সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ফররুখ আহমদের কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্য : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০২০ ২১:২৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:২৭

ছবিঃ ফররুখ আহমদ

 

ফররুখ আহমদকে ইসলামি রেনেসাঁর কবি বলা হয়। কিন্তু সাহিত্যবিচারে তাঁর কবিতায় শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হয়নি। বাংলাসাহিত্যে হাতেগোনা কয়েকটি সফল মহাকাব্য রয়েছে ফররুখের ‘নৌফেল ও হাতেম’ অন্যতম। কবির বেশ কিছু ছড়া আমাদের মানসপটে প্রোথিত হয়েছে। কবিতায় অলংকার প্রয়োগে সফলতার পরিচয় পাওয়া যায়। সবকিছু মিলিয়ে তাঁর কবিতায় ভিন্ন একটা আমেজ পাওয়া যায়। কবিতায় আলাদা এক জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ পথচলায় তিনি যথেষ্ট সফলও।

কবি ফররুখ আহমদের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২)। সনেট ও গদ্য কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি ফররুখ আহমদ। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য মেঘনাদ বধ  মহাকাব্যের পরে অন্যতম সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদ রচিত হাতেম তায়ী(১৯৬৬)। তাঁর নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১) একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। কাব্যনাট্যগুলো: মুহূর্তের কবিতা(১৯৬৩), ধোলাই কাব্য(১৯৬৩)। কাহিনীকাব্য: নতুন লেখা (১৯৬৯), কাফেলা (১৯৮০), হাবিদা মরুর কাহিনী (১৯৮১), সিন্দাবাদ (১৯৮৩), দিলরুবা (১৯৯৪)। গীতিনাট্য: আনার কলি (১৯৬৬)। শিশুতোষ গ্রন্থ: পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), চাঁদের আসর (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০), ফুলের জলসা (১৯৮৫) ইত্যাদি। কবি ফররুখ আহমদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও আলোচিত কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি । এখানে মুসলমানদের গৌরবের কথা যেমন বলা হয়েছে; আবার তাদের অধঃপতনের কথাও বলা হয়েছে। ইসলামি ঐতিহ্য ও আরবি-ফারসির প্রচুর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

‘রূপক’ কবিতা রচনায় কবি ফররুখ আহমদ শক্তিমত্তার প্রমাণ রেখেছেন। ‘পাঞ্জেরি’ অন্যতম জনপ্রিয় রূপক কবিতা। ‘সাতসাগরের মাঝি’ও অন্যতম রূপক কবিতা। পাঞ্জেরি বা মাঝিকে ত্রাণকর্তা হিসাবে দেখেছেছেন। জাতির সংকটে নেতৃত্বের প্রতি আহ্ববান ছিল। যেমন-

(১) ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?/সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?/তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;/অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।/রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে/কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?...ও কি দরিয়ার গর্জন-ও কি বেদনা মজলুমের!/ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুরজয়ভেরী।/পাঞ্জেরি!’-(পাঞ্জেরি)

(২) ‘কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা।/নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।/দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।/তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না?/ সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকো জাহাজ,/অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ...সকাল হয়েছে। তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?/তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,/যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,/যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি/পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলে বকাওলি?/ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চলেছে ভেসে /অজানা ফুলের দেশে,/ভুলেছ কি সেই জমরুদ তোলা স্বপ্ন সবার চোখে/ঝলসে চন্দ্রলোকে,/পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি,/অশ্রান্ত সন্ধানী।(সাত সাগরের মাঝি)

