সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নিয়তির নীল চিঠি : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪১

আপডেট:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৪

 

আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এ্যাকেবারে নিরুপায় হয়ে আমি তোমার সাহায্যের স্মরণাপন্ন হলাম। ছেলেটাকে উনিশ বছর আগলে রেখেছিলাম। কোনোদিনই কষ্ট কাকে বলে সেটা ওকে বুঝতে দিইনি। কে তাঁর বাবা, কোথায় থাকেন সবকিছু জ্ঞান হবার পর জানলেও বাবা সম্পর্কে মনের ভেতর তার কোনোদিন ছবি তৈরি হয়নি। পাঁচ বছর বয়সে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। ষোলো বছর বয়সে ও মেট্রিক পাশ করে। আর আঠারো বছরে ইন্টার পরীক্ষা দিলো। উনিশে রেজাল্ট। আমি তাকে পরম মমতায় ও গভীর ভালোবাসায় ভুলিয়ে রেখেছিলাম।

আমি হাসিমুখে গ্রহণ করেছিলাম তোমার দেওয়া উপহার। ওকে পেটে ধরে মফস্বলের একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে বলা যায় এককাপড়ে চলে এসেছিলাম। সেই থেকে এই উনিশ বছরের সংগ্রাম। ঢাকা শহরের সমস্ত আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিলাসী জীবন ফেলে আমি চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাধ্য করেছিলে তুমি। কারণ আমার বাবা-মা ওকে অ্যাবরশন করতে বলেছিলেন। আমি কোনোভাবেই ওকে হত্যা করতে চাইনি। আমার সমস্ত ভালোবাসা ছিল ওকে ঘিরে। আমার শরীরের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে, রক্তের প্রতিটি অনুপরমাণু দিয়ে ওকে বড় হতে সাহায্য করেছি। একটি দিনের জন্যও আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি। অনেক শ্রম, ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে আমি ওকে বড়ো করেছি। কিন্তু আর পারলাম না। আমাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো নিয়তির কাছে।

তোমাদের বিরাট বড় বাড়িতে আমার স্থান হয়নি। আমি হয়তো আমার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। আমাদের বিয়েটা কোনোভাবেই মেনে নিতো না তোমার বাবা মা। বিশেষ করে তোমার মা। তিনি আমাকে নানাভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এ বাড়িতে আমার কোনো দাবি নেই। তাঁর ছেলের প্রতিও নেই। তিনি বলেছিলেন প্রয়োজনে থানা পুলিশ করবেন। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর অপছন্দের এই আমাকে তিনি মেনে নেবেন না। কারণ একটাই- আমি তাঁদের অমতে তোমাদের বাড়িতে অনাহুতের মতো উপস্থিত হয়েছি। নানা আকার ইঙ্গিতে উনি আমাকে এভাবেই বুঝিয়েছিলেন। আমি যখন তোমাদের বাড়ি থেকে নিচের দিকে নামতে থাকি তখন উনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- আমার গায়ের রং কালো- সেটাও নাকি আমার অপরাধ! আমি ঝড়ের বেগে তোমার মায়ের দিকে ঘুরে তাকিয়েছিলাম। যদিও আমার চোখে তখন অশ্রু ঝরছিল কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই আমার চোখে যে ঘৃণা দেখেছিলেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

কী বিচিত্র এই পৃথিবী! যেই আমি আমার নিজের ও অনাগত সন্তানের অধিকার বুঝে নেব, সেই আমাকেই হুমকি দেওয়া হয়েছে থানা পুলিশের।

আমি চাইনি আইন আদালতের মাধ্যমে আমার অধিকার কিংবা তোমার মায়ের অহংকার প্রতিষ্ঠা হোক। আমি চাইনি তোমার পরিবারের কাছে, আত্মীয়স্বজনের কাছে, বন্ধুবান্ধবের কাছে, চিরপরিচিত সমাজের কাছে সারাজীবন তোমার মাথা হেট হোক। ইউনিভার্সিটিতে যে তোমাকে আমি নেতৃত্ব দিতে দেখেছি। মাথা উঁচু করে আঙুল উঁচিয়ে বক্তৃতা দিতে দেখেছি- সেই তোমাকে ঠিক ততটায় তোমার মায়ের কাছে ভিজেবেড়ালের মতো মাথা নিচু করে থাকতে দেখেছি। আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে, এতোটুকু সত্য কথা বলার সৎসাহস তোমার ছিল না।

