সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

রাস সুন্দরী দেবী: এক ব্যাতিক্রম নারী চরিত্র : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
১৪ অক্টোবর ২০২০ ২০:১৬

আপডেট:
১৪ অক্টোবর ২০২০ ২২:১১

ছবিঃ রাস সুন্দরী দেবী

 

রাস সুন্দরী দেবী বাংলা সাহিত্যের এক ব্যাতিক্রম নারী চরিত্র। গ্রামের সহজ সরল আট পৌড়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত নারীরা,নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থা কথা সে সময়ে ছিল ভাবনার বাইরে,ছিল না শহরের সঙ্গে কোনও আত্মীকতা, না ছিল সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান। তবু ও সেই সময়ে তিনি সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় "আমার জীবন" নামে দুই খণ্ড আত্ম জীবনী রচনা করেছিলেন। সালটা ছিল ১৮৭৬ । যা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম আত্মজীবনী। বলাবাহুল্য তিনি ছিলেন আত্মজীবনী কাহিনীর প্রথম পথ প্রদর্শক, বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ভাবতে কেমন অবাক লাগে তাই না? বর্তমান এই সময়ে ও দাঁড়িয়ে নারী জীবনে হাজারো প্রতিবন্ধকতা, আজও হাজার হাজার নারীদের আত্মহত্যা করতে হয় কুসংস্কারের গণ্ডির মধ্যে দিয়ে, আধুনিকতায় মোড়া সমাজ ব্যবস্থা প্রাচীন কুসংস্কারের মধ্যে দিয়ে আষ্টে পিষ্টে বন্দি, তখনতো না ছিল নারী শিক্ষা ব্যবস্থা না ছিল জ্ঞানের আলো। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য এক নারী হিসাবে সমাজে তিনি আত্ম প্রকাশ করেন।যা প্রশংসার দাবি রাখে।

প্রাচীন বঙ্গের প্রত্যন্ত পাবনার পোতামিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাস সুন্দরী দেবী। ১২১৬ বঙ্গাব্দর চৈত্র মাসে (১৮১০ইং)। পিতা পদ্ম লোচন রায় মারা যান খুব ছোট্ট বেলায় তাই তিনি তার মা ও নিকট আত্মীয়দের দ্বারা প্রতিপালিত হন। ১২ বছর বয়সে তিনি ফরিদপুরের রামদিয়া গ্রামের রাজবাড়ির নীলমনি রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি একজন বৈষ্ণব ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন। সীমিত আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে, তিনি ভক্তি (নিষ্ঠা) দ্বারা চালিত হয়ে পড়তে শেখেন, তার প্রখর ইচ্ছা হইতে বাল্মীকি পুরাণ ও চৈতন্য ভাগবত পড়তেন। তিনি ১২ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ জন জন্মের কিছু দিনের মধ্যে মারা যান। এতগুলো সন্তান হওয়ায় এবং তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কারণে অসংখ্য মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। তার সাতটি সন্তানের মৃত্যু হয় চোখের সামনে। এছাড়া স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি, হারিয়েছেন নাতি-নাতনিদেরও। এই সব প্রিয়জনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা কতখানি দুঃসহ শোকের তা ফুটে উঠেছে তার লেখনিতে। তার বেঁচে থাকা সন্তানেরা হলেন বিপিন বিহারী সরকার, দ্বারকনাথ সরকার, কিশোরী সরকার, প্রতাপচন্দ্র সরকার এবং শ্যামসুন্দরী। তার স্বামী ১৮৬৮ সালে মারা যান। তার ছেলে কিশোরী সরকার কলকাতা হাইকোর্টের একজন আইনজীবী হয়ে ওঠে এবং বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের লেখক।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা আজও নারী শিক্ষা প্রসারে জনপ্রিয় তা অর্জন করলে ও মানসিকতায় আসেনি পরিবর্তন। উনিশ শতকে নারীদের নিয়ে বহু আন্দোলন করে গেছেন মণীষীরা, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হল বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ। নারীর অবস্থান কিছুটা সমাজে রক্ষণাবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন তা না হলে আজও নারীর জীবন রয়ে যেতো পর্দার আড়ালে।. কিন্তু সঠিক পথের দিশা আজও হয় নি।

অজ পাড়া গাঁয়ে এক বিশাল সংসারের ঘানি টেনেছেন। দেয় নি কেউ তাকে বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তা সত্বেও নিজের প্রচেষ্টায়, বহু কষ্টে সব কিছু বজায় রেখে ও  বিদ্যার্জন করেছিলেন। কথায় বলে যদি কেউ সঠিক পথে পরিশ্রম করেন তা বিফলে যায় না, তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোনো কাজে সফল হওয়া যায় না, তিনি সেই যুগে ও পড়াশোনা শিখে আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন একেবারে নিজের প্রচেষ্টায় আর এই আধুনিক যুগে, যেখানে হাতের তালু বন্দি বিশ্ব সেখানে নারী শিক্ষার অগ্রগতি কিন্তু তেমন ভাবে প্রসার হয়নি, নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, নানা প্রযুক্তি শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠলে ও কিন্তু মানসিকতায় কিছুটা পিছিয়ে আছে।

