সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

গঙ্গার সৃষ্টিকাহিনি : সম্বুদ্ধ সান্যাল


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৫

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:২৫

ছবি: সংগৃহীত

 

রাজা হরিশ্চন্দ্র ও শৈব্যার নাম সবার জানা আছে নিশ্চয়। সারা দুনিয়ায় অমন ধার্মিক রাজা মেলা বড় দুষ্কর। এই হরিশ্চন্দ্র রাজারই উত্তরপুরুষ ছিলেন আমাদের রামচন্দ্র। হরিশ্চন্দ্রের পূর্বপুরুষ সেই মান্ধাতার আমল থেকেই রামচন্দ্রের বংশকে আমরা সূর্যবংশ বলেই জানি। তবে হরিশ্চন্দ্র বা রামচন্দ্রের মতো ধার্মিক এই বংশের সব পুরুষ ছিলেন না। এদের মাঝের কিছু পুরুষের উচ্চ বংশীয় দাপটের ফলে খানিক মতিভ্রমই হয়েছিল বলা চলে। ফলে অমন উচ্চ বংশ প্রায় যায় যায় অবস্থায় পড়েছিল মাঝে। শেষে মা গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্তে অর্থাৎ পৃথিবীতে এনে ভগীরথ নামের এক রাজা কোনোমতে বংশ রক্ষা করেন। আমাদের প্রিয় গঙ্গা নদীর মর্তে আনার গল্পই শোনাবো আজ।

রাতের বেলায় খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তারাগুলোকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের ঠিক মাথার উপর বেশ কয়েক লক্ষ তারা একসাথে জটলা করে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই তারার সারিকে আমরা চিনি ছায়াপথ নামে। এই পৃথিবীও কিন্তু এমনি মস্ত এক ছায়াপথের মধ্যে সামান্য একটা গ্রহ। আমাদের এই ছায়াপথের নাম হলো আকাশগঙ্গা। পুরাণে বলা হয় এক সময় আমাদের এই গঙ্গা নদী আকাশগঙ্গার পথে স্বর্গ অর্থাৎ আকাশপথে প্রবাহিত হতো। সূর্যবংশেরই এক বিখ্যাত রাজা ভগীরথ অনেক তপস্যা করে সেই স্বর্গের নদীকে আমাদের ভারতের বুকে এনে ফেলেছিলেন। তার জন্যেই গঙ্গা নদীকে এই ভারতের সবচেয়ে পবিত্র নদী হিসেবে মানি আমরা। রাজা হরিশ্চন্দ্রের পুত্র ছিলেন রুহিদাস। তিনি অযোধ্যার রাজাও হন এক সময়। রুহিদাসের পুত্র ছিলেন ভীষণ ক্ষমতাশালী সগর রাজা। তার ক্ষমতার জন্য এক সময় স্বর্গের দেবতারাও বেশ ভয়ে ভয়েই থাকতেন। সগর রাজার কিন্তু কোনো সন্তান ছিল না। এত ক্ষমতা থাকা সত্বেও এই জন্য রাজার মনে বেশ দুঃখ ছিল। তখনকার দিনে কারোর কোনো দুঃখ থাকলে তারা দেবতাদের তপস্যা করত। কঠোর তপস্যায় যদি কোনো দেবতাকে খুশি করা যেত, তবে সেই দেবতা তাকে তার মন মতো কোনো বর দিয়ে দিত। এমনি করে কত রাক্ষসও তপস্যায় দেবতাদের খুশি করে কোনো বর নিয়ে সেই ক্ষমতায় দেবতাদেরই আক্রমণ করে বসত, আর শেষে ঠ্যাঙানি খেয়ে আবার রাক্ষসরাজ্যে ফেরৎ যেত নয় মরত দেবতাদের হাতে। সুতরাং বর সবসময় বুঝেসুঝে নেওয়াই ভালো। তেমনি এই সগর রাজার কোনো ছেলেপুলে না হওয়ায় রাজা এক বনে গিয়ে শিবের তপস্যা শুরু করলেন। বেশ কয়েক বছর তপস্যা করায় এক সময় শিবঠাকুর তার উপর ভীষণ খুশি হলো ও বর চাইতে বললো। সগর রাজা তার দুঃখের কথা জানাতে শিবঠাকুরও খুশি খুশি তাকে বললেন যে রাজার ষাট হাজার এক খান ছেলে জন্মাবে। সগর রাজার ছিল দুই রাণী, কেশিনী ও সুমতি। কয়েকদিন বাদে রাণী কেশিনী এক সুন্দর পুত্রের জন্ম দিলো। রাজা তার নাম রাখলো অসমঞ্জ। ওদিকে রাণী সুমতি জন্ম দিলো একখানি প্রকান্ড লাউয়ের। রাজা তো ষাট হাজার পুত্রের বদলে অমন লাউ দেখে রেগেই গেল আর তা দিল ভেঙে। সুমতি রাণী মনের দুঃখে সেই লাউয়ের বীজগুলিকে একপাত্র ঘিয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে দিলো। এর বেশ কয়েকদিন পর সেই ঘিয়ের পাত্রে রাখা লাউয়ের ষাট হাজার বীজের থেকে সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে জন্মালো শিবের বরে। তারা যেমনি একরোখা তেমনি দুর্দান্ত। অন্যদিকে অসমঞ্জ ছিল নরম স্বভাবের, ধর্মকর্মেই তার মতি।