তোমার বাবা-মায়ের আপত্তির মুখে, আমার অনাগত ভবিষ্যতের প্রশ্নে তোমাকে নির্জিব জড়পদার্থের মতো দেখেছি। সেদিনই আমি তোমাকে চিনে নিয়েছিলাম। মানুষ চিনতে আমি কখনও ভুল করিনি। কিন্তু সারাজীবন যার সাথে থাকব বলে ভেবেছিলাম, সেই প্রিয়মানুষটিকেই চিনতে আমার সবচেয়ে বড় ভুল হলো। সেই ভুল শোধরাতেই কেটে গেল আমার জীবন যৌবন।

 

২.

সাদাত, তোমার মনে পড়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতে একদিন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তুমি কিছুতেই আমাকে ছাড়তে চাইছিলে না। বারবার বলছিলে আর একটু থাকি। একটু রাত হোক। আমি তোমাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। রাত হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।

তোমার সেই একই বায়না, আজ রাতে চাঁদ উঠবে, রাত করে আমাদের বাড়ির ছাদে উঠে দুজনে একসাথে জোছনা দেখব।

আমি বারবার বোঝাতে চাইছিলাম, আমাদের বাড়ির ছাদটা খুব পিচ্ছিল। কিন্তু তুমি কোনো কথাই শুনলে না। সেই রাত দশটা বাজল তারপর টিএসসি থেকে সরাসরি দুজনে খিলগাঁওয়ে আমাদের বাসায় পৌঁছালাম। সেদিন তোমার প্রতি আমার এতোটাই বিশ্বাস ছিল যে, তুমি যা বলবে সেটাই হচ্ছে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সত্যি। এতোটাই তোমার প্রতি নির্ভরতা ছিল যে, তুমিই আমার পৃথিবীর একমাত্র ভরসার জায়গা।

রাতে বাড়িতে এসে সোজা আমাদের ছাদে চলে গেলে তুমি। তোমার পিছু পিছু আমিও। ছাদে দাঁড়াতেই আমার মনে হলো আকাশটা যেন নীচে নেমে এসেছে। আমাদের হুড়মুড় করে ছাদে ওঠা দেখে মা নিচে থেকে চিৎকার করে সেদিন তোমায় বলেছিল, ‘সাদাত, বাবা এই অসময়ে ছাদে কেনো? পা পিছলে পড়ে যাবে কিন্তু...। আমাদের বাড়ির ছাদটা ভীষণ পিচ্ছিল...।’

সেদিন তুমি ছাদ থেকেই মায়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেছিলে, ‘যারা নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারে না, পায়ের নিচে যারা শক্ত ভিত তৈরি করতে পারেনি তাদেরই শুধু পা পিছলে যায় খালাম্মা।’

তারপর আমার মাকে তুমি নিজের মায়ের মতো করেই ডেকেছিলে, ‘মা, ও মা! ছাদে একটু এসো না। একটু বসো না আমাদের পাশে এসে। দেখে যাও আকাশটা কত সুন্দর! চাঁদটা আজ তার সম্পূর্ণ আলো দিয়ে পৃথিবীটাকে কতো সুন্দর করেছে! জোছনায় ঝলমল করছে প্রকৃতি!’

তুমি সেদিন কতো অকপটেই না আমার মা’কে খালাম্মা থেকে ‘মা’ ডেকেছিলে।

তোমার ‘মা, ও মা’ ডাক শুনে তোমার খালাম্মা ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সেদিন আমার প্রিয়তম হিসেবে নয়, তার ছেলের ডাকে ছাদে উঠে এসেছিলেন। তারপর আমাদের সাথে জোছনার আলোয় প্লাবিত হয়েছিলেন। আমার মা সেদিন দুজনেরই ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন। কিছুক্ষণ ছাদে থেকে মা তোমার জন্য খাবার প্রস্তুত করতে নিচে নেমে গিয়েছিলেন।

তুমি আমার হাতটা তখন তোমার হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলেছিলে, ‘দেখলে তো, মা আমাদের দুজনকে ছাদে থাকার অঘোষিত অনুমতি দিয়ে গেলেন।’

