সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ঈশ্বরচন্দ্রের পরার্থপরতা ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা : শান্তনু কুমার


প্রকাশিত:
১৭ অক্টোবর ২০২০ ২০:৫৮

আপডেট:
১৭ অক্টোবর ২০২০ ২১:১৭

ছবিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। লখনৌ ক্যানিং কলেজে সংস্কৃত পড়াবার দায়িত্ব নিয়ে যাত্রাপথে অসুস্থ শরীরে দু-একদিনের জন্য সাময়িক বিশ্রাম নিতে যুবক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এসেছেন বিদ্যাসাগরের কর্মাটাঁড়ের বাগানবাড়িতে। 'কর্মাটাঁড়' অর্থে এখানে একসময় 'করমা' নামে জনৈক মাঝির 'টাঁড়' বা উঁচু জমি ছিল যা বন্যাতেও ডুবে যেত না। ছোটনাগপুরের এই টাঁড় অঞ্চলে প্রায় তিন একর জায়গা কিনে বিভিন্ন ফল ফুলে সম্মৃদ্ধ একটি বড় বাংলোয় বিদ্যাসাগর জীবনের শেষ ১৮ বছরের প্রায় অনেকটা সময়ই বাস করেছিলেন, শান্তি খুঁজেছিলেন সেখানকার হতদরিদ্র সাঁওতালদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। 

হরপ্রসাদ দেখলেন, সাত সকালেই একজন সাঁওতাল ৫-৬টি ভুট্টা নিয়ে হাজির। 'ও বিদ্যেসাগর, তুই আমার এই ভুট্টা ক'টি নিয়ে পাঁচ গণ্ডা পয়সা দে নইলে ছেলেটার চিকিৎসা হবে না'---বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ সেই পয়সা দিয়ে ভুট্টাগুলি নিয়ে নিলেন। এরকম অনেকেই এসে  ভুট্টা বিক্রি করে গেল, বিদ্যাসাগরও বিনা দরদামেই  কিনে কিনে ঘরের তাকগুলো ভর্তি করে ফেললেন। হরপ্রসাদ বললেন, এত ভুট্টা নিয়ে আপনি কি করবেন? বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন 'দেখবি রে, দেখবি।' 

এরপর বেলা বাড়তেই অভুক্ত সাঁওতালেরা দলে দলে সেখানে হাজির হল--- 'ও বিদ্যেসাগর, আমাদের কিছু খাবার দে।' হরপ্রসাদ দেখলেন   বিদ্যাসাগরের ঘরের তাকে দু-একরকম মিষ্টান্ন আছে। বিদ্যাসাগরকে তিনি বললেন, ওই মিষ্টান্ন থেকে কিছু ওদের দিন না। বিদ্যাসাগর স্মিত হেসে বললেন, আরে দূর, ওরা কি ওর স্বাদ জানে না রস জানে! ওদের দিলে ওরা টপাটপ খেয়ে নেবে, খাবার হলেই হল, ভালো মন্দ কিছু বোঝে না। এ খাবারের জন্য এক ক্রোশ দূরে কোরা গ্রামের কিছু লোকজন আছে। ভালো খাবার দিলে এক কামড় দিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবে কোথাকার খাবার, কি কি আছে এর মধ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝি, ওদের জিভ আছে। বিদ্যাসাগর তাক খালি করে প্রত্যেককে ভুট্টা দিলেন। শুকনো ডালপাতায় আগুন ধরিয়ে সেগুলি সেঁকে নিয়ে তারা গোগ্রাসে খেতে লাগল। এ যে তাদের নিত্য পরমান্ন ! হরপ্রসাদের সামনে এবার সকালে ভুট্টা কেনার রহস্য উন্মোচিত হল। এরপর বিদ্যাসাগর হঠাৎই উধাও হলেন। হরপ্রসাদ ভাবলেন এই ভরদুপুরে ঠা ঠা রোদে পণ্ডিতমশাই গেলেন কোথায় ! বেশ কিছুক্ষণ পরে তাঁকে দেখা গেল চাষির আলের ক্ষেত ধরে ফিরছেন, হাতে একটা বাক্স নিয়ে। হরপ্রসাদ শুধোতে বিদ্যাসাগর বললেন, এক সাঁওতাল ছেলের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল বলে ওর মা আমায় ডেকে পাঠাল, আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে ওর রক্ত পড়া বন্ধ করলাম---- আমার এটুকু দেরী হওয়ার জন্য তুই কিছু মনে করিস না হরপ্রসাদ।

