সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবর্তন : ডা: মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৮

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:২৭

 

দুপুরে ঘুম আসছে না নীলার। বিছানা ছেড়ে চা বানিয়ে লনে এসে বসে। কি মায়াবী বিকেল!  কমলা রোদে চিকচিক করছে সবুজ ঘাস। এখন কি হেমন্ত কাল! কে জানে!

দু'দিন বাদে তাদের একমাত্র সন্তান ময়ুরাক্ষীর বিয়ে। মেয়েটা চলে যাবে। বাড়িটা আরো ফাঁকা হয়ে যাবে ।

নীলার মন বিষণ্ণ হতে থাকে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পরে। আপাতত বিয়ে সংক্রান্ত কোনো কাজ নেই ওর । ইভেন্ট ম্যেনেজমেন্টকে বিয়ের সব দায়িত্ব দেয়া আছে। দুই পরিবারের দেশ - বিদেশের বন্ধু, স্বজন, সেলিব্রেটিরা গায়ে হলুদ, মেহেদি, বিয়েতে অনলাইনেই অংশ নিবে। রাত দিন জুম রিহার্সাল চলছে। নির্দিষ্ট পোশাক পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সবার ঠিকানায়।

নীলা দোতালায় মেয়ের ঘরের দরজায় আস্তে টোকা দেয়। ঘুম ঘুম চোখে ময়ুরাক্ষী দরজা খুলে দেয়। গাঢ় নীল রঙ নাইটি, ঘাড় বরাবর ঘন চুল এলোমেলো উড়ছে, বিকেলের সোনা রোদ মুখে পরেছে -- মেয়েকে মুগ্ধ হয়ে দেখে নীলা।
ঘোর কাটিয়ে বলে -
: ঘুমাচ্ছিলে ? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নীচে আস। স্যান্ডউইচ বানিয়েছি, খাবে।
: না মা, খেতে ইচ্ছে করছে না। মেয়ে আনমনা হয়ে উত্তর দেয়।
নীলা কিছু না ভেবেই বলে -
: মন খারাপ? পুলকের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
: এখানে মন খারাপের কি দেখলে মা! সব কিছুতেই তুমি পুলককে টেনে আন, সমস্যা কি তোমার !

নীলা মেয়ের সাথে কথা বাড়ায় না। নীচে এসে টিভি চালিয়ে ফেয়। হাসান মানে ময়ুরাক্ষীর বাবার অফিস থেকে ফেরার জন্য অপেক্ষা করে।

ময়ুরাক্ষীর আজ এমনতেই ভাল্লাগছে না। তার উপর মায়ের এইসব কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মা সারাক্ষন ওকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগে।

পুলক - ওর হবু বর। ওর সাথে ময়ুরাক্ষীর ঝগড়ার সম্পর্কও তৈরী হয়নি, বেশি ভাবেরও। করোনা লক ডাউনে প্রাক্তন প্রেমিক সৈকতের সাথে যখন ময়ুরাক্ষীর রিলেশন ব্রেক আপ হলো তখন ফেসবুকে পুলকের সাথে পরিচয়। সম্পর্কটা দ্রুত এগোতেও থাকে। অল্প সময়ে ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের মা বাবাও সহজে রাজী হয়ে যায়।

ময়ুরাক্ষীর হঠাৎ একা লাগে। পুলকের নাম্বারে রিং দিয়ে আবার কেটে দেয়। বন্ধুদের সাথে দেখা হলে ভাল লাগতো। কতদিন দেখা নেই! ওদেরকে কি বাসায় আসতে বলবে? না থাক। এখন কেন যেন হই চই আর ভাল লাগে না। হতে পারে এটা লক ডাউনে গড়ে ওঠা অভ্যাস!

ময়ুরাক্ষী শুনেছে ওর মায়ের বিয়েতে নাকি আত্মীয় বন্ধু মিলিয়ে প্রায় জনা তিরিশেক মেহমান সাতদিন ধ'রে নানু বাড়িতে থেকেছে। মেহেদি, হলুদ, বিয়ে, নাচানাচি, আদিখ্যেতা, ঘর ভর্তি লোকজন- ডিজগাস্টিং! এখন এমন হ'লে ও নির্ঘাত বাসা থেকে পালিয়ে যেতো।

আজ দুপুরে খাওয়া হয়নি ময়ুরাক্ষীর। ঘুমিয়ে পরেছিল। মাকে আজ রাগিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এখন খেতে চাইলে মায়ের সব রাগ উধাও হয়ে যাবে। ব্রাইডাল মাস্কের নতুন ডিজাইন নিয়েও মায়ের সাথে কথা বলা দরকার। রাবার ব্যান্ডে চুল আটকে চটি পরে ময়ুরাক্ষী নিচে নামে আসে।

ময়ুরাক্ষীর বাবা হাসান চৌধুরি অফিস শেষে বাসায় ফিরছেন। আর মাত্র দুদিন আছে মেয়ের বিয়ের। ক্যাটারিং, ডেকোরেশন, লাইটিং, খাবার সব অনলাইনে ফাইনাল করা হয়ে গেছে। বাসার ডিজিটাল স্টুডিওটাকে আরেকটু আপডেট করা দরকার শুধু। বড় ডিজিটাল স্ক্রীন লাগাতে হবে। মেহেদি, গায়ে হলুদ ও বিয়ের প্রোগ্রাম সবই তো ভার্চুয়ালি হবে । হাসান গাড়িতে গা এলিয়ে দেয় - ঝামেলাহীন, নির্ভার লাগে।

