সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

আগাছা  : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫৯

 

রূপালী বেগমের উপর যে জ্বীনের আছর আছে তা এলাকার সবাই জানে। তার উপর জ্বীন ভর করেছে তা শুনতে শুনতে এখন সেটা আর কারোও কাছে নতুন ঘটনা নয়। রুপালী বেগম দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই হাসিখুশি মানুষ। হলদে রংয়ের ছাপা শাড়িতে তার রূপ আরো খোলতাই হয় এজন্য মন ভালো থাকলে সে হলদে শাড়ি পড়ে, তার হাতের সোনার বালা দুটোও সেদিন যেন বেশী চকচক করে। তবে রটনা আছে রূপালী বেগমের নতুন শাড়ির আঁচল জ্বীন কেটে নিয়ে যায়। এখন তিনি যে শাড়িটি পড়ে আছেন সেটারও আঁচলের খানিকটা অংশ নাই,রূপালী বেগম অবশ্য এ নিয়ে এখন আর মাথা ঘামান না।

পাড়ার সকল বাচ্চা কাচ্চার আদরের কাকীমা তিনি।কারনে অকারনে বাচ্চাদের দাওয়াত থাকে তার বাড়িতে, পীঠা পুলি তৈরী করার শুধু একটা উছিলা হলেই হল, সবার দাওয়াত। আজও আয়োজন চলছে। বাড়ির ভিতরের পুকুর পারের তাল গাছ থেকে  দুটো পাকা  তাল পড়েছে কাল বিকেলে,বছরের প্রথম পাকা তাল তাই  সে দুটোরও ভাগীদার পাড়ার বচ্চারা। ওরা আনন্দ নিয়ে পিঠা খাবে , কাকীমা বলে কোল ঘেঁষে দাঁড়াবে, ঐ ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর গায়ের ওমই রূপালী বেগমের বেঁচে থাকার আনন্দ।