যে দুটি বড় কারণে বিদ্যাসাগর শহর থেকে দূরে নিজেকে সরিয়ে এনেছিলেন তাঁর একটি যদি হয় শারীরিক অসুস্থতা অপরটি নিশ্চিত পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক হেনস্থা। ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্যের উৎসমূলে ছিল এক পথ দুর্ঘটনা। কুমারী মেরী কার্পেন্টার তখন ভারতে এসেছেন স্ত্রীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে। ব্রিস্টলে জীবনের শেষ ক'দিন কুমারী ক্যাসেলের বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন রাজা রামমোহন। সেখানে যাজক কার্পেন্টারের কন্যা মেরী রামমোহনের সান্নিধ্যে আসেন ও তাঁর জীবন দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে ভারতে আসেন বেশ কয়েকবার।  বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ১৮৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর উত্তরপাড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান, বিদ্যাসাগর ছিলেন অন্য একটি ঘোড়ার গাড়িতে। ফেরার পথে বালী স্টেশনের পথের বাঁকে গাড়ি উল্টে গেলে বিদ্যাসাগর রাস্তায় ছিটকে পড়েন ও অজ্ঞান হয়ে যান। মেরী কার্পেন্টার তাঁকে অতি যত্নে কোলে শুইয়ে রুমাল দিয়ে বাতাস দিতে থাকেন এবং জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরান। দুর্ঘটনায়  তাঁর মাথা, লিভারের প্রভূত ক্ষতি হয়, শরীর একেবারেই ভেঙে পড়ে  যা খ্যাতনামা চিকিৎসক বন্ধু মহেন্দ্রলাল সরকারের একান্ত চিকিৎসাতেও ভালো হয়নি।

অন্যদিকে সংস্কৃত প্রেসের অংশীদারিত্ব নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে  অনুজ ভাইয়ের বিরোধ, বিদ্যাসাগরের অসম্মতিতে এবং তাঁকে লুকিয়ে বীরসিংহ গ্রামের এক বিধবার বিয়ে দিয়ে বিদ্যাসাগরকে হেয় করা ---- এসব কাজে লিপ্ত ছিল তাঁর আপন ভায়েরা ও গ্রামের কিছু লোকজন। তাঁর প্রতি নিন্দামন্দ এতটাই ছিল যে প্রায়ই বিদ্যাসাগর ব্যঙ্গ করে বলতেন, ওই লোকটা যে আমার বিরুদ্ধে বলছে, আমি নিশ্চয় ওর কোনো উপকার করিনি। পুত্র নারায়ণচন্দ্রও পিতাকে সুখ দেননি। এ কারণে তিনি চিরদিনের জন্য বীরসিংহ গ্রাম  ত্যাগ করেন। চলে আসেন ফরাসডাঙ্গা, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত বর্ধমান এবং কর্মাটাঁড়। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে পদ্ধতিগত কারণে ঊর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সঙ্গে মতবিবাদও স্বার্থপর শিক্ষিত সমাজের প্রতি বৈরাগ্যের এক অনিবার্য প্রতিফলন।

