সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ছায়াপথ : বিনোদ ঘোষাল


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩৩

আপডেট:
৫ এপ্রিল ২০২১ ২০:৪০

ছবিঃ বিনোদ ঘোষাল

 

অ্যাই তুমি চা খাবে কখন? জিগেস করল রাকা।
আরেকটু পরে দাও। বিছানায় গড়িয়ে বলল স্নিগ্ধ।
উফ তুমি না সত্যিই... ওঠো না বাবা।
ধুর তাড়া দিও না তো। আজ সানডে।
আরে তোমার ছুটি জানি আমার তো নেই। তোমাকে চা দিয়েই বাবাকে চা দিতে হবে। তাড়া দিল রাকা।

এমন চাকরি ছেড়ে দাও যেখানে সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করতে হয়। লাস্ট উইকে কী কথা দিয়েছিলে মনে আছে? বিছানায় আধশোয়া হয়েই রাকার সামনে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল স্নিগ্ধ। ওর শরীর থেকে রাত্রের ঘুমের আলস্যটা এখনও জড়িয়ে রয়েছে। কেমন একটা মায়া জড়ানো ভালোবাসার গন্ধ। স্নিগ্ধকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে হলো রাকার। হাতটা বাড়াতে গিয়েও গুটিয়ে নিল। একবার ছুঁলেই অমনি স্নিগ্ধ বলবে আদর চাই...এক্ষুনি। আর আদরের সময়ে স্নিগ্ধ খুব ওয়াইল্ড হয়ে ওঠে...একটা সুতোও গায়ে রাখতে দেয় না। স্নিগ্ধর এই পুরুষালি এ্যাগ্রেসিভনেসটা দারুন ভালো লাগে রাকার। নিজেকে আপ্রাণ মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ওর মধ্যে। কিন্তু মোটেই এখন আদরের সময় নয়।

এই ওঠো না। ধৃত ভালো লাগে না। বলে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধর একগাল হাসি। রোজ সকালে তোমার হাতের এই এক কাপ চা না পেলে দিনটা শুরুই হয় না আমার।

হুম খুব হয়েছে। আমি উঠব এবার। তাহলে আমাদের আউটিং এর কী হবে?

দেখি হয়তো দুপুরের দিকে চলে আসতে পারি। জবাব দিল রাকা। তখন বেরোনো যাবে।

ওক্কে।... এ্যাই বাবা কোথায়?

তিনি তো সকাল থেকেই তার ক্ষেতিবাড়ি নিয়ে তুমুল ব্যাস্ত। অনেক ডাকলাম, সাড়া নেই। কখন চা রেখে দিয়েছি, এখনও ফেরেনি।

কোনও মানে হয়! বুড়ো বয়েসে ভিমরতি ধরেছে তোমার বাবার। বলে ফিকফিক করে হাসল স্নিগ্ধ।

আহা অমনি আমার বাবা হয়ে গেল না? তোমার যেন কেউ না। বলল রাকা।

হুমম তাও তো ঠিক। তাহলে উপায়? কিন্তু সাংঘাতিক একটা নেশা ধরে গেছে বাবার এই লাউ-কুমড়ো ফলানোর। এই বয়েসে এসব ধকল পোষায়?

শুধু তাই নয় উৎসাহ দেওয়ার নাকি নিত্যনতুন বন্ধুবান্ধবও জুটছে।

ব্যাস তাহলে আর কি? করছে করুক। কিছু একটা করতে তো হবে একা মানুষ।

আর আমরা? বলেই আচমকা থেমে গেল রাকা। কয়েকমুহুর্ত দুজনেই চুপ। তারপরেই রাকা তড়বড় করে বলে উঠল এই আমি কিচেনে গেলাম এখন। তুমি চা খাও বসে বসে।

তোমার সারা ম্যাডাম কী কী রান্না শেখালো একটাও তো আমাদের কাউকে খাওয়ালে না।

হি হি হি আচ্ছা বেশ আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানাবো। টেস্ট করে দেখো। মুখে দেওয়া যায় কি না।

ওক্কে। চললে তাহলে রান্নাবান্না করতে?

হ্যাঁ। তোমার মতো সারাদিন বিছানায় গড়ালে হবে? খেলে চা টা?