রূপালী বেগম এলাচির ঘ্রান খুব ভালোবাসেন, বাসার সামনের একটুকরো খোলা জায়গায় দুটো এলাচির ঝাড় লাগিয়েছে তিনি। ঝাড় দুটোতে এইবার মাত্র সাদা -খয়েরী মিশেল রং এর ফুল এল। রাত নামলে ফুলের ঘ্রান তীব্র হয়, তখন এলাচি ফুলের মৌ মৌ গন্ধে চারদিক ভাসতে থাকে। এলাচির ঝাড় দুটোর গোড়ায় বেশ আগাছা জমেছে, পরিস্কার করা দরকার নইলে সাপ খোপের বাসা হবে।
রূপালী বেগম এই বাড়িটি পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছেন। মফস্বল শহরের নামী এলাকায় দেড়তলা বিল্ডিং, সামনে বাগান করার খোলা জায়গার তিনদিক ঘিরে বৈঠকখানা আর পিছনে উঠোন।বা দিকে উঠোন রেখে এগিয়ে গেলে রান্নাঘর, রান্ন্ঘরের মাথার উপর ছায়া দিচ্ছে একটা রেইনট্রি আর আর  একটা কাঠ বাদামের গাছ। দুটো গাছই কাকের অভয়ারন্য, বেশ কয়েকটি কাক বাসা বেঁধেছে সেখানে ,কয়েকটা কাকের বাসাতে আবার ছানা পোনা নিয়ে জমজমাট সংসার। রান্না ঘরের উল্টোদিকে পুকুর , পুকুরের ওপাড়ে সীমানা ঘিরে লাগানো কলা গাছের সারি ,দু-চারটা নারিকেল গাছ,দুটো তালগাছ, বাঁশের ঝাড়; সব মিলিয়ে আট কাঠার মত জমি। রূপালী বেগম নীচতলার দক্ষিণ দিকের বারান্দাওয়ালা রুমটাতেই থাকেন দিনের বেশীরভাগ সময়। বাড়ির বাকী সদস্যরাও নীচতলাতেই থাকে। তবে দোতালার দুটো রুমের একটাতে তার স্বামী ইদানিং আস্তানা গেড়েছেন, অন্যটা খালিই থাকে।মাঝে মধ্যে দুপুরবেলা রূপালী বেগম উপরে এসে এ রুমটাতে বিশ্রাম নেন,তার কথায় দখলে রাখেন। কিন্তু আসলে এ রুমটা দিয়ে পুকুর পাড়টা স্পষ্ট দেখা যায়, জানালা খুলে দিয়ে তাই তিনি গাছেদের দেখেন , উদাস চোখে তালগাছ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন, জীবনের হিসাব নিকাশ মেলাতে চেষ্টা করেন , তখন কখনো কখনো তার প্রচন্ড কান্না পায়, বাবাকে দোষারূপ করতে ইচ্ছা হয়,কেন তিনি এমন জীবন তাকে গছিয়ে দিয়ে পরপারে চলে গেলেন। তবে তার এ ভাবনা গুলোর সাক্ষী বুকের ভিতর থেকে বের হয়ে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাসেদের এ ঘরের চার দেয়ালের বাইরে বের হতে দেখেনি কেউ কোনোদিন।
রূপালী বেগমের স্বামী শাহাদৎ হোসেন শহরের নামডাক ওয়ালা উকিল। বাসার সামনের বৈঠক খানাতেই সকাল বিকেল প্রাইভেট চেম্বার করেন। লোকজনের আনাগোনাও রয়েছে বেশ। বৈঠক খানার ভিতরটাতে দশ বারোটা চেয়ার দেয়া  মক্কেলদের বসার জন্য। আর একপাশে একটা ছোট খাট,  খাটের উপরে কাঠের বাক্স, লেখার খাতার স্তূপ। খাটের উপরে বসে মহুরী সাহেব যাবতীয় লেখালেখি করেন। অন্যপাশে দেয়াল ঘেঁষে কাঁচের আলমারিতে রংচং এ আইনের বই,তারই সামনে বড় একটা সেগুন কাঠের টেবিল। টেবিলটার ওপাশে বড়সড় হাতল ওয়ালা চেয়ারটাতে যখন শাহাদৎ সাহেব বসেন তখন তার মাথা ছাড়া সবকিছু টেবিলের তলায় ঢাকা পড়ে যায়। মক্কেলরা বেশীরভাগই চর অঞ্চলের লোক, জমিজমা নিয়ে মামলা মোকাদ্দমা, ধুরন্ধর টাইপ। তবে ধুরন্ধরিতে শাহাদৎ হোসেনও কম জান না, মামলার মারপ্যাঁচ তার ভালই জানা আর এজন্যই তার এত পসার। মক্কেলদের মুখে মুখেও রূপালী বেগমের জ্বীনের গল্প বেশ পরিচিত, নতুন মক্কেলরা যারা এগল্প প্রথমবার শোনেন তারা ভিতর বাড়ির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে শাহাদৎ হোসেনের কতটা দুর্ভোগ আর দূর্ভাগ্য তা কল্পনা করে মুখে চুকচুক আওয়াজ করতে করতে 'আহা!' উচ্চারন করেন। কারো কারো আবার অন্তর থেকে বের হয়ে আসে লম্বা দীর্ঘশ্বাস। এসব খবরের অনেকটাই বাতাসে ভেসে প্রতিদিন অন্দরমহলে রূপালী বেগমের কানে পৌঁছায়।

এ বাড়িতে রূপালী বেগমের নিজের বলতে তার একছেলে, একমেয়ে। ছেলেমেয়ে দুটোই বাবার মত খর্বাকৃতির তবে মুখচোখ সুন্দর। তার আরও তিনজন সন্তান জন্মের পর এক দেড় মাস করে আয়ু পেয়েছিল। রূপালী বেগম মাঝে মাঝে ভাবেন তারা হয়তো তার মত দীর্ঘাঙ্গী হতো। কোনো অসুখ বিসুখ ছাড়াই বাচ্চাগুলো কেমন টপটপ করে মরে গেল রূপালী বেগমের এখনো ঘোরের মত মনে হয়।