ষাট হাজার অমন দুর্দান্ত ছেলে পেয়ে রাজার মনে আনন্দ আর ধরে না। একেই সগর রাজার প্রচুর নামডাক, তার উপর এত ছেলে দেখে রাজা ভাবল যে সে ত্রিভুবন জয় করবে। এদিকে সেই ষাট হাজার ছেলেও ত্রিভুবনে তাদের দৌরাত্ম দেখাতে ওস্তাদ। তাদের অত্যাচারে প্রত্যেকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ত্রিভুবনবাসীরা একদিন এর বিচার চাইতে গেল ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মাও তাদের বোঝালো এই ষাট হাজার ছেলে তাদের কর্মফলেই একদিন সব একসাথে মরবে। ওদিকে সগর রাজার রোখ চেপেছে যে সে ত্রিভুবনের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হবে। তখনকার যুগে যজ্ঞের সেরা যজ্ঞ ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞ। এ যজ্ঞে এক ঘোড়াকে ছেড়ে দেওয়া হতো তার মতো। সে যেদিকে যাবে, রাজার বাহিনীও সেই সেই জায়গাগুলো যুদ্ধ করে দখল করে নেবে। চারদিক ঘুরে ঘোড়া আবার ফেরৎ আসলে সেই ঘোড়ার মাংস বা মেধ দিয়ে এই যজ্ঞ হতো বলে তার নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ।

ইতিমধ্যে সগর রাজা তার ষাট হাজার এক ছেলের বিয়েও দিয়ে দিয়েছে। পুত্র পুত্রবধুদের নিয়ে তার অযোধ্যা রাজ্যে এক জমজমাট পরিবার। কিন্তু তার নাতি বলতে মাত্র একখান, অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান। অসমঞ্জ শুধু ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন, তাই সগর রাজার তেমন ভরসা নেই তার উপরে। এ ছেলের দ্বারা কিছু হবে না ভেবে রাজা তাকে স্ত্রী-পুত্র সমেত দিল বনবাসে পাঠিয়ে। বনে অসমঞ্জ তার নরনারায়ণ সেবা নিয়ে আপন খুশিতেই থাকে। অপরদিকে ষাট হাজার পুত্রের কান্ডকারখানায় রাজা তাদের শাসনও করে না। তারা একে মারে, ওকে ধরে, মেয়েরা জল আনতে গেলে তাদের কলসী ভেঙে দেয়, প্রজাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয় ইত্যাদি অনিষ্ট করে বেড়ায়। এই সময় রাজা স্থির করল এবার তার ছেলেরা যুদ্ধের উপযুক্ত হয়েছে, তাই অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য তৈরী হতে শুরু করল।

প্রথমেই রাজা তার ষাট হাজার পুত্রদের ভাগ করে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে পাঠিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু পুত্রেরা বললো যে ঘোড়ার সাথে তারা সমস্ত ভাই একসাথেই যাবে। প্রথমে যজ্ঞের ঘোড়াকে স্বর্গে পাঠাতে চাইল রাজা। ঘোড়া ছুটলোও সেদিকে, তার পিছনে রাজার সমস্ত সন্তানও ছুটলো। ওদিকে দেবরাজ ইন্দ্র এই খবর পেয়ে বড় শঙ্কায় পড়ল। রাজ্যপাট তার এই যায় অবস্থা। তিনি অমনি ছুটলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। সব শুনে ব্রহ্মাও মহা ফ্যাসাদে পড়ে অন্য কোনো উপায় না দেখে ইন্দ্রকে বুদ্ধি দিল যে ঘোড়া চুরী ছাড়া এই সমস্যার অন্য কোনো উপায় নেই আর। ঘোড়া না পেলেই আর যজ্ঞ হবে না, তিন লোক বাঁচবে এতে। এই উপায় শুনে এক রাতে ইন্দ্র তার ছল খাটিয়ে সগরপুত্রদের ঘুমের সুযোগ নিয়ে রাতের বেলায় সেই ঘোড়া চুরী করে পাতালে পালালো। তখন কপিল মুনি পাতালে এক আশ্রমে তপস্যা করছিলেন। তপস্যা করার সময় মুনির তেজ থাকে অতি সাঙ্ঘাতিক। ইন্দ্র তা জানত। তিনিও তপস্যারত মুনিকে দেখে তাঁর আশ্রমের পেছনে যজ্ঞের ঘোড়াটিকে বেঁধে আবার ফিরে আসলো স্বর্গে। সকাল হলে রাজার পুত্ররা দেখে তাদের ঘোড়া নেই। ষাট হাজার পুত্র অমনি তখন সেই ঘোড়া খুঁজতে লাগল। সারা স্বর্গ-মর্ত্য খুঁজে তারা যখন সেই ঘোড়া পেল না, তখন সব ভাই মিলে পাতাল খুঁড়তে চলল। ষাট হাজার ভাইয়ের শক্তিতে কোদাল দিয়ে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলল তারা। পাতালের ভিতরে প্রবেশ করতেই তাদের চোখে সবার আগে পড়ল কপিলমুনির আশ্রম। এদিক ওদিক খুঁজতেই দেখল আশ্রমের পেছনে তাদের ঘোড়া বাঁধা আছে। অমনি তাদের সব রাগ গিয়ে পড়ল মুনির উপর। ব্যাটা ঢোঙ্গী বাবা ঘোড়া চুরী করে নিয়ে এসে তপস্যা করতে বসেছেন ভেবে সব ভাইয়েরা মিলে মুনিকে আচ্ছা করে গাল দিতে লাগলো। তাঁর গোঁফ-দাড়ি টেনে, চোর বলে নানা প্রকার উৎপাত শুরু করলো মুনির প্রতি। তাতেও মুনির ধ্যান ভাঙে না দেখে কোদালের ডান্ডা দিয়েও প্রহার করতে লাগল মুনিকে। সঙ্গে চোর অপবাদও দিয়ে চলল ক্রমাগত। এই হেন অত্যাচারে মুনির ধ্যান কতক্ষণই বা থাকে, এমন সময় তা গেল ভেঙে। চোখ খুলেই মুনি দেখতে পেলেন সেই ষাট হাজার ভাইকে। আরো দেখলেন তারা কিভাবে অত্যাচার করে চলেছে তাঁর উপরে। এতে মুনি গেল ভয়ানক রেগে। একে তাঁর ধ্যান ভেঙেছে বলে কথা, তার উপরে ক্রমাগত চলছে চোর অপবাদ। অমনি মুনি তার সমস্ত তেজে যেই না ষাট হাজার ভাইয়ের দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়েছেন, সেই তেজে অমনি সব ভাই একেবারে পুড়ে ছাড়খার। সবাই মারা পড়ল কপিল মুনির রোষে পড়ে আর তিন ভুবনের প্রতি ব্রহ্মার সেই ভবিষ্যতবাণীও ফলে গেল। তিনলোকের বাসিন্দারাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এই ঘটনায়। সগর রাজার ষাট হাজার দুর্দান্ত পুত্রের ভস্ম শুধু পড়ে রইল কপিল মুনির আশ্রমে।

