সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের গানের অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ : সিরাজুল ইসলাম জীবন 


প্রকাশিত:
২০ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪২

আপডেট:
২০ অক্টোবর ২০২০ ২২:৩৫

ছবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম

 

গত ২৭ আগস্ট ২০২০ দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় শাকিলা নাছরির পাপিয়া একটি কলাম লিখেন। তিনি ঐ পত্রিকার একজন নিয়মিত কলামিস্ট। লেখক ঐ কলামে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি লেখায় আমাকেও টেনে এনেছেন। তাই তার কলামের সূত্র ধরেই আমার আজকের এই লেখা। 

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে চরম শত্রুরও কোনো সন্দেহ নাই। এ-কথাও সত্য যে, তাঁর অনেক গান চুরি হয়েছে, বেহাত হয়েছে, যে-গুলো এখন অন্য নামে চলছে। মূলত এই পয়েন্টকেই ফোকাস করেছেন শাকিলা নাছরিন পাপিয়া। তিনি লেখাটির সূচনা করেছেন একটি বিখ্যাত গান দিয়ে---চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়, আমার সমাধি 'পরে...

মৌলিক প্রশ্ন হলো গানটি মূলত কার লেখা। কোথাও কাজী নজরুল ইসলাম,  কোথাও প্রণব কুমার রায়ের লেখা এমনটিই দেখা যাচ্ছে গুগল এবং ইউটিউবে। গানের ভুবনে নজরুল যদি হয় পূর্ণিমার চাঁদ প্রণব কুমার বড়জোর সেখানে তারা হতে পারেন। তিনি নজরুলের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং গান লেখার স্বকীয়তাও অর্জন করেছিলেন। নজরুলের লেখা গানের প্রভাব রয়েছে প্রণব কুমারের উপর। আসলে কেবল প্রণব কুমার নয়, আধুনিক বাংলা গান নজরুল দ্বারা প্রভাবিত ছিল শতভাগ।  প্রণব কুমারের  লেখা অনেক কালজয়ী গানও আছে। তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি উল্লিখিত গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা হওয়াই সম্ভব এবং যুক্তিযুক্ত।

বাংলা গানের কিংবদন্তী গীতিকারদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ধরন ও বৈশিষ্ট্য আছে কথা এবং সুরে। আপনি যদি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন এই তিনজনের তিনশ গান একসঙ্গে করে শোনা শুরু করেন, যদি সঙ্গীত বিষয়ে আপনার মোটামুটি নলেজ থাকে তাহলে কোনটা রবীন্দ্রনাথের, কোনটা নজরুলের, কোনটা লালনের চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবেন। স্টাইল কখনোই দুজনের একরকম হওয়া সম্ভব নয়। আমি এখন পুরো গানটি তুলে ধরছি---

চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়
আমার সমাধি 'পরে
দেখো মোর ঘুম ভেঙে যায় নাকো
যেন ক্ষণিকের তরে।।
ফুল যদি কভু নাহি থাকে হায়
শুধু আঁখি-বারি প্রিয় ফেলিও হেথায়
উতলা হাওয়ার পরশে যেমন
বন-শেফালীকা ঝরে।।
আকাশে তখন ছায়া নামে যদি
সন্ধ্যা ঘনায় বনে
মনে করো দোঁহে দেখা হয়েছিল
সে-কোন গোধূলি ক্ষণে,
আমার আঁধার সমাধিতে প্রিয়
তোমার প্রেমের দ্বীপ জ্বেলে দিও
ঝরা মালিকার পরিমল যেন থাকে
থাকে তব হিয়া ভরে।। 