রূপালী বেগম সাজগোজ করে পরিপাটি থাকতে ভালবাসেন। হাত, পা, চুলের নিয়মিত যত্ন নেন।প্রতিসপ্তাহে নিয়ম করে লাভলী এসে কাঁচা হলুদ, মেহেন্দি বেটে লাগিয়ে দিয়ে যায়। লাভলীর বয়স পনের কি ষোল হবে। লাভলীর মা মাজেদা রান্নার কাজ করে রূপালী বেগমের হেঁসেলে। আজও প্রতিদিনের মত রূপালী বেগম তার শোবার ঘর লাগোয়া বারান্দায় মোড়া পেতে বসেছেন। লাভলী এতক্ষনে মেহেন্দি বাটা শেষ করে রূপালী বেগমের হাতের নখে লাগিয়ে দিচ্ছে। লাভলীকে রূপালী বেগমকে খুব স্নেহ করেন। এই মেয়েটি আসলেই কেবল সে কথা বলার লোক পায়। লাভলীও অনবরত কথা বলে, এত কথা, এত কৌতুহল তার মনে কোথা থেকে আসে কে জানে, ভাবেন রূপালী বেগম। তার নিজের ছেলেমেয়েদেরও আশ্রয় স্থল তিনি। বাইরে তাদের শারীরিক অসঙ্গতির কারনে মানুষের কাছে প্রচুর হেনস্থা হতে হয়, তাদের চোখে করুন হয়ে লেগে থাকা সেই যন্ত্রনা রূপালী বেগম বেশ পড়তে পারেন। আজকাল তারা আর বাইরের মানুষের কাছ ঘেঁষেনা তেমন। এখন তারা কলেজে পড়ে, পড়ার চাপ ও বেশী এজন্য হয়তো লোকজনের সাথে মাখামাখিও কম আর তার সাথে অজানা অস্বস্তি তো আছেই।

রুপালী বেগম প্রায়ই অসুস্থ থাকেন।গত চার-পাঁচ বছর ধরে তার এ অসুখটার বাড়াবাড়ি। আগে বছরে ফি বছরে এক দু বার হয়েছে কিন্তু এখন তা প্রায় প্রতি মাসে রুটিন করে একবার কখনও দুবার । রূপালী বেগমের খিঁচুনীর রোগ আছে, খিঁচুনী উঠলে মুখ থেকে ফেনা পর্যন্ত বের হয় আজকাল। তখন তিন চার জন তাগড়া লোকও তাকে সামলাতে পারেনা। তবে চিকিৎসা তেমন হয়নি আগে , এখনতো আরও! রূপালী বেগম ভাবেন এ অসুখ, না বেঁচে যাওয়া, তবে কি সুখ!

লাভলীর বকবকানীতে চিন্তায় ছেদ পড়ে। লাভলী তাকে আম্মা বলে ডাকে। কৌতুহলী লাভলী জিজ্ঞেস করে,
- আম্মা আপনার লগে জ্বীন আছে, না? আপনে তারে দেখছেন? সে পুরুষ না মহিলা?
- না
- আপনারে হে খাওন দেয় না? এই ধরেন মিষ্টি, ফল?
- কেন তুই খাবি?
- দেয় কিনা কন? কি ফল দেয়, আম্মা?
- না দেয় না
- ও, তার মাইনে গরীব জ্বীন, আমাগো মতন গরীব! আপনার লগে খালি গরীবেরই দেহা হয়, আম্মা!
লাভলী হতাশ হয়।

ওদিকে রূপালী বেগমের শ্বাশুড়ি মিনারা খাতুন কখন এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লাভলী ও রূপালী বেগমের কথোপকথন শুনছিলেন। মিনারা বেগমের গলা শোনা যায়, "ঐ জ্বীনেই খাইলো সব, আমার পোলাডার জীনবডা, আহা! ঐ পারুল না থাকলে সংসার আর সংসার থাকলো নারে সব ভাইসা যাইতো। মানা করছিলাম এত সুন্দরী বউ এ কাজ নাই, কে হুনে কার কতা! বড়লোক উকিলের একমাত্র কইন্যা, বাড়ি পাওয়া যাইব, বৈঠকখানা পাওয়া যাইব! তিন তিনডা ছাওয়াল মরল,থাকল আছাতা দুইডা, তাগোরে তো চোকের মাথায় খুঁইজ্যাই পাওয়ন যায়না। নে এবার বাড়ি আর বৈঠকখানা ধুইয়া পানি খা!...." মিনারা বেগমের বিলাপ চলতে থাকে।

পারুল বিবির নাম শুনেই অস্থির হয়ে ওঠেন রূপালী বেগম। পারুল বিবি আসার পরে কত কিছু পরিবর্তন হল এ বাড়িতে! রূপালী বেগমের গভীর থেকে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়। লাভলী জিজ্ঞেস করে
-আম্মা খারাপ লাগতাছে? মাথায় তেল দিয়া দেই
- দে, তেলের সাথে লেবুর রস নিস একটু
লাভলী তেল আনতে ঘরে যায়।