(৩) ‘মন মোর আসন্ন সন্ধ্যার তিমি মাছ-/ডুব দিল রাত্রির সাগরে।/তবু শুনি দূর হ’তে ভেসে আসে-যে আওয়াজ/অবরুদ্ধ খাকের সিনায়।/সূর্য মুছিয়াছে বর্ণ গোধুলি মেঘের ক্লান্ত মিনারের গায়,/গতি আজ নাইকো হাওয়ায়/নিবিড় সুপ্তির আগে বোঝে না সে শান্তি নাই তমিস্রা পাথারে।...মনের দিগন্তে মোর চমকায় সহস্র অশনি।/শুনি আকাশের ধ্বনি:/তোমার দুর্ভাগ্য রাত্রি মুক্ত পূর্বাশার তীরে/হয়েছে উজ্জ্বল,/তোমার অরণ্যে আজ পুরাতন বন¯পতি/ছাড়িয়াছে বিশীর্ণ বল্কল।/...আকাশে উধাও ডানা, ছেড়ে যায় পুরাতন লুণ্ঠিত মিনার/ছেড়ে যায় আকাশের বর্ণ বিভা, দিগন্ত কিনার;/বন্দীর স্বপ্নের মত বাঁধামুক্ত মন; -মোর মন’। (মন, সিরাজাম মুনীরা)

‘চিত্রকল্প’ নির্মাণে ও অলংকার প্রয়োগে কবি ফররুখ আহমদ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ফররুখ আহমদের কবিতায় উপমা-উৎপেক্ষার যুতসই ব্যবহার দেখতে পাই। বিভিন্ন অলংকার ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। যদিও তিনি ইসলামি-ঐতিহ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষার বহুল চর্চা দেখা যায়। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি।

(১) দেখ আসমানে ফোটে সিতারার কলি/আরশির মত নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকগুলি।
(২) ঘন সিন্দোল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেহুঁশ/হাতির দাঁতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আবলুস/নামে নির্ভীক সিন্ধু-ঈগল দরিয়ার হাম্মামে। (সিন্দবাদ)
(৩) ইরানী ছুরির মত তীক্ষ্ণধার হাওয়া উত্তরের/বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস (মুহূর্তের কবিতা)
(৪) বর্ষার বিষন্ন চাঁদ, বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে, অস্ফুটে ব্যথার মৃদু স্বর আছে এ আকাশে (বর্ষার বিষন্ন চাঁদ)
(৫) এইসব আঁধারের পানপাত্র, র্মমর নেকাব,/ছাড়ায়ে হীরার কুচী জ্বলিতেছে জুরেখার খা’ব,/লায়লির রঙিন শারাব। (এই সব রাত্রি)
(৬) সফেদ পালক চমকে বিজুরী, চমকে বর্ণধেনু,/সোনালি, রূপালি রক্তিম রংগিন। (আকাশ-নাবিক)
(৭) ‘সমুদ্র-সিনা ফেড়ে ছুটে চলে কিশতী, কালো আকীকের মত এ নিকষ দরিয়ার বুক ছিঁড়ে (সিন্দাবাদ), সূর্য আজ ডুব দিল অক্সাসের তটরেখা পারে (স্বর্ণ-ঈগল)
(৮) শারিয়ারের নীল আকাশের সিতারা করে বিলাপ (শাহরিয়ার)
(৯) রক্তমনির চেয়েও লাল সুনভিত/একটি তাজা রক্ত গোলাপ; (ব্যতিরেক অলংকারের প্রয়োগ, ঝরোকা)
(১০) ‘গোধূলি-তরল সেই হরিণের তনিমা পাটল/-অস্থির বিদ্যুৎ, তার বাঁকা শিঙে ভেসে এল চাঁদ, এ দিকে হরিণ আনে বাঁকা শিঙে চাঁদ, সূর্যাস্তের অগ্নিবর্ণ সেহেলির বিমুগ্ধ স্বপনে, তারার সেনালি ফুল ছিটে পড়ে রাত্রির অঙ্গনে।।’-(বন্দরে সন্ধ্যা)
(১১) সাত মানাতের সরে নাচে পিশাচ /আধো জীবন্ত তনু;/ রং চটা তার আকাশে কখন নিজেহে বর্ণধনু।/ সে সিঁদরাতুল-মুনতাহার /পথ লোলা বুলবুলি(নিশান-বরদার)