গেট পার হয়ে ঢোকার মুখে হাসানের সহসাই মনে হয় এ কেমন বিয়ে বাড়ি ! সুনসান নীরব, অন্ধকার ! অথচ ওর বিয়েতে ওদের পুরো বাড়ি লাল নীল হলুদ বাতিতে ঝলমল করছিল সাত দিন ধরে। সরগরম, কোলাহল মুখর!

আর কি দিন এলো এখন! আলোকসজ্জা নিষেধ, মানুষের সমাগম নিষেধ। হাসানের টাকার অভাব নেই। অথচ একমাত্র মেয়ের বিয়েতে সে ইচ্ছে মতন খরচ করতে পারছে না! করোনার কাছে সব যেন অর্থহীন। খুব অসহায় লাগে ওর।

হাসান কলিং বেল বাজায়। ময়ুরাক্ষী দরজা খুলে দেয়। মেয়েকে দেখে অবাক হয় হাসান। মনে পরে মেয়েটা যখন ছোট ছিল তখন অফিস থেকে ফিরলে অন্য কেউ দরজা খুলে দিলে শুরু হয়ে যেত মেয়ের চিৎকার, কান্নাকাটি। আজ আগের মতন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসান। সেই পুতুল পুতুল মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে! মাস্ক খুলতে খুলতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পরে ও। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মা মেয়ে দুজন সোফায় বসে কথা বলছে।
বাবাকে দেখে ময়ুরাক্ষী বলে -

: বাবা, ওই কাবার্ডে রাখা তোমাদের বিয়ের ছবির এলবামগুলি একটু নিয়ে আস প্লিজ! মেয়ের এমন কথায় বাবা মা দুজন দুজনের দিকে তাকায় কিছুক্ষন। মেয়ের আজ হলোটা কি!

ধূলি ঝেড়ে ছবির এলবাম মেয়ের হাতে দিয়ে পাশে বসে। কতদিন পর ওরা আজ তিনজন একসাথে !

ময়ুরাক্ষি এলবামের পাতা উল্টাতে থাকে। কত ছবি, কত স্মৃতি ! ছবির কত মানুষ এর মাঝে পৃথিবী থেকে, যোগাযোগের গন্ডি থেকে হারিয়ে গেছে। নীলা লাজুক লাজুক বউ সেজে বসে আছে। রুমাল মুখে বর বেশী হাসান রঙ বেরঙ কাপড়ে সাজানো গেটের সামনে বোকার মতন দাঁড়িয়ে। কত্তো কত্তো লোকজন বর কনেকে ঘিরে।

মায়ের গায়ে হলুদের একটা ছবি দেখে ময়ুরাক্ষী রীতিমতন আঁতকে ওঠে :
- মা তোমাকে এতো লোক মিলে ওপেন স্পেসে গোসল করাচ্ছে !!
ছবিটা দেখে নীলাও স্মৃতিকাতর হয়ে পরে --

: আমাদের সময় গায়ে হলুদে এমনটাই হতো। মজাও ছিল অন্যরকম । একদল আমায় গোসল করাচ্ছে। আর ভাবি,দাদি নানির দল গাইছে -
'লীলাবতী লীলাবতী বরজ কইন্যা ওরে কি দিয়া সাজাইমু তোরে --'।

: বিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষ, মেঝেতে ঢালাও বিছানা, খাওয়া দাওয়া, রাত জেগে গল্প --- নীলা স্বগতোক্তি বলতে থাকে।

ময়ুরাক্ষী বিয়ের গল্প শুনতে শুনতে মায়ের কাঁধে মাথা রাখে। ওর গলা ধরে আসে -
: মা, তোমরা কতো লাকী ছিলে ! কতো আনন্দ হতো! কতো মজা ছিল!

বাবার দিকে তাকিয়ে ময়ুরাক্ষী বলে --
: আচ্ছা বাবা, আমার মেয়ের বিয়ের সময় তোমাদের বিয়ের মতন ঘরভর্তি লোক থাকবে তো! 'লীলাবতী লীলাবতী' গান হবে! আমার মেয়ে কি অফিস ফেরত তার বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পরতে পারবে !

হাসান ও নীলা চুপ করে থাকে। এর উত্তর জানা নেই ওদের। বাতাসে জানালার পর্দা দুলছে। ঘরের নীরবতা বাইরের অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।
হাসান মেয়ের হাত নিজের মুঠিতে জড়িয়ে ধরে।

টিভির স্ক্রলে তখন দেখা যাচ্ছে 'কোভিড ১৯ এর ভেজাল ভ্যাক্সিন আটক করেছে আইন শৃংখলা বাহিনী - আসল গড ফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।'

এলবামের ছবিগুলি ওদের কাছে তখন ঝাপসা হতে শুরু করেছে। 

 

ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top