সে রাতে কতক্ষণ ছাদে থেকেছিলাম আমার এখন আর মনে পড়ছে না। তবে মাঝ রাত তো হবেই। তোমারও কী মনে পড়ছে না? মা নীচে থেকে ডেকে ডেকে হয়রান। অবশেষে নামতে হয়েছিল দুজনকে। সেদিন আমারও একটুও ছাদ থেকে নীচে নামতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মাঝরাতে মা তোমাকে ‘নতুন জামাই’য়ের মতো করে পাশে বসে খাওয়ালেন। তারপর একটা ফোন এলো আর তুমি তাড়াহুড়ো করে চলে গেলে।

তুমি চলে যাওয়ার পর মা আমার সেদিন কী বলেছিলেন জান? বলেছিলেন, ‘মা! সবারই একটা ঘর দরকার হয় তাই না? প্রত্যেকটা প্রাণীরই একটা ঠিকানা থাকে। প্রত্যেকটা প্রাণীরই একটা নিরাপদ আশ্রয় লাগে। বনের পাখিরাও নিজ নিজ আশ্রয় খুঁজে নেয়। পশুদেরও একটা আস্তানা থাকে।’

মায়ের গলার স্বরটা সেদিন হঠাৎই বদলে গিয়েছিল। আমার কাছে অন্তত মায়ের গলার স্বরটা সেদিন অচেনা ঠেকেছিল। শেষ পর্যন্ত মা সোজাসুজিই বলেছিলেন, ‘সাদাতের সাথে তোর মানাবে ভালো। আর তোমার মায়ের সে কী প্রশংসা মায়ের কণ্ঠে ঝরে পড়েছিল!’

আমি তোমার মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাকে বলেছিলাম, ‘মা তুমি জান না, মানুষ শিক্ষিত হলে আর যাই হোক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয় না। এটা ওটা নিয়ে যখন তখন খিটিমিটি করে না। আর শিক্ষিত মানুষের সাথে ঝগড়া করেও আনন্দ। সাদাতের পুরো পরিবারটাই শিক্ষিত। আর যাই হোক ওর মা তো অজ পাড়াগায়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। ওর মা লেখাপড়া জানা। আধুনিক।’

 

৩.

তুমি সকলের অজান্তেই ভুল পথে পা বাড়ালে। আমাকে টেনে নিয়ে গেলে সমাজ-পঙ্কিলতায়। আমার পরিবারকে টেনে নিয়ে গেলে অন্ধকারের অতলে। আমার বাবা-মা’কে ভাবনার সাগরে দিলে ভাসিয়ে। তারা হাবুডুবু খেল আমাকে নিয়ে। আমি তখন ঝড় সামলাতে ব্যস্ত। ডানা ঝাপটানো পাখি। আমার মনের ভেতর উথাল পাতাল। কোথাও কোনো খড়কুটো পর্যন্ত নেই যা আঁকড়ে ধরব। তুমি বলেছিলে, ‘আমরা তো বিয়ে করেছি, বাবা-মায়ের অমতে বা অনুমতি ছাড়া। এই তো। এ ছাড়া তো আমরা কোনো অপরাধ করিনি। এখন তো আমাদের সব সম্পর্ক হতে পারে। ধর্মমতে আমরা তো কোনো পাপ করছি না।’

আমি বাঁধা দিইনি। বাঁধা দেওয়ার মতো সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই তখন আমার ছিল না। আমি তখন শুধু তোমাকেই বুঝি। আমি শুধু তোমাতেই বাঁধা। আমার সব নির্ভরতা তোমাতেই। কিন্তু এখন বুঝি কী দরকার ছিল কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করা? কী তাড়া ছিল হোটেলে গিয়ে বিয়ের প্রথম রাত কাটানো?

এক সপ্তাহ আমরা হোটেলে কাটানোর পর আমার বাবা-মায়ের সামনে তোমার মাথা নত ভাবটা আমার পছন্দ হয়নি। যে তুমি আমাকে হোটেলে বলেছিলে, আমরা তো কোনো পাপ করছি না। সেই তুমিই আমার বাবা-মায়ের সামনে মাথা নত করে বুঝিয়ে দিলে যে, আমরা পাপ করে এসেছি।