হ্যাঁ। দারুন বানিয়েছ।

থ্যাঙ্ক ইউ। আমি যাই?

না আরেকটু বসো না পাশে।

প্লিজ সোনা এবার ছাড়ো। বলল রাকা। আবার ছুঁতে ইচ্ছে হল স্নিগ্ধকে।

উমউম... আজ রাত্রে কিন্ত সব উশুল করব মনে থাকে যেন...

আচ্ছা বেশ বলে ঠোঁট টিপে হাসল রাকা। তারপর বলল এই বুবুনের হোমটাস্কগুলো একটু দেখো তো। কাল রাত্রে বলছিল কী যেন একটা বুঝতে পারছে না।

কোথায় ও? জিজ্ঞেস করল স্নিগ্ধ।

কোথায় আবার। বাবু সকাল থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেটে মেতেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। দেখে নেব। আমি যাই এবার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা বাবাকে আরেকবার ডাক দিও তো। দেখো চাষবাস ছেড়ে ঘরে ফেরাতে পারো কি না।

আমার আর সময় নেই তুমি একবার ট্রাই করো। আমি কিচেনে গেলাম। লাভ ইউউউউউ...। বলেই উঠে গেল রাকা।

আরও কিছুক্ষন বিছানায় গড়াল স্লিগ্ধ। নাহ এবার ওঠা উচিত...অনেক বেলা হয়ে গেছে। নাহ...বুৰুনের হোমটাস্কগুলো একবার দেখতে বসতে হবে। অবশ্য ছেলে যদি বসতে রাজি হয় তবেই। মাস কয়েক হলো ক্রিকেট খেলায় খুব মেতেছে। স্নিগ্ধর অবশ্য ক্রিকেটের থেকে বিলিয়ার্ডই বেশি প্রিয়। রোজ সারাদিনে অন্তত তিন-চার ঘন্টা খেলবেই খেলবে। তখন রাকা, রাকার বাবা কিংবা বুবুন সকলে শত ডাকলেও সাড়া দেবে না।

বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের এককোনে রাখা স্টোভটা জ্বালিয়ে স্নিদ্ধ ভাবল রাকার বাবা তার সখের বাগানের কাজ সেরে ফিরল কি না একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। বাগানের পর শুরু হবে আবার অ্যাকোরিরয়ামে মাছেদের পরিচর্যা...উউফ বুড়ো পারেও এই বয়েসে। অদ্ভুত এনার্জি লেভেল! স্নিগ্ধ ওই বয়েসে পৌঁছলে এত এনার্জি থাকবে? রাস্তার দিকের পেল্লায় কাঠের জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল স্নিগ্ধ। কলকাতার সকাল সাড়ে নটার আলোতে একা দাঁড়িয়ে থাকল। নিচে সরু রাস্তা দিয়ে মানুষজন-রিক্সা, ঘেয়ো কুকুর ময়লা ফেলার গাড়ি যে যার মতো বাচ্ছে।

এই জুন মাসে দার্জিলিংএ কেমন ঠান্ডা? লন্ডনে এখন কটা বাজে? অনেক রাত নিশ্চয়ই? আর ঢাকায় নাকি এখন খুব বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। কথাগুলো পরপর মনে এল স্নিগ্ধর। রাকা অফিসের কাজ সেরে কখন ফ্রি হবে কে জানে? বুবুন হোমটাস্ক নিয়ে ওর কাছে কখন বসবে তাও জানা নেই? আর রাকার বাবাকে বাগান থেকে এখনও ফেরৎ আনা ঘায়নি। অনেকবার ডেকেও সারা পায়নি। আউটিং এর প্ল্যানটাই বরং করে রাখা যাক। আজ অনেক দূরে কোথাও যেতে হবে। সাইবেরিয়া? গেলে হয় কিন্তু .... ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠলো স্নিগ্ধ।

 

২.

