের অবস্থা বোঝার মতো মানসিক অবস্থায় সোফিয়া নেই। বরং সে বুঝতে পারছে না, এমন অবুঝ হওয়ার কী আছে! বয়স্ক লোকেরা থাকে অসুখের চক্রে। মানুষের জীবন যেমন সুখ আর দুঃখের মালা দিয়ে গাঁথা, তেমনি বুড়ো মানুষের জীবন সুখ আর অসুখের মালা দিয়ে গাঁথা। সোফিয়ার মতে- জীবনের বাস্তবতা দেখতে দেখতে দুঃখ বয়স্কদের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে না; তখনই অসুখ দখল করে নেয় দুঃখের স্থান। তাই সোফিয়া সাজুকে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এত অস্থির হওয়ার কী আছে? তোমার তো আর মাথা খারাপ হয়ে যায়নি; রাতটা অন্তত যেতে দাও!’

সাজুর মনে হচ্ছে, তার মাথা খারাপই হয়ে গেছে! বাবা-মাকে দেখার জন্য তার হৃদয়ের গহীনে অস্বাভাবিক তাড়না তৈরি হয়েছে। যেন এক অদৃশ্য ও অলঙ্ঘনীয় টানে তার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে বাবা-মায়ের কাছে! হঠাৎ নানা স্মৃতি এসে ভিড়েছে হৃদয়ের আঙিনায়। বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে তার পিঠে চড়া, তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুড়ি কেনা, তারপর সেই ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য বাবা-ছেলে মিলে সুতায় মাঞ্জা দেওয়া! মায়ের কাছে লাটিম কেনার জন্য ঘ্যানঘ্যান করা, শীতের সকালে ভূরোর ক্ষীর আর খেজুরের রস খাওয়ার জন্য তার কাছে বায়না ধরা-কত্ত সোনালি স্মৃতি!

শেষমেশ সোফিয়া কিছুটা নরম হলো। সাজুকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘দেখো, বুড়ো মানুষের অসুখ লেগেই থাকে। আর গ্রামের মানুষরা জানোই তো কেমন হয়! তুমি ফোন পেয়ে যাতে আগে-পিছে না ভেবেই রওনা দাও, সেজন্য এভাবে বলেছে। এখন ঘুমাও। সারারাত জার্নি করে যাওয়ার চেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিও।’

অনেকদিন পর নির্ঘুম একটি রাত পার করল সাজু। ভোর হতেই ছুটে চলল গ্রামের পানে। যে চাচা সাজুকে ফোন করেছিলেন, গ্রামে ঢুকতেই তার চায়ের দোকান। তিনি সাজুর বাবার স্কুলবন্ধু। চাচার সঙ্গে বহুদিন পর সাজুর দেখা। দেখা হতেই চাচা সাজুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘বাবারে, বাপ-মা কারও চিরদিন থাকে না। সোবহান ভাই ফেরেশতার মতো মানুষ ছিল! মানুষটা চইলা গেল।’

হঠাৎ এমন সংবাদে সাজুর হাত-পা নিথর হয়ে এল। রহমত চাচা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আইজ আমার লগে হাসপাতালে যাওনের কথা ছিল। চোখে ভালোমতো দেখত না বেচারা। গরুটা বিক্রি কইরা চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করল। অথচ সেই না-দেখাই তার সর্বনাশ ডাইকা আনল। গতকাইল বাজার করতে করতে সন্ধ্যা নামল। বাড়িতে ফেরার জন্য রাস্তা পার হওনের সময় ট্রাকের ধাক্কায় মইরা গেল। চোখে ঠিকমতো দেখতে পারে নাই বইলা আমার ভাইটা বাঁচতে পারল না ।’ এটুকু বলে রহমত চাচা হু-হু করে কেঁদে উঠলেন।

সাজুর সমস্ত চেতনা যেন অসাড় হয়ে পড়েছে। চাচা কেঁদে বলতে লাগলেন, ‘বাড়িতে যাও বাবা। লাশ হয়তো কথা কইতে পারে না কিন্তু মরা বাপটা তার কইলজাটারে দেখতে নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে আছে!’

 

চায়ের দোকান থেকে পথ ধরে কিছুটা এগোলেই সাজুদের বাড়ি। যে উঠানে তার বাবা তাকে নিয়ে খেলেছে, তাকে পড়িয়েছে, গল্প শুনিয়েছে, সেই উঠানেই রাখা আছে বাবার লাশ। বাড়ির পথের দিকে তাকিয়ে সাজু কিছুই দেখতে পেল না- দু চোখের অশ্রু তার দৃষ্টি ঘোলা করে দিয়েছে! বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল সাজু। সে যেন স্পষ্ট অনুভব করছে, তার বুকের মধ্যখানের হৃদয়টি এতদিন ছিল কুৎসিতভাবে ছানিগ্রস্ত! হৃদয়ের এই ছানিমুক্তি অপারেশনের মাধ্যমে ঘটে না। প্রকৃতির অবাক খেয়ালে, সেটি ঘটে পরম আপন কেউ চিরতরে হারিয়ে গেলে।

 

লেখক: আসিফ মেহ্দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top