এই ঘটনার এক বছর পর সগর রাজা দেখল তার ষাট হাজার পুত্র যে আর ফেরৎ আসে না। কোনো খবর না পেয়ে রাজামশাই পড়ল মহা চিন্তায়। অগত্যা বনের থেকে সে ডেকে পাঠালো অসমঞ্জের পুত্র অংশুমানকে। তাকেই শেষমেশ আজ্ঞা দিলো তার ষাট হাজার কাকাকে খুঁজে আনতে। ঠাকুর্দার আজ্ঞা শুনে অংশুমান তার রথে চড়ে বেড়োলো তিন ভুবনের উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে কত কি দেখল সে। যাকেই দেখে, তাকেই শুধায় তার কাকাদের আর যজ্ঞের ঘোড়ার কথা। কেউ বলতে পারে খানিক, কেউ পারে না। পৃথিবীর পূর্বদিকের সাগরে সে দেখল এক নীলবর্ণ হাতি তার দাঁতের উপরে পৃথিবীকে ধারণ করে আছে। অংশুমান তাকে প্রশ্ন করলো তাদের কথা। হাতি বলল উত্তরদিকের সাগরের দিকে যেতে। সেখানে দেখল এক সাদা রঙের হাতি দাঁড়িয়ে আছে। তাকেও প্রশ্ন করায় সেই হাতি পশ্চিমের দিকে পথ দেখিয়ে দিলো। পশ্চিম সাগরের কাছে এসে সে দেখল এক লাল রঙের হাতি দাঁড়িয়ে। সেই হাতি তার দাঁতের উপর পৃথিবীর মাটি ধরে আছে। যখন সে মাথা নাড়ায়, তখনই নাকি ভূমিকম্প হয়। সগর রাজার ছেলেদের কথা তাকেও জিজ্ঞাসা করল অংশুমান। এরপর তার কথায় অংশুমান দক্ষিণ দিকে এসে দেখতে পেল কপিল মুনির আশ্রম ও সেখানেই অশ্বমেধের ঘোড়া বাঁধা আছে তখনও। আশ্রমে কপিল মুনিকে তার ষাট হাজার কাকার কথা জিজ্ঞাসা করাতেই মুনি জানালো তাদের কীর্তি ও তার জন্য মুনির কোপে পড়ে কীভাবে তারা পুড়ে ছাই হয়ে আছে। এই শুনে অংশুমান অনেক দুঃখ করল কপিল মুনির সামনে। সে সগর রাজার নাতি ও এই ষাট হাজার ভাই রাজার সন্তান তাও জানালো। শেষে কপিল মুনিকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, তার নানা গুণগান করে জানতে চাইল এই ষাট হাজার ভাইয়ের মুক্তির উপায়। কপিল মুনি তখন অংশুমানের উপর খুব খুশি। তিনি জানালেন এই ভাইয়েরা সবাই আপাতত প্রেত হয়ে আছে। তাই শুনে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল এতে তাদের বংশের বদনাম। কীভাবে তারা এই প্রেতযোনীর থেকে মুক্তি পাবেন? কীভাবেই বা সূর্যবংশের সদগতি হবে? কীভাবে তার বংশ ব্রাহ্মণের রোষানল থেকে মুক্তি পাবে? কপিল মুনি তখন অংশুমানের উপর যথেষ্টই তুষ্ট। তিনি উপায় দিলেন ওই উপরের আকাশগঙ্গাকে যদি কোনোভাবে মর্তে এনে ফেলা যায় ও তার প্রবাহকে এই স্থানে এনে এই ভস্মরাশির উপর দিয়ে বইয়ে দেওয়া যায়, তবেই এদের মুক্তি আর সূর্যবংশের সদগতি। অংশুমান আরো জানতে চাইল গঙ্গাকে কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবেই তা মর্তের উপর দিয়ে বইয়ে দেওয়া যাবে? কপিল মুনি তার সমস্ত প্রশ্নের এক এক করে উত্তর দিতে লাগলেন ও গঙ্গার জন্মবৃত্তান্তও ব্যাখ্যা করতে লাগলেন।