‌নজরুলের গানের যে ভাব এবং ভাষা তার হুবহু মিল দেখছি এই গানে। গানটির প্রতিটি শব্দ এবং বাক্য নজরুলের সঙ্গীত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে  সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ । নজরুল তার সঙ্গীতে যে অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহার করে থাকেন এখানেও তার ব্যতিক্রম করেননি। সঙ্গীতে নজরুল কিছু কিছু শব্দের অতিমাত্রিক ব্যবহার করেছেন তাঁর শত শত গানে, এখানেও ঠিক তাই ই করেছেন। যেমন 'প্রিয়' শব্দের ব্যবহার তিনি সঙ্গীতে এত বেশি করেছেন যে এমনটি আর কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় না, কিন্তু একবারও মনে হয়নি অপ্রোয়জনীয় ব্যবহার হয়েছে। এই গানেও 'প্রিয়' শব্দটি তিনবার ব্যবহার করেছেন। গানে তিনি ঠিক তেমনি ফুলের ব্যবহারও করেছেন অতিমাত্রায়। এই গানেও 'ফুল' শব্দ হিসেবে এবং শেফালীকা ব্যবহার করে নিজের বৈশিষ্ট্যই জানান দিয়েছেন। গানটির প্রথমেই চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে---এমন শব্দমালা নজরুলের অসংখ্য গানে ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন সূত্রে। এরকম শব্দগুচ্ছের ব্যবহার অন্য কোনো গীতিকারের বৈশিষ্ট্যে নেই। যেন, যদি, কভু, শুধু ইত্যাদি সর্বনাম ও অব্যয় শব্দের ব্যবহারও তিনি তার অজস্র গানে করেছেন, এখানেও ঠিক তাই করেছেন। এগুলো কীসের ইঙ্গিত দেয়? তাঁর বহুল ব্যবহৃত শব্দ যেমন---সমাধি, সমাধি 'পরে, মোর, ঘুম ভেঙে যায়, ক্ষণিকের তরে, হায়, আঁখি-বারি, ফেলিও, হেথায়, পরশ, বন-শেফালীকা, ঝরে, আকাশ, ছায়া, সন্ধ্যা, সে-কোন, গোধূলি ক্ষণ, আঁধার, দ্বীপ, জ্বেলে দিও, ঝরা মালিকা, পরিমল, তব, হিয়া ইত্যাদি শব্দের নিখুঁত ব্যবহার নজরুল-সঙ্গীতের ঘ্রাণ মনে করিয়ে দেয়। এসব শব্দের ব্যবহার তিনি অন্যান্য সঙ্গীতে যেরকম চমৎকার ব্যবহার করেছেন, ঠিক এখানেও অপরূপ ব্যবহার কী প্রমাণ দেয় না যে, এই গান নজরুলের হওয়াই সম্ভব! যদি গানটি প্রণব কুমারের হয় তাহলে তাঁর অন্যান্য গানের সঙ্গে এই গানটির শব্দ এবং সুরে সাদৃশ্য থাকবার কথা, আমি শুনে দেখেছি সেটা কিন্তু নেই। প্রণব কুমারের লেখা হলে গানটিতে 'সমাধি' শব্দের ব্যবহার না হয়ে শ্মশান শব্দ হবার কথা। অন্তত আমার মনস্তত্ত্ব তাই ই বলে। 

 

এবার আসি গানটির সুর বিশ্লেষণে। নজরুলের বেশকিছু গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত। তিনি অন্য অনেক গীতিকারের গানেরও সুর করেছেন। কিন্তু নজরুলের গানের সুরের সঙ্গে ওসব গানের সুরের সুস্পষ্ট পার্থক্য ধরা পড়ে। এই গানটির সুরও করেছেন কমল দাশই। আর গানটিতে অনেকেই কণ্ঠ দিয়েছেন। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ফিরোজা বেগম। ফিরোজা বেগমই নজরুল সঙ্গীতের একমাত্র শিল্পী যিনি নজরুল সঙ্গীত ছাড়া আর অন্য কারো গানে কণ্ঠ দেননি। তিনি জীবদ্দশায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি আমি নিজ কানে শুনেছি। অনেকেই চেষ্টা করেছেন ফিরোজা বেগমকে দিয়ে বিভিন্ন টাইপের গান গাওয়াতে, কিন্তু তাঁকে রাজি করাতে পারেননি। তিনি নজরুল প্রেমে এতটাই মজেছিলেন যে এর বাইরে অন্য গানের চিন্তাই করতে পারেননি। অর্থ লোভের অনেক উর্ধ্বে ছিলেন ফিরোজা বেগম। সুতরাং এমন মানসিকতার একজন ফিরোজা বেগমের পক্ষে  প্রণব কুমারের লেখা একটিমাত্র গানে কণ্ঠ দেয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব। নজরুল-কমল দাশগুপ্ত-ফিরোজা বেগম---এই ত্রয়ী ছিলেন একসূত্রে গাঁথা। এই তিনজনের মাঝখানে নজরুল সঙ্গীতের বাইরে অন্য সঙ্গীতের কোনো প্রবেশ ছিল না। এমন আরো অনেক সঙ্গীত রয়েছে যে-গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন; গীতিকারের নাম নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়। নজরুলের সব গানের হিসেব পাওয়া হয়তো কোনোদিনই সম্ভব নয়, তবু অনুসন্ধান, প্রচেষ্টা থাকলে হয়তো কবির আরো কিছু গান অন্তত চিহ্নিত করা সম্ভব---তাহলে জাতীয় কবির প্রতি সম্মান ও সুবিচার করা হবে বলে বিশ্বাস করি।

 

সিরাজুল ইসলাম জীবন 
শিক্ষক, কবি,  গল্পকার, নজরুল গবেষক এবং সাহিত্য সমালোচক।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top