নিচুশ্রেণিকে দলে উঁচুতে ওঠে সুবিধাবাদীরা। কাজী নজরুলের অনেক কুলি ও মজুর, মানুষ প্রভৃতি কবিতায় বজ্রবিদ্রোহ দেখি। সময়কে অস্বীকার না করে অনেক কবিই এরকম অসঙ্গতি তুলে ধরে লিখেছেন। রবীন্দ্র থেকে সুকান্ত- সবাই। কবি  বলেছেন-‘আজকে ওমর পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন/পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণ-পণ,/উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা/দিক-দিগন্তে তাদের খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা!/যাদের হাতের দোর্রা অশনি পড়ে জালিমের ঘাড়ে,/যাদের লাথির ধমক পৌঁছে অত্যাচারীর হাড়ে...’। কবি ফররুখ আহমদও লিখলেন আরও এমন কিছু চরণ; তার কিছু কবিতাংশ তুলে ধরি-

(১) ‘জনতার সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ্বে উঠি অতি অনায়াসে/তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে। (লাশ/ সাত সাগরের মাঝি)
(২) ‘মানুষের হাড় দিয়ে করেছো এ নগর পত্তন/মরুভ‚মি হল বন, মরুভ‚মি মানুষের মন’ (পোড়ামাটি)।
(৩) ’পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে/ সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর/সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।/প’ড়ে আছে মৃত মানবতা /তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।/আকাশ অদৃশ্য হ’ল দাম্ভিকের খিলানে, গম্বুজে...শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,/ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার/,মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;/ সাক্ষ্য তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর পর।/ স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা/এ পাশবিকতা, /শতাব্দীর ক্রূরতম এই অভিশাপ/বিষাইছে দিনের পৃথিবী।/রাত্রির আকাশ।...তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি/নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি;/ আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;/ ধ্বংস হও তুমি ধ্বংস হও।।’ (লাশ)

ফররুখ আহমদকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি বলা হয়। কিন্তু তাঁর কবিতায় মানবিকতা মূখ্য হিসাবে ধরা দিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোমান্টিসিজম জেগে উঠেছে। কবি আবু রুশদের ভাষায়, ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি।...তাঁর কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ। সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তাঁর কাব্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবু তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক কবি। তাঁর একটি বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষè অনুভ‚তিশীল মন আছে, যা সৌন্দর্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করার সাহস রাখে; কিন্তু রোমান্টিসিজমের বিপদ স¤পর্কে যা সর্বদা সচেতন’। আরও কয়েকটি কবিতাংশ-

(১) ‘শুনেছিলাম স্বপ্নঘোরে তোমার নাম,/ছুঁয়েছিলাম কেশরাশি, অলকদাম,/হাজার রাতের কথায় তোমার জেগেছে ভয়;/তোমায় হারাই চিত্ত আমার শংকাময়,/পুরানো চাঁদ দেখি দ্বারে চির নূতন,/চ¤পা হয়ে ফোটে আমার বিস্মরণ,/প্রাচীন কথায় গাঁথা তোমার নতুন মালা/চির-নতুন পূর্ণিমা ওই চাঁদের থালা;/তোমার প্রেমের জাফরানে আজ সব রঙিন/শাহেরজাদী! বিদায়, দেখ জাগছে দিন।।’ (বিদায়, হে বন্য স্বপ্নেরা)

(২) ‘কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিল বিকল–/সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,/অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল/গলানো ই¯পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বারবার।/...আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়াপাড়াতে।/দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;/উজ্জ্বীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;/কাঁচড়াপাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।/(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে/কাঁচড়াপাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।।’(কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি, হে বন্য স্বপ্নেরা, প্রথম প্রকাশ: সওগাত, ১৯৪১ খ্রি.)। এখানে কলকাতার নিকটবর্তী রেল শহর কাঁচড়াপাড়ার শ্রমিক-নাগরিকের আশা-হতাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

