সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

হাওরের ইতিবৃত্ত : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার


প্রকাশিত:
৭ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫০

আপডেট:
৭ নভেম্বর ২০২০ ২১:২৮

 

নদীমাতৃক এবং কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত বিশাল নিম্ন জলাভূমিপূর্ণ যে অঞ্চলটি এক সময় ‘ভাটিবাংলা’ হিসেবে খ্যাত ছিল, ভূ-প্রাকৃতিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ অঞ্চলটিই বর্তমানে মোটামোটি ভাবে হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন কালের নানা তথ্যে ‘শ্রীহট্ট’ বলতে যে অঞ্চলটিকে নির্দেশ করা হয় ভাটি অঞ্চলটি তারই অন্তর্গত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সিলেট বা সুরমা অববাহিকার সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার ৫০টি উপজেলার সমন্বয়ে ১৪,৫৩৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই হাওর অঞ্চলটি বিস্তৃত। দেশের প্রায় এক দশমাংশ এই হাওরাঞ্চলে ১,২৪,৯৫,৯৬৫ জন মানুষের বসবাস। ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’-এর তথ্য অনুযায়ী এখানে রয়েছে প্রায় ৪১৪টি হাওর। এই হাওরগুলোতে আবার বিভিন্ন মাপের ৬,৩০০টি বিল বিদ্যমান। এ গুলোর মধ্যে ৩,৫০০টি স্থায়ী ও ২,৮০০টি অস্থায়ী বা ঋতুভিত্তিক বিল। 

হিউয়েনসাঙ তার বর্ণনায় সিলেটকে সমুদ্র তীরবর্তী দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন নানা তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, সংশ্লিষ্ট এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল। ভূ-গঠন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নানা তথ্যে হাওরাঞ্চলের সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। অবস্থানগত দিক বিবেচনায় এ এলাকাটি লোক কাহিনীর সেই ‘কালিদহ সায়র’কেই যেন নির্দেশ করে। হাওরের উৎপত্তি সম্পর্কে কারো কারো অভিমত, প্রাচীন কালে এই অববাহিকাটি বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিল। এ অংশটি উত্তরে মেঘালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে ত্রিপুরার পাহাড় এবং পূর্বদিকে মনিপুরের উচ্চ ভূমি দিয়ে ঘেরা বলে প্রতি বছর মৌসুমী বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট প্লাবনের ফলে অসংখ্য নদীবাহিত পলি নিম্ন জলাভূমিতে জমা হতে থাকে।

অনবরত পাহাড় ক্ষয়ের মাধ্যমে সমুদ্রবক্ষে পতিত পলিতে জেগে ওঠা সমতল ভূমির মাধ্যমে প্রাচীন কালেই এ অঞ্চল বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকায় সঙ্কুচিত হয়ে সাগর সদৃশ নিম্নাঞ্চলে পরিণত হয়। কারো কারো মতে, প্লাইস্টোসিন যুগে অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ বছর পূর্বে কোনো এক নৈসর্গিক কারণে ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের কিয়দংশ প্লাবন সমভূমি অপেক্ষা কিছুটা নিচু হয়ে এই হাওর অঞ্চল সৃষ্টি করে। কেহ কেহ মনে করেন, ১৭৮৭ সালের বন্যা ও ভূমিকম্পের পর ব্রহ্মপুত্র নদী তার গতিপথ মধুপুর গড়ের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে পরিবর্তন করলে পলিমাটি ভরাট হওয়ার অভাবে এই অঞ্চল নিচু থেকে যায়।

একটি বিশেষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ হাওরাঞ্চল। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে সৃষ্ট মানব বসতির ধারা এ অঞ্চলেই প্রথম শুরু হয়েছিল বলে অনেকের অভিমত। এ দেশের ভূ-গঠনকালেই অনবরত পাহাড় ক্ষয়ের ফলে নদীবাহিত পলি-বালিতে জেগে ওঠা সংশ্লিষ্ট সমতল ভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক কালেই নানা নৃগোষ্ঠীর অভিবাসন শুরু হয়। তাদের সংঘর্ষ-সমন্বয়ে সৃষ্ঠি হয় এখানকার প্রাগৈতিহাসিক সঙ্করজাত জনসমাজ। ইতিহাস কালেও নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। সকলের মিলিত প্রয়াশে সৃষ্টি হয় এ অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি।