মা আমাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে সব কথা জানতে চাইল। আমি মাকে সবকিছু খুলে বললাম। মা পুরোটা বিশ্বাস করল কীনা জানি না। মায়ের চোখে একধরনের জিজ্ঞাসা খেলা করছিল। সেদিনও আকাশে চাঁদ উঠেছিল। আমি তোমাকে ছাদে আসার জন্য কতো করে ডাকলাম। তুমি এলে না। তুমি ততক্ষণে আমার মা’কে কিছু একটা বুঝিয়ে কোথায় চম্পট দিয়েছো। তারপর আর দেখা নেই। একদিন দুদিন করে মাস পার হলো। ফোনে কথা হতো কখনো আমার সাথে, কখনো তোমার শাশুড়ির সাথে। বলতে আজই আসব। আসব আসব করে এক মাস গেল, দু মাস পার হলো। তারপর যখন আমাদের বাড়িতে এলে ততদিনে আমার শরীরে পরিবর্তন এসেছে। আমি না বুঝলেও মা বুঝেছিলেন আমি তোমার সন্তানের ‘মা’ হতে চলেছি।

বাবা-মা দুজনেই আমাকে বললেন, ‘তোদের বিয়েটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। তুই বাচ্চাটা অ্যাবরসন করে ফেল।’

আমি মানতে পারিনি। ‘অ্যাবরসন! কক্‌খনো করব না। তাতে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে এ পৃথিবীতে আমাকে যতটা হেনস্থা হতে হয় হবো।’

 

৪.

মা দিনে দিনে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। যে মা আমাদের প্রেমটাকে একধরনের উৎসাহ দিয়েছিল, সেই মা আজ আমাদের প্রেম, আমাদের বিয়েটাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করেছেন। কারণ তার আরও একটা মেয়ে আছে। তাকেও তো বিয়ে দিতে হবে। সমাজ নিয়ে তাকে চলতে হয়।

তারপর মা তোমার সাথে ম্যারাথন... কথা বললেন। আমি আড়াল থেকে কিছুই শুনতে চাইনি। কারণ ওই যে তোমার প্রতি আমার অগাধ নির্ভরতা। মায়ের কথা শেষমেষ তুমি ফেলতে পারনি। কিন্তু পুরোটা রাখোওনি। বাবা-মা চেয়েছিল তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে, সামাজিকভাবে আমাদের বিয়েটা হোক।

আমার মা কখনো কপটতা পছন্দ করেন না। তাই তিনি সরাসরি তোমার মায়ের সাথে তার মেয়ের প্রেগনেন্সির খবরটাও অকপটে বলে ফেললেন। আর সেটাই আমার জীবনে কাল হলো। তোমার মা আমাকে এ অবস্থায় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। একবার কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তোমার কোনো আত্মীয়টাত্মীয় হবে হয়তো, তিনি আমায় বলেছিলেন, আমি এখন ইচ্ছে করলে তোমাদের বাড়িতে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি। কিন্তু আমি তা চাইনি। জীবিত থাকতে যিনি আমাকে পছন্দ করেননি, মেনে নেয়নি, আজ তিনি নেই বলে আমাকে সুযোগ নিতে হবে! আমার রুচিতে আমার মানসিকতায় বেধেছে।

তুমি কিছুটা দায়িত্ব আর কিছুটা লোক দেখানোর ভান করে আমাকে বউ সাজিয়ে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে। তারপর যেটা হলো সেই বাংলা সিনেমার চিরাচরিত দৃশ্যের মতো। আমার হেরে যাওয়া, আমার জিততে না শেখা- সবকিছুর জন্য তোমার প্রতি আমার সীমাহীন বিশ্বাস আর অগাধ নির্ভরতা দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাদাতকে আমি চিনি, সে কখনো ভুল করতে পারে না, সে কখনো দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে না। এই বিশ্বাসই আমাকে তিলে তিলে শেষ করল।

 

৫.

