সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু হত্যা: একটি অনন্য অধ্যায়ের  সমাপ্তি ও জাতির বিবেক দংশন : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
১৫ আগস্ট ২০২০ ২২:০৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৬

ছবিঃ বঙ্গবন্ধু

 

এখনো আকাশে শুনতে পাওয়া যায় মানুষের ক্রন্দনের বিলাপ, বাতাসে ভেসে আসে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনায় শোকার্ত হৃদয়ের যাতনা। যুগ যুগ ধরে এভাবে যে সকল অবিসংবাদিত নেতাদের নিজ দেশের তরে বলিদান দিতে হয়েছিল তাদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের আব্রহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি (মহাত্মা গান্ধি), ইন্দিরা গান্ধি, চিলির সালভাদর আলেন্দে অন্যতম। নিজ দেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের মনের গহীন থেকে হারিয়ে ফেলেনি কিংবা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারেনি অমলিন স্মৃতি। কীর্তিময় জীবন থেকে দূরে রাখতে পারেনি তাদের সৃষ্টিতত্ত্ব। আজও সাধারণ জনগণকে ভাবিয়ে তুলে তাদের ভালবাসার নির্বাক চাহনি। বিশ্বে অনেক নেতাকে এভাবে ঘাতকের আঘাতে বলিদান হতে দেখেছি। কিন্তু, সপরিবারে হত্যা যে তারও চেয়ে অনেক বেশি বিভীষিকাময়; অনেক বেশি যাতনার!

আমাদের দেশে সপরিবারে বর্বর হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আগস্ট মাসের এই দিনে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনের কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য বিভিন্ন কাজ শেষে ১৪ আগস্টের মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন শেখ কামাল। তাই হয়তো রাত্রির নির্জনতাকে বেছে না নিয়ে সকাল বেলাকেই বেছে নিয়েছিল ঘাতকরা।

চক্রান্তকারীদের বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষতে বিদীর্ণ হয়ে আসে সকালের নিস্তব্ধতা। ভোরের ক্ষীণ আলোয় শ্রাবণের বৃষ্টি যেন জানান দিয়েছিল প্রকৃতির অশ্রুসিক্ত নয়নের ধারা। হত বিহ্ববল জাতি দিশেহারায় নির্বাক হয়ে পড়ে। সেদিন ঘাতকদের নির্মম হত্যা কান্ড থেকে রক্ষা পায়নি শিশুপুত্র রাসেল! পৈশাচিকতার উন্মত্ততা পুরোদমে বিচরণ করেছিল তাদের মাঝে ! অস্তমিত হয়ে আসে একটি অনন্য অধ্যায়। স্বাধীনতা অর্জন এখানেই অনেকটা ম্লান হয়ে আসে। বস্তুত; আগস্ট মাসের এই দিনটি হয়ে উঠেছিল এক মর্মবেদনায় ঘিরে রাখা অশ্রুসিক্ত দিন।

তিনি আমাদের জাতির পিতা। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী গণঅভ্যুত্থানের গণমঞ্চে  বাংলার আপামর জনগণ কর্তৃক 'বঙ্গবন্ধু ' অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের পাশে থেকে অভিনব দক্ষতায় নেতৃত্ব দেয়ার কৌশল বিস্ময় জাগানিয়া বলা চলে। সেজন্যই আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গৌরববোধ করি। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, আপামর জনগণের কাছের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদ পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছেন। তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষ দর্শনে সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন।

সত্যের ন্যায় অটল ছিলেন বলেই তাঁকে কখনো রক্তচক্ষু কাবু করতে পারেনি। নিষ্পেষিত জীবনের পথ রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে বীর বসুধা পুরুষ তিনি হলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার মাঝে কখনো 'জাতিবিদ্বেষ' কিংবা 'আত্মশ্লাঘা' শব্দটি দেখতে পাওয়া যায়নি। সেজন্যই রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও নিজ বাসভবনে অবস্থান করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের শুধু একটি দেশের মানচিত্র দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি সব সময় আপামর জন সাধারণের চিন্তা চেতনা নিয়ে কাজ করতেন। সদা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থেকে সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছেন।

মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন হয় ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যাকে বাঙালীর ইতিহাসে মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলে অভিহিত করা হয়। ছয় দফা দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তাঁকে কারা বরণ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু  গ্রেপ্তারের পর আন্দোলন আরো বেগবান হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা  ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে আবারও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারী ১১ দফার ভিত্তিতে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এরপর গণ অভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্থান সরকার ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। স্বায়ত্তশাসণ আন্দোলন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্থানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর আক্রমণ শুরু করে। সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয়। তার আগেই ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