এখানে রয়েছে একটি নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার। এখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, জনজীবন, পেশা, অর্থনীতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা প্রভৃতি দেশের অন্য যে কোনো অঞ্চল থেকে কিছুটা ভিন্নতর। বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ হাওর অঞ্চলটি কৃষির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদেরও বিশাল ভাণ্ডর হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোনের ৭টি জেলার ৫০টি উপজেলার সমন্বয়ে ১৪,৫৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই অঞ্চলটি সমগ্র দেশের দশ ভাগের এক ভাগ। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে বরাবরই খাদ্য-উদ্বৃত্ত এই এলাকাটির বৈশিষ্ট্য এবং ধরণ বাংলাদেশের যে কোনো এলাকা থেকে স্বতন্ত্র। বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ এই হাওর অঞ্চলটি কৃষির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদেরও বিশাল ভাণ্ডর হিসেবে স্বীকৃত। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে এই বিশেষ বৈশিষ্টমণ্ডিত অঞ্চলটির উৎপত্তির সাথে বাংলাদেশের ভূ-গঠন প্রক্রিয়ার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ অঞ্চলে মানব বসতিরও তথ্য অবগত হওয়া যায়।

এই হাওরের সাগরতুল্য বিস্তৃতি সম্পর্কে তৎকালীন সিলেটের রেসিডেন্ট রবার্ট লিন্ডসে’র বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি কলকাতায় আসেন ১৭৭২ সালে। সেখান থেকে ঢাকায় ১৭৭৬ সালে এবং  ১৭৭৮ সালে তিনি রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সিলেটে আসেন। নৌপথে ঢাকা থেকে সিলেট যাত্রার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন,‘এবার ঢাকাকে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা হলাম সিলেটে। নদীপথে কুড়ি মাইল যাওয়ার পর পৌঁছলাম ফিরিঙ্গি বাজারে। গঙ্গার শাখানদী বুড়িগঙ্গা এখানে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। দু’টির মিলিত হওয়ার পর নাম হয়েছে মেঘনা। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম নদীর একটি। এ নদী দিয়েই আমাকে মাইলের পর মাইল যেতে হবে। এখন বর্ষার মওসুম। চারদিকে থৈ থৈ পানি। মনে হয় পরিত্যক্ত বিষাদ ঘেরা বিপন্ন এক অঞ্চল। শুধু বৃষ্টির পানিতে এ ভাবে সবকিছু তলিয়ে যায় না। অন্য কারণও আছে। হিমালয় এবং অন্যান্য পর্বতে গ্রীষ্মকালে বরফ গলে যায়। তাতার, আসাম ও তিব্বতের পাহাড়ে বরফ গলা পানি ছোট ছোট নদী দিয়ে নেমে আসে। বেঙ্গল প্রদেশের নিম্নাঞ্চল এতে ডুবে যায়। স্রোত বয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। বছরে প্রায় তিন মাস এভাবে পানিতে ডুবে থাকে সমগ্র অঞ্চল। নীল নদের মত এ পানি এখানকার জমিকে উর্বরতা দান করে। এই অথই জল রাশির মধ্যে আমি সমুদ্রে চলার মতই কম্পাস ব্যবহার করে সিলেটে যাওয়ার পথ ঠিক করলাম। এ কথা বললে নিশ্চয়ই কেউ অবিশ্বাস করবে না। এভাবে প্রায় একশ’ মাইল বিস্তৃত হাওর পাড়ি দিতে হল আমাকে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। কৃত্রিম টিলার উপর ঘরবাড়ি দেখলাম। মাটি প্রায় দেখাই যায় না। নৌকাই লোকের ভরসা। প্রতিটি বাড়ির ঘাটে ঘাটে নৌকা। বর্ষাকালে মানুষের জীবন হয় খুব কষ্টের।’