বুবুনের পড়াশোনা একদম হচ্ছে না বাবা। তুমি প্লিজ একটু টাইম দাও ওকে।

রাকার কথায় খুব যে চিন্তিত হলেন আশুতোষবাবু, তা নয় তবে অল্প মাথা নেড়ে বললেন হুমম।

প্রবলেমটা কিন্তু সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে বাবা। এই বয়েসে যদি সারাদিন ক্রিকেট আরও কীসব হাবিজাবি ভিডিও গেম নিয়ে মেতে থাকে তাহলে পড়বেটা কখন? স্নিগ্ধও সময় পায় খুব কম। আর আমার সময় আর বৃৰুনের সময় তো ম্যাচই করে না। আমি যখন জেগে থাকি ও ঘুমোয়। মহা মুশকিলে পড়েছি।

আশুতোষবাবু আবার বললেন হুমম।

তুমি আমার কথায় পাত্তা দিচ্ছ না বুঝতে পারছি। রাগ করল রাকা। স্নিগ্ধও এড়িয়ে যায় তোমার মতো।

এই রে তুই আবার রেগে গেলি নাকি? ঘাবড়ে গেলেন সত্তর বছরের আশুতোষ চক্রবর্তী একত্রিশ বছরের রাকার কাছে। মেয়েটা এমনিতে সবসময় খুব হাসিখুশি কিন্তু বড্ড অভিমানী। একবার রেগে গেলে মানানো খুব কঠিন। হাজার চকোলেট, ফুল দিলেও ভুলবে না। আচ্ছা মা তুই রাগিস না। আমি কথা দিচ্ছি এবার নিজের ফার্মিং এর কাজকম্ম কমিয়ে বুবুনের পড়াশোনার দিকে বেশি নজর দেব।

আশুতোষের কথায় একটু যেন ঠান্ডা হল রাকা। একটু থেমে নিয়ে বলল স্নিগ্ধ তো নিজের তালেই রয়েছে সারাক্ষন। হয় অফিস না হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। বুবুনের দায়িত্ব যেন আমার একার!

রাকার কথার কোনও উত্তর দিলেন না আশুতোষ। শুধু ভাবলেন এই সংসারটায় সত্যিই কি কারও কোনও দায় রয়েছে? ইচ্ছে করলে এক মুহুর্তে যেখানে নিজেকে সরিয়ে ফেলা যায়। শুধু ভালোবাসাটাই একমাত্র সুতো যা ওদের চারজনকে গেঁথে রেখেছে।

স্নিগ্ধ ফেরেনি এখনও অফিস থেকে? জিজ্ঞেস করলেন আশুতোষ।

না বোধ হয়। আমিও আজ ফিরব অনেক রাত্রে। স্নিগ্ধকে বলে রেখেছি।

আচ্ছা।

বাবা ....

হ্যাঁ বল।

তুমি কেমন আছ?

রাকার এমন প্রশ্নে বুকের ভেতরটা আচমকা যেন কেঁপে উঠল আশুতোষের। এা..হ্যাঁ ভাল ভালোই তো দিব্বি আছি। আচ্ছা আমি এখন উঠি রে। দেখি মাছগুলোকে খেতে দিতে হবে।

প্রেশারের ওষুধটা রেগুলার খাচ্ছ তো? জিজ্ঞেস করল রাকা।

ওই খাচ্ছি আর কি।

তার মানে রেগুলার খাচ্ছ না? তাই তো? আচ্ছা বাবা এমন করলে হবে বলো তো?

তুই অত চিন্তা করিস না তো। একা মানুষ, মাঝেমাঝে একটু আধটু ভুলে যাই আর কি।

তুমি একা? তাহলে আমরা কেউ নই বলছ?

এই রে না না মানে আমি তা বলিনি। আচ্ছা মা এবার থেকে রোজ খাব প্রমিস। এবার উঠি।

আচ্ছা যাও। মনে থাকে যেন।

আশুতোষ চলে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকে রাকা। মনে মনে অনেককিছু ভাবতে থাকে। অনেক অনেক পুরনো দিনের কিছু কথা। বর্ধমানে নিজের পুরনো বাড়ির কথা, স্কুলের কথা, পুরনো বন্ধুদের কথা। বরাবরই মেধাবী ছাত্রী ছিল রাকা। কলেজে পড়ার সময় থেকেই দীপ্তাংশুর সঙ্গে প্রেমটা জমে উঠেছিল। দুজনেই একই ব্যাচের। দুজনেরই ঝকঝকে রেজাল্ট। কলেজে সবাই জানত ওদের দুজনের মধ্যে যতই প্রেম থাক রেজাল্ট নিয়ে দুজনের মধ্যে একটা গোপন রেষারেষি বরাবর রয়েছে। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে দুজনেই ভালো চাকরি পেল। পাবার পরের বছরেই ঝপাং করে বিয়ে আর বিয়ের বছর দেড়েক পরেই স্কলারশিপ পেয়ে যেদিন ইউ কে যাওয়ার সুযোগ পেল রাকা প্রথম বাধাটা এসেছিল দীপ্তাংশুর কাছ থেকেই। না তুমি যাবে না।

মানে!...কেন?