পুরাকালে গোলোকধাম, অর্থাৎ কিনা বিষ্ণুর বাসস্থানে বিষ্ণু, তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী, নানা দেবদেবী ও মুনিঋষিসমেত বেশ একটা গানের আসরে বসেছিলেন। সবাই নানাভাবে যোগদানের পর পালা এলো শিবের। ভোলাভালা শিব এমনিতেই নৃত্যগীতে বেশ পারদর্শী ছিলেন। এমনি সময় তিনি এমন এক গান ধরলেন যে স্বয়ং বিষ্ণু সেই গান শুনে মনের দিক থেকে বড় দুর্বল হয়ে পড়লেন। সেই সঙ্গীত তার চিত্তকে এমন বিগলিত করে তুলল যে তাঁর একাংশ গানের সুরের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে পড়ল। বিষ্ণুর দেহের থেকে বেড়িয়ে আসা সেই গলে যাওয়া অংশ যাতে নষ্ট না হয়, তাই ব্রহ্মা দেবতা তা তুলে রাখলেন তার কমন্ডলুতে। ব্রহ্মার সেই কমন্ডলুর জল আকাশপথে বয়ে চলল স্বর্গের ধারা হয়ে যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামেই চিনি। কপিলমুনি অংশুমানকে জানালেন যে সেই জল যদি কোনো রকমে পৃথিবীতে এনে ফেলা যায়, তবেই তার সেই ষাট হাজার খুড়োর মুক্তি সম্ভব। কিন্তু সে এক অসম্ভব চেষ্টা। কিন্তু তিনি এই বরও দিলেন যে একদিন এই বংশেরই কেউ একজন সেই গঙ্গাকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনবে আর তাতেই সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রের প্রেত অবস্থার থেকে মুক্তি হবে।

এমন বর পেয়ে অংশুমান ঘোড়া নিয়ে তার রাজ্য অযোধ্যায় ফিরে আসলো। সব শুনে রাজপুরোহিতরা মাথা নেড়ে সগর রাজাকে নিদান দিলো যে তার অশ্বমেধ যজ্ঞ করা আর সম্ভব নয় কারণ এই ঘোড়ার জন্য বংশের মানুষেরা মুনির অভিশাপে প্রেত হয়ে গেছে যেহেতু। সুতরাং এই যজ্ঞ করলে তা কোনো ফল দেবে না। আগে এই প্রেতেদের মুক্তির ব্যাবস্থা করা হোক, তারপর না হয় যজ্ঞের কথা ভাবা যাবে। সব শুনে সগর রাজা মনের দুঃখে ভেঙে পড়ল। ষাট হাজার ছেলে মরে যাওয়ার দুঃখ কি আর কম! যে ছেলেদের নিয়ে তিনি তিন ভুবন জয় করার স্বপ্ন দেখতেন, তারাই যে আর নেই। সঙ্গে এসে জুটেছে বংশের অভিশাপ। সগর রাজা অনেক চিন্তা করে দেখলেন আগে বংশের শাপ মুক্তি ঘটাতে হবে। অনেক চিন্তা করে রাজা তার নাতি অংশুমানের হাতে রাজ্যপাট দিয়ে চললেন স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনতে। বুড়ো রাজা গঙ্গার তপস্যা করতে করতে মরেই গেল। সব শুনে অংশুমান রাজাও আরো কিছুদিন তার রাজত্ব করে শেষে তার ছেলে দিলীপকে রাজত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সেও চলল গঙ্গার তপস্যা করতে। অনেকদিন তপস্যা করে একদিন সেও দেহ ছেড়ে চলল স্বর্গলোকে। দিলীপ সব শুনে ভাবল সেই পারবে গঙ্গাকে ফিরিয়ে আনতে। এদিকে তার রাণীরও সন্তান হবে। দিলীপ বংশ রক্ষার জন্য ছেলের মুখ না দেখে সেও চলল গঙ্গার তপস্যা করতে। অনেক কাঁদতে কাঁদতে একদিন রাণী এক ছেলের জন্ম দিলো। কিন্তু মুশকিল হলো এই ছেলে ঠিক মানুষের মতো দেখতে নয়, মাত্র এক তাল মাংসপিণ্ড। ওদিকে ততদিনে দিলীপও ব্রহ্মার তপস্যা করতে করতে আর সংসারের শোকে এক সময় পরলোকের দিকে যাত্রা করলো। ওদিকে দুই রাণী সেই একতাল মাংসপিণ্ডকে নিয়ে বসে থাকে রাজ্যে আর বংশ রক্ষা না হওয়ার বিলাপ করে চলে। অযোধ্যার অমন সূর্যবংশ তখন ধ্বংসের মুখে।