এদেশের ভূমিরূপ গঠন প্রক্রিয়ার ইতিহাসের সাথে এর যেমন সংশ্লিøষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় তেমনি সপ্তম শতাব্দীতে এখানে মানব বসতিরও তথ্য জানা যায়। মোগল আমলে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষাপর্বে ভূঁইয়াদের শক্ত প্রতিরোধক্ষেত্র ছিল ভাটি অঞ্চল। ড. আবদুল করিম ভাটির যে সীমানা নির্ধারণ করেছেন তা হল : ‘গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা, এই তিন বৃহৎ নদী ও তাদের শাখা প্রশাখা বিধৌত এবং বেষ্টিত (বৃহত্তর) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও সিলেটের নিম্ন অঞ্চল নিয়ে ভাটি গঠিত।’ কেউ কেউ উক্ত সীমাস্থিত বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নিম্নভাগ; বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা; সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল এবং ত্রিপুরা তথা কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন উত্তর-পশ্চিমাংশের নিম্নভূমি বেষ্টিত নিচু এলাকাকে এক সময়ের ভাটিবাংলা হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রয়াশ পেয়েছেন।

এই অঞ্চলের প্রাচীন অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কৈলাসচন্দ্র সিংহ রাজমালায় উল্লেখ করেছেন, ‘শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, ময়মনসিংহের পূর্ব্বাংশ, ত্রিপুরা জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ দর্শনে বোধ হয় এই স্থানে পূর্ব্বে একটি বৃহৎ হ্রদ ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদে প্রবাহিত কর্দ্দম দ্বারা ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার সন্ধিস্থল সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হইলে, এই হ্রদ বিশেষরূপে মানব মণ্ডলীর দৃষ্টিপথে পতিত হইয়াছিল। এজন্যই দ্বাদশ শতাব্দী পূর্ব্বে হিয়োনসাঙ শিলহট্ট রাজ্যটি সমুদ্র তীরবর্তী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বরবক্র, সুরমা, মনু, ক্ষমা প্রভৃতি নদী সমুহ এই হ্রদের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইত। নদী প্রবাহে আনীত কর্দ্দম রাশি দ্বারা এই হ্রদ ক্রমে শুষ্ক হইয়া অসংখ্য বিল সৃষ্টি হইয়াছে। এই সকল বিলের কান্দি বা উচ্চ স্থানস্থিত গ্রামগুলি অদ্যাপি বর্ষাকালে সমুদ্র মধ্যস্থিত দ্বীপ বলিয়া বোধ হয়। অনুমানিক শ্রীহট্ট জেলার প্রায় চতুর্থাংশ বিল ও নিম্নভূমি, ইহার সহিত ময়মনসিংহ জেলার পূর্ব্ব প্রান্তস্থিত নিম্নভূমি ও ত্রিপুরা জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তস্থিত নিম্নভূমি সংযুক্ত করিলে বোধ হয় উল্লিখিত হ্রদের পরিমাণ ফল দুই সহস্র বর্গমাইল হইতেও অধিক ছিল।’

প্রাচীন নানা তথ্য থেকে জানা যায় যে, অতি প্রাচীন কালে বাংলাদেশের এই অংশটি বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল। বাংলার এই নিম্নাঞ্চলে সুপ্রাচীন কাল থেকে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে তা-ই ভাটি বাংলার অভিধায় পরিচিতি পায়। এই ভাটি বাংলার জনজীবন মূলত হাওর কেন্দ্রীক। সিলেট ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে বলা হয়েছে: During wintet a haor is a vast, almost limitless stretch of green land, whilst in rainy season it is a vast sea of turbulent water. The word haor is believed to be a corrupted form of the Sanskrit word Shagar (sea) or the Arabic word Bahar (sea).

ইংরেজী (Sea) শব্দের বাংলারূপ ‘সমুদ্র’ বা ‘সাগর’। ‘সাগর’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হওয়ায় আঞ্চলিক ভাষায় তার উচ্চারণগত রূপটির কিছুটা পরিবর্তন ঘটে ‘সাগর’ থেকে ‘সায়রে’ রূপান্তরিত হয়। সাগর বা সায়র মূলত অন্তহীন জলভাগ। যুগ পরম্পরায় অবিরাম পলিপ্রবাহে বঙ্গখাতের এই বর্ধিতাংশটির তলদেশ ভরাট হয়ে ক্রমান্বয়ে সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কিছু অংশ বিশাল জলাধার হিসেবেই থেকে যায়। বর্ষাকালে এই জলাধারটি বিশাল হ্রদ বা সাগরাকৃতি ধারণ করে। তাই সাগরতুল্য এই বিশাল হ্রদ বা বিস্তীর্ণ জলভাগ অত্রাঞ্চলে সাগর বা সায়র হিসেবেই কথিত হত।