তিনি গোপনে পড়ার সাথে সাথে লেখা শিখলেন, তারপর ষাট বছর বয়সে অত্যন্ত সাবলীল ও সতেজ বাংলা ভাষায় লিখে ফেললেন নিজের আত্মজীবনী।পরবর্তীতে ৮৮ বছরে তার দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করেছেন। কতোটা দৃঢ় মানসিকতা থাকলে,কতটা ধৈর্য থাকলে তবেই এই বয়সে এমনে মাইল ফলক স্টোন পৌঁছানো যায়। কারণ এই সময়ে এক তরুণ বা তরুণী মানসিকতায় বৃদ্ধ হয়ে যায় সেখানে তিনি প্রায় মৃত্যুর দুয়ারে খুব কাছাকাছি থেকে ও এমন অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী প্রথম প্রকাশিত হয়।

এই অত্যাধুনিক যুগে ও সমাজে নারী ও পুরুষ দুটি শ্রেণীতে বিভাজন করা হয় আজও, নারীদের ভোগ্য, পন্য, আমদানি, রপ্তানি, বিলাস বহুল চিহ্ন স্বরূপ ধরা হয় সেক্ষেত্রে রাস সুন্দরী দেবীর এহেন প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে তা বলা বাহুল্য, কারণ তখন কার সময় নারী শিক্ষা তো দূরের কথা তাদের পর্দার আড়ালে থাকতে হতো, বাইরে বেরোনোর কোন সুযোগ ছিল না, খুব অল্প বয়েসেই দিয়ে দেওয়া হতো বিয়ে যার অর্থ তারা জানত না,  সে সময়ে নারী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবা হয় নি। সে সময়ে ছেলেরা মাটিতে দাগ কেটে কেটে পড়া লেখা করত। তিনি তা দেখতে দেখতে  মনে মনে পড়া শিখে ফেলেন। সেই সময়ে ফার্সি ভাষা ও শিখে ফেললেন একই ভাবে। তিনি কোনও রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নি। তবে অবশ্য বাংলা স্কুল তাদের বাড়িতে ছিল, এক মেম সাহেবের কাছে তিনি গোপনে পড়া শুনা শিখে নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্কুলটিতে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে গেলে তা চির তরে বন্ধ হয়ে যায় তার সাথে সাথে তার ও বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

তার এই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গ্রাম বাংলার কুসংস্কারবিদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার কথা। গৃহে আবদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা বঞ্চিত নারীর নিগৃহীত জীবনের করুণ বিবরণ। এটা শুধু একজন নারীর পিঞ্জরে বন্ধ জীবন কাহিনী নয় হয়ে উঠেছে ইতিহাসের প্রামাণ্য জীবন্ত দলিল। কীভাবে এই আট পৌড়ে ভাষায় লেখা গ্রন্থ পরবর্তী ইতিহাসে অসামান্য দলিল হয়ে উঠল তা বোধগম্য বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায় গুলবদন বেগম যখন হুমায়ুন নামা লিখেছিলেন, সে সময়ে তেমন কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে নি। কিন্তু বর্তমানে এই সব জীবন্ত দলিল ইতিহাসবিদদের কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের লেখনীতে কোন অলঙ্কার নেই, কৃত্তিম জাঁকজমকপূর্ণ ভাষার চিহ্নমাত্র ছিলনা। সহজ সরল ভাষায় উঠে এসেছে এক চরম বাস্তবতা। চোখের সামনে যা দেখেছেন যা শুনেছেন তা সততার সাথে তুলে ধরেছেন। তাই রাস সুন্দরী দেবীর এই গ্রন্থটি একই ধারার সামঞ্জস্য বর্তমান। আর সেই জন্যে এই জীবনী গ্রন্থটি সমাজ দর্পনে অসামান্য এক দলিল প্রমাণ হিসাবে আজ এতদিন পরে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। বইটি পড়ে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র  নাথ ঠাকুর । গ্রন্থের ভূমিকা তার সেই মুগ্ধতার কথা লিখেছিলেন তাঁর লেখনীতে।

এ সময়ে আরো রক্ষণশীল ধারায় বইছে সমাজের চাল চিত্র। আধুনিকতায় মোড়া সভ্যতা তবে সে কাল আর এ কাল পার্থক্য শুধু ধ্যান ধারণায়। তখন মেয়েরা পড়াশুনা করতে পারত না। মেয়েরা সংসারের কাজ কর্ম করবে, সবার সেবা যত্ন করবে, বাইরে কাজ কর্ম করার কথা স্বপ্নে ও ভাবতে পারতেন না। বিশেষ করে নিয়ম ছিল যে বাড়ির বউ হাত খানেক ঘোমটা দিয়ে ঘরের মধ্যে বন্দি থাকবে, কারো সাথে কথা বলা যাবে না, তবেই হত ভালো বউ।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান, জল স্থল, অন্তরীক্ষে। প্রাচীন যুগে খনা, গারগী, মৈত্রেয়ী, বর্তমানে মেরিকম, পি টি ঊষা, ঝুলন গোস্বামী, সাইন নেহাওয়াল, কল্পনা চাওলা, দীপা কর্মকার এমনে বহু মহিয়সীরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে, তবু ও পরিবর্তন হয় নি রক্ষণশীল সমাজের বস্তা পচা চিন্তা ধারা। আজও এ সমাজে কন্যাভ্রুন কে পৃথিবীর আলো হতে বঞ্চিত করা হয়, এখনো নারীদের পণ প্রথার আগুনে আত্মাহুতি দিতে হয়। নারী ও শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। ধর্ষণ হলো এই সমাজের বাস্তব চিত্র। তবে সে দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় রাস সুন্দরী দেবী ছিলেন দুই মধ্যবর্তী  সময়ের ব্যতিক্রমী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। 

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top