একদিন মহাঋষি বশিষ্ঠ জানতে পারলো এই কথা। রাজপ্রাসাদে এসে তিনি দুই রাণীকে বললেন যে ঋষি অষ্টাবক্র যে পথে স্নানে যায়, সেই পথে এই ছেলেকে রেখে আসুক তারা। ঋষি অষ্টাবক্র কিন্তু যে সে ঋষি নন, সাক্ষাৎ বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ আছে। তিনিই একমাত্র পারেন এই শিশুকে মানুষের রূপ দিতে। বশিষ্ঠের কথা মতো দুই রাণী একদিন ঋষি অষ্টাবক্রের স্নানযাত্রার পথে সেই শিশুকে ফেলে রেখে আসলো। অষ্টাবক্র মুনির স্নানের পথে সেই ছেলেকে দেখে বড়ই মায়া হলো। তিনি সেই ছেলেকে বর দিয়ে একদম এক সুন্দর মানুষ গড়ে তুললেন আর রাণীদের বললেন যে তাদের এই ছেলে একদিন এক মহাপুরুষ হবে। দুই রাণীও খুশি হয়ে সেই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসলো অযোধ্যা রাজ্যে। পুরো মানুষ রূপে রাজপুত্রের নানা ভাগে জন্ম হওয়ায় রাণীরা তার নাম রাখল ভগীরথ।

ঋষি বশিষ্ঠ রাজপুত্র ভগীরথের যাবতীয় পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন ছোটবেলার থেকে। শিক্ষা দিতে দিতে তিনি তাকে তার বংশের ইতিহাসও সমস্ত জানালেন। কীভাবে তার পূর্বপুরুষেরা গঙ্গা নদীকে মর্ত্যে আনতে গিয়ে মারা গেছেন, সে সব কথা জানালেন তাকে। আর এও বললেন যে তার পূর্বপুরুষেরা গঙ্গাকে মর্ত্যে আনতে যে কঠোর পরিশ্রমের দরকার তা না করে কেবলই অল্পশ্রমে তপস্যাই করে গেছেন। কাজের কাজ কেউই করেনি। যদি কেউ পারে তবে গঙ্গা নদীকে ভগীরথই পারবে মর্ত্যে আনতে। তার জন্য যা যা শিক্ষার দরকার বশিষ্ঠ তার সমস্ত দিতে লাগলেন ভগীরথকে। একদিন ভগীরথ তার দুই মা’কে বলল যে তার শিক্ষা এবার সম্পূর্ণ হয়েছে। সে এখন গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে আনতে যেতে চায়। দুই মা তার অনেক দুঃখে তাকে বিদায় দিলো কাঁদতে কাঁদতে। ভগীরথ বশিষ্ঠ মুনিকে প্রণাম করে অযোধ্যা থেকে চলল স্বর্গের দিকে গঙ্গা নদীকে আনতে।

ভগীরথ সবার প্রথমেই দেবরাজ ইন্দ্রের ভীষণ তপস্যা শুরু করলো সাত বছর ধরে। শেষে ইন্দ্র আর থাকতে না পেরে তার কাছে এসে তার নাম, ধাম ইত্যাদি জানতে চাইলো। ভগীরথও তার পরিচয় দিয়ে আর তার তপস্যার কারণ জানিয়ে দেবরাজের থেকে উপায় জানতে চাইলো। দেবরাজ তাকে জানালো যে স্বর্গের গঙ্গাকে মর্ত্যে আনা মুখের কথা নয়। এর উপায় তার জানা নেই। তবে যদি কেউ জানাতে পারেন তিনি হলেন মহেশ্বর শিব। ভগীরথ যেন তার স্তব করে। যদি শিবঠাকুর তার স্তবে খুশি হন, তবেই গঙ্গা নদী মর্ত্যে আসতে পারে। এই শুনে ভগীরথ আবার শিবের তপস্যা শুরু করলো দশ বছর ধরে শুধু জল বাদে কিচ্ছুটি না খেয়ে।