সিলেট ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় শব্দের আদিতে ব্যবহৃত ‘স’ বা ‘শ’ বর্ণ ‘হ’ এবং ‘অ’ উচ্চারণ হতে দেখা যায়। যেমন: সর <হর <অর, সাপ <হাপ <আপ, সাজ <হাজ <আজ, শাক <হাক <আক, শান <হান <আন ইত্যাদি। একই কারণে সম্ভবত এই ‘সাগর’ থেকে ‘সায়র’, তা থেকে ‘হায়র’ এবং  ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি। এই ‘হাওর‘ শব্দটি বর্তমান পর্যায়ে আভিধানিক শব্দ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। তৃণমূল পর্যায়ে এই ‘হাওর’ শব্দটিই উপরোক্ত নিয়মে ‘আওর’ হিসেবে উচ্চারিত হয়। ‘হাওর’ বা ‘আওর’ মূলত সাগর সদৃশ পানিপূর্ণ বিস্তীর্ণ প্রান্তর - যা সারা বছরই আংশিকভাবে হলেও জলমগ্ন থাকে।

বাংলাদেশের এক বৃহদাংশ পৃথিবীর বৃহত্তম আয়তন বঙ্গখাতের অংশবিশেষ। এ দেশের অধিকাংশ এলাকা প্রাচীন কালে গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল। সে সমুদ্রটির নাম ছিল আসাম উপ-সাগর। হিমালয় থেকে আগত নদী নালা দ্বারা পলি সঞ্চিত হয়ে প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি হলে, তা দেখতে গোলাকার খাতের মত মনে হয়। এই খাতই বঙ্গখাত হিসেবে পরিচিত।

ভূ-অভ্যন্তরে বিশেষ স্তর ও অসম স্তরসমূহ পরীক্ষা দ্বারা বিভিন্ন স্তরের গঠন প্রণালী ও কোন কোন পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পাহাড়াঞ্চল ব্যতিত বেশীরভাগ জমি সমতল। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর গড় উচ্চতা  ৮ থেকে ১২ মিটারের মধ্যে। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান মৌসুমী বৃষ্টি প্রধান এলাকায়। এর পাহাড়াঞ্চলের মৃত্তিকা অতিরিক্ত ক্ষয়প্রবণ। এখানকার নদীনালার উৎসস্থল পাহাড়াঞ্চলে হওয়ায় অগণিত নদীনালার স্রোতে বয়ে আসা পলি-বালি নিম্নাঞ্চলের জলভাগে জমা হতে থাকে। মূলত এভাবেই এদেশের বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির সৃষ্টি।

তবে এদেশের কিছু অংশ প্লাইস্টোসিন যুগে কোনো এক নৈসর্গিক কারণে উত্থিত হয় এবং প্লাবন সমভূমি অপেক্ষা গড়ে ১০ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যায় বলে ভূমিরূপ বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তাদের মতে বৃহত্তর বঙ্গ ব-দ্বীপের অংশবিশেষ এসকল অঞ্চলে প্রায় ১০ লক্ষ বছর পূর্বে এমনটি ঘটেছিল। দিনাজপুর, রাজশাহী, রংপুর ও বগুড়া জেলার বরেন্দ্র ভূমি; ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্বর্তী মধুপুর গড় এবং কুমিল্লার লালমাই পাহাড় উক্ত ভূমিরূপেরই অংশবিশেষ। ঠিক একই কারণে ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের কিয়দংশ আস্তে আস্তে নিচু হয়ে যায় - যা হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।

ভূমিরূপ বিজ্ঞানীদের মতে, ইয়োসিন যুগে কলিকাতা থেকে ময়মনসিংহ বরাবর একটি কবজা বলয় সৃষ্টি হয়, যা নাগা পাহাড়ের ডাউকি চ্যুতির ন্যায় চ্যুতি সৃষ্টি করে। অনেকের মতে, মেঘালয় ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর সংঘটিত ‘ডাউকি চ্যুতি’র কারণে অতি প্রাচীন কালে এলাকাটি ৩ থেকে ১০ মিটার বসে যায়। ১৭৮৭ সালের বন্যা ও ভূমিকম্পের পর ব্রহ্মপুত্র নদী তার গতিপথ মধুপুর গড়ের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে পরিবর্তন করলে পলিমাটি ভরাট হওয়ার অভাবে এই অঞ্চল নিচু হয়ে যায়। এ কারণেই দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই হাওর এলাকার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নদীপ্রবাহের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতের অসংখ্য পাহাড়ি নদী এই অববাহিকায় পানি সরবরাহ করে। হাওর অববাহিকাটি উত্তরে মেঘালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে ত্রিপুরার পাহাড় এবং পূর্বদিকে মনিপুরের উচ্চভূমি দিয়ে ঘেরা বিধায় প্রতি বৎসর মৌসুমী বৃষ্টিপাতে সামান্যতেই প্লাবিত হয়ে যায়। এই প্লাবন তথা নদীবাহিত পলি জমা হয়ে এ অঞ্চলের নিম্ন জলাভূমিতে সাগরসদৃশ হাওর অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।