কর্মাটাঁড়ে দরিদ্র মানুষদের জন্য যে দাতব্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয় গড়ে তুলেছিলেন তার মূলে ছিল বিদ্যাসাগরের ওই চিকিৎসাবিদ্যাটির প্রতি গভীর অনুরাগ এবং শাস্ত্রটির পাঠ ও জ্ঞানার্জন। ফরাসি হোমিওপ্যাথ ডাঃ বারিগ্নি (Dr. Berigni) ও ডাঃ রাজেন্দ্র লাল দত্ত একত্রে হোমিওপ্যাথি  চর্চা শুরু করেন কলকাতায়। ডাঃ দত্তের চিকিৎসায় বিদ্যাসাগরের দীর্ঘকালের মাথার ব্যামো নিরাময় হলে তিনি এই  বিকল্প বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন। শারীরতত্ত্বের খুঁটিনাটি জানার জন্য তিনি মানুষের কঙ্কাল পর্যন্ত কেনেন। এছাড়া তাঁর বিশাল লাইব্রেরিটি অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে হোমিওপ্যাথি বইতেও সম্মৃদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণাগারে যে ডায়েরিটি পাওয়া যায় সেখানে বিদ্যাসাগরের কর্মাটাঁড়ে দু-দশকের অবস্থানকালে প্রেসক্রিপশানের ওষুধপত্তের নাম পাওয়া যায়। সালফার-৩০, ব্রায়োনিয়া-৩০----সেসময় যা নিত্য ব্যবহার হত তা এখনও হয়। হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের উপলব্ধি----ওষুধের উৎকৃষ্টতা, মূল্যের স্বল্পতা এবং সেবনের সুবিধা। এসব দেখে তিনি এই চিকিৎসার প্রচারে ব্রতী হন। বহু বিতর্কের পরে তিনি ও রাজেন্দ্র লাল সেকালের যশস্বী এলাপ্যাথির ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকারকে হোমিওপ্যাথির গুণাগুণ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ডাক্তার সরকার হাতে কলমে এর সুফল উপলব্ধি করে এলাপ্যাথি বর্জন করে এই বিকল্প চিকিৎসাশাস্ত্রকেই শিরোধার্য করেছিলেন।

দেশের দুঃস্থ জনগণের চিকিৎসার জন্য বিদ্যাসাগরের আরাধ্য বিকল্প বিদ্যাটি ছোটোভাই ঈশানচন্দ্রকেও আকৃষ্ট করে। ঈশানচন্দ্রের মৃত্যুর পর চিত্তরঞ্জনের কাছে মিহিজামে পুত্র পরেশ নাথ, কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে পৌত্র প্রশান্ত,  প্রপৌত্র প্রতীপ---এঁরা বংশ পরম্পরায় প্রচলিত ধারার বাইরে দেশে বিদেশে বহু গবেষণার মাধ্যমে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করেছেন বা করছেন যা 'ব্যানার্জী প্রোটোকল' নামে সুবিদিত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায়, এলগিন রোডে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বাড়ির বিপরীত দিকে, রাত্রিব্যাপী দীর্ঘ লাইনে চিকিৎসার জন্য যে জমায়েত দেখা যায়----তা নিশ্চিত দূর দূরান্ত থেকে আসা অসুস্থজনের আরোগ্যলাভের প্রত্যাশায় ক্লেশকর নিশিযাপন----হোমিওপ্যাথি  চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রত্যয়ের যে বর্তিকাখানি বিদ্যাসাগরপ্রমুখ ব্যক্তিরা সেদিন স্বহস্তে প্রজ্বলিত করেছিলেন তারই কিরণরেখায় আজ উজ্জীবিত রোগগ্রস্ত অগণিত মানুষের প্রতীক্ষারত উৎকণ্ঠিত মুখগুলি।

কবি বলেছেন, 'ক্ষুধিত পীড়িত অনাথ অসহায়দের জন্য আজ তিনি বর্তমান নাই, কিন্তু তাঁহার মহান চরিত্রের যে অক্ষয়বট বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালী জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে। .......দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব.......'    

 

গ্রন্থ ও তথ্যঋণ:
বিদ্যাসাগর: হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় / সাহিত্য একাডেমি
বিদ্যাসাগর: চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় / ইন্ডিয়ান প্রেস, এলাহাবাদ
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় / গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স
বিদ্যাসাগর চরিত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর /রবীন্দ্র রচনাবলী ২য় / বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণ 
রাজর্ষি রামমোহন: জীবনী ও রচনা / অনিল চন্দ্র ঘোষ / প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী
Ishwar Chandra Vidyasagar-A Story of his Life and Work: Subal Ch. Mitra / Ashish Publishing House, New Delhi.
Vidyasagar-- A Re-assessment: Gopal Haldar / People's Publishing House, New Delhi.
Mary Carpenter-Wikipedia
Long-lost diary hints at Vidyasagar's tryst with Homeopathy : The Times of India, Kolkata 06.08.2015

 

শান্তনু কুমার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top