সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

আফরোজা অদিতিরি পূজার লেখা

এই সময়ে শারদীয় পূজা উৎসব : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
১৯ অক্টোবর ২০২০ ২৩:১৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:২০

 

দেবী দূর্গা ‘দূগতিনাশিনী’, মহাশক্তির প্রতীক। পুরাকালে অসুরদের অত্যাচারে যখন বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ্বর স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন তখন তাঁদের শরীর থেকে যে তেজরশ্মি নির্গত হয়েছিল তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলেন এই নারীশক্তি দেবী দূর্গা। দেবী দূর্গা ত্রি-নয়নী। তাঁর বাম চক্ষু হলো চন্দ্র অর্থাৎ বাসনা, ডান চক্ষু হলো সূর্য অর্থাৎ কর্ম এবং তৃতীয় চক্ষু হলো অগ্নি অর্থাৎ জ্ঞান। শাস্ত্রমতে দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দূর্গা। দেবীর বাহন সিংহ। দেবীপুরাণ অনুসারে বিষ্ণু দূর্গার বাহন হিসেবে সিংহকে নির্মাণ করেছিলেন। সিংহ রজোগুণে এক প্রচণ্ড শক্তির উৎস। সিংহের ওপর আসীন দেবী এবং তাঁর এক পা অসুরের ওপর। তাঁর যেমন তিনটি নয়ন তেমনি দশটি হাত। দশটি হাতে আছে : ত্রিশূল, শঙ্খ, চক্র, খড়্গ, গদা, ধনুর্বাণ, ঘণ্টা, নাগপাশ, বজ্র, পদ্ম,কমণ্ডলু, অক্ষমালা। নয়টি হাতে অস্ত্র অন্য হাতে পদ্ম্, কমণ্ডলু, অক্ষমালা। দশটি হাত ও দশটি অস্ত্রের মাহাত্য অনেক প্রকারের!

দূর্গা পূজা সনাতন ধর্মালম্বীদের হিন্দুদের সবচেয় বড়ো ধর্মোৎসব। এই পূজা বছরে দুইবার হয়। আশ্বিন মাসে পূজা হলো শারদীয় দূর্গাপূজা এবং চৈত্রমাসে হলো বাসন্তি দূর্গাপূজা। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠতিথিতে এই পূজার প্রচলন করেছিলেন রাজা সুরথ। রাজার কিছু মন্ত্রী ও সভাসদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যবন জাতির কাছে পরাজিত হয়ে বনে নির্বাসিত হয়েছিলেন রাজা সুরথ; সেই বনে সমাধি নামে এক বৈশ্যের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সমাধিকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা বাড়ি থেকে বের করে দিলে আশ্রয় নেন বনে। তাঁরা দুজনে বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মেধামুনির আশ্রমে আশ্রয় পান এবং মেধামুনির সাহচর্যে আসেন; তাঁর পরামর্শে তাঁদের হারানো বৈভব ফিরে পাওয়ার জন্য চৈত্রমাসে দেবী দূর্গার পূজা শুরু করেন রাজা সুরথ। রামায়ন অনুসারে রাবনকে বধ করার জন্য শরৎ কালে দেবী দূর্গার আরাধনা শুরু করেন রাজা রামচন্দ্র। এই উপমহাদেশে বাসন্তি দূর্গাপূজা নয়, শারদীয় দূর্গোৎসবই বড়ো করে করা হয়। এই উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ বেশ কয়েটি দেশ-অঞ্চলে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