এই নদীগুলোর মধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারাই প্রধান। এই নদী-অববাহিকাই হাওর অঞ্চল। হাওর ও নদীর অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ অঞ্চলে হাওরবিহীন অনেক নদী আছে কিন্তু নদীবিহীন একটি হাওরও নেই। সুরমা, কুশিয়ারা, সোমেশ্বরী, রত্না, বৌলাই, যাদুকাটা, ঝালকালি, ধামালিয়া, নোয়াগাং, উমিয়াম, ধলাই, পিয়াইন, সারী, বরদল, গোয়াইন, সুনাই, জুরী, মনু, লংলা, বিবিয়ানা, খোয়াই, কালনী, সুতাং প্রভৃতি নদী হাওরের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ডাউকি চ্যুতির ব্যাপারে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘প্রায় ১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট সুরমা অববাহিকা ওলিগোসিন ও প্লায়োসিন উপযুগের মধ্যে কোন এক সময় অবনমিত হয়ে যাওয়া বঙ্গীয় অববাহিকার উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিরাজ করছে। শিলং ম্যাসিফের দক্ষিণে সুরমা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল দিয়ে অতিক্রমকারী ডাউকি চ্যুতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-গাঠনিক উপাদান, যার কারণে আর্কিয়ান ভিত্তিশিলা সুরমা উপত্যকার ১৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। গঠনগতভাবে সুরমা অববাহিকা দুটি বৃহৎ ভূ-গাঠনিক উপাদান উত্তরের উত্থিত শিলং ম্যাসিফ এবং বার্মা প্লেটের পশ্চিমমুখী অগ্রসরমাণ ইন্দো-বার্মা ভ্রাম্যমাণ বলিত বলয় দ্বারা গঠিত।’

বাংলাদেশের ভূমিরূপ গঠন ও সঞ্চায়নের ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করে ভূ-বিজ্ঞানীরা ধারনা পোষণ করেন যে, টারসিয়ারি যুগ ভূমিরূপ গঠনের ইতিহাসের জন্য উল্লেখযোগ্য। শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র ভারতেই এ যুগে ব্যাপক ওলট-পালট হয়েছে। কোবারের মহীখাত সৃজনীতত্ত্ব মতে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে বর্তমান হিমালয় পর্বতের স্থলে ছিল এক সাগর। তার নাম ছিল টেথিস । এর উত্তরে আঙ্গারা ভূমি আর দক্ষিণে গন্ডোয়ানা ভূমি নামে দুটি মহাদেশ ছিল। এর দীর্ঘ পর টারসিয়ারি যুগে এক ‘মহাগিরিজনি আন্দোলন’ শুরু হয়। এ আন্দোলনের ধাক্কা এসেছিল উত্তরের আঙ্গারা ভূমির তরফ থেকে আর প্রতিহত করে গন্ডোয়ানা ভূমি যা প্রি-ক্যামব্রিয়ান মহাযুগের ‘অনড়ভূমি’ নামে খ্যাত। ক্রমাগত চাপের ফলে মধ্যবর্তী নরম পলল স্তর সঙ্কুচিত হয়ে ভঙ্গিল পর্বত শ্রেণীর সৃষ্টি করে যার নাম হিমালয় পবর্তমালা।