এমন তপস্যা দেখে শিবঠাকুর ভগীরথের উপর ভীষণ খুশি হলেন এক সময়। তিনি ভগীরথের কাছে এসে বর দিলেন যে সেই পারবে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনতে। তবে তার আগে গোলোকধামে গিয়ে বিষ্ণুর সেবা করতে হবে অনেক। বিষ্ণু যদি খুশি হয়ে অনুমতি দেন, তবেই গঙ্গা মর্ত্যে আসতে পারে। সঙ্গে সারা স্বর্গ রাজ্য ঘুরে বেড়ানোর অনুমতিও দিয়ে দিলেন তাকে। শিবের থেকে অনুমতি নিয়ে ভগীরথ চলল গোলোকধামে বিষ্ণুর সেবা করতে। দিনরাত, শীতগ্রীষ্ম কিচ্ছুটি না মেনে অনেকদিন ধরে সে বিষ্ণুর সেবা করায় একদিন বিষ্ণু তাকে দেখা দিয়ে তার সেবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ভগীরথ তাঁর দেখা পেয়ে সমস্ত খুলে বললেন যে পুর্বপুরুষদের বুদ্ধিনাশে তার বংশ আজ বিলোপ হওয়ার মুখে। সব শুনে বিষ্ণু তাকে উপায় দিলেন যে গঙ্গা তো আছে ব্রহ্মার কাছে। এই বলে তিনি ভগীরথকে নিয়ে চললেন ব্রহ্মলোকে। কিন্তু ব্রহ্মা অতি ধুরন্ধর দেবতা। তার প্রতি ছল না করলে গঙ্গাকে তার কমন্ডলু থেকে বের করা যাবে না। এই বলে বিষ্ণুদেব ব্রহ্মলোকের সমস্ত জল শুষে নিলেন। শুধু বাকি থাকলো কমন্ডলুর মধ্যেকার গঙ্গা।

ব্রহ্মার দরজার কড়া নাড়তেই তিনি তড়িঘড়ি বেড়িয়ে আসলেন ঘরের থেকে। বিষ্ণুকে দেখেই তিনি বসতে বললেন। তাঁর পা ধুইয়ে দিতে তিনি জলের খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু জল পান কোথায়। বিষ্ণু তো আগেই সব জল শুষে নিয়েছেন সেখানকার। শেষে ব্রহ্মার মনে পড়ল কমন্ডলুর মধ্যেকার গঙ্গার কথা। তিনি কমন্ডলু থেকে গঙ্গার সেই জল দিয়ে বিষ্ণুর পা ধুইয়ে দিলেন। বিষ্ণুর পা ধোওয়া সেই জল বয়ে চললো ব্রহ্মলোকের উপর দিয়ে। ভগীরথ তো এই ঘটনা দেখে হেসেই বাঁচে না। সব শেষে বিষ্ণু ভগীরথকে বললেন যে এই জল তুমি নিয়ে যাও মর্ত্যে আর তোমার বংশরক্ষা কর তা দিয়ে। বিষ্ণুর পা ধোওয়া জলের থেকে গঙ্গার উৎপত্তি বলে গঙ্গার আরেক নাম হলো ‘অঘ্রিংজা’। এই বলে তিনি ভগীরথকে এক শঙ্খ হাতে দিয়ে বললেন যে তা বাজাতে বাজাতে তুমি যাও, আর গঙ্গাকে বলে দিলেন শঙ্খের আওয়াজ শুনতে শুনতে তুমি ভগীরথের সঙ্গে গিয়ে সূর্যবংশ রক্ষা কর। এখন থেকে তুমি মর্ত্যেও নদী হয়ে বইবে আর মর্ত্যের যত পাপী আছে, সবাই তোমার জলে স্নান করে তাদের পাপ ধুয়ে ফেলবে কারণ তুমি সরাসরি স্বর্গের থেকে নেমে এসেছো।

বিষ্ণুর শরীর থেকে জন্ম বলে গঙ্গা তাঁকে পিতা বলে মানত। পিতার আদেশ মেনে সে চলল ভগীরথের সঙ্গে মর্ত্যের দিকে। সব দেখে ব্রহ্মা ভাবলেন যে কি বোকাটাই না তিনি বনেছেন বিষ্ণু আর ভগীরথের পাল্লায় পড়ে। শেষে তিনি ভগীরথের সমস্ত কাহিনি শুনে তাকে একখানি রথ দিয়ে দিলেন পথের কষ্ট কম হওয়ার জন্য। রথে চেপে ভগীরথ চলল মর্ত্যের উদ্দেশ্যে, পেছনে গঙ্গা তার প্রচন্ড জলরাশি নিয়ে শঙ্খের ধ্বনি শুনতে শুনতে চলল তার সাথে।