আমি বলছি তাই যাবে না।

প্লিজ তুমি এতটা অবুঝ হয়ো না। আমার কেরিয়ার শুরুতেই এতবড় একটা ক্কোপ। আর মাত্র বছর দুয়েকের ব্যাপার। আর যেখানেই যাই না কেন তোমার রাকা তোমারই থাকবে। কথা দিচ্ছি ফিরে এসেই তোমায় সারাদিন আদর করব। আপ্রাণ মজা করার চেষ্টা করেছিল সেদিন রাকা।

দীপ্তাংশু বলেছিল কেরিয়ারই যদি তোমার শেষ গন্তব্য হয় তাহলে আমাকে ছাড়।

মানে?

মানে আমার বাড়ির কেউ মেনে নেবে না যে যে বাড়ির বউ একা একা দু বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেছে।

এটা তোমার বাড়ির লোকের ধারনা নাকি তোমার নিজের ধারনা সেটা স্পষ্ট করে বলবে?

ঘা খুশি ভেবে নিতে পার।

বেশ বুঝেছি। ভেবে নিলাম তাহলে।

সেদিনই শেষ দেখা ছিল ওদের দুজনের। তারপর কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। আর কোনওদিনই একসঙ্গে থাকা হলনা। ফেসবুকে কেউ কাউকে আনফ্রেন্ড কিংবা ব্লক না করলেও মনের ভেতর থেকেই ব্লকেজ বা অবন্ধুত্বের জন্ম হয়ে গেছিল কবে যেন। হাই হ্যালোর কথাটুকুতেও সংকোচ এসে গেছিল। প্রায় একবছর পর একটা ছোট্ট মেল এসেছিল রাকার কাছে। দীপ্তাংশু আবার নতুন করে সংসার করতে চায়। বাধা দেয়নি রাকা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে একা এবং শুধুই একা। এই দেশেও দু এক জন বন্ধু যে জোটেনি তা নয়, তবে খুব বেশিদূর এগোতে ভয় পেয়েছে রাকা নিজেই।

মাঝেমাঝে রাকা ভাবে এই জীবনটাও তো মন্দ নয়। মন্দ কি? ধাঁধা লেগে যায়।...নাহ থাক এসব আবোল তাবোল ভাবনা। স্নিগ্ধ ফিরেছে কি না একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। ছেলেটা বড় ভালো। স্নিগ্ধর কাছে কিছুই লুকোয়নি রাকা। সব বলেছে। তাপরেও এত আপন করে নিয়েছে স্নিগ্ধ ওকে। মনে মনে সবসময়ই যেন ওকে জড়িয়ে রেখেছে এমন একটা অনুভূতি হয় রাকার। স্নিগ্ধ খুব বেড়াতে ভালোবাসে। একসময় ওর স্বপ্ন ছিল গ্লোবটটার হওয়ার। পেরে ওঠেনি। এখন রাকাকে সঙ্গে পেয়ে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায় যেখানে খুশি। দুজনে মিনে প্রায় সারাপৃথিবী চষে বেরিয়েছে। নিত্যনতুন বেড়ানোর জায়গা আবিস্কার করা আর রাকাকে সঙ্গে নিয়ে সটান সেখানে চলে যাওয়া স্নিগ্ধ একটা নেশা। বাধা দেয় না রাকা। ভালো লাগে ওর সঙ্গে বেড়াতে। দুজনে যখন একসঙ্গে নির্জন কোনও সমুদ্রতীরে সূর্যাস্ত কিংবা পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখে কী ভালো যে লাগে তখন। মনের ভেতরে জমে ওঠা জং মুহূর্তে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। খুব আবেগ ওর মনে। স্নিগ্ধ যখন ওকে আদর করতে চায় কিংবা আদর করে কী সুন্দর যে তখন দেখতে লাগে ওকে। শুধু একবারের জন্যও ওর স্পর্শটা যদি...। একত্রিশ বছরের শরীরটায় আবার শির শির করে ওঠে রাকার। আজ স্নিগ্ধকে আবার কাছে টানবে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে ওকে।

 

৩.

