সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

সূচনার অনুভূতি : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৪

আপডেট:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩৬

 

আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সূচনা। চমৎকার চাঁদ পৃথিবী যেন মায়াবতী হয়ে উঠেছে। এত সুন্দর পৃথিবী। অথচ জীবনটা কেন এমন বিষময় একটা ঘোরের মধ্যে আছে সূচনা। অনেক ভেবে দেখেছে। জীবনকে উল্টে পাল্টে বিশ্লেষণ করেছে। মৃত্যু ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ সূচনা খুঁজে পেল না।
এই তো সেদিনও বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে  রাস্তায়, মাঠে অথচ আজ কত বড় হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় কত সমস্যা ছিল। পুতুল হারিয়ে যাবার সমস্যা, বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া  হবার সমস্যা, বই হারিয়ে যাবার সমস্যা ,আরও কত কি সমস্যা। যে কোন সমস্যা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। অথচ আজ তার সমস্যা কে সমাধান করে দেবে? সূচনা শেষ পর্যন্ত একটা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিল।

কারণ যখন বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়, তখন কিছুই থাকে না।  সূচনার দাদীমা ঘুমিয়ে আছে খাটে। কেমন নিশ্চিন্ত ঘুম। ঘরের লাইটটা নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালো। তারপর ড্রয়ার থেকে এ্যালবামটা বের সুচনা তাকালো সেই ছবিটির দিকে । কামালের এই হাস্যেজ্জ্বল ছবিটা যেন বিদ্রুপ করছে সূচনাকে।

কামালের সঙ্গে পরিচয় বান্ধবীর বোনের বিয়েতে। সুদর্শন, স্মার্ট এক যুবক। হাসি যার ঠোঁটে লেগেই থাকে। তখন সবে মাত্র কলেজে পা দিয়েছে সূচনা। পরিচয় থেকে ভাল লাগা, ভাল লাগা থেকে প্রেম। কামালের মায়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে সূচনার। কয়েকদিন ওদের বাসায় দুপুরে ভাতও খেয়েছে। সূচনা জানতো কামাল ওর মাকে সব জানিয়েছে। ওদের বাসার সবাই সম্পর্কটা মেনেও নিয়েছে। 

আজ যখন সূচনার বিয়ের ব্যাপারে বাসায় কথা  উঠেছে তখন কামাল পিছিয়ে যাচ্ছে। ভাল চাকরি করে। বাবার এক সন্তান। তারপরও কামালের বক্তব্য নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত সে কিছুই করতে পারবে না।

সূচনার পরিবার থেকে যখন জোড়েসোড়ে বিয়ের চেষ্টা শুরু করেছে তখন কামালের নির্লিপ্ততা সূচনাকে অস্থির করে তুলল।
কামালের কাছে স্পষ্ট করে জানতে চাইল তার মনোভাব কি?
কামাল  নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল আমার এখনো পাঁচ  বছর সময় লাগবে বিয়ে করার জন্য। তুমি যদি দেরি করতে না পারো তা হলে মা-বাবার কথা মতোই বিয়ে কর।
আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সূচনা মাথায়। এ কেমন কথা? যে মানুষটা একদিন সূচনাকে না দেখলে থাকতে পারতো না। কথায় কথায় বলত, “তোমাকে আমার বুক থেকে কেড়ে নেবে এত সাহস কার? বিধাতাও এত বড় অবিচার করতে পারবে  না। "সেই মানুষটা হঠাৎ এমন অচেনা হয়ে গেল  কেন?