এবার মহালয়া হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দেবী আসছেন মহালয়ার পঁয়ত্রিশ দিন পরে কারণ আশ্বিন মাস মল মাস অর্থাৎ অশুভ। মলমাসে কোন শুভকাজ করা হয় না বলেই এবারে দূর্গোসব হবে কার্তিক মাসে। মহালয়া অর্থাৎ পিতৃপক্ষের শেষ থেকেই দেবীপক্ষ বা পূজার শুরু। পৌরাণিক মতে পিতৃপক্ষের শেষদিন সনাতন ধর্মালম্বীরা তাঁদের স্বর্গীয় পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। তাঁরা মনে করেন, মহালয়ার দিন পূর্বপুরুষের আত্মাগণ পৃথিবীতে আসে এবং তাঁরা, তাঁদের সন্তানসন্ততির কাছ থেকে তর্পন আশা করে। মহাভারতের বর্ণনা মতে, কর্ণ ছিলেন দাতা হিসেবে প্রসিদ্ধ। এই প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণ যখন মারা যান তখন স্বর্গে তাঁকে কোন খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে শুধু স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল যে কর্ণ জীবিত অবস্থায় শুধু স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন কোন খাদ্যবস্তু দান করেননি এবং পিতা-মাতাকেও দেখভাল করেননি তাই এই ব্যবস্থা। এই কথা শুনে কর্ণ বলেন, “আমি তো আমার পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষ কারা তা জানতাম না তাই তাঁদের দেখভাল করিনি ও স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছি।” এই কথা শুনে দেবরাজ কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন এবং কর্ণ এই ১৬ দিনপর যথাযোগ্য মর্যাদায় পিতৃপুরুষের তর্পণ শেষ করেন। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, প্রতিমাশিল্পীরা সব নিয়মরীতি মেনে পতিতাপল্লী থেকে মাটি এনে তবেই প্রতিমা গড়েন এবং ষষ্ঠির দিন মায়ের (প্রতিমা) চক্ষু দানের মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হয়। ষষ্ঠির দিন হয় বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস। এরপর মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্নান ও পূজা করা হয়। (নবপত্রিকা হলো নয়টি গাছ; কলা,অপরাজিতা,হলুদ,জয়ন্তি, বেল, দাড়িম্ব, অশোক, মানকচু, ধান)। যথারীতি আচার-অনুষ্ঠান মেনে স্নান করিয়ে পূজা করে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে কলাবউকে দেবীর পাশে বসিয়ে পূজা করা হয়;এইদিন থেকেই মূলত পূজার আনন্দ শুরু। এরপর মহাঅষ্টমীতে নানা রকম ব্রত-পূজা হয়ে থাকে আর থাকে কুমারী পূজা; কুমারী পূজা প্রথমে বেলুর মঠে শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিভিন্ন বয়সী কুমারীদের বিভিন্ন নামে পূজা করা হয়। বয়স ভেদে নামকরণ করা হয়। এই কুমারী পূজা দেখেছি রামকৃষ্ণমিশনে। তারপর মহাঅষ্টমী ও মহা নবমীর সন্ধিক্ষণে হয় সন্ধিপূজা। মহানবমীতে মহানবমী কল্পারম্ভ, নবমীবিহিত পূজা। সাধারণের জন্য এই তিনদিন থাকে পূজা আরতি প্রতিমা দর্শন প্রসাদ বিতরণ। এরপর আসে নিরঞ্জন- অর্থাৎ প্রতিমা নিরঞ্জন; নিরঞ্জনে থাকে দশমী বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, কৃত্য, কুলাচার এবং বিসর্জন শেষে অপরাচিতা পূজা। বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা বিসর্জিত হয়। বিজয়াদশমীর দিন সকল পূজা শেষে প্রতিমাকে সাতপাক ঘুরিয়ে বিসর্জন দেয়া হয় কোন নদী ঝিল বা জলাশয়ে। প্রতিমা নিরঞ্জনের দিনই হলো বিজয়াদশমী। এই দিন সনাতন সম্প্রদায়ের সকলের অশ্রুসজল চোখ এবং বেদাভারাক্রান্ত মন থাকে। তাঁরা মনে করেন, গিরিরাজ ও মেনকার কন্যা তাঁর পুত্রকন্যাসহ (লক্ষী-সরস্বতী-কার্তিক-গনেশ) পিতৃগৃহে এসেছিলেন তারপর আনন্দসুখে কাটিয়ে মায়ের অশ্রু ঝরিয়ে আবার কৈলাশে ফিরে যাচ্ছেন।