বহুকাল পর তোমাকে লিখতে বাধ্য হয়েছি। যদি তোমাকে আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন না পড়ত, তোমাকে যদি না লিখতে হতো তবে সেটাই হতো আমার জন্য উত্তম। আমি আমার নিজের সাথে ও তোমার মায়ের কাছে কথা দিয়াছিলাম যে, আমি তোমার সাথে কোনোদিন কোনোরূপ সম্পর্ক রাখব না। এতকাল আমি তা মান্য করে এসেছি। আমার সাধ্যমতো আমি একাকি নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছি এবং তোমার সন্তানের লেখাপড়া শেখানোর সমস্তরকম দায়িত্ব পালন করেছি। তোমার সন্তান তোমার মতোই মেধাবী এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে যে ভালো রেজাল্ট করবে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। রেজাল্ট বের হওয়ার আগে সে তোমার কাছে যেতে চাইলে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করাই। সে তোমার ও আমার সম্পর্কের বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও এতোদিন পরে তোমার সাথে দেখা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবব্ধ হওয়ায় আমি নিরুপায় হয়ে তাকে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে ঢাকায় পাঠালাম। জানি না সে ঠিকমতো চিনে তোমার বাসায় পৌঁছাতে পারবে কিনা। যদি পৌঁছায় তবে আমার মতো করে তাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। আর সত্যকথা হলো এই যে, তোমার সন্তানকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর মতো সম্বল, শারীরিক ও মানসিক শক্তি কোনোটাই আমার নেই। এতো বছর পর নিজের সন্তানকে দেখে তার প্রতি তোমার আগ্রহ জন্মাবে এবং মায়া জন্মাতে পারে। আমি ঠিক জানি না। তবে আমি নিজের জন্য তোমার কাছে কিছুই চাইনি। কখনো কিচ্ছু চাইবও না। কারণ তুমি আমাকে যে উপহার দিয়েছো এর চেয়ে বেশিকিছু নারীজীবনে দরকার হয় না। জীবনের শেষ কটা দিন আমি আমার মতো করে কাটাতে চাই। আমি চাই না, আমার সম্পর্কে তোমার নতুন করে কৌতূহল হোক। নতুন করে আগ্রহ জন্মাক।

রাফিয়ার সাথে এ জীবনে আর সাক্ষাৎ হলো না। হবেও না। তাকে বোলো নিরুপায় হয়েই ছেলেটাকে তার গলগ্রহ করতে হলো। এ জন্য তার কাছে আমি করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। কয়েকবছর আগে শুনেছিলাম, তোমাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। কন্যাটি এতোদিনে প্রায় আমার নীলের মতোই বড় হয়েছে। তোমার কন্যাকে আমার দোয়া ও স্নেহ দিয়ো। নীল তোমার কাছে পৌঁছালো কিনা সে ব্যাপারে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার হবে। ছেলেটির পৌঁছানোর সংবাদ কোনোভাবে আমাকে জানালে বিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।

 

আমি আজও তোমার পায়ের শব্দ শুনতে পাই। তুমি দূর থেকে আসছ শুধু আমারই জন্য। আমি আজও আমার চারপাশে তোমার গন্ধ খুঁজি। কিন্তু জানি এ জীবনে আর কখনো আমাদের দেখা হবে না। কারণ তোমার মায়ের সামনে আমি যে তোমাকে মেরুদণ্ডহীন এক ভিজেবেড়ালকে দেখেছিলাম। আমি ভালোবেসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তুখোড় ছাত্রনেতাকে, আমি ভালোবেসেছিলাম ভীষণ পরিশ্রমী আর মেধাবী একজন ছাত্রকে। আমি ভালোবেসেছিলাম অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা এক আপোষহীন ইউনিভার্সিটির শেষবর্ষের ছাত্রনেতাকে। মেরুদণ্ডহীন, ভিজেবেড়ালের সাথে আমার সম্পর্ককে এখন আমি আর স্বীকার করি না। আমি তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। নীল আমার অসুস্থতার কথা পুরোপুরি জানে না। ও জানে ওর মা অসুস্থ। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমি জানি যে-কোনোদিন আমার শেষদিন হয়ে যাবে। ডাক্তার তেমনটিই বলেছেন। অনিচ্ছাসতত্ত্বেও নীলকে তোমার ও তোমাদের গলগ্রহ করতে হলো। সেজন্য ক্ষমা চেয়ে তোমাকে ছোট করব না। তুমি তোমার সাম্রাজ্যে মাথা উঁচু করে থাক। অনুরোধ শুধু এটুকুই আমার ‘নীল’কে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়ো। নীল যদি তার অধিকার বুঝে নেয়, তাতে আমার কোনো দোষ নেই। আমার মৃত্যুর পর তোমার যা ইচ্ছে তাই করো আমি দেখতে আসব না।

ইতি
নিয়তি

 

মশিউর রহমান, শিশু সাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক
শিশু সাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওর্য়াড ও অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশু সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদশে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top