কি রে তুই নাকি একদম পড়াশোনা করিস না,সত্যি নাকি? জিজ্ঞেস করল স্নিগ্ধ।

হ্যাঁ সত্যি। সটান উত্তর বুবুনের।

কেন?

আমার ভালো লাগে না।

তাই বললে হয়? বড় হতে হবে না? এবার বললেন আশুতোষ।

বড় না পড়লেও হওয়া যায়। আবার উত্তর বুৰুনের।

স্নিগ্ধ বুঝল বুবুনের মুড আজ একেবারে ঠিক নেই। আশুতোষ বুঝতে পারলেন না। বললেন, হুঁ তা চেহারায় বড় হওয়া যায় বৈ কি। কিন্তু পড়াশোনা না করলে মনের থেকে বড় হওয়া যায় না, জ্ঞানের দিক থেকে ...

আশুতোষের কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিল বুবুন। বলল, বাজে কথা, মিঃ মুখার্জি আর মিসেস মুখার্জি দুজনেই এডুকেশনে টপ লেভেল এন্ড ৰোথ অফ থেম আর ওয়েল এসটাবলিশড। বাট আর দে গুড হিউম্যান বিং? নো নেভার...দেন হোয়াট ইজ দ্য পারপাস অফ গ্যাদারিং সাচ বুলশিট সারটিফিকেটস এন্ড রেজাল্টস এন্ড ডিগ্রিজ?

স্নিগ্ধ দেখল বুবুনের মুখটা রাগে থমথমে হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে ও জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা থাক এসব কথা, চকোলেট খাবি?

কী ব্র্যান্ড? ফিক করে হেসে বলল বুবুন।

রিকার্ট চলবে?

ওহ সেই ফ্রান্সের ব্র্যান্ডটা? ওটা অনেকবার দিয়েছ তুমি। নতুন কিছু নেই...

আচ্ছা বেশ তোর কি লাগবে বল কাল সকালেই পেয়ে যাবি।

আমার নিপশিল্ডের চকোপলোগি চাই।

আশুতোষ জিজ্ঞেস করলেন সেটা আবার কোনদেশি চকোলেট?

বুবাই বেশ গর্বের সঙ্গে বলল এটা ডেনমার্কের চকোলেট। সবথেকে দামি। ওটা আমাকে কেউ কোনোদিন দেয়নি।

আচ্ছা বেশ কাল পেয়ে যাবি, খুশি? হেসে বলল স্নিদ্ধ।

ইয়েস। এবার একগাল হাসি বুবাইয়েরও।

তাহলে এবার টাস্কগুলো দেখা।

হ্যাঁ দেখাচ্ছি। আগে একটু টয়লেট যাচ্ছি। বলে উঠে গেল বুৰুন।

তারাতারি কিন্তু। আমি শুতে যাৰ। আজ খুব ঘৃম পেয়ে গেছে।

ওকে, বলে উঠে গেল বুবুন। আশুতোষ আর স্নিদ্ধ মুখোমুখি।

রাকার কাছে শুনলাম তুমি নাকি রেগুলার মেডিসিন নাও না?

অ, তোর কাছেও নালিশ পৌঁছেছে তার মানে? খক খুক করে হাসলেন আশুতোষ। 

হুম সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু এটা তুমি ঠিক করছ না। সারাক্ষন নিজের ক্ষেতখামারি নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? নিজের শরীরের দিকেও তো একটু নজর দিতে হবে নাকি?

এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফল সোনা বলছিস? বলেই হ হো করে হাসলেন আশুতোষ। আবারও সেই হাসিতে মুগ্ধ হল স্নিদ্ধ। মানুষটা এই বয়েসেও এমন প্রাণখোলা হাসি কী করে হাসে কে জানে? স্নিগ্ধ নিজেও ফিল করে ও বছরের মধ্যেই অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে। নেহাৎ এত সুন্দর একটা ফ্যামিলি পেয়েছিল তাই বেঁচে থাকতে ভাল লাগে, নইলে যে...