টেথিস সাগরের বুকে হিমালয় পর্বতের উত্থান, বাংলাদেশ অঞ্চল আসাম সাগরে নিমজ্জিত হওয়া এবং অসংখ্য নিম্নজলা, হ্রদ ও গিরিখাত সম্ভবতঃ এ যুগেই সৃষ্টি হয়। ক্রিটাসিয়াস থেকে মায়োসিন (১৩৬-৬৩ মিলিয়ন বছর আগে) কালের মধ্যে অনুমান কয়েকবার বঙ্গখাতের উত্থান ও অবনমন ঘটে। রাজশাহী ও বগুড়ার প্রাচীন তুরা বেলে পাথর পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্যালিওসিন কালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মহাদেশীয় ভূখন্ড ছিল, মায়োসিন যুগে ভূ-অবনমনের ফলে আবার বিরাট অংশ সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। এ সময়ে সিলেটের টেকের ঘাটে চুনাপাথর সৃষ্টিকারী ‘প্রবাল’ জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীর জন্ম হয়। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে চুনাপাথর সঞ্চয় থেকে ধারণা করা হয় যে, অঞ্চলটি ওলিগো-মায়োসিন যুগে (৩ কোটি বছর পূর্বে) সমুদ্র বক্ষে নিমজ্জিত ছিল।

ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকে এ অঞ্চলের অন্যতম ভূমিরূপ পলল সমভূমি সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দ্বারা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমে এই সমভূমি পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে এবং দক্ষিণে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। এই পলল সমভূমির উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ৩ মিটার হতে ১০ মিটারের মধ্যে। এই অঞ্চল এমন এক বৃহৎ, সুষম অবনমিত ভূ-প্রকৃতি যা পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে মেঘালয় মালভূমির পাদদেশ, পূর্বে সিলেটের উঁচু সমভূমি এবং দক্ষিণে পুরাতন মেঘনা মোহনা প্লাবনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে এই অববাহিকার সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১১৩ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলটিকে সিলেট অববাহিকা নামেও অভিহিত করা হয়।

অসংখ্য হ্রদ (বিল) ও বৃহদাকৃতির জলাশয় (হাওর) দ্বারা ৫,০২৫ বর্গ কিলোমিটারের এই এলাকা গঠিত। বৃহৎ পিরিচাকৃতির এই অববাহিকা অবনমনশীল এবং ভূতত্ত্ববিদদের মতে এই অবনমন প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে মধুপুর গড়ের উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিগত ২০০ বছরে এই এলাকা ৯ থেকে ১২ মিটার অবনমিত হয়েছে বলে পরিমাপ করা হয় এবং বর্তমানেও তা সক্রিয় রয়েছে।

এই জলাভূমিকে বাংলাদেশের একক সর্বনিম্ন ভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হাওরের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট স্থায়ী জলাভূমিকে বিল বলা হয়। এগুলো নিম্নভূমি অঞ্চলের সর্বনিম্ন অংশ দখল করে আছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিবেশী অন্যান্য পাহাড়ি জলপ্রবাহ যেমন মনু, খোয়াই, মগরা, মাহাড়ো প্রভৃতি এই অঞ্চলে ঘন জলনিষ্কাশন পরিবহন জাল তৈরি করেছে। এই নদীবাহিত পলি মূলত সিলেটের নিম্ন প্লাবনভূমি গঠনের উৎস।

বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বভাগের পাহাড়াঞ্চল হিমালয় পর্বতের সাথে সংযুক্ত আসাম ও ত্রিপুরার পর্বতমালায় অংশবিশেষ। এ অঞ্চলের নদীসমূহ সংশ্লিষ্ট পাহাড়াঞ্চল থেকেই উৎপন্ন। অতিরিক্ত ক্ষয়প্রবণ এই পাহাড় শ্রেণি থেকে অনন্তকাল হতে নদী স্রোতে বয়ে আসা পলি, বালি, কাঁকর প্রভৃতি বিস্তীর্ণ জলভাগে সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি করেছে সমতল ভূমির। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান, সিলেট, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার কিছু অংশ বাদ দিলে সমগ্র বাংলাদেশই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী বিধৌত সমভূমি। পূর্ব ভাগের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের নিম্নভাগ ও ময়মনসিংহের পূর্বভাগের বিস্তীর্ণ জলভাগ বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল। উক্ত জলভাগই ‘কালিদহ সায়র’ হিসেবে সুদূর অতীতে কথিত হতো বলে লোককাহিনী থেকে জানা যায়।