ব্রহ্মলোক থেকে মর্ত্যে নামার পথে পড়ে সুমেরু পাহাড়। ভগীরথ আর গঙ্গা সেখানেই প্রথম নামল স্বর্গ থেকে। ভীষণ প্রকাণ্ড সে পাহাড়, আর তার মধ্যে আছে প্রকাণ্ড আরো এক সুড়ঙ্গ। ভগীরথ সামনে থাকার জন্য পেছনের গঙ্গাকে দেখতে পায়নি সেখানে আর অমনি গঙ্গা ভুল করে ঢুকে গেছে সেই সুড়ঙ্গে। সেখানে ঢুকে আর বেড়োনোর পথ পায় না সে। খানিক দূর যাওয়ার পর ভগীরথ দেখল পেছনে গঙ্গা নেই, সে সেই সুড়ঙ্গে আটকা পড়ে গেছে। অমন প্রকাণ্ড সেই পাহাড়, তা ভেদ করে গঙ্গাকে সেই সুড়ঙ্গ থেকে বের করা ভগীরথের মতন এক মানুষের পক্ষে অসম্ভব। অনেক চেষ্টাতেও গঙ্গাকে ফেরাতে না পেরে সে ভেবে দেখল এই পর্বত ফাটিয়ে বের না করতে পারলে তার বংশরক্ষা বোধ হয় আর হলো না। গঙ্গার সাথে শেষমেশ আলোচনা করে সে জানতে পারল এমন বিশাল পর্বত ফাটানোর ক্ষমতা একমাত্র আছে স্বর্গের ঐরাবত হাতির। তাকে যেভাবেই হোক আনার ব্যাবস্থা করতে বলল গঙ্গানদী। সব শুনে ভগীরথ আবার স্তব শুরু করলো ইন্দ্রের। প্রচণ্ড সেই স্তবে এক সময় খুশি হয়ে ঐরাবত নিয়ে ইন্দ্রদেব সেখানে এসে পৌঁছাল আর ঐরাবত তার দাঁত দিয়ে সুমেরু পর্বতকে চার ভাগে চিরে দিলো। সেই চার ভাগ দিয়ে গঙ্গা বসু, ভদ্রা, শ্বেতা আর অলকানন্দা ধারায় বেড়িয়ে আসলো সুমেরুর মধ্যে থেকে। এরমধ্যে তিন নদী তিন দিকে বয়ে গেল আর অলকানন্দা নদী মর্ত্যের উপর দিয়ে চলল ভগীরথের সঙ্গে সঙ্গে।

আদি কৈলাশ পর্বতের কাছে এসে গঙ্গা এবার পড়ল মর্ত্যের মাটির উপর। তখন তার বেগ প্রবল। মহা বেগে সে ছুটে চলল পৃথিবীর উপর দিয়ে। সেই স্রোতে মর্ত্যের যায় যায় অবস্থা। ভগীরথ দেখল এ তো মহা বিপদ। মর্তই ধ্বংস হয়ে যাবে গঙ্গার প্রবল স্রোতে। ততক্ষণে পৃথিবী কাঁপতে শুরু করেছে। উপায় না দেখে ভগীরথ গঙ্গার সামনে জোর হাতে মর্ত্যকে বাঁচানোর উপায় জানতে চাইল। মর্ত্যই যদি না থাকে তবে গঙ্গা পাতালে পৌঁছাবে কি করে। সব শুনে গঙ্গা বলল তাকে যে একমাত্র শিবই যদি তাঁর মাথার গঙ্গাকে ধারণ করতে পারে, তবেই মর্ত্য একমাত্র বাঁচবে। এই শুনে ভগীরথ আবার শিবের স্তব শুরু করল। এক বছর স্তব করার পর শিব এসে জিজ্ঞাসা করলেন প্রার্থনার কারণ কি। ভগীরথ তাঁকে জানালেন সব কথা। মর্ত্যকে বাঁচাতে তখন পার্বতী শিবকে বললেন তাঁর জটায় গঙ্গাকে ধারণ করতে যাতে তার গতি কমে যায়। পার্বতীর কথা মহেশ্বর ফেলতে কি পারেন, তিনি তাঁর জটায় গঙ্গাকে ধারণ করলেন। জটার পাকে পড়ে গঙ্গার গতি মন্থর হয়ে গেল আর পৃথিবীর উপর দিয়ে শান্তভাবে গঙ্গা বয়ে চলল। এই ঘটনায় ভগীরথও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল খানিক। শিব যে স্থানে গঙ্গাকে তাঁর জটায় ধারণ করেছিলেন আমরা তাকে চিনি হরিদ্বার নামে। এখানেই গঙ্গা পার্বত্য এলাকা থেকে সমভূমিতে এসে পড়েছে আর তার গতিও আগের থেকে অনেক মন্থর হয়েছে।

এরপর গঙ্গা নিশ্চিন্তে চলতে থাকে ভগীরথের সাথে। ত্রিবেণীর কাছে প্রয়াগে এসে গঙ্গার সাথে এসে মিলিত হয় তার আরো দুই বোন, যমুনা আর সরস্বতী। তিন বোনের তিন পুণ্য জল নিয়ে গঙ্গা ভগীরথের সাথে চলতে থাকে পাতালের উদ্দেশ্যে।

বারাণসীর কাছে তখন জহ্নুমুনির আশ্রম ভগীরথ তা জানত না। সে গঙ্গাকে নিয়ে পৃথিবীরও আগে সৃষ্ট বারাণসীর পাশ দিয়ে চলেছে। জহ্নুমুনির আশ্রমের কাছে তখন গঙ্গা তার প্রবল জলরাশি নিয়ে এসে পৌঁছেছে কি মুনি দেখে এ তো ভারী বিপদ, গঙ্গার জল তাঁর আশ্রম, ক্ষেত, খামার সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অমনি তিনি গঙ্গার জল আঁজলাতে তুলে দিলেন নিজের পেটে চালান করে। ভগীরথ খানিক দূর গিয়ে দেখে গঙ্গা তার পেছনে নেই। খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারল তা ততক্ষণে জহ্নুমুনির পেটের ভিতরে। ভগীরথ পড়ল মহা বিপদে। জহ্নুমুনির কাছে গিয়ে কাতর স্বরে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। সব শুনে মুনি তার প্রতি সদয় হয়ে আবার গঙ্গাকে মুখ দিয়ে ফিরিয়ে দিতে গেল। ভগীরথ অমনি তাকে বাধা দিয়ে বলল মুখ থেকে গঙ্গাকে বের করলে তা এঁটো হয়ে যাবে। তখন তা আর কোনো কাজে লাগবে না, তার বংশও আর বাঁচবে না। এত কষ্ট সমস্তই সার হবে। তখন জহ্নুমুনি তার কান দিয়ে গঙ্গাকে বের করে দিলেন আর গঙ্গাও তেমনি পবিত্র রয়ে গেল। জহ্নুমুনি গঙ্গাকে এর পর সন্তান রূপে কামনা করায় গঙ্গার আরেক নাম হয় জাহ্নবী।