হ্যাঁ তাই ই বলছি। এমন কোরো না প্লিজ।

আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা করিস না। এই আমি এবার খেতে উঠব। বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুৰুন এসে পড়ল। আশুতোষ বললেন এই যে লিটিল প্রিন্স আমি এবার উঠব। আমার পাওনাটা এবার দাও দেখি বলে নিজের গাল বাড়ালেন। বুবুনও নিজের মুখ বাড়িয়ে আশুতোষের গালে একটা চুমু খেল সজোরে। সত্তর বছরের পুরনো ঢিলে চামড়া যেন সত্যিই সিক্ত হয়ে উঠল সেই কিশোরের চুমুতে।  

বাই সুইট ড্রিম।

আশুতোষ উঠে যাওয়ার পর স্নিগ্ধ বলল দে এবার দেখা দেখি তোর হোমটাস্ক। 

দেখাচ্ছি। তার আগে তোমরা কী প্রমিস করেছিলে মনে আছে তো?

আলবৎ মনে আছে। কাল আমাদের বুবুন স্যরের জন্মদিন সেই কারনে আমরা সকলে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসব এবং বার্থডে সেলিব্রেট করব, রাইট?

ইয়া দ্যাটস ইট।

 

৪.

আজ সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে মিস্টার এন্ড মিসেস ব্যানার্জি এসেছিলেন, বলল বুবুন।

ছিঃ ওইভাবে বলতে নেই তোমাকে বলেছি না। মিস্টার এন্ড মিসেস মুখার্জি আবার কী কথা? মৃদু ধমক দিল রাকা।

কেন বলব না? আমি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না। জোর দিয়ে বলল বুবুন।

দেখ বুবুন আফটার অল ওরা তোমার...

স্নিগ্ধর কথার শেষ লাইনটা কমপ্রিট করতে দিল না বুবুন। না ওরা আমার কেউ হয় না।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন ওসব কথা থাক। আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। আমরা একদম ঠিক রাত বারোটাতেই সেলিব্রেট করব। তারপরেই আমাদের বুবুন স্যারের তেরো বছর বয়েস হয়ে যাবে।

ভাবা যায়! এর পর দেখব একদিন গার্লফ্রেন্ডও হয়ে যাবে। তখন কি আর আমাদের পাত্তা দেবে?

এ্যাই একদম বাজে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। রাগ দেখাল বুবুন।

আচ্ছা আচ্ছা বেশ। তা মিঃ আর মিসেস মুখুজ্জে কী গিফট দিল সেটা বললি না তো? ঠোঁট চেপে হেসে জিজ্ঞেস করলেন আশুতোষ।

জানি না। আমি দেখা করিনি ওদের সঙ্গে। মুখ গম্ভীর করে বলল বুবুন।

কেউ আর কোনও উত্তর করল না বুৰুনের।

তোমরা কে কী গিফট দিচ্ছ আমাকে কেউ কিন্তু কিছুই বলোনি।

সেটা কেন বলব তোকে? সেটা সারপ্রাইজ। উত্তর দিল স্নিগ্ধ

আচ্ছা বেশ। আর তো দু মিনিট। তারপরেই জানতে পেরে যাব।

ঠিক দু-মিনিট পেরোলেই কিন্তু বুৰুন। বলল রাকা। মনে খুব উত্তেজনা হচ্ছে। এই বছর প্রথম বুবাইয়ের বার্থডে সেলিবেট করছে ওরা তিনজনে মিলে। আজ একটা স্পেশাল কেক বানিয়েছে রাকা। সেটাই গিফট দেবে ও।

নাও দু মিনিট হয়ে গেছে। বুৰুন কথাটা বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আচমকা স্কাইপির কানেকশন কেটে গেল। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। চারটে অসমবয়েসি মানুষ বারবার চেষ্টা করে যেতে লাগল রিকানেক্ট করতে। কিছুতেই হল না। অসংখ্যবার চেষ্টার পর ব্যার্থ হয়ে ভারি বুক নিয়ে যে যার ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