এই কালিদহ সায়র টারশিয়ারি যুগে অবনমনের ফলে সৃষ্ট জলভাগের নামান্তর হওয়াই স্বাভাবিক। অনবরত পাহাড় ক্ষয়ের মাধ্যমে সমুদ্র বক্ষে জেগে ওঠা সমতল ভূমির মাধ্যমে প্রাচীন কালেই উহা বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকায় সঙ্কুচিত হয়ে সাগর সদৃশ নিম্নাঞ্চলে পরিণত হয়। কালক্রমে এর চতুষ্পার্শ্বে জেগে ওঠা সমতল ভূমিতে মানব বসতি সম্প্রসারিত হয়। অপর দিকে এর ভাটি অংশের সমতল ভূমির মধ্য দিয়ে উক্ত জলাশয়ের যে ধারা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয় তা মেঘনা নামে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদীর মর্যাদা লাভ করে।

নদীর স্রোত এবং পাহাড় ক্ষয়ের ধারা বর্তমান কালেও অব্যাহত। আজও ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে এই জলভাগের তলদেশ। এভাবেই অতীতে এই বিশাল জলভাগে জেগে ওঠা চর বা সমতল ভূমি বিচ্ছিন্ন ভাবে সৃষ্টি করেছে পৃথক পৃথক জলাধার। মূলত এই জলাধারগুলোই হাওর হিসেবে পরিচিত। অতীতে এই হাওরগুলোর আকৃতি সর্বসাধারণের কাছে সাগরতুল্য ছিল। সম্ভবত তাই আঞ্চলিক ব্যবহারে এই সাগর বা সাগরতুল্য জলভাগ ‘হাওর’ হিসেবে কথিত হতে থাকে। পৃথক পৃথক হাওর পৃথক পৃথক নামে কথিত হওয়ার ফলে যেমন ‘সায়র’ শব্দটি লোপ পায় তেমনি সেই সায়রের ‘কালিদহ’ নামটিও হয়তো এক সময়ে লোক কাহিনীতে পুনর্বাসিত হয়েছে।

বাংলাদেশের ভূমির অবস্থা ও গঠন অনুসারে এখানকার ভূ-প্রকৃতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তন্মধ্যে টারশিয়ারি যুগের পাহাড়াঞ্চল সর্ব প্রধান। এর পরের অবস্থানে প্লাইস্টোসিন কালের সোপান সমূহ। শেষ ধাপে আছে সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি। এ অঞ্চল সমূহকেও আবার অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। টারশিয়ারি অঞ্চল সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আংশিকভাবে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় সীমাবদ্ধ। প্লাইস্টোসিন সোপান উত্তর-পশ্চিমাংশের বরেন্দ্রভূমি, মধ্যভাগের মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড় এলাকায় সীমাবদ্ধ। বাদবাকী সমগ্র বাংলাদেশ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদী ও এদের উপনদী-শাখানদী বাহিত পলি দিয়ে গঠিত। বর্ষাকালে এদেশের নদীসমূহে প্লাবন হওয়ার ফলে নদী অববাহিকায় পলি জমা হয়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত জলাভূমি বা হাওর-বিল এদেশের ভূ-প্রকৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিছু জলাভূমিতে সারা বৎসরই পানি থাকে। অধিকাংশগুলো শীত ও গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায়। রাজশাহী অঞ্চলের চলনবিল, গোপালগঞ্জের বিল, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শেরপুর জেলার হাওর ও বিল বাংলাদেশের এই বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ।

সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমির মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার পূর্বদিকের সামান্য অংশ নিয়ে সিলেট অববাহিকা অঞ্চল গঠিত। এই এলাকাটি সংলগ্ন প্লাবন সমভূমি হতে অপেক্ষাকৃত নিচু। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এ অববাহিকার উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার (১০ ফুট)।
মধুপুর সোপান গঠনের সঙ্গেও হাওরের উৎপত্তির বিষয়টি জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর একটি। পূর্বে এই নদীর গতিপথ ছিল মধুপুরের পূর্ব দিকে। উৎপত্তিকাল থেকে আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত এটি এগারসিন্ধুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৭৮৭ সালে সংঘটিত বন্যা ও ভূমিকম্পের ফলে এই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনটি শুরু হয় ১৭২০ সাল থেকে এবং শেষ হয় ১৮৩০ সালে। এই ১১০ বৎসরে ব্রহ্মপুত্র পূর্বের গতিপথ পরিবর্তন করে মধুপুর গড়ের পশ্চিম দিকের বর্তমান গতিপথ ধরলে পলিমাটির অভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিচু থেকে যায়।