রূপালী বেগমের মনে পড়ে সেবার তার শ্বাশুড়ি গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলেন আর আসার সময় সাথে নিয়ে আসলেন তার খালাত বোনের মেয়ে পারুল বিবিকে। পারুল বিবির স্বামী গ্রামের মেম্বার ছিলেন, খুন হয়েছিলেন রাজনীতির জের ধরেই। সেই কেসের সুবাদেই তার এ বাড়িতে আসা।কেস সুরাহা হয়েছে সেই কবে তবে তার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। পারুল বিবির বাসায় আসার পরপরই তার অসুখটার বাড়াবাড়ি হয়। একবার খিঁচুনি উঠলে খাট থেকে পড়ে গিয়ে কপালের খানিকটা কেটে যায়, আটটা সেলাই লেগেছিল। রূপালী বেগম হাত দিয়ে কপালটা ছোঁয়, সেলাইয়ের জায়গাটা অনুভব করেন। সে পর্যন্ত তার ডাক্তারি চিকিৎসাই হচ্ছিল। কিন্তু কেমন করে যেন পারুল বিবি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হল তাদের গ্রামের বাড়িতে এরকম রোগীকে ওঝা দেখানো হয়, এটা জ্বীন ভুতের আছর। সেই প্রথম ওঝা এল বাড়িতে। রূপালী বেগমের অভিমান হয়েছিল খুব তার স্বামীর উপর। তাই তিনি ওঝাকে ঘড়ে ঢুকতে দেননি কিন্তু তাতে রটনা হল নিশ্চয়ই এটা জ্বীনের কারবার। ঐ রাতে লন্ড্রি থেকে আয়রন করে আনা কাপড় পড়তে গিয়ে রূপালী বেগম দেখলেন আঁচলের সাথে গাঁথা লন্ড্রির ট্যাগটি কাটা হয়নি। রূপালী বেগম হাতের কাছে কাঁচি না পেয়ে সূতো ধরে টান দিতেই কাপড়ের আঁচলের অল্প একটু অংশ ছিড়ে ফেললেন। মন মেজাজ খারাপ ছিল বলে এটা নিয়ে কোনও আফসোস ও হলনা তার। কিন্তু পরে এটা ঠিকই ধরা পড়ে গেল পারুল বিবির চোখে। পারুল বিবি রটিয়ে দিলো জ্বীন রূপালী বেগমের শাড়ির আঁচল কেটে নিয়ে গেছে। রূপালী বেগম কাউকে কিছু বললেন না। শুধু ভাবলেন পারুল বিবির এরকমের আচরনের কারন কি?

রূপালী বেগম রান্না ঘরে যান। লাভলী মোড়া পেতে দেয়, "আম্মা বসেন"। লাভলীকে  ওর মা মাজেদা লালশাক বাছতে দিয়ে তাল নিয়ে বসে । "বাহ্ আজকের শাক গুলোতো বেশ ভালো, কোনখান থিকা নিছ", রূপালী বেগম মাজেদাকে জিজ্ঞেস করেন।
- ভ্যান থিকা, কাইল একটা কাম হইছে, আফা
- কি হইছে?
- কাইল বাথরুম ধুয়োনের সময় নাকফুলডা পইরা গেছে। খুঁজছি, পাই নাই,দৌড়াইয়া ঘরে আইছি,মাইয়া কয় আমারডা পইরা থাহ,হেরপর হেরডা নাহে দিয়া রাখছি। ডরে মাইয়ার বাপরে কই নাই পনর'শ টাহা দিয়া আইনা দিছিল, কইব এত দামী জিনিসটা রাখতে পারলিনা! মাইয়ারডা নাহে দেলাম নাইলে মুহের দিক চাইয়াই টের পাইব। জিগাইব নাকফুল কই। খেয়াল করে...

মাজেদার কথা৷শুনে ওর মেচতা পড়া মুখটার দিকে চেয়ে থাকে রূপালী বেগম। কথা বলার সময় কেমন উপচে পড়া উৎসাহ, লজ্জার লাল আভা ওর মেচতা পড়া কালচে মুখটাও লুকাতে পারেনা। রূপালী বেগমের চোখের কোল ভিজে যায় ভাবে ওরও মুখের দিকে তাকাবার কেউ আছে অথচ আমার! ভাবেন এটা কি ঈর্ষা! ঈশ্বর কতভাবে কতজনকে কত কি দেন! ঈশ্বরের প্রতি কি ঈর্ষা করলে চলে! রূপালী বেগম মনে মনে বলেন সুখে থাক, এমন আনন্দে থাক। তবে ভাবনা থেকে বের হতে পারেন না, মোড়া ছেড়ে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা হন, নিশব্দে চোখের কোলে জমে ওঠা ক্ষোভ মুছতে মুছতে ভাবেন, একই ঘরে থেকেও কিছু না হয়ে থাকাটা যেমন লজ্জার তেমন অপমানের।