লন্ডনের যে ফ্ল্যাটে গত সতেরো বছর ধরে একা রয়েছে সেই ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল রাকা। এখন এই শহরে রাত সাড়ে সাতটা। কিচেন স্ক্র্যাম্বেল কম্পিউটার গেমে আজ বড় সখ করে বুবুনের জন্য একটা চকোলেট কেক বানিয়েছিল ও। সেটাই গিফট করবে ভেবেছিল। দেওয়া হল না। একটা সময়ে অফিস আর নিজের ফ্ল্যাট এর বাইরে যেন আর কোনও জগতই ছিল না ওর। এমন সময়ে একে একে স্নিগ্ধ এল, আশুতোষ এল সব শেষে এল বুবুন। সবাই এসেছিল সোসাল সাইটে। অনেকেই যেভাবে আসে। বন্ধু হয়। কিন্তু এই চারজন কবে যেন পরস্পরের বড্ড নিজের হয়ে গেল...খুব নিজের। রোজ সকালে এককাপ গরম চায়ের ছবি সেন্ড করে মোবাইলে মিসড কল করে যখন স্নিগ্ধর ঘুম ভাঙায় রাকা কী যে ভালো লাগে তখন...মনে হয় একেবারে সামনে যেন। নিশ্বাস নিলে স্নিগ্ধর গায়ের গন্ধ আসে নাকে। কিংবা বুবুনের পাঠানো হোমটাঙ্ক দেখতে দেখতে মনে হয় ছেলেটা ওর সামনে খাটের ওপর বসে পড়া শিখছে।

আশুতোষ এসে দাঁড়াল বাড়ির ছাদে। ঢাকা শহরের উত্তরার আকাশ ভর্তি তারা। আজ থেকে সাত বছর আগে লীলা চলে যাওয়ার পর থেকে সারা দিন একা কাটত আশুতোষের। ও চলে যাওয়ার পরে আর ভালো লাগত না কিছু। নিজেরও চলে যেতে ইচ্ছে করত এই বিমর্ষ পৃথিবীটা ছেড়ে। একটা মাত্র ছেলে সেও চাকরি নিয়ে চলে গেছে দুবাই। বিয়ে করে ছেলে বউ নিয়ে ওখানেই সেটলড। যোগাযোগ খুব কম। নাতির মুখ জীবনে একবারই দেখেছিল। অনেক বছর আগে। লীলা যখন ছিল তখন সারাদিন বাড়ির সামনের জমিটায় রোজ সকালে অনেক ফুল আর সবজির চাষ করত আশুতোষ। ও চলে যাওয়ার পর আর কিছু ইচ্ছে করত না। গোটা জমিটা আগাছায় ভর্তি হয়ে গেল একসময়। তারপর একসময় কম্পিউটারে ফার্মভিল খেলা শিখে ফেলেছিল একদিন। সবটাই কম্পিউটারে, তবু সেটাই কবে যেন নেশার মতো হয়ে গেল। আর বড় মায়ায় পড়ে গেল স্নি্ধ, রাকা আর বুবুন নামের বাচ্চা ছেলেটার প্রতি। কোনওদিন হয়তো দেখাই হবে না ওদের সঙ্গে। কত কত দুরে থাকে সবাই একে অপরের থেকে ... তবু এমন সুন্দর একটা সংসার...একা বোধটা বছর দেড়েক ধরে যেন অনেকটাই কমে গেছে। এত দূরে থেকেও এত কাছে থাকা যায়! বড় মায়া...বড্ড মায়া এখনও এই পৃথিবীটায়...