কিন্তু এ ধারণাটি প্রথমতঃ ভূ-গঠন প্রক্রিয়ার ইতিহাসের নিরিখে গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন না। দ্বিতীয়তঃ সম্পূর্ণ হাওর অঞ্চলটি সিলেট অববাহিকায় অবস্থিত। এ অববাহিকা মূলত মেঘনা নদীর উজান অংশ থেকে বরাকের শাখা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজান অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বরাক নদী আসামের নাগা পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে মনিপুর রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের বদরপুর ও  সিলেটের অমলসিদ নামক স্থানে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এরপর সুরমা নদী খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নিকট দিয়ে এবং কুশিয়ারা নদী ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ হয়ে স্থানে স্থানে বিভিন্ন নাম ধারণ ও বিভিন্ন নদীর শ্রোতধারা নিয়ে উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকা, উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল পাদদেশীয় সমভূমি, সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি, সিলেট প্লাবনভূমি এবং পুরনো মেঘনা মোহনা প্লাবনভূমি এই পাঁচটি প্লাবনভূমি পার হয়ে মেঘনার সাথে একত্রিত হয়েছে।১৭ এ অঞ্চল প্রতি বৎসর পাহাড়ি ঢলে বহুবার বন্যাকবলিত হওয়ায় নদী-বাহিত পলি-বালিতে কেবল সমতল ভূমির উচ্চতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে না, নদ-নদীর তলদেশও ভরাট হয়ে পর্যাপ্ত পানি ধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছে ।

হাওর অঞ্চল সম্পর্কে ড. দীনেশচন্দ্র সেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ভূমিকায় চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “উত্তরে গারো পাহাড়, জয়ন্তা ও খাসিয়ার অসম শৈলশ্রেণি, - তাহাদের পদলেহন করিয়া একদিকে সোমেশ্বরী ও অপর দিকে কংস ছুটিয়াছে। এই বিস্তৃত ভূখণ্ড ছাড়িয়া দক্ষিণ-পূর্ব্বে নানা ধারায় ধনু, ফুলেশ্বরী, রাজেশ্বরী, ঘোরা-উৎরা, সুন্ধা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র ক্কচিৎ ভৈরব রবে, ক্কচিৎ বীণার ন্যায় মধুর নিক্কনে প্রবাহিত হইয়াছে। এই সকল নদনদীর অন্তর্ব্বর্ত্তী দেশসমুহ এককালে জলের নীচে ছিল। এই সমস্ত প্রদেশই এখনও বহু বিল ও জলাশয়াকীর্ণ। বিলগুলিকে তদঞ্চলে ‘হাওর’ বলে।”

সিলেট অববাহিকার সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা পরিবেষ্টিত ও সমন্বয়ে এই হাওর অঞ্চলটি গঠিত। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মোতাবেক এখানে রয়েছে প্রায় ৪১৪টি হাওর। এই হাওরগুলোতে আবার বিভিন্ন মাপের প্রায় ৬,৩০০টি বিল বিদ্যমান। এ গুলোর মধ্যে প্রায় ৩,৫০০টি স্থায়ী ও ২,৮০০টি অস্থায়ী বা ঋতুভিত্তিক বিল।

যাহোক ভূ-বিবর্তনের নানা ধাপ পেরিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের সৃষ্টি। এরই এক ধাপে ভূ-অবনমনের ফলে যে নিম্ন জলাভূমির সৃষ্টি হয় তা দক্ষিণবর্তী সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যে কারণে বর্তমান ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের মধ্যবর্তী হাওর অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের অংশবিশেষই ছিল বলে প্রাচীন নানা তথ্য থেকে অবগত হওয়া যায়।

কেবল ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্রের কারণে নয়-- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও বাংলাদেশের হাওর এক বিরাট স্থান জুড়ে আছে। বর্ষা কালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ পানির যৌবন দেখলে সাগর বলে ভ্রম হয়। দ্বীপের মতো গ্রামগুলো ভেসে থাকে অথৈ পানিতে। অথচ শীতকালে সেখানেই বিস্তীর্ণ মাঠ ভরা ফসলের শ্যামলিমায় মন ভরে যায়।

 

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top