প্রিয় বাঙালীর প্রিয় জন্মভূমিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আমরা তখন থেকে নবজন্ম লাভ করেছিলাম। পেয়েছিলাম আমাদের দেশ মাতৃকার অধিকার। যার রক্তে আজও দেশ জেগে উঠে, স্বপ্ন দেখি দেশপ্রেমের বাহুডোরে। যার বজ্রকন্ঠে শুনতে পেয়েছি ৭ ই মার্চের সাড়া জাগানো ভাষণ। শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হিসেবে বিবিসি জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর অভিধা স্বরূপ পরিচিত হন এই মহান পুরুষ। নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করতে পেরেছিলেন ওনার যোগ্য নেতৃত্বের সুসঙ্গত গুণাবলীর জন্য

তাই; আমি আমার একটি কবিতায় লিখেছিলাম-

আমি বলি বাঙালী কেন ভাই,
এমন কয়জন নেতা দেখিতে পাই শ্রেষ্ঠত্বের দুনিয়ায়?

সত্যিই, তিনি ছিলেন বাঙালী জাতির পথ প্রদর্শক; সমগ্র জাতির পুরোধা স্বরূপ। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধের দামামা থামিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার পাওয়া অসম্ভবের নামান্তর বটে। অথচ ধূসর এ পৃথিবীতে এক সময় যাদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন এঁকেছিলেন, দেশকে ভাল বেসেছিলেন তার প্রতিদানে সপরিবারকে বলিদান দিতে হয়েছিল কতিপয় মানুষের নির্মম হত্যা কান্ডের মধ্য দিয়ে।

দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যা কান্ড ঘটলে বাঙালী জাতি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আরেক কঠিন সময়ের আবর্তনে ঢাকা পড়েছিল! দেশ ও জাতিকে সংশয়াবর্তে রেখে কিংবা দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য যেসব লোক এ নির্মম হত্যা কান্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তারা হয়তো দেশপ্রেমের আবহে দেশের স্বাধীন স্বত্ত্বাকে মেনে নিতে পারেনি। হয়তো ধারণ করতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি।

দিল্লিতে ইনস্টিটিউট অব পিস এ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের কর্ণধার ও স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, Research and Analysis Wing(RAW)-এর প্রধান আর এন কাও ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় গিয়ে খোদ মুজিবকে বলেছিলেন যে তাঁর জীবনে হামলা হতে পারে। কিন্তু মুজিব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন, "ওসব হতেই পারে না, গোটা বাংলাদেশ আমাকে ভালবাসে, ওরা সবাই আমার ছেলেমেয়ের মতো। কে আমাকে মারতে যাবে?" (তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা, ১৫ আগস্ট, ২০১৮)।

এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি দেশের মানুষকে কতটুকু বিশ্বাসের মাঝে আগলে রাখতেন। বুকে বিশ্বাস ধারণ করেছিলেন, সাধারণ জনগণ তাঁকে কখনো মারতে উদ্যত হবে না। ভালবাসার মিশেলে নিজেকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই হয়তো সবার মনের মণিকোঠায় ঠাঁই নিয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি বলেছিলেন, ” আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে দুর্বলতা আমি তাদের খুব বেশি ভালবাসি।” অথচ, বিশ্বাসের উপর আঘাত এনে হত্যা করতে পিছপা হয়নি নর পশুর হায়েনারা।

হত্যা করেই বসে থাকেনি। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক Indemnity (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটি দূুটি ভাগে বিভক্ত ছিল।

 প্রথমত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ভোরে বলবৎ আইনে পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টসহ কোন আদালত মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় অংশে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না!

বঙ্গবন্ধু এম আর আখতার মুকুলকে বলেছিলেন, "আমি ঠিকই বুঝতে পারতাছি, চিলির পর বাংলাদেশ, আলেন্দের পর এবার আমার পালা। আমিও শ্যাষ দেইখ্যা ছাড়ম। পারুম কিনা জানি না।"

সত্যিই; তিনি কি আঁচ করতে পেরেছিলেন ঘাতকদের নির্মম চাহনি নাকি প্রাণের মাঝে বেজে উঠেছিল রুদ্ধশ্বাসের কন্ঠ স্বর। হয়তো; করুণ সুর বেজে উঠেছিল চারপাশ ঘিরে। ঘোর অমানিশার মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন আঁততায়ীর নির্মম আঘাতে!

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সকলের প্রিয় নেতাকে নিস্তব্ধতার আঁধারে মোড়িয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল নিষ্ঠুর হত্যা কান্ডের মধ্য দিয়ে। সকলকে শোকে ভাসিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে হত্যা করে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছিল।

সর্বোপরি যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ একটি শোষণ বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেছিলেন, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঘাতকদের নির্মম হত্যা কান্ডে জাতির বিবেককে আজও দংশিত করে।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top