(৩) ‘দুনিয়া: সেই উজ্জ্বল আসমানি শামিয়ানা/লুকালো কোথায়, হয়নি আমার জানা।/আসমান: ছিলাম যেখানে, আছি আমি সেখানেই।/পাই না তোমাকে; তোমারি তো দেখা নেই।/দুনিয়া: দু’চোখে আমার মৃত্যুর কালো আঁধি।/আসমান: হিম কুয়াশায় বন্দিনী শাহজাদী।।’ (শীতরাত্রির আলাপ, তসবিরনামা)

‘তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে’(পাঞ্জেরি),‘হামাগুড়ি দিয়ে কারা চলে ঐ পতাকীদল?’(হে নিশান-বাহী), ‘ডানা-ভাঙা আজ সে ধুলায় যায় তারে পায় ঠেলে’(স্বর্ণ-ঈগল), ‘কেটেছে রঙিন মখমল দিন’(সিন্দাবাদ), ‘বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল’(সাত সাগরের মাঝি), ‘উচ্ছৃঙ্খল রাতের ভুলের আজ বুঝি শেষ নাই’(শাহরিয়ার)- এমন সব রূপক/চিত্রকল্প বা উপাদান ব্যবহার করে মুসলিম জাতির দুর্বলতা বা অনৈক্য প্রকাশ করেছেন। তাদের সোনালি দিনে কালোমেঘের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। কবি এসব দেখিয়ে দিয়ে জাতিকে গৌরব পুনরুদ্ধার করার জন্য বলেছেন।  আরও কিছু উদাহরণ-

(১) ‘সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ার শাদা তাজী।/খুরের হল্কা,- ধারালো দাঁতের আঘাতে ফুরইক জ্বলে/সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ার শাদা তাজী।’-(বার দরিয়ায়)
(২) ‘সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও/খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।/আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো/আর উচ্ছল আনন্দের মত/বাগে এরেমের এক ঝাঁক মৌমাছি...’ (ঝরোকা)
(৩) ‘কোন প্রকৃতির কাছে আজ ওরা পড়িয়াছে বাধা/গোলাপের পাপড়িতে ছুঁড়িতেছে আবর্জনা, কাদা/কোন শয়তান?/বিষাক্ত কামনা দিয়ে কে ভরায় আকাশের রঙিন খিলান?’(লাশ/সাত সাগরের মাঝি)
(৪) ‘দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?/কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভির,/হে মাঝি! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,/নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির... তবু শুনবে কি, তবু শুনবে কি সাত-সাগরের মাঝি/শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;/এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর,/এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গী বন্দর/এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,/ক্ষুধির শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।/আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,/ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,/ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,/তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।’-(সাত সাগরের মাঝি)
(৫) ‘ভেঙে ফেল আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ/দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাধ,/ছিড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ/নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ।’ (সিন্দাবাদ/সাত সাগরের মাঝি)। কবি ফররুখ আহমদ ডুবে যাওয়া জাতিতেও আশা দেখছেন। মাঝি হিসাবে যোগ দিতে আহŸবান করছেন। অনুপ্রাণিত করছেন এভাবে, ‘এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে/তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ তোরণ/এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠেছে কেঁপে/এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে/তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ তোরণ’-(সাত সাগরের মাঝি)।