এরপর গঙ্গাকে নিয়ে ভগীরথ পৌঁছালেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গৌড়, অর্থাৎ মালদহে। সেখানে পদ্মমুনি ভগীরথের সমস্ত কাহিনি শুনে গঙ্গাকে আরো পূর্বে নিয়ে যেতে চাইলেন। ভগীরথ দেখল তাতে তার কর্মলাভ হবে না, উপরন্তু আছে মুনির অভিশাপের ভয়। তখন গঙ্গা নিজেই উপায় বের করল। সে দুই ভাগ হয়ে একভাগ ভগীরথের সঙ্গে চলল পাতালের দিকে, অন্যভাগ নিয়ে পদ্মমুনি চলল আরো পূর্ব দিকে। এই ঘটনার জন্যই আমরা পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ মিলে সম্পূর্ণ সবুজ এক বঙ্গদেশকে দেখতে পাই। তারপর গঙ্গাকে নিয়ে ভগীরথ এসে পৌঁছাল নদীয়া জেলার নবদ্বীপ ঘাটে। এতটা পথ আসার পর গঙ্গা নবদ্বীপে বিশ্রাম করতে চাইল। ভগীরথ আর গঙ্গা একরাত নবদ্বীপে বিশ্রাম করে বলে নবদ্বীপ ধাম এক পূণ্যস্থান হয়ে ওঠে। যত বৈষ্ণব অর্থাৎ কিনা বিষ্ণুর উপাসকেরা তাই নবদ্বীপ ঘাটে স্নান করে অনেক পূণ্য অর্জন করে। নবদ্বীপের পর সাগরের কাছে এসে ভগীরথ আর কপিল মুনির আশ্রম খুঁজে পায় না। এক বছর ধরে সেই খোঁজাখুঁজি চলল। শেষে গঙ্গা হাঁপিয়ে পড়ে ভগীরথকে বলে কোথায় তার কপিল মুনির আশ্রম, কোথায় বা সেই ভস্মরাশি, আর কোথায়ই বা পাতাল যেখানে সে সাগরে মিলিত হবে। কোনো উপায় না দেখে শেষে গঙ্গা সেখানে ক্লান্ত হয়ে একশ ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একশ ধারাকে নিয়ে মুনির আশ্রমের খোঁজ করতে করতে এক সময় ভগীরথ সাগরদ্বীপের কাছে সেই আশ্রম দেখতে পেল। দেখতে পেল ষাট হাজার পুত্রের সেই ভস্মরাশি। তখন গঙ্গার একটি ধারাকে নিয়ে সে বইয়ে দিলো ভস্মের উপর দিয়ে। স্বর্গের গঙ্গার ছোঁয়ায় প্রেত অবস্থার থেকে মুক্ত হয়ে সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান চলল স্বর্গের উদ্দেশ্যে আর ভগীরথের বংশও রক্ষা হলো শেষ পর্যন্ত।

এর পর গঙ্গার একশ ধারা সমেত গঙ্গা ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রে। গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির আশ্রমের পাশে মুলধারাটি ষাট হাজার পুত্রের মুক্তি ঘটিয়েছিল বলে সেই সাগর সঙ্গম এক পূণ্যস্থান হয়ে ওঠে। আজও সেখানে কেউ দরিদ্রসেবা করলে সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে সে মৃত্যুর পর সরাসরি স্বর্গ লাভ করতে পারে বলে কথিত আছে। কত কত মানুষ আজও সেখানে স্নান করে দরিদ্র সেবা করে এর জন্য।

গঙ্গাকে মর্ত্যে এনে ষাট হাজার পূর্বপুরুষকে মুক্তি দিয়ে তাকে সমুদ্রের সাথে মিলিয়ে ভগীরথ ফিরে আসে অযোধ্যায়। তাকে ফিরে পেয়ে তার দুই মায়ের সে কি আনন্দ। এতকাণ্ডের পর তার বিয়ে দিয়ে বসানো হলো অযোধ্যার সিংহাসনে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এর পর ভগীরথ সুখে রাজত্ব করতে লাগল।

গঙ্গা মায়ের মন্ত্রটি কিন্তু সবাই মনে রেখো। স্নানের সময় এই মন্ত্র উচ্চারণে দেহ পবিত্র হয়ে ওঠে –

ওঁ দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে,
ত্রিভূবন তারিণি তরলতরঙ্গে।
শঙ্করমৌলি নিবাসিনি বিমলে,
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে....

 

সম্বুদ্ধ সান্যাল

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top