কবে- কখন এই পূজা শুরু হয় তা জানা যায় না তবে যখন থেকে জানা যায় তখন পূজার রূপ অবশ্য এমন ছিল না। পূর্বে ধনীগৃহে আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা করা হতো। তখন এই পূজা “বনেদি বাড়ির পূজা” নামে অভিহিত ছিল। সেই সময় পূজা উদ্যাপনকালে ধনী রথি-মহারথিদের সঙ্গে ইংরেজদের নিমন্ত্রণ করা হতো। সেখানে গান-বাজনার আসর হতো, প্রতিমার সামনেই বাইজিনৃত্য হতো, গরু এবং শুকরের মাংসের সঙ্গে মদ খাওয়া হতো। কিন্তু এর প্রতিবাদে রানি রাসমনি নিজের জানবাজারের বাড়িতে শুদ্ধাচারে পূজা শুরু করেন। রানি রাসমনির জামাতাগণও তাঁর প্রদর্শিত পথেই পূজা করেছেন। এই পূজাতে সকল গরীব-জনগণ, তাঁর প্রজারা অংশ নিতো। তাছাড়া এই পূজা ভারতে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ দেবী দূর্গা শক্তির প্রতীক। কথিত আছে, এই পূজাতে আকৃষ্ট প্রথম বারোজন বন্ধু চাঁদা তুলে সার্বজনীন পূজার আয়োজন করেন। সেই থেকে এটি বারোয়ারি পূজা নামে খ্যাত হয়েছে। বর্তমানে এই পূজা বড়ো বড়ো মন্দির-মহল্লা-পাড়াতে একজোটেই হয়ে আসছে। এই পূজা এখন বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা নামেও খ্যাত হয়েছে। বর্তমানে এই পূজা ‘থিম’ বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মঞ্চ তৈরি হয় এবং আলোকমালায় সজ্জিত হয়। বাজী পোড়ানো, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়; আরতি প্রতিযোগিতা হয়; প্রতিমা নিরঞ্জনে শোভাযাত্রা হয়। নানান উপাচারে পূজা-উৎসব সম্পন্ন করা হয়। এই পূজা উপলক্ষ্যে ‘শারদ সম্মান’ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

পূজার কথা লিখতে গিয়ে কিছু কথা মনে পড়ে গেল। তখন ১৯৬৫-১৯৬৬ সালের দিকে। পাবনা মহিলা কলেজ হোস্টেলে থাকি। নতুন কলেজ। হোস্টেলে মেয়ে বেশি নয়। আমাদের কলেজে তো সরস্বতী পূজা হতো সেখানে তো উপস্থিত থাকতাম, অঞ্জলি দিতাম। আমাদের হোস্টেল সুপার ছিলেন মাননীয় রুবি দত্ত। আমাদের কয়েকজনের উৎসাহ দেখেই ঐ বছর পূজার সময় আমাদের কয়েকজনকে পূজা দেখাতে নিয়ে গেলেন। খুব ভালো লেগেছিল আমার। তখন তো শাড়ি পরতো বেশিরভাগ মেয়ে। আমরাও পরেছিলাম। আমি কস্তা পেড়ে সাদা শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। অনেকগুলো পূজামণ্ডপে ঘুরেছিলাম। অঞ্জলি দিয়ে, প্রসাদ খেয়ে খুব আনন্দ করে হোস্টেলে ফিরেছিলাম। ঢাকাতে শুধু রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়েছি। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়া হয়নি। তবে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গিয়েছি। পূজা বা ঈদ যে কোন পার্বনেই ঢাকাতে তো খুব যানজট হয়। তাই খুব যাওয়া হয়ে ওঠে না। এই সময়ে বিশ্বের ঘাড়ে চেপে বসা কোভিড-১৯ বড়ো ছোঁয়াচে। এইজন্য এই উৎসবে নানারকম বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। এখানে এবাবের পূজা মন্দির প্রাঙ্গনে হবে; কোন বাজী পোড়ানো হবে না; সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিহার করা, মেলা পরিহার করা, আরতি প্রতিযোগিতা হবে না; প্রতিমা নিরঞ্জনে হবে না কোন শোভাযাত্রা; অর্থাৎ পূজা হবে ছোট আকারে। গতবছরের মতো ত্রিশ হাজারের বেশি পূজামণ্ডপ হয়তো সাজানো হবে না দেশে। কিন্তু মাকে বরণ করা হবে। তাঁর বোধন, অঞ্জলি, ভোগ আরতি, মন্ত্র উচ্চারণ, প্রতিমা নিরঞ্জন সব হবে। সকলের বিশ্বাস দেবী দূর্গা দূর্গতিনাশিনী; তিনি আসছেন সব রোগবালাই, শোকতাপ দূর হবে; দূর হবে সকল অনাচার-অত্যাচার। সকলের প্রার্থনা সব যেন ঠিক হয়ে যায়; বিশ্ব আগের মতো হোক, আর জীবন হয়ে উঠুক প্রফুল্ল! সকলের প্রার্থনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও প্রার্থনা করি, অশুভ শক্তি নাচছে ধরায় বাঁচার কর উপায় / পুষ্পপত্রে জড়িয়ে দেব হও তুমি মা সহায়। কারণ ধর্ম যার যার তাঁর তাঁর নিজস্ব কিন্তু শুভ সকলের।

সূত্র: বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,অন্তর্জাল

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top