রূপালী বেগম খুব ভালো করে জানেন শাহাদাত হোসেনের কাছে সে কখনও প্রেম ছিলো না, ছিল প্রয়োজন। আজ প্রয়োজনও ফিকে হয়ে গেছে। বৈষয়িক সাফল্য তার অনেক আগেই এসেছে, কিন্তু রূপালী বেগমের সঙ্গ যেদিন সে এড়িয়ে যেতে চাইল সেই দিন থেকেই রূপালী বেগম মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন নিজেকে আলাদা করে ফেলবার। পারুল বিবির সাথে তার নিজেকে কোনো প্রতিযোগীতায় বসাতে ইচ্ছে হয়নি। কষ্ট হয়, কষ্ট হবেনা কেন মনের মধ্যে হাহাকার চলে চব্বিশ ঘণ্টা। আর শরীরের যন্ত্রণা, সেতো কাঁটার মত গলার মধ্যে বেঁধে থাকে, তারপর একসময় কাঁটাটাকেই স্বাভাবিক সত্য বলে মনে হয়।

জানালায় তাকান রূপালী বেগম, আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেছে, যে কোন সময় বৃষ্টি হবে। মনে পড়ল দোতালার বারান্দায় তার নতুন শাড়ি শুকোতে দেয়া আছে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট্ট কাঁচিটা বের করে কোমরে গুঁজে নিয়ে দোতালায় উঠতে যাবে অমনি সিঁড়ির মুখেই পারুল বিবির সাথে তার দেখা হয়। পারুল বিবিকে কেমন অপ্রস্তুত মনে হয়, যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। রূপালী বেগম টের পেলেন শাহাদাৎ হোসেন দোতালায় আছেন।  উপরে উঠতে উঠতে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন পারুল বিবি সিঁড়ি গোড়ায় তখনও দাড়িয়ে । রূপালী বেগম দোতালায় তার রুমে না গিয়ে সোজা ছাদে চলে যান। রেলিং ধরে দাড়াতেই একঝাঁক পায়রা তার সামনে থেকে উড়ে যায়। রূপালী বেগমের পায়রা হতে খুব ইচ্ছে হয়। নীচে হৈচৈ এর আওয়াজ শুনে তাকাতেই দেখেন পাড়ার ছেলেরা তার গাছের জাম্বুরা পাড়ার জন্য একসাথে হয়েছে, ওরা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলবে। অন্য যে কোন দিন হলে এতক্ষনে পারুল বিবির হাঁক ডাক শোনা যেত, আজ সব নিশ্চুপ। রূপালী বেগমের হাতের নাগালেই একটা জাম্বুরা, সেটা ছিড়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতেই ছেলেদের মধ্যে আনন্দের বন্যা। রূপালী বেগমের এমন বাধঁন হারা আনন্দ পেতে ইচ্ছা করে। রূপালী বেগম কিছুক্ষন উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে ঘোলাটে আকাশের দিকে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়। হঠাৎ কি মনে করে কোমড়ে গোঁজা কাঁচিটা দুরে ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি আর মনে মনে বলেন, আর আঁচল কাটবনা, কোনোও জ্বীন না, নিজের মত বাঁচব এবার, এতে যদি সংসার থেকে কিছু আগাছা উপরে ফেলতে হয় তাই হবে, সাহস নিয়ে সামনে দাঁড়াব। রূপালী বেগম লাভলীকে ডাক দিয়ে বলেন, "বৃষ্টি আসছে, লাভলী বারান্দার কাপড় তোল..." তারপর নীচে নেমে আসেন ধীরে, ধীরে, তার স্বাভাবিক চলনের থেকেও অনেকটাই ধীরে।

কিছুক্ষন পরে লাভলী উত্তজিত হয়ে ঘরে ঢোকে, "আম্মা, আম্মা আইজ আপনার শাড়ী জ্বীনে কাটে নাই, আমি শুকাইতে দেওনের সময়ে আয়াতুল কুরসী পইরা ফুঁ দিছিলাম!"


রূপালী বেগম লাভলীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। হঠাৎ বাতাসে জানালার পর্দা বেশ অনেকখানি উড়ে যায় আর সেই সাথে ঘরে ঢুকে পড়ে একরাশ এলাচি ফুলের গন্ধ। আজ মনে হয় মিষ্টি গন্ধটা একটু বেশীই নাকে লাগছে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top