সূচনা দু’চোখে অন্ধকার দেখতে পেল। এত বড় অপমান সে মেনে নিতে পারছিল না। শেষে নিরুপায় হয়ে ছুটে গেল কামালের মায়ের  কাছে। কামালের মার মন সূচনার চোখের জলে গললো না। তিনি সব শুনে বললেন, কামাল তো কত বান্ধবীর সঙ্গেই আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কার সঙ্গে বন্ধুত্ব আর কার সঙ্গে প্রেম তা আমি কি করে বুঝব? তাছাড়া ছেলেরা এই বয়সে একটু আধটু ওরকম করেই থাকে। প্রেম করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন কোন কথা নেই। তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে একটা ছেলে ভদ্রভাবে তোমাকে উপেক্ষা করলো তারপরও তার পিছু ছাড়ছো না এ কেমন বেহায়পনা?

সূচনা মাথা নিচু করে চলে এলো বাড়িতে। কতদিন কামালের সঙ্গে তার কেটেছে পার্কে, বন্ধুর বাড়িতে, বৃষ্টি ভেজা দুপুরে কামালের বাড়িতে। এসব স্মৃতি সে কিভাবে ভুলবে? নিজেকে অশুচি, অপবিত্র মনে হয় সূচনার । অনেক ভেবেছে সে। আত্মহত্যা ছাড়া কোন পথই খুঁজে পায়নি।হাতের কাছেই  ঘুমের ট্যাবলেট ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। আজ এ পৃথিবীটাকে এত ভাল লাগছে কেন  সূচনার?
হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে চমকে উঠে সূচনা। একি দাদীমা জেগে আছে! দু’চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। দাদীমা হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় খাটের কাছে। খাটের উপর বসিয়ে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে  প্রশ্ন  করে, “কিরে দিদি ভাই, কি হয়েছে তোর? ক’দিন ধরে তোকে কেমন যেন মনে হচ্ছে? আমায় খুলে বল কি হয়েছে?"

কয়েকদিন যাবৎ বুকের মধ্যে যে চাপা কান্নাটা জমা ছিল বরফ হয়ে। একটা স্নেহের স্পর্শে তা গলে গিয়ে বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো মত দু’কুল ছাপিয়ে বয়ে গেল। দাদীমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সূচনা। দাদীমা বাধা দিলেন না। কিছুক্ষণ পর কান্না যখন থামল সূচনার মুখটা তুলে ধরে দাদীমা বললেন, তোর কি হয়েছে তা আমি জানি না, তবে তোকে একটি গল্প বলি শোন, দাদীমা বলতে শুরু করলেন-
তখন আমার বয়স আট কি দশ। আমাদের গ্রামেরই বিধবা মেয়ে সন্ধ্যা দিদি। তার সঙ্গে আমার খুব ভাব। বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখে আসছি সাদা থান পরাশুভ্র বসনা রজনীগন্ধা সন্ধ্যাদিকে। শুনেছি সাত বছর বয়সে দিদির বিয়ে হয়েছিল। বছর না ঘুরতেই বর কলেরায় মারা গিয়েছিল।
সেই থেকেই দিদি সাদা থান পরে থাকে। মাছ-মাংস খায় না। চুল কেটে ছোট করে রাখে। মাটিতে শোয়। কোন বিয়ে অথবা আনন্দের অনুষ্ঠানে তার প্রবেশ নিষেধ। পূজা করেই কাটে তার দিন-রাত। সাত বছরের সন্ধ্যাদি যখন দিনে দিনে বাড়তে  বাড়তে ১৭ শেষ করে ১৮ তে পা দিল তখন  সামাজিক হাজারটা নিয়ম-কানুন শত চেষ্টা করেও তার রূপ-লাবণ্য আড়াল করতে পারল না। এদিকে মাটির দেবতা আর নিরামিষও পারল না সন্ধ্যাদির হৃদয়কে বসন্তের দোলা থেকে রক্ষা  করতে।