ফররুখ আহমদের ‘‘ঝুমকো জবা’’ ছড়াটি আমরা কে না পড়েছি: ‘ঝুমকো জবা বনের দুল/উঠল ফুটে বনের ফুল।/সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,/ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।/সেই দুলুনির তালে তালে,/মন উড়ে যায় ডালে ডালে’। আর একটি বহুল পঠিত ছড়া হচ্ছে-বৃষ্টির ছড়া । এ ছড়া-কবিতাটি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে: ‘বিষ্টি এল কাশ বনে/জাগল সাড়া ঘাস বনে,/বকের সারি কোথা রে/লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।/নদীতে নাই খেয়া যে,/ডাকল দূরে দেয়া যে/...মেঘের আঁধার মন টানে,/যায় সে ছুটে কোন খানে/,আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে/আমন ধানের দেশ পানে’। তিনি বেশ কিছু  শিশু-কিশোর কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর রচিত অন্যান্য কাব্য-কবিতার তুলনায় শিশু-কিশোর ছড়া-কবিতার ওপর খুব কম আলোচনা হয়েছে। তাঁর রচিত শিশু-কিশোর কাব্যের সংখ্যা মোট ২১টি। প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যা ৭ টি। কবির বেঁচে থাকাকালীন প্রকাশ হয়েছে ৪ টি ছড়ার গ্রন্থ। অন্যান্যগুলো অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ-পাখির বাসা(১৯৬৫), হরফের ছড়া(১৯৭০), চাঁদের আসর(১৯৭০), ছড়ার আসর(১৯৭০), ফুলের জলসা(১৯৮৫)। কবির প্রথম শিশুতোষ বই পাখির বাসা। এখানে সাতটি অনুচ্ছেদে ভাগ করে মোট পয়ত্রিশটি ছড়া-কবিতা  আছে। ভাগগুলো হচ্ছে- পাখির বাসা, মজার ব্যাপার, পাখ-পাখালি, পাঁচ মিশালী, রূপ-কাহিনী, সিতারা ও চলার গান। পাখির বাসা শিরোনাম অধ্যায়ে আছে পাখির বাসা, ঘুঘুর বাসা, বকের বাসা, প্যাঁচার বাসা, গাঙ শালিকের বাসা, বাবুই পাখির বাসা, চড়ুই পাখির বাসা ইত্যাদি ছড়া-কবিতা।

ফররুখ আহমদ গীতিকার হিসাবেও সফল। কয়েকটি জনপ্রিয় ইসলামি গান: (১) দ্বীন দুনিয়ার সাথী আমার নূরনবী হয়রত..., (২) শুনেছি এ বাণী পথে ঊষার,/ মান একতা শৃঙ্খলার।, (৩) তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে/খোদা  ছাড়া, (৪) চাঁদ ছিল জেগে রাতের মিনারে প্রভাতের কিনারা। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘মধুর চেয়ে মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা’  গানটি বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য গানটি: ‘ডালে ডালে পাখীর বাসা/মিষ্টি মধুর পাখীর ভাষা/সাত সাগরে নদীর বাসা/কুলুকুলু নদীর ভাষা।/হাজার সুরে হাজার ভাষায়/এ দুনিয়া ঘেরা/আর মাতৃভাষা বাংলা আমার/সকল ভাষার সেরা’। শিশুদের জন্যও তিনি অনেক গান রচনা করেছিলেন। বিপুল কাব্যপ্রতিভার অধিকারী ফররুখ আহমদ ১৯৬০ সালে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’(মরণোত্তর) ও ১৯৮০ সালে তাঁকে  মরণোত্তর  ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়। এছাড়া ১৯৬৫ সনে ‘প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৬৬ সালে ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ পান।

কবি ফররুখ আহমদ কবিতার স্বর  ভিন্ন ও শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।  এজন্য বিভিন্ন কবি ও সমালোচকের অকুণ্ঠ প্রসংসাও পেয়েছেন। ধর্মীয় শব্দাবলির প্রাচুর্যতার মধ্যেও শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারাটাই ফররুখের কৃতিত্ব। কবি ফররুখ আহমদের কবিতায় ইসলামী ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। বহু আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। তবে কবিতার শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হয়নি। এক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের ফররুখ নিয়ে একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য বলি মনে করি। তিনি লিখেছেন, ‘তিনি(ফররুখ আহমদ)মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়। না, ভুল বললাম, নিঃস্ব কথাটা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর মানসিক ঐশ্বর্যের কোনো কমতি ছিল না। তিনি রেখে গেছেন এমন কয়েকটি গ্রন্থ, যেগুলো পঠিত হবে দীর্ঘকাল’।বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় মারা যান।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top