বুবুন চুপ করে বসে ছিল দার্জিলিং ওর স্কুল বোর্ডিংএর বেডে। ভীষন কান্না পাচ্ছে...ভীষন। ল্যাপটপটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে মেঝেতে। ভেঙে যাক...সব কিছু ভেঙে যাক। আজ সকালে কলকাতা থেকে মা মনিকা মুখার্জি আর বাবা শৈবাল মুখার্জি এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে। করেনি। কেন করবে দেখা? মা-বাবা কি একটুও বোঝে না ওর এখানে একা একা থাকতে একটুও ভালো লাগে না। মাসে শুধু একবার করে বাবা কিংবা মা এসে দেখা করে যায়। আর মাঝেমাঝে একটা ফোন কেমন আছিস? পড়াশোনা ঠিক চলছে তো? কিছু লাগবে তো বল নেক্সট বার নিয়ে যাব। কিচ্ছু লাগবে না আমার কিচ্ছু লাগবে না মা, শুধু আমাকে নিয়ে যাও বাবা এখান থেকে। একা একা আমার দমবন্ধ লাগে। রাকা আন্টি, স্নিগ্ধ আঙ্কেল আর আশু দাদু যদি ওর ভালো লাগা খারাপ লাগা সবকিছু এত থেকেও বুঝতে পারে তাহলে তোমরা কেন পার না মা? সারাদিন কম্পিউটারে ক্রিকেট খেলতে আমার একটুও ভালো লাগে না। তবু খেলি। যাতে পড়াশনা না করতে হয়, যাতে আমাকে এই বোর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেয় ওরা, যাতে আমি আবার তোমাদের কাছে গিয়ে থাকতে পারি। তুমি জানো না বাবা স্নিগ্ধ আঙ্কেল আর রাকা আন্টি আমাকে কী ভালোবাসে। আমার খুব ছোটবেলায় যেমনটা তোমরা আমাকে বাসতে। তোমরা ঝগড়া করে আলাদা থাকো বলে আমাকেও দূরে সরিয়ে দিলে? এত দূরে! কেন? ভাবতে ভাবতে চোখের দুই কোনে দুটি তরল হিরের কুচি নিয়ে বন্ধ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল বুবুন। ঝাপসা কালো কালো পাহাড়গুলোর মাথায় আকাশ দেখা যাছে।

আর স্নিগ্ধ, সিগারেট ধরিয়ে এসে বসল শ্যামবাজারে হরপ্পা যুগের একটা বাড়ির সিঙ্গল রুমের পেল্লায় কাঠের জানলাটার সামনে। কলকাতায় একটা ছোট কোম্পানিতে সেলসের চাকরি পাওয়ার পর কম ভাড়ায় এই ঘরটা পেয়ে গেছিল। গত তিন বছর ধরে এখানেই রয়েছে। বেয়াল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেল। বাড়ি থেকে, বন্ধুরা মিলে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অনেক। মনের ভেতর একটা পরিপাটি সংসারের তীব্র ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়নি স্নিগ্ধ। পারেনি রাজি হতে ভয়ে। আসলে মাস গেলে যা মাইনে হাতে আসে তাতে নিজেরটা চালাতেই হিমসিম খেয়ে যেতে হয় তার ওপর কী দরকার একটা মেয়েকে দারিদ্রে টেনে এনে। তার থেকে এই তো বেশ ভালো আছে। রাকা বুবাই আর আশুতোষকে নিয়ে গুছোনো সংসার। ছায়ার, তবু সংসার তো।

চারটে একলা মানুষ ঘে যার আকাশে তাকিয়ে ছিল ঘন অন্ধকারে। অসংখ্য নক্ষত্রে ভরা ওই ছায়াপথ, যেখানে ওদের একসঙ্গে হেটে চলা...অপেক্ষা করছিল চারজনেই। আবার কখন...

 

সমাপ্ত

লেখক পরিচিতিঃ
বিনোদ ঘোষালের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগরে। জীবনে বহু বিচিত্র কাজে জড়িয়ে পড়ার পর অবশেষে তিনি লেখালেখিকেই একমাত্র পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, ফিচার, নাটক, চলচ্চিত্র সমালোচনা তার লেখালেখির বিষয়। দেশ পত্রিকাতে বিনোদ ঘোষালের লেখা প্রথম গল্প ‘একটু জীবনের বর্ণনা’  প্রকাশিত হলে, গল্পটি পাঠকমহলে বিশেষ সাড়া ফেলে। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র জীবনকে ভিত্তি করে লেখা তার দীর্ঘ উপন্যাস ‘কে বাজায় বাঁশি?’ একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিনোদ ঘোষাল ২০১১ সালে তার ‘ডানাওলা মানুষ গল্প’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন কেন্দ্রীয় সাহিত্য একাডেমি যুব পুরস্কার। ২০১৪ সালে তিনি ‘নতুন গল্প ২৫’ বইটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি পূর্বভারত পুরস্কার, মিত্র ও ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার, শৈলজানন্দ পুরস্কারে সম্মানীত হয়েছেন। দেশের বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের সাহিত্য উৎসবে বাঙালি লেখক প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনি মাননীয় ভারতের রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতিভবনে 'রাইটার্স ইন রেসিডেন্স প্রোগ্রামে' যোগদান করেন। অর্জন করেছেন ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলোশিপ ।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top