একদিন দেবতার জন্য সাজানো পূজা সন্ধ্যাদি অর্পণ করল অনলদার পায়ে। অনলদা শহরে থেকে তখন লেখাপড়া করে। পূজার ছুটিতে গ্রামে এসেছে। সারাক্ষণ পুকুর পার আর মন্দিরের কাছে তার  ঘুরঘুর। তাই তো সন্ধ্যাদি পাথরের মূর্তির মুখ থেকে চোখ তুলে তাকাল রক্ত-মাংসের দেবতার পানে।
একদিন সন্ধ্যাদি আমাকে চুপি চুপি ডেকে নিয়ে  বলল, আমার একটা কাজ করে দিবি।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,  অনলদাকে বলবি  সন্ধ্যাদি বিকেলে মন্দিরের পিছনে যে বাগানটা আছে সেখানে ডেকেছে। আমি ভাল করে সন্ধ্যাদির দিকে তাকিয় দেখলাম, মুখটা শুকনো, চোখ বসে গেছে, চুল উসকো-খুসকো। কেমন যেন মায়া হলো আমার।
আমি সঙ্গে সঙ্গে অনলদাদের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে শুনি হঠাৎ কি কারণে অনলদা শহরে চলে  গেছেন। বাড়ির মানুষও অবাক। তারাও কিছু বলতে পারে না।

 আমি দুপুরের খাবারের পর আবার গেলাম সন্ধ্যাদির কাছে অনলদার খবরটা দিতে। গিয়ে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। ফিরে আসছিলাম। আবার কি মনে করে বন্ধ দরজার ফুটোয় চোখ রাখলাম। ভিতরের দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। সন্ধ্যাদিকে তার মা আর দাদা মারছে। ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পরছে। সাদা কাপড় লাল টকটকে হয়ে গেছে।

আমার চোখে পানি এস গেল। তাড়াতাড়ি চলে এলাম বাড়িতে। কাউকে কিছুই বললাম না। কিন্তু  কিছুতেই সেই বীভৎস দৃশ্য ভুলতে পারছিলাম না। পরের দিন সকালে শুনলাম সন্ধ্যাদি গলায় দড়ি  দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের লাশ দেখতে দেয়া হয়নি।
বাবাকে প্রশ্ন করলাম, সন্ধ্যাদির কি হয়েছিল?  দিদি মরে গেল কেন?

বাবা উত্তর দিলেন, বড় হও তারপরে বুঝবে। বড় হতে হতে আজ আমি মৃত্যুর দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছি অথচ আজও বুঝি না একই অপরাধে অপরাধী দু’জন মানুষ। এদের একজন আত্মহত্যা করে আর একজন মাথা উঁচু করে সমাজে বেঁচে থাকে কেন?

সূচনা, সমাজ আজ অনেক এগিয়ে গেছে। তুই লেখাপড়া শিখেছিস। এখনো যদি সন্ধ্যাদির সত সূচনারাও হেরে যায়, তাদের ভাগ্য পাল্টাতে না পারে, নতুন করে সমতার সমাজ না গড়তে পারে তাহলে তোরা কোন সভ্যতার অহংকার করিস?

কেউ যদি তোর বিশ্বাসের অমর্যাদা করে তাহলে লজ্জিত হবে সে, তুই কেন?
তোর শিক্ষা তোকে কী শিখিয়েছে? এত লেখাপড়া শিখেও যদি তোরা এ  যুগের মেয়েরা সন্ধ্যাদির যুগের বিশ্বাস আর কুসংস্কার আঁকড়ে থাকস তা হলে ছিড়ে ফেল  সার্টিফিকেট।

যে তোকে একবার প্রত্যাখ্যান করে, তুই তকে  হাজারবার প্রত্যাখ্যান করে উঠে দাঁড়া। জীবন কি এতই তুচ্ছ যে জানোয়ারের স্পর্শে তা  নষ্ট হয়ে যাবে?

সূচনা অবাক হয়ে তাকায় দাদীমার দিকে। দাদীমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়- অসীম সম্ভাবনাময় এ জীবন কোন প্রতারক পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার আগুনে ঝলসে যেতে  পারে না। একদিন না একিদন এ সমাজ